সরল গরল-মনমোহনের সফরে বাংলাদেশের মন মোহন হবে কি? by মিজানুর রহমান খান
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফর সামনে রেখে আমরা কি খুব বড় ধরনের বরফ গলার বিষয় আশা করতে পারি? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের এক বছর পর সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণা একটি কেতাদুরস্ত তথ্য প্রকাশ করেছেন। মি. কৃষ্ণা বলেছেন, ‘আমি মনে করি, এই সফর ২০১১ সালে হতে পারে।
আমরা তারিখ নির্ধারণে পারস্পরিক আলোচনা চালাচ্ছি।’ কোনো আনুষ্ঠানিকতায় এটা প্রকাশ করা হয়নি। গত সপ্তাহে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলন হচ্ছিল। সেখানে সম্ভবত একজন বাংলাদেশি সাংবাদিক প্রশ্ন রেখেছিলেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করার পর এক বছর হয়ে গেছে। আপনি ও আপনার প্রধানমন্ত্রী কবে ঢাকা যাচ্ছেন।’
ঢাকায় আমরা লক্ষ করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সরকারের দুই বছর পূর্তি ভাষণে ভারত প্রসঙ্গটি একেবারেই এড়িয়ে গেছেন।
এক বছর আগে এই কলামে লিখেছিলাম, ভারতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত ফলপ্রসূ ও হূদ্যতাপূর্ণ সফরের পর ট্রানজিটের মতো যেসব বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে, তা বাস্তবায়নের জন্য দরকার একটি দ্বিমুখী ইতিবাচক পরিবেশ। আর সে জন্য উগ্র ইসলামি মৌলবাদীসহ যারা দুই দেশের সম্পর্কের উন্নয়ন দেখতে চায় না, সেই শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার আগেই মনমোহনের ঢাকা সফর প্রত্যাশিত। এক বছর পর ১১ জানুয়ারি ভারতের টেলিগ্রাফ পত্রিকায় কৃষ্ণা শ্রীনিবাসনের লেখা পড়লাম। চিন্তাযুক্ত হলাম। তিনি ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। বাংলাদেশে হাইকমিশনার (১৯৮৯-৯২) ছিলেন। তাঁর মূল্যায়ন গুরুত্বপূর্ণ বৈকি। আসলে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আমাদের মনোভঙ্গির কোনো অমিল নেই। তিনি লিখেছেন, ‘এক বছর আগে শেখ হাসিনার সফরের মধ্য দিয়ে দুই প্রতিবেশীর সম্পর্কে এক নতুন ঊষার আশাবাদ তৈরি হয়েছিল। উভয় দেশ দৃশ্যত পারস্পরিক স্বার্থের বিষয়ে দারুণভাবে সচেতন এবং যথাসম্ভব নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী তার সুরক্ষা দিতেও বদ্ধপরিকর। কিন্তু সময়ের ধারাবাহিকতায় ঢাকায় একটা বিড় বিড় (অসন্তোষ) শুরু হয়েছে। এমনকি ভারতের শুভাকাঙ্ক্ষীদের মধ্যেও বলাবলি শুরু হয়েছে, বাংলাদেশ যখন ভারতের অগ্রাধিকারের প্রতি অনুকূল সাড়া দিয়েছে, তখন নয়াদিল্লি তার প্রয়োজন মেটানোর প্রতি অবহেলার সঙ্গে অমনোযোগী। এ ধরনের নেতিবাচকতা শেখ হাসিনা ওয়াজেদের ভবিষ্যৎ নির্বাচনী সম্ভাবনা ও রাজনৈতিক স্থিতির ওপর প্রভাব ফেলবে।’ ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব গুরুত্ব দিয়েছেন যে এ বিষয়ে দিল্লির উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত এবং প্রতিকারের জন্য তার দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। আমরা অবশ্য বলব এভাবে, ভারত বাংলাদেশের মানুষের মন জয় করবে।
