সরল গরল-প্রধান বিচারপতির দৃষ্টিভঙ্গি ভ্রান্তিপ্রসূত by মিজানুর রহমান খান

বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেছেন, ‘রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগ—আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ একে অপরের পরিপূরক। কেউ কারও ওপরে নয়।’ এই বক্তব্য তো এভাবে আসা অসমীচীন বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। পরিপূরক কথাটি তো সর্বজনীন শব্দ।


মন্ত্রিসভা যৌথভাবে এমনকি তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে সংসদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। সেখানে ‘কেউ কারও ওপরে নয়’-এর মতো অভিব্যক্তি কী করে প্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে? চাঁদের আলো না থাকুক, কিন্তু সংসদের আলো থাকতে হবে। এবং তাতেই সব স্তম্ভ, এমনকি চতুর্থ স্তম্ভও হবে আলোকিত। আমাদের সংসদ যতখানি অনালোকিত, আমরা ততটাই অনালোকিত থেকে যাচ্ছি। ‘আমরা অন্য কাউকে বিচার বিভাগের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতে দেব না।’ এ কথা কেন এল, তা বুঝতে আমরা অক্ষম। সামগ্রিকভাবে তাঁর বক্তব্যের নির্যাস গ্রহণ করতে আমরা অপারগ। আমরা জানি না, বিচারপতি অপসারণে সংসদীয় অভিশংসন-প্রথা ফিরে আসার সম্ভাবনায় সুপ্রিম কোর্ট সচকিত কি না। প্রচ্ছন্নভাবে জেনারেল জিয়ার মরণোত্তর বিচার পর্যন্ত চেয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু সংসদকে মানতে পারেননি তাঁরা। তাই জিয়ার সামরিক ফরমানপ্রসূত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে তাঁরা দুঃখজনকভাবে টিকিয়ে রাখলেন। তীরে এসে তরী ডোবালেন। অথচ সেখানটাতেই বিচার বিভাগের জবাবদিহির স্পর্শকাতর প্রশ্ন জড়িত।
মার্কিন সংবিধানের মুখ্য রূপকার জেমস মেডিসন তাঁর ফেডারেলিস্ট ৫১তে রাষ্ট্রের এক অঙ্গের কাজে অন্য অঙ্গের আত্মরক্ষার সামর্থ্য আলোচনা করেন। তিনি লিখেছেন, ‘প্রত্যেক অঙ্গকে তার আত্মরক্ষার জন্য সমান অধিকার দেওয়া সম্ভব নয়। প্রজাতন্ত্রী সরকারে আইনসভার কর্তৃত্ব প্রয়োজনীয়ভাবে প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে।’ বাংলাদেশ সংবিধানের আওতায় আমরা যে এ কথা বলতে শিখেছি তার আসল উদ্গাতা ১৬১০ সালে ব্রিটেনে প্রধান বিচারপতি স্যার এডওয়ার্ড কোক ও ১৮০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি মার্শাল। লিখিত সংবিধানের আওতায় মার্শালই প্রথম কিছুকে ‘অসাংবিধানিক’ ঘোষণা করেন।
বরেণ্য মার্কিন বিচারপতি জেরেমি ফ্রাঙ্ক তাঁর কোর্টস অন ট্রায়াল শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, বিপ্লব শুরু হওয়ার পর থেকে আমেরিকার সংবিধান প্রণয়ন-প্রক্রিয়ায় ফরাসি দার্শনিক মন্টেস্কুর ধারণা প্রভাব পেতে শুরু করে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক অঙ্গরাজ্য কঠোরভাবে ক্ষমতার বণ্টন নীতি মানত না। যেমন নিউজার্সির গভর্নর রাজ্যের সুপ্রিম কোর্ট ও আইনসভায় রীতিমতো আসন নিয়ে ভূমিকা রাখতেন। ব্রিটেনের মতো যুক্তরাষ্ট্র কেন কংগ্রেসকে সার্বভৌম করল না? আবার ব্রিটিশ সংসদের সার্বভৌমত্ব কি সে দেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য হুমকি বলে গণ্য হয়েছে?
