স্মরণ-দেশের হূদয় তারে রাখিয়াছে বরি by কাজল রশীদ

‘বাড়িও না ও হাত, পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।’ পঙিক্তটা রণেশ দাশগুপ্তের। তুরস্কের বিপ্লবী কবি নাজিম হিকমতের কবিতা থেকে অনূদিত। সাংবাদিক মানিক সাহার স্মরণে দৃপ্ত এই উচ্চারণ। সততা ও পেশাগত নিষ্ঠার পরাকাষ্ঠায় তিনি ছিলেন সংশপ্তক। যাপিত জীবনে বামন ছিল না মনোবৃত্তি।


লোভ-লালসা, প্রলোভন, আপসকামিতা ও সুযোগ-সুবিধার ঊর্ধ্বে ছিলেন আমৃত্যু।
মানিক সাহা জানতেন তাঁর জীবন বিপদাপন্ন। তবুও আপসের পথে পা বাড়াননি। পিছপা হননি সততা ও আদর্শ থেকে, যা ছিল তাঁর গোটা জীবনের মহত্তম অর্জন। তাঁর চিঠিতে শঙ্কা ও বৈরিতাকে চপেটাঘাত করার দুঃসাহস মেলে: ‘একজন অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও নিরপেক্ষ সাংবাদিক হিসেবে দেশের প্রতি আমি যে দায়িত্ব পালন করছি, তাতে একটি স্বার্থান্বেষী মহল ক্ষুব্ধ হচ্ছে।...আমি এতে মোটেই ভীত নই। কারণ আমি জানি, কোনো অন্যায় কাজের সঙ্গে আমি যুক্ত নই।’ পাঠান্তে মনে পড়ে সরদার ফজলুল করিমের কথা: ‘জীবন দিয়েই জীবন রক্ষা করতে হয়। ইচ্ছা করলেই সবাই তা করতে পারে না।’ মানিক সাহা পেরেছিলেন। বিপরীত স্রোতে চলার সাহস সবার থাকে না। বিজয় না হওয়া পর্যন্ত পরিবেশ, প্রতিবেশ ও অন্ধকারের সঙ্গে লড়াইয়ের সাহস কারও কারও থাকে। যাঁরা জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অবিচল থাকেন নিজস্ব বিশ্বাস ও আদর্শ নিয়ে মানুষের কল্যাণব্রতে, মানিক সাহা ছিলেন ও রকম উজ্জ্বল ব্যতিক্রমী মানুষের একজন।
মানিক সাহার আবাল্যের জনপদ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সাংবাদিক হত্যার ঘটনা নতুন নয়। ১৯৯৪ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে তিনি দেখেছেন ১১ জন সাংবাদিকের নির্মম মৃত্যু। খুলনা শহরেই নির্মমভাবে খুন হন তাঁর পরম শ্রদ্ধা ও প্রযত্নের মানুষ কমরেড রতন সেন। মানিক সাহাও হয়তো জানতেন, কিংবা আঁচ করতে পেরেছিলেন, তাঁর ভাগ্যেও ঘটতে পারে নৃশংস হত্যার পরিণতি। কিন্তু জানলে কী হবে, জীবনের ব্রত থেকে তো সরে আসার মানুষ তিনি নন। ১৯৮২ সালে শুরু হওয়া ২২ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে যে পুণ্য তিনি অর্জন করেছেন, তা তো হন্তারকের ভয়ে বিসর্জন দিতে পারেন না। পরোয়া করেননি মৃত্যুভয়। সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে অবিচল থেকেছেন সংবাদ, বিবিসি, একুশে টেলিভিশন ও নিউ এজ-এর সংবাদকর্মী হিসেবে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায়। মানিক সাহার সাৈন্দর্য ও গৌরব নিহিত এখানেই।
শৈশবে মাতৃহারা মানিক সাহা বড় হয়েছেন মাসিমার আদর-যত্ন আর ভালোবাসার স্নেহ-শাসনে। অভাব-অনটনের মধ্যে লেখাপড়া করলেও ছোটবেলা থেকেই সাধারণ মানুষের প্রতি ছিল নিবিড় টান, যার পরিণত প্রকাশ বাম রাজনীতির প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত ও সম্পৃক্ত হওয়া। বাম ছাত্রসংগঠন ‘বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন’-এর খুলনা জেলা শাখার সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। দুই দফায় ২৮ মাস কেটেছে কারাভ্যন্তরে। প্রথমবার ১৯৭৬ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে। আর দ্বিতীয়বার এরশাদবিরোধী গণ-আন্দোলনে।