তবে আমাদের যে উদ্বেগ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, তা শ্রীনিবাসনের নিবন্ধের মধ্য দিয়ে ঢাকার গত কয়েক দিনের শৈত্যপ্রবাহের মতো যেন বেশ জাঁকিয়ে বসল। এর কারণ, শ্রীনিবাসন আমাদের পুরোনো কাসুন্দি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। আমরা বহুকাল আগে থেকে শুনে আসছি, ভারতীয় রাজনীতিকেরা বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল হলে হবে কী, তাঁরা শেষতক আমলাতন্ত্রের সঙ্গে পেরে ওঠেন না। তাঁদের চেয়ে অনুদার ও অমনোযোগী ভারতের আমলাতন্ত্র। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, দিল্লিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি যখন গভীর সন্তুষ্টি প্রকাশ করা হচ্ছে, তখন শ্রীনিবাসন আমাদের জানাচ্ছেন, ভারতীয় আমলাতন্ত্রই বাধা। তাঁর কথায়, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক গড়ার প্রয়োজনীয়তা ভারতের সব দলের কাছেই প্রার্থিত। তাদের উদ্দেশ্য অভিন্ন। ভারতের সরকার জেনে-শুনে বাংলাদেশ কিংবা আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষতির কারণ হবে না। কিন্তু এখানে অস্থিরতার একটা উৎস আছে, সেটা হলো, দুঃখজনকভাবে অমনোযোগী ভারতীয় আমলাতন্ত্র।’ তাঁর উক্তিতে আরও পরিষ্কার যে দিল্লির সাউথ ও নর্থ ব্লকে যাঁরা বাংলাদেশ ডেস্কের দায়িত্বে রয়েছেন, বাংলাদেশ নিয়ে ভাবার কিংবা মনোযোগী হওয়ার সময় তাঁদের নেই। এই যখন ভারতের আমলাতন্ত্রের অবস্থা, তখন আমাদের জানতে ইচ্ছে হয়, ভারতের উচ্চপর্যায়ের রাজনীতিকেরা কি তাহলে আমলাতন্ত্রকে বাগে রাখতে অসমর্থ? সেই প্রশ্নেরও একটি জবাব শ্রীনিবাসনের লেখায় আমরা পাই। তাতে আমরা সমস্যা হয়তো অনুধাবন করতে পারি, কিন্তু উদ্বেগ, খটকা তো কমেই না, বরং প্রকট হয়। শ্রীনিবাসন লিখেছেন, ‘নিস্পৃহ থাকাই হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের স্টাইল। কোনো কিছুতে তিনি সক্রিয় হতে চান না। তিনি তাঁর অধীনস্থদের মাধ্যমে নিজের ইচ্ছার রূপদানে অক্ষম। ভারতীয় আমলাতন্ত্রের জন্য সময়সীমার বিস্তৃতি হয়তো ২০১৩ সালে অনুষ্ঠেয় বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠান পর্যন্ত এবং তারা তাদের ব্যাপকভিত্তিক এজেন্ডার মধ্যে বাংলাদেশকেও স্রেফ অন্যতম একটা দেশ হিসেবে গণ্য করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের নেতাদের জন্য সময় দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে এবং সেটা শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময় গৃহীত সিদ্ধান্ত মাঠপর্যায়ে বাস্তবে রূপদানের প্রশ্নে জড়িত।’