মন্টেস্কুর ক্ষমতার পৃথক্করণ নীতি গ্রহণ করা মাত্রই আগের সমস্যা কিন্তু চুকেবুকে যায়নি। ফ্রাঙ্ক লিখেছেন, ‘কতিপয় ব্যক্তির কাছে এ-সংক্রান্ত তত্ত্ব যেভাবে ধরা দিল, সেভাবে এর ফাটলটা কখনোই স্পষ্ট হয়নি। তবে প্রথমেই রাজকীয় ক্ষমতা সম্পর্কে ভয় ছিল। তাই নির্বাহী এবং এমনকি বিচার বিভাগও আইনসভার অধীন থাকাকেই উত্তম মনে করল। কিন্তু এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা অর্থনৈতিক রক্ষণশীলদের শঙ্কিত করে তুলল। তারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের উদারনৈতিক প্রবণতাকে ভয়ের চোখে দেখত। পরবর্তী সময়ে আমাদের জাতীয় সংবিধান গৃহীত হলো, আর তাতে কংগ্রেসের কর্তৃত্ব হ্রাস করার বিনিময়ে প্রেসিডেন্ট এবং আদালতের ক্ষমতাকে শক্তিশালী করা হলো।’
তাঁর বক্তব্যে আমরা আরও দেখি, ‘কংগ্রেস যদিও জনপ্রিয়তার দৃষ্টিকোণ থেকে জনগণের কণ্ঠস্বর হয়েই থাকল, কিন্তু রক্ষণশীলেরা ধারণা করল যে কংগ্রেসে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে খেয়াল-খুশিমতো আইন পাসের সুযোগ তৈরি হতে পারে।’ সুতরাং জেরেমি ফ্রাঙ্ক আমাদের দেখাচ্ছেন যে, আইনসভা অবদমনের যে ইচ্ছা, সেটা অন্তর্গতভাবে রক্ষণশীল। আজ বাংলাদেশের সমাজে যাঁরা অন্ধের মতো আদালতঘেঁষা হওয়ার প্রবণতা দেখাচ্ছেন, তাঁদের কি আমরা শুধুই রক্ষণশীল বলব? ফ্রাঙ্ক যুক্তরাষ্ট্রের গোড়ার ইতিহাস সম্পর্কে লিখেছেন, ‘এবং যখন সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে কংগ্রেস অধিকতর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলো, তখন রক্ষণশীল সংখ্যালঘু তাদের স্বার্থের পরিপন্থী জনপ্রিয় আইন তৈরি দেখে ভীত হলো। এবং যখন তারা একই সঙ্গে দেখল প্রেসিডেন্টরা ক্রমাগতভাবে জনগণের ইচ্ছার প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছেন, তখন তারা আদালতের দিকে ঝুঁকল। দীর্ঘ সময় ধরে আদালত সামগ্রিকভাবে রক্ষণশীল ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁরা জনপ্রিয় আইনকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা দিয়েছেন। অন্যান্য আইনকে তাঁরা এমনভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যার ফলে কংগ্রেসের উদ্দেশ্য নস্যাৎ করা হয়েছে।’
আমরা অবশ্য ‘হার মাস্টার্স ভয়েস’-এর আইনসভা পেয়েছি। তবে এখন বিবেচ্য কে বড়, সেই বিতর্কটা কেন এল। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি প্রশাসনিক কমিটি আছে। নামেই এর পরিচয়। জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা জিএ কমিটি। প্রধান বিচারপতি এ কমিটি পুনর্গঠন করেন। হাইকোর্ট বিভাগের তিনজন জ্যেষ্ঠ বিচারক এর সদস্য। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে জ্যেষ্ঠতা বৈধ আকাঙ্ক্ষা হিসেবে স্বীকৃত। জ্যেষ্ঠতার নীতি ও চেতনা অনুসরণ করাই কর্তব্য। সংসদের কাছে জবাবদিহির বাধ্যবাধকতা হয়তো তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু ওই রায় মানতে জিএ কমিটি বাধ্য ছিল। প্রায় ২০০ জ্যেষ্ঠ জেলা জজকে ডিঙানোর প্রস্তাবটি দিয়েছে সরকার। অনুমোদন দিয়েছে জিএ কমিটি। এরপর সংসদীয় স্থায়ী কমিটি নয়, কমিটির সভাপতি কৌতূহলী হন বিষয়টি কীভাবে হলো। তাই সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারকে আমন্ত্রণ জানানো হয় তথ্য দিতে। এটা মিথ্যা যে, কমিটি রেজিস্ট্রারকে তলব করেছে। প্রথমে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার যাননি। দ্বিতীয় চিঠির পর সৌজন্য হাজিরা দেন। রেজিস্ট্রার গিয়ে কোনো কথা বলেননি। অথচ এর আগে যখন বিচারকদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর প্রশ্ন ছিল, তখন একই কমিটির সভাপতি একই ভাষায় চিঠি দিয়েছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার পড়িমরি ছুটে গিয়েছিলেন। এখন তিনি বিচারপতি হয়েছেন। প্রশাসনিক এখতিয়ারে ফুল কোর্ট তখন বৈঠকে বসেননি। কিন্তু এবার তাঁরা বসলেন। এবং জানিয়ে দিলেন, বাংলাদেশের সংসদ সার্বভৌম নয়। তাই তাঁরা সংসদীয় কমিটিতে যাবেন না। প্রখ্যাত ভারতীয় আইনবিদ বিচারপতি ভি আর কৃষ্ণ আয়ারকে মনে পড়ল। তিনি লিখেছেন, ‘বিচার বিভাগ কোনো বস্তুবাদী ট্রেড ইউনিয়ন নয়, যারা নিজেদের বিশেষ অধিকার বাড়াতে সচেষ্ট থাকবে।’ অন্যদিকে বিএনপির দরকার ছিল আলুর গুদামে আগুন লাগা। ফুল কোর্টের সিদ্ধান্তে আগুন লাগল। আলু পুড়ল। শীতার্ত সন্ধ্যায় বেগম খালেদা জিয়া তাঁর স্বাদ নিলেন। তিনি বললেন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারকেরাই বলে দিয়েছেন এই সংসদ সার্বভৌম নয়। আসলে এটা পরিণত হলো বাংলাদেশে প্রকৃত ইস্যু আড়াল করার একটি দৃষ্টান্তে। যে যেভাবে পারেন জনগণের দৃষ্টিকে আড়াল করতে সুযোগ হাতছাড়া করেন না। এ প্রসঙ্গ এখানেই থাক। আসুন, মূল তর্কটা শেষ করি।
ফ্রাঙ্ক লিখেছেন, ‘কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যখন আদালতের লোকবলে বড় পরিবর্তন আনা হলো এবং তাতে আইনসভার প্রতি অধিকতর বন্ধুভাবাপন্ন বিচারিক দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ ঘটল, তখন রক্ষণশীলেরা নির্দয়ভাবে আদালতের সমালোচনা শুরু করলেন। তাঁরা এখন বলতে শুরু করলেন যে রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গকে সংযত করতে আইনসভাকে সক্রিয় হতে হবে।’ জেরেমির এই বইটি ছাপা হয়েছিল ১৯৪৯ সালে। ট্রুম্যান তখন প্রেসিডেন্ট। জেরেমির এই বিশ্লেষণ আমাদের জন্য বেশি প্রাসঙ্গিক এই জন্য যে, ওই সময় মার্কিন সুপ্রিম কোর্টে দলীয়করণ প্রকট হয়ে উঠেছিল। ‘কোর্ট প্যাকিং’ করেছিলেন রুজভেল্ট।
ব্রিটেনের সংসদের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে বলা হয়, তারা নারীকে পুরুষ এবং পুরুষকে নারী বানানো ছাড়া আর সবকিছুই নিরঙ্কুশভাবে করতে সক্ষম। সে কারণে কয়েক দিন আগে যখন লিখেছি, ব্রিটিশ সংসদীয় কমিটিতে ব্রিটেনের উচ্চ আদালতের বিচারকেরা গিয়ে থাকেন, তখন আমাকে অনেকেই স্মরণ করান যে, বাংলাদেশের সংসদ তো সার্বভৌম নয়। সুতরাং এটা এখানে অচল। তাঁদের চিন্তার খোরাক দিই। ডাইসির মতো পণ্ডিত ভর করেছেন ব্ল্যাকস্টোনের প্রতি। পণ্ডিত ব্ল্যাকস্টোন লিখেছেন, ‘কোক সংসদের ক্ষমতা ও এখতিয়ার সম্পর্কে বলেন, এর সীমানা এতটাই অতিক্রান্ত যে এটি বাঁধনহারা এবং এটি নিরঙ্কুশ। কোনো কিছু দিয়েই একে বাঁধা যাবে না।’ আমরা এখানে দেখব যে ব্ল্যাকস্টোন হাইকোর্ট সম্পর্কে বলতে গিয়েও ‘সার্বভৌম’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। ব্ল্যাকস্টোনের কথায়, ‘আর এই হাইকোর্ট সম্পর্কে তিনি সত্যিই বলেন, এর রয়েছে আইন তৈরি, নিশ্চিতকরণ, বর্ধিতকরণ, সংযতকরণ, স্থগিতকরণ, বাতিলকরণ, পুনরুজ্জীবিতকরণ এবং ব্যাখ্যা প্রদানের ক্ষেত্রে সার্বভৌম ও অনিয়ন্ত্রণযোগ্য কর্তৃত্ব।’ সে কারণে আগেই বলেছি, প্রসঙ্গ নির্দিষ্ট না করে কে বড়, কে সার্বভৌম সে ধরনের কোনো মন্তব্য অস্পষ্ট, অসম্পূর্ণ এবং আরও ধাঁধাপূর্ণ প্রতীয়মান হতে বাধ্য। আমাদেরও শুধু সংসদ নয়, আদালতও আইনের উৎস।
ব্রিটিশ আইনবিদ হ্যারল্ড জে লাস্কি তাঁর পার্লামেন্টারি গভর্নমেন্ট ইন ইংল্যান্ড বইয়ে লিখেছেন, ‘আরোপ করার প্রয়োজনে বিচারকের জন্য কোনো অনুরাগহীন কিংবা যার অস্তিত্ব মনোনির্ভর নয়, বিষয়মুখ অর্থাৎ অবজেকটিভ আইন নেই। মার্শালের প্রসিদ্ধ উক্তি হচ্ছে, কোনো মামলায় বিচার বিভাগের কোনো অভিপ্রায় নেই।...বিচারকের অভিপ্রায়কে বাস্তবে রূপদানের উদ্দেশ্যে কখনো বিচারিক ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটেনি। আইনসভার অভিপ্রায়কে বাস্তবে রূপদানের লক্ষ্যে সর্বদাই বিচারিক ক্ষমতার অনুশীলন হয়ে থাকে। কিংবা অন্য কথায় আইনের যা অভিপ্রায়, সেটাই বিচারক বাস্তবে রূপদান করেন।’ মার্শালের এই উক্তিটি উল্লেখ করে লাস্কি লিখেছেন, ‘এটি একটি মহৎ রূপকথা। এবং সেটি আজও রূপকথাই (বাংলাদেশেও-লেখক) রয়ে গেছে। বিচারক লেজিসলেটর বা আইনপ্রণেতা হতে পারেন না।’
আমরা যখন আদালতের সিদ্ধান্তে সংসদকে পাশ কাটিয়ে বিজি প্রেস থেকে আদালতের মনমতো সংবিধান মুদ্রণ করে আনছি, আমরা তখন ঠেকায় পড়ে তাতে সমর্থন দিচ্ছি। সেদিন চ্যানেল আইয়ের তৃতীয় মাত্রায় ডেপুটি স্পিকার অস্ফুট কণ্ঠে বললেন, সংসদ পারেনি বলেই আদালতকে সেটা করতে হলো। সংসদ যে রাবারস্ট্যাস্প, এটা তাঁরই স্বীকারোক্তি।
অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব মনে রেখে আমরা এই প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়েছি। কিন্তু তার মারাত্মক অপব্যবহার ঘটার আশঙ্কা এখনই প্রকাশ করছি। আমরা মনে রাখব, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন বেগবান থাকার সময় বার ও বেঞ্চ এককাট্টা হয়েছিলেন। তাই তাঁরা সংসদকে পাশ কাটিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বিভক্ত করাসংক্রান্ত বিধান বাতিল করেছিলেন। ১০০ অনুচ্ছেদ পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। তখন পর্যন্ত উপমহাদেশের সাংবিধানিক বিবর্তনের ইতিহাসে তার কোনো নজির ছিল না। এবারও আমরা যেভাবে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করছি, তেমনি