স্থানীয় সরকার-পৌর নির্বাচনের গতি-প্রকৃতি by তোফায়েল আহমেদ

সরকারের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তির পর তৃতীয় বর্ষের সূচনাতেই সারা দেশের ৩১০টি পৌরসভার মধ্যে ২৫৭টিতে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। নগর স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনে ৭০ লাখেরও বেশি ভোটার ২৫৭ জন মেয়র ও তিন হাজার ৯০ জন কাউন্সিলর নির্বাচন করবেন। এই নির্বাচন নানা কারণে গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে।


প্রথমত, অনেক পৌরসভায় ৭ থেকে ১০ বছর পর এ নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তাই এ দীর্ঘ সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের নানা ধরনের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া এখানে প্রতিফলিত হতে পারে। দ্বিতীয়ত, অনেক পৌরসভার জন্য এটিই প্রথম নির্বাচন। ওই সব স্থানে গ্রামীণ নেতৃত্বের জঠর থেকে নতুনভাবে নগর নেতৃত্বের উন্মেষ ঘটবে। তৃতীয়ত, সরকার ও নির্বাচন কমিশনের জন্য নগরকেন্দ্রের এই নির্বাচনগুলো অন্য কিছু কারণেও খুব গুরুত্বপূর্ণ। সরকার যেহেতু স্থানীয় সরকার ও নির্বাচনী আইন পরিবর্তন না করেও দলীয়ভাবে পৌরসভা নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছে, তাই নির্বাচনী প্রচারণা ও ফলাফলে দলের প্রভাব কতটুকু কীভাবে কাজ করে, তা দেখার বিষয়।
অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন তাদের অবশিষ্ট মেয়াদে ২০১২ সালের আগে পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ ও সিটি করপোরেশন নির্বাচন ছাড়াও কিছু উপনির্বাচন সম্পন্ন করবে। আগে অঘোষিতভাবে রাজনৈতিক দল বা দলীয় নেতা-কর্মীরা স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিলেও এবারই প্রথম দলীয় মনোনয়নে নির্বাচনের ঘোষণা এসেছে। তাই দলগুলোর নির্বাচনী আচরণ ও নির্বাচন কমিশন প্রণীত নির্বাচনী আচরণবিধির সংঘর্ষ ও সামঞ্জস্য পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে। সরকার হয়তো সরাসরি না হলেও প্রচ্ছন্নভাবে চাইবে তাদের সময়কালের মধ্যবর্তী এ সময়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনী ফলাফলের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হোক। নির্বাচন কমিশন চাইবে, তারা ২০০৮ সাল থেকে স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে নির্বাচন পরিচালনার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তার ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন থাকুক। তবে ভোলার উপনির্বাচনে যে সেই সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে সক্ষম হয়েছে, কমিশন নিজেও খুব উচ্চকণ্ঠে তা বলেনি। তাই হয়তো এবার সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী মোতায়েনে কমিশন কুণ্ঠিত হয়নি। তবে এবারে নির্বাচনী ঝুঁকি কিন্তু কিছুটা অন্যখানে, যা ইতিমধ্যে সাভার, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুরসহ কোথাও কোথাও স্পষ্ট দেখা গেছে। নির্বাচন কমিশন এ ক্ষেত্রে সাভারের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, দেশের আরও বহু এলাকায় দলীয়কৃত প্রশাসনের কর্মকর্তারা তাতে সতর্ক হয়েছেন বলে মনে হচ্ছে না। বিষয়টিতে আরও সতর্ক পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন এবং ব্যত্যয় দেখা গেলে কঠোরভাবে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
সরকারের তরফ থেকে দলীয় প্রার্থীকে জেতানোর পরিকল্পিত কোনো প্রয়াস এখনো চোখে পড়েনি। স্থানীয়ভাবে অবশ্য দলীয় নেতাদের স্থানীয় প্রয়াসে কোনো বিরাম নেই। সরকার ও সরকারি দলের জন্য এই নির্বাচন একধরনের ত্রিশঙ্কু অবস্থার সৃষ্টি করেছে। দেশের কমসংখ্যক পৌরসভায়ই সরকারি দল জোট বা বিরোধী দল একক প্রার্থী দিতে সক্ষম হয়েছে। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচন ও সরকার গঠনকালীন ‘সংস্কারবাদী’ শব্দটি জনপ্রিয় একটি রাজনৈতিক ভর্ৎসনা হিসেবে আবির্ভূত হয়। গত উপজেলা নির্বাচন থেকে নির্বাচনী সংস্কৃতিতে ‘বিদ্রোহী’ নামক নতুন একধরনের প্রার্থিতা গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। প্রার্থীরা বিভিন্ন স্থানে গর্ব ভরে নিজেদের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন।