ভারতীয় কূটনীতিকেরা প্রকাশ্যে ও ঘরোয়াভাবে আমাদের বোঝাতে চাইতেন, ট্রানজিটও তাঁদের অগ্রাধিকার নয়; বন্দরসহ অন্য আর কিছুই তেমন নয়; তাঁদের সর্বোচ্চ উদ্বেগ ও সংবেদনশীলতার জায়গা তাঁদের জাতীয় নিরাপত্তা। সোজা কথায়, উত্তর-পূর্ব ভারতের কথিত স্বাধীনতাকামী লোকদের সশস্ত্র সংগ্রামে বাংলাদেশের ভূমি যাতে ব্যবহূত না হয়, তা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশ সেটা করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের পর ভারতের সব মহল থেকে আমরা সন্তুষ্টির কথাই শুনে আসছি। সমপ্রতি ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার বলেন, বিচ্ছিন্নতাবাদবিরোধী অভিযান এখন অবশিষ্ট পর্যায়ে।
২০০৯ সালে বাংলাদেশে গ্রেপ্তার হওয়া আসামের উলফা নেতা অরবিন্দ রাজখোয়া সরকারের সম্মতিতে জামিনে বেরিয়ে বীরোচিতভাবে সভা করছেন। এমনকি কারাবন্দী অনুপ চেটিয়াকে ঢাকা থেকে এখন ভারতই তাদের দেশে নিতে কৌশলগত কারণে দেরি করতে পারে। অরবিন্দ ১১ জানুয়ারি কথিতমতে চীনে থাকা পরেশ বড়ুয়া ও অনুপের বাড়িতে যান। শ্রীনিবাসন লিখেছেন, ‘ভারতীয় স্বার্থ রক্ষায় শেখ হাসিনা রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়েছেন। সে জন্য উচ্চ প্রশংসা তাঁর প্রাপ্য এবং তাঁকে তাঁর সাহসের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে।’
আমাদের গণমাধ্যম যখন উলফাকে সন্ত্রাসী, বিচ্ছিন্নতাবাদী বলতে ছাড়ে না। তখন কিন্তু আমরা দেখি, পিটিআই উলফা চেয়ারম্যানের সভার খবর, তাঁর মুমূর্ষু মাকে দেখতে যাওয়া সমীহ ভরে পরিবেশন করছে। ৩০ বছর আগে যেখানে উলফার জন্ম হয়েছিল, সেখানকার মানুষ গান্ধীভক্ত মুক্তিযোদ্ধা উমাকান্তের ছেলে অরবিন্দকে সংবর্ধনা দিয়েছেন। কিন্তু মানিক সরকার যেমনটা সেদিন বললেন যে দুই দেশের গহিন অরণ্যই বাধা। বিদ্রোহীরা তাড়া খেলে তারা এখনো বাংলাদেশে পালিয়ে যায়। আবার ঢুকে সহিংস ঘটনা ঘটায়। অরণ্য ও দুর্গম অঞ্চল বাধা ঠিকই, কিন্তু বিদ্রোহের কারণ ও তা দমনে সেটাই একমাত্র বাধা নয়। পারমাণবিক শক্তিধর উদীয়মান বিশ্বশক্তি ভারতের কাছে অনেকটাই অচেনা পশ্চাৎপদ উত্তর-পূর্বাঞ্চল। বিদ্রোহ দমন শুধু বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতার ওপর নির্ভর করেনি এবং করবে না। সেখানে অনুন্নয়ন ও অনগ্রসরতার যে সমস্যা, তা বহুপক্ষীয়ভাবে সমাধান করতে হবে। আর সে জন্য বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানকে নিয়ে যে ধরনের উদ্যোগ দরকার, তার কোনো আলামত এখনো আমরা দেখি না। বিপরীতে যদি বলা হয়, বাংলাদেশ একাই ভারতকে ট্রানজিট দেয়নি, ভারতও বাংলাদেশকে দিয়েছে, সেটা কিন্তু তুলনীয় হতে পারে না। এমনকি শুল্ক দিলেও নয়। সবাইকে নিয়ে বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প হলে সবাইকে সবার টেকসই শুল্ক দেওয়া হবে। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিজোরাম, সিকিম ও অরুণাচল প্রদেশে জল, তাপ বা গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎ প্রকল্পে বাংলাদেশ আগ্রহ দেখাচ্ছে। শ্রীনিবাসন লিখেছেন, ‘এ ধরনের প্রকল্প খুবই কাঙ্ক্ষিত। অথচ ভারতীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় একটা সভা পর্যন্ত করতে পারছে না।’ ভারতীয় আমলাতন্ত্রের এই উদাসীনতা শুধু বাংলাদেশিদের নয়, উত্তর-পূর্ব ভারতের শান্তি আলোচনার সাফল্য দেখতে আগ্রহী মহলের কাছেও অনভিপ্রেত বলে গণ্য হওয়ার কথা। মেঘালয়ে জন্ম নেওয়া বাঙালি মেয়ে অরুন্ধতী রায় মাওবাদী নন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সশস্ত্র মাওবাদীদের কর্মকাণ্ডে তিনি দেশপ্রেম দেখেন। তাঁদের প্রতি তাঁর সমর্থন ব্যক্ত করেন।
তিস্তা নদীর পানির হিস্যা প্রশ্নে আমরা শুনছি, ১৫ বছর মেয়াদি একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তির বিষয়ে কথাবার্তা চলছে। এতটা নির্দিষ্ট সুখবর এই প্রথম জানা গেল। কিন্তু প্রথমেই খটকা জাগে, ভারতের অসাধারণ সহযোগিতা ও শুভেচ্ছায় বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের চার দশক পর এসে কেন এমন একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে গঙ্গা চুক্তির মেয়াদের চেয়ে কম মেয়াদি চুক্তি হবে। শ্রীনিবাসনের মন্তব্য, ’শেখ হাসিনার সফরের পর দ্বিতীয় শুষ্ক মৌসুম সমাগত। কিন্তু কোনো অন্তর্বর্তীকালীন তিস্তা চুক্তি হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ, যে রাজ্য সবচেয়ে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের সঙ্গে কি নয়াদিল্লি এ পর্যন্ত আলোচনা করেছে? কলকাতা সরকার সব ইস্যুতেই নিষ্ক্রিয়। হয়তো রাজ্যের নির্বাচন পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করতে চায়। কিন্তু এ ধরনের যুক্তিতর্কের কোনো মূল্য বাংলাদেশের জনগণের বোঝার কথা নয়।’
শ্রীনিবাসন আমলাতন্ত্রের কথা বলছিলেন। ১০ জানুয়ারি তাঁর নিবন্ধ প্রকাশের ঠিক এক দিন আগে দ্য হিন্দু পত্রিকায় সন্দ্বীপ দীক্ষিতের একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করা ‘সূত্রগুলোর’ বরাতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। আমরা ধারণা করতে পারি, এই সূত্র আমলাতান্ত্রিক। সে কারণে দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলো ভারতের আমলাতন্ত্র কীভাবে দেখছে, এটা হয়তো তার একটা প্রতিফলন। ‘সূত্রগুলো’ বলেছে, ’বিরোধ নিয়ে ৩৮ বছর কাটানোর পর তুলনামূলকভাবে সীমান্ত সমস্যার সুরাহা করা গুরুত্বপূর্ণ। উভয় পক্ষ ছিটমহল-সংক্রান্ত তথ্যবিনিময় শেষ করার অভ্যন্তরীণ সময়সীমা নির্ধারণ করেছে। ভারতে বাংলাদেশের প্রায় ৯০টি এবং বাংলাদেশে ভারতের প্রায় ১০৫টি ছিটমহল রয়েছে। এই সূত্র আরও জানাচ্ছে, অপদখলীয় এলাকার বিষয়ে আমাদের মধ্যে কোনো অনুমোদিত তালিকা পর্যন্ত নেই। এই প্রথম একটি সম্মত তালিকা প্রণয়নের দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এটা ঠিক হলেই বাস্তবে ভূখণ্ডের বিনিময়ের প্রশ্ন আসবে।’ সেটা কবে?