এ দেশে বাম আন্দোলনের অর্জন ও ঐতিহ্য নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা কথা রয়েছে। কম-বেশি কূটতর্কও যে নেই, এমনটি বলা যাবে না। কিন্তু একটা বিষয়ে প্রায় সবাই মনে হয় একমত—ষাট-সত্তরের দশকের বাম আন্দোলন এ দেশে কিছু সত্যিকারের ভালো মানুষের জন্ম দিতে পেরেছে, যাঁরা প্রকৃত অর্থে দেশপ্রেমিক, অসাম্প্রদায়িক, পরোপকারী, মানবদরদি, কর্মনিষ্ঠ, সজ্জন ও আলোকিত। এ ধারার উজ্জ্বল প্রতিভূ হলেন সাংবাদিক মানিক সাহা।
সজ্জন এই মানুষটিকে ২০০৪ সালের আজকের দিনে খুলনা প্রেসক্লাব থেকে মাত্র ৩০০ গজ দূরে বোমা মেরে হত্যা করা হয়, যার নেপথ্য কারণ হিসেবে অনেক প্রসঙ্গ নানা মহল থেকে উচ্চারিত হয়েছে। তাঁর শত্রুসংখ্যাও কম ছিল না। কেননা, এখানে মন্দ লোকের সংখ্যা কম নয়। তারা আবার নিজেদের মধ্যে সংগঠিতও। এদের মধ্যে রয়েছে: মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী, উগ্র মৌলবাদী চক্র, সুবিধাবাদী ও সুযোগসন্ধানী সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা-কর্মী, পরিবেশ ধ্বংস করে লবণ পানিতে চিংড়ি চাষে লিপ্ত প্রভাবশালী মহল, চোরাচালানি, অস্ত্র ব্যবসায়ী, সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ, সুন্দরবন ধ্বংসকারী এবং মংলা বন্দর লুটপাটকারী। রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে মানিক সাহা সব সময়ই ছিলেন এদের সব ধরনের অন্যায়, অপকর্ম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার, সাহসী এক কলমযোদ্ধা। অশুভ শক্তির মুখোশ উন্মোচনে সব সময় সচেষ্ট ছিলেন তিনি। আমৃত্যু লড়াই করেছেন অসহায়, দুর্বল, অভাগা, অধিকারবঞ্চিত মানুষের পক্ষে। স্বাধীনতাবিরোধী, ঘাতক, মৌলবাদী, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের বিপক্ষে।
স্বাধীন স্বদেশে অদ্ভুত এক অন্ধকারাচ্ছন্ন সময় গেছে তখন। ২০০১-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর হঠাৎ করেই নিজ ভূমে বিপন্ন হয়ে ওঠে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা। পাশাপাশি বিরোধী রাজনীতিক নেতা-কর্মীদের ওপরও চালানো হয় অত্যাচার-নির্যাতনের স্টিম রোলার। খুলনা ও তার আশপাশে সংঘটিত বর্বরোচিত এসব অন্যায়-অত্যাচার প্রকাশের লক্ষ্যে দৃঢ়হাতে কলম ধরেন মানিক সাহা। বস্তুনিষ্ঠভাবে তুলে ধরেন সেসব চিত্র। শুধু একা নন, সহকর্মীদেরও উদ্বুদ্ধ করেন সত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে সাহসী ভূমিকা পালনের জন্য। এ কারণে খুব দ্রুত স্বার্থান্বেষী মহলের চক্ষুশূল হয়ে পড়েন তিনি। চিহ্নিত হন অপকর্মের পথে প্রধান বাধা হিসেবে, যার বর্বরোচিত প্রকাশ ঘটে নৃশংস এক হত্যাকাণ্ড।
আজ মানিক সাহার মৃত্যুর ষষ্ঠ বার্ষিকী। আজও নিষ্ঠুর এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচিত হয়নি। বিচার পাননি স্ত্রী নন্দা, মেয়ে নাতাশা ও পর্শিয়াসহ অগণন সুহূদ-স্বজন। ঘরোয়া আয়োজনের বাইরে তাঁকে নিয়ে হবে না কোনো স্মরণানুষ্ঠান। তার পরও স্মরিত হবে তাঁর জীবন ও কর্ম। শুধু পারিবারিক পরিসরে কিংবা খুলনায় নয়, সারা দেশে, তবে নীরবে-নিভৃতে। কেননা, ‘দেশের হূদয় তারে রাখিয়াছে বরি’।

No comments

Powered by Blogger.