তাই মনে হচ্ছে, এবার দলীয় মনোনয়নের নামে যে লেজেগোবরে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে পৌরসভা তথা স্থানীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও পৌর এলাকার জনগণ উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাজনৈতিক দলে স্থানীয়ভাবে গৃহবিবাদ তীব্র হয়েছে। অন্যদিকে শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের পরিচয়বিহীন ব্যক্তিরা প্রার্থী হওয়ার সাহস হারিয়েছেন। এতে সুজন পরিচালিত মেয়র পদপ্রার্থীর একটি জরিপে দেখা যাচ্ছে, অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে আসনপ্রতি মেয়র পদপ্রার্থীর গড়সংখ্যা ও হার কমেছে। নারীদের মেয়র হিসেবে প্রার্থিতা চোখেই পড়ছে না। প্রার্থী হওয়ার জন্য নিজ নিজ এলাকার জনগণের চেয়ে দলের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের মুখাপেক্ষী বেশি হয়েছেন প্রার্থীরা।
নির্বাচন কমিশনে প্রার্থীদের হলফনামায় দেওয়া তথ্যের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে বর্তমান পৌর নির্বাচন ও স্থানীয় নেতৃত্বের গতি-প্রকৃতি নিয়ে আরও বিস্তারিত জানা যাবে। এগুলো প্রার্থীদের স্বেচ্ছায় দেওয়া তথ্য এবং নির্বাচন কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে এসব তথ্য সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করেছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, স্থানীয় নির্বাচনে এই সাত তথ্য প্রদান, এর ব্যবহার ও যাচাই-বাছাই এবার অনেক ব্যাপ্তি ও ব্যাপকতা পাচ্ছে। সুজন এসব তথ্য নিয়ে দেশের ১০০টি পৌরসভায় পৌর মেয়র পদপ্রার্থীদের ‘জনগণের মুখোমুখি’ অনুষ্ঠান করছে। এসব অনুষ্ঠানে মেয়র পদপ্রার্থীরা অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন এবং একই মঞ্চ থেকে বক্তব্য ও জনগণের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন এবং স্বতঃপ্রণোদিত তথ্যগুলোর সপক্ষে প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন। এসব দিক থেকে ২০১১ সালের পৌর নির্বাচন অত্যন্ত ব্যতিক্রম একটি নির্বাচন। এই নির্বাচনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অতীতের পৌরসভা নির্বাচনের অনেক কিছুই নেই। আবার অনেক নতুন বিষয় সংযোজিত হয়েছে। নেই জনসভা, মিছিল ও মাইকের ঘনঘটা, রঙিন পোস্টার, নেতা-নেত্রীর ছবি, শোডাউনসহ অনেক কিছু। তা ছাড়া রয়েছে প্রার্থীর সাত তথ্য, যা একজন ভোটারের পক্ষে সহজলভ্য। ওই তথ্যগুলোর দিকে মনোনিবেশ করলে কিছু নতুন দিক যেমন উন্মোচিত হয়, তেমনই মনে নতুনভাবে দেখা দেয় কিছু শঙ্কা ও প্রশ্ন। সে রকম কিছু বিষয়ের অবতারণা নিচে করা হলো।
২১২টি পৌরসভার মেয়র পদপ্রার্থীদের প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সেখানে মোট এক হাজার ৭৮ জন মেয়র পদপ্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাতে পৌরসভাপ্রতি গড় প্রার্থীর সংখ্যা পাঁচজন। এই এক হাজার ৭৮ জনের মধ্যে ৪৬১ জন তথা ৪৩ শতাংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। অন্যদিকে ২০ শতাংশ প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসির নিচে। এর মধ্যে শুধু অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন প্রার্থীও রয়েছেন। নির্বাচনের পরে দেখা যাবে, নির্বাচিত মেয়রদের মধ্যে জনগণ কাদের বাছাই করেছেন।
মেয়র পদপ্রার্থীদের পেশার ক্ষেত্রে একটি সাধারণ তথ্য বেরিয়ে এসেছে; ২১২টি পৌরসভার মেয়র পদপ্রার্থীদের ৭০ শতাংশ (৭৫২ জন) সরাসরি নিজেদের পেশা ‘ব্যবসা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কৃষি, চাকরি ও আইন পেশার প্রার্থী আছেন যথাক্রমে ১৩, ১০ ও ৪ শতাংশ। কৃষি ও চাকরি উল্লেখ করা পেশাজীবীর মধ্যেও ছদ্মবেশী ব্যবসায়ী রয়েছেন। পেশাদার সমাজকর্মী ও অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রায় নেই বললেই চলে।