আমরা লক্ষ করি, দ্য হিন্দুর বর্ণিত প্রতিবেদনের সূত্রগুলো ‘পারস্পরিক গিভ অ্যান্ড টেক’ বা দেওয়া-নেওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। সূত্রগুলো বলেছে, ইতিহাস যা রেখে দিয়ে গেছে, সে বিষয়ে পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়া হওয়া উচিত। এই ’সূত্রগুলো’ বেরুবাড়ী-বিষয়ক প্রশ্নে কথাটি বলেছে। উভয় পক্ষ এখন নাকি সম্মত যে বেরুবাড়ীতে যে লাইনটি টানা হয়েছে, তা ছিল ঐতিহাসিকভাবে একতরফা। এই উপমহাদেশে ঐতিহাসিকভাবে কে, কখন, কোথায় কী একতরফা করেছিল, তার ঝাঁপি খোলা আর প্যান্ডোরার বক্স খোলা একই কথা। সুতরাং এ নিয়ে কোনো মন্তব্য নয়। শুধু এটুকুই বলব, দুই দেশের দীর্ঘ স্থলসীমান্তের যে তিনটি স্থানের প্রায় সাড়ে ছয় কিলোমিটার জায়গা চিহ্নিত করা হয়নি, তা কখনো আমলা পর্যায়ে সুরাহা হতে পারে বলে বিশ্বাস করি না।
আমরা অস্বস্তির সঙ্গেই লক্ষ করি যে দুই দেশের সম্পর্কে নতুন প্রভাত আসার প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তিকল্পে আন্তর্জাতিক সালিস আদালতে গিয়েছে। উইকিলিকসের প্রকাশিত তথ্য থেকে আমরা জানতে পারছি, আমাদের সমুদ্র উপকূলবর্তী ব্লকে অনুসন্ধানকাজ চালাতে মার্কিন কোম্পানিগুলো সতর্ক।
বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় মার্কিন তেল কোম্পানিগুলোর অনুসন্ধানকাজ ব্যাহত হয়েছিল। মার্কিন অধ্যাপক মার্কাস ফ্রান্ডা লিখেছেন, ‘ভারতীয় নৌবাহিনী শক্তি প্রদর্শনের পর মার্কিন তেল কোম্পানিগুলো বঙ্গোপসাগরে তাদের কাজ গুটিয়ে নিয়েছিল।’ তিন দশক পর এসে কনোকো ফিলিপসের আগ্রহ সম্পর্কে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীকে বলেছেন, উপকূলের যে ব্লকটি সম্পর্কে কোনো বিরোধ নেই, সেটি দিয়ে প্রথম কাজ শুরু করতে চায় কনোকো ফিলিপস। আমরা এটুকু বুঝতে পারি, আন্তর্জাতিক আদালত থেকে রায় পাওয়া না গেলে আমাদের সমুদ্র সম্পদ আহরণের প্রচেষ্টা ব্যাহত হতে থাকবে। মনমোহনের সফরে তাতে হয়তো কোনো পরিবর্তন আনবে না।
অগ্রজ সাংবাদিক সাজ্জাদ শরিফ যদিও জানালেন, গত বছর ভারত সফরকালে বাংলাদেশি সাংবাদিকদের প্রণব মুখার্জি বলেছিলেন, ’বাংলাদেশের বিষয়ে মি. মনমোহনের বিশেষ আগ্রহ আছে।’ ভারতীয় কর্মকর্তাদের কথায়, বাংলাদেশি সাংবাদিকদের মনে হয়েছে, মি. মনমোহনের একটি স্টাইল হলো, তিনি কোনো দেশে নিছক প্রীতি সফরে যান না। যেখানেই যান, তা তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ কথায় আশাবাদ জাগে। কিন্তু সে জন্য পরিবেশ লাগে। এবং তা আকস্মিক তৈরি হয় না।