ধারায় এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কোথাও সংবিধান পুনরুজ্জীবিত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। এমনকি পাকিস্তানেও নয়। বাহাত্তরের সংবিধান যে যুক্তি দেখিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ নিজেদের মতো করে পুনরুজ্জীবিত করেছেন, সে বিষয়ে তাঁরা একটি নতুন তত্ত্ব অস্পষ্ট হলেও দাঁড় করিয়েছেন। সেটা হলো, সামরিক ফরমান দিয়ে ওই অনুচ্ছেদগুলো বাতিল করা হয়েছে বলেই সেগুলোকে বাতিল করা হয়নি। বরং ওই সব অনুচ্ছেদ বাতিলে সংসদেরও ক্ষমতা ছিল না। কারণ ওই অনুচ্ছেদগুলো সংবিধানের মৌলিক কাঠামো। তার মানে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সংসদ যদি বদলে দেয়, তাহলে সংসদকে তা আর ফেরাতে হবে না। তাঁদের আর সংবিধান সংশোধন করতে হবে না। ক্ষুব্ধ জনগণ আদালতে যাবেন। আদালত তা বাতিল করবেন। সরকার পুনরায় তা ছেপে দেবে।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ভিত্তিতে ভারতের সংবিধান নতুন করে ছাপার ঘটনা ঘটেনি। ইন্দিরা গান্ধী এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে সংসদ সদস্যপদ হারিয়েছিলেন। ক্ষুব্ধ ইন্দিরা সুপ্রিম কোর্টের যে রিভিউ ক্ষমতা (যে ধরনের ক্ষমতাবলে আমরা অষ্টম, পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর রায় পেলাম) সেটা খর্ব করলেন। সুপ্রিম কোর্ট তা বাতিল করলেন। কিন্তু সে অনুযায়ী সংবিধান পুনর্মুদ্রিত হয়নি। ভারতের সংসদে নতুন করে সংশোধনী এনে আগেকার বিলুপ্ত বিধান পুনরুজ্জীবিত করা হয়। সুতরাং বাংলাদেশের জনগণকে যেন হাইকোর্ট দেখানো না হয়। ইদানীং মনে হচ্ছে, হাইকোর্ট দেখানোর মাত্রাটা ক্রমেই বিস্তৃত হয়ে চলেছে।
রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের মধ্যে যে কারণে ক্ষমতার বণ্টন, সেটা মূলগতভাবে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য। রিভিউ ক্ষমতা একটি সেফটি বাল্ব। সাধারণভাবে সব লিখিত সংবিধানে লেখা থাকে, সব আইন সংবিধানের বিধানাবলির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। বাংলাদেশের সংসদ এই অর্থে সার্বভৌম নয় কারণ তারা যা খুশি আইন করতে পারে না। আবার আইন করার বিষয়ে সংবিধান তাদের কোনো সীমা বেঁধে দেয়নি। আমাদের কৃতী আইনজ্ঞ মাহমুদুল ইসলাম লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ সংসদের এই অর্থে সার্বভৌমত্ব রয়েছে, কারণ সংসদে পাস করা আইনের ভাইরেস বা ক্ষমতা সম্পর্কে আদালত প্রশ্ন তুলতে পারেন না। আবার সংবিধান যদি কোনো আইন তৈরিতে কঠোরভাবে কোনো নিয়ম মানতে বলে, তাহলে সংসদকে সেটা মানতেই হবে। সেই অর্থে সংসদ সার্বভৌম নয়। আর সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্বের অর্থ হলো, সংবিধানের দেওয়া ম্যান্ডেট সব পরিস্থিতিতে প্রাধান্য বজায় থাকবে।’ অথচ আমাদের জনগণ জানলেন, ‘প্রধান বিচারপতি বলেছেন বিচার বিভাগ কারও ওপর তার শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করছে না। তাই আমরা অন্য কাউকে বিচার বিভাগের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতে দেব না। কারও বলা উচিত নয় যে তারা শ্রেষ্ঠ এবং তাদের কাছে আমরা জবাবদিহি করতে বাধ্য।’ এই প্রকাশ্য মন্তব্যে আমরা কোনো বিচারিক মনন খুঁজে পাই না। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা একে অপরের পরিপূরক, শ্রেষ্ঠত্ব বা সার্বভৌমত্বের মালিক জনগণ, অন্য কেউ নয়। আমরা বাংলাদেশের জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য।’ কিন্তু জিরো পয়েন্টে কোনো জবাবদিহি হয় না। জবাবদিহি কোনো বায়বীয় শব্দ নয়। একজন বিচারক বিবেকের কাছে, সৃষ্টিকর্তার কাছে, আইনের কাছে, সর্বোপরি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। একজন দুর্নীতিগ্রস্ত ও অযোগ্য বিচারকের জবাবদিহির প্রশ্ন আরেকজন ন্যায়পরায়ণ ও যোগ্য বিচারকের জবাবদিহির প্রশ্ন এক হতে পারে না। যদিও এই দুই ধরনের বিচারককে নিয়েই বিচার বিভাগ গঠিত। সুতরাং জবাবদিহির প্রশ্ন কখন কোন প্রেক্ষাপটে কেন তোলা হয়েছে, সে বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। প্রধান বিচারপতির প্রকাশ্যে মন্তব্যের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের মনে একটা ভুল ধারণা জন্মাবে। মনে হবে সংসদীয় কমিটি হঠাৎ করেই শ্রেষ্ঠত্ব বিতর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। তা ছাড়া সৃষ্টিকর্তার কাছে জবাবদিহির কথাটি আমাকে একটি বিষয় মনে করিয়ে দিল। সেটি একটি পাকিস্তানি আচরণবিধি। ১৯৭৭ সালে আমাদের জুডিশিয়াল কাউন্সিল এটি নকল করে। তবে তখন তারা জিয়ার শাসনেও বাহাত্তরের মূল সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা সমুন্নত রাখে। সৃষ্টিকর্তাসংক্রান্ত বাক্যাবলি বিলোপ করেই সেটি তারা গ্রহণ করেছিল, যা এখনো টিকে আছে।
যে সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক, সেটি গ্রহণ করেছে সুপ্রিম কোর্টের একটি প্রশাসনিক কমিটি। এর দায়-দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের সব বিচারক নেবেন, তা মনে করার কারণ নেই। কারণ সিদ্ধান্তটি অবশ্যই বিতর্কিত। জনগণের দোহাই দিয়ে জনগণকেই ফাঁকি। জেরেমি ফ্রাঙ্কের একটি উক্তি দিয়ে শেষ করি: ‘কোনো গণতন্ত্রে সরকারের কোনো অঙ্গ সম্পর্কে জনগণের সামনে সত্য তুলে ধরা কখনোই অবিচক্ষণ বলে গণ্য হতে পারে না। জনগণকে শিশু মনে করা অর্থাৎ তারা মানুষসৃষ্ট প্রতিষ্ঠানের ঘাটতি, যা এড়ানো যায় না, সেটা তারা মেনে নিতে অক্ষম, সেটা মনে করা সম্পূর্ণরূপে অগণতান্ত্রিক। ...আমাদের বিচারব্যবস্থার ত্রুটিবিচ্যুতি দূর করার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে, আমাদের সব নাগরিককে এটা জানিয়ে দেওয়া যে আমাদের বিচারব্যবস্থা আসলে কেমন চলছে। আমাদের আদালতগুলোর জন্য জনগণকে শ্রদ্ধাশীল রাখার বিষয় অজ্ঞতার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা ও তা বজায় রাখার চেষ্টা একটা ভ্রান্তি।’
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.