মেয়র পদপ্রার্থীর মামলা-মোকদ্দমার তথ্যে দেখা যায়, ২৭ শতাংশ প্রার্থী বর্তমানে বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত, ৬৮ শতাংশ প্রার্থী অতীতে কোনো না কোনো মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন এবং ৫ দশমিক ৩০ শতাংশ (৮৮ জন) প্রার্থী ৩০২ ধারায় হত্যা মামলায় অভিযুক্ত। সাতটি তথ্যের মধ্যে প্রার্থীরা স্বেচ্ছায় নির্বাচন কমিশনে যেসব তথ্য দিয়েছেন, তার মধ্যে মামলাসংক্রান্ত তথ্যটি প্রণিধানযোগ্য। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থী অবশ্যই আছেন।
স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির দেওয়া তথ্য থেকে দেখা যায়, প্রায় সব মেয়র পদপ্রার্থীর আয়সীমা আয়করযোগ্য ব্যক্তিদের পর্যায়ভুক্ত। কিন্তু প্রকৃত করদাতা প্রার্থী হচ্ছেন ১০ হাজার ৭৮২ জনের মধ্যে মাত্র ১৯ শতাংশ (২০০ জন)। মেয়র পদপ্রার্থীদের মধ্যে ৩৩৮ জন বিভিন্ন অঙ্কের ঋণ নিয়েছেন। এর মধ্যে ১৯৮ জনের ঋণের পরিমাণ ৫ লাখ থেকে ১০ কোটি টাকার মধ্যে। তাই বলা যায়, সম্পদসংক্রান্ত তথ্য পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য ও সংগতিপূর্ণ নয়। এ রকম একটি আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ধারণ করে আমাদের নগর স্থানীয় সরকারের একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ২৫৭টি পৌরসভার নাগরিকেরা এসব প্রার্থীর মধ্য থেকে শিক্ষিত, সৎ ও যোগ্য প্রার্থী খুঁজবেন এবং চলতি মাসের মধ্যেই এ প্রতিষ্ঠানগুলোর আনুষ্ঠানিক নেতৃত্ব জাতি পেয়ে যাবে।
নির্বাচন এ দেশে সব সময়ই উৎসবের আমেজে অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু নির্বাচনের পর নির্বাচিত নেতৃত্ব জনগণকে কী সেবা ও সহায়তা দেবেন, সে বিষয়টি বরাবরই অস্বচ্ছ থাকে। পৌরসভাগুলোর মধ্যেও বিভিন্ন রকমের পৌরসভা রয়েছে। যেমন—জেলা সদরের পুরোনো পৌরসভা, আবার একেবারে নতুন গ্রামীণ পৌরসভা। এর মধ্যে পৌরসভা হওয়ার আইনি যোগ্যতাই অর্জন করেনি অনেক পৌরসভা। তাদের নিজস্ব আয়ের প্রশ্নটি সুদূরপরাহত। কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের কথা বাদ দিলেও মেয়র পদপ্রার্থীদের বা স্থানীয়ভাবে যেসব দল প্রার্থী দিয়েছে, তাদের দলের বা প্রার্থীর কোনো সুস্পষ্ট নির্বাচনী ইশতেহার নেই। পৌরসভার নিজস্ব আয় বাড়ানোর কোনো চিন্তা না করে শুধু সরকারি অর্থে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে। প্রতিশ্রুতি শোনা যায়, কিন্তু নেই পৌরসভাকে নিয়ে কোনো স্বপ্ন বা রূপকল্প। সরকার অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকার বা দলের প্রধান নেতা বা নেত্রীদের স্বপ্নই তাঁদের স্বপ্ন। নির্বাচনী প্রচারণায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দোয়া কামনা, শুভেচ্ছাবিনিময়, করমর্দন আর কোলাকুলির প্রাধান্য। নগরভিত্তিক জোরালো কোনো ইস্যু খুব একটা পাওয়া যাচ্ছে না।
এবারের নির্বাচনের একটি ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এ পর্যন্ত সহিংসতা তুলনামূলকভাবে কম। ঝিনাইদহে তিনজনের নিহত হওয়ার ঘটনা ছাড়া বড় ধরনের সহিংসতা দেখা যায়নি। তবে গোপনে গরিব ভোটারদের মধ্যে অর্থ বিতরণ চলছে, যা প্রার্থী ও ভোটারদের একাংশ অত্যন্ত সহজ ও স্বাভাবিক বলেই ধরে নেয়। তা ছাড়া নগদ টাকা, শাড়ি, দাওয়াত—এসব কিছুটা নির্বাচনী সংস্কৃতির অংশ হিসেবে সহনীয় হয়ে পড়েছে। আচরণবিধির অন্যান্য বিষয় লঙ্ঘনের ঘটনা খুব বেশি উল্লেখযোগ্য নয়। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, দেশে সবকিছুর ব্যয় বাড়লেও পৌরসভার মতো নির্বাচনে প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয় তুলনামূলকভাবে কমেছে। এতে অবশ্য সাধারণ ভোটারদের কোনো লাভ হচ্ছে না। ধনী প্রার্থী কম ব্যয়ে বেশি বাজেটের পৌরসভা পরিচালনা করবেন। অন্যদিকে অনেক প্রার্থীর প্রচারণার ব্যয় সাশ্রয় হলেও মনোনয়ন পেতে তাঁরা বেশ কিছু বাড়তি অর্থ ব্যয় করেছেন বলে জানাচ্ছেন। তাই নির্বাচনের পর সততা রক্ষা করলেই জনগণ স্বল্প ব্যয়ের সুবিধাটা পেতে পারে।
তোফায়েল আহমেদ: স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সদস্য, স্থানীয় সরকার কমিশন।

No comments

Powered by Blogger.