শ্রীনিবাসন আমলাতান্ত্রিক যে চিত্র তুলে ধরেছেন, তার কিছুটা আমরাও খালি চোখে দেখি। বিএসএফের গুলিতে নিষ্পাপ ফেলানীর মর্মস্পর্শী হত্যাকাণ্ডও তার একটি দৃষ্টান্ত। হয়তো আগের তুলনায় সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপকতা কমেছে, কিন্তু দেখার বড় বিষয় অন্যত্র। শ্রীনিবাসনের নিবন্ধে বলা হয়েছে, ‘সীমান্ত সমস্যার নিষ্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ রাইফেলস ও বিএসএফের মধ্যে সংঘর্ষ অব্যাহত থাকবে।’ তিনি এ জন্য সিলেট-তামাবিল সেক্টরের সাম্প্রতিক ঘটনার দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন। তিনি কারণ দেখান যে সীমান্তের একদিকে কিংবা উভয় দিকে সর্বদাই এমন মহল থাকবে, যারা তাদের স্বার্থে অনিষ্ট করে যাবে। সাধারণভাবে তাঁর কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু আমরা মনে করি না যে সীমানা চিহ্নিত হলেই মানুষ মারা বন্ধ হবে। সীমান্তে বিএসএফের হত্যাকাণ্ড বস্তুত আমাদের দেশের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তুলনীয়। ওই সব হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রেও প্রায়ই ক্রসফায়ার কিংবা এনকাউন্টারের মতোই গল্প সাজানো হয়। আমরা অবাক বিস্ময়ে ভাবি, ভারতের শক্তিশালী সুশীল সমাজ ও মানবাধিকারকর্মীরা কেন ভারতীয় সীমান্তের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে মানবাধিকারের লঙ্ঘন হিসেবে দেখতে ব্যর্থ হন। ভারতের মূল ধারার গণমাধ্যমকেও ঠিক তেমনটা সচকিত বলে মনে হয় না। আমরা মনে করি, দ্বিপক্ষীয় সব হিসাব-নিকাশ এবং দেওয়া-নেওয়ার কূটনীতির ঊর্ধ্বে মানবিক সম্পর্কের উন্নয়নের বিষয়টি গুরুত্বের দাবি রাখে। টাইমস অব ইন্ডিয়ায় ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১০ একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘কাশ্মীরে কিশোর হত্যার দায়ে ১৪ বিএসএফ সদস্য বরখাস্ত’। বিএসএফ কমান্ডার আর কে বারদি ওই তরুণকে নাকি গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনিও বরখাস্ত হন। ১৬ বছরের কাশ্মীরি কিশোর জাহিদ ফারুক শাহকে হত্যার দায়ে ১৫ জনকে বরখাস্তের পর আনুষ্ঠানিক তদন্ত চলে। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৫ জনের বিরুদ্ধে বিএসএফের নেতৃত্বাধীন জেনারেল কোর্ট অব ইনকোয়ারি চলাচালে তাঁদের বরখাস্ত করা হয়, যাতে তদন্তকাজে বিঘ্ন না ঘটে। অথচ এই বিএসএফ বাংলাদেশ সীমান্তে ব্যাপকভিত্তিক হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। কিন্তু তার কখনো তদন্ত অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। বিএসএফের ইন্সপেক্টর জেনারেল সম্প্রতি কলকাতায় দাবি করেছেন যে তাঁদের বাহিনী বিরাট সংযমের পরিচয় দিয়ে চলেছে। কিন্তু তাঁর নিজস্ব প্রাক্কলন অনুযায়ী, গত চার মাসে গুলিবর্ষণের ২০টি ঘটনা ঘটেছে, যা তাঁর মতে অপরিমিত ও অগ্রহণযোগ্য। ভারতীয় আইনে যা দণ্ডনীয়।
আমরা মনেপ্রাণে চাই, মনমোহনের আসন্ন সফর একটি মাইলফলক হয়ে থাকুক। সে জন্য জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কের জায়গা ও ভিতটা পাকাপোক্ত হওয়া দরকার। ফেলানী হত্যাকাণ্ডের দায়ে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের এখনই বরখাস্ত করা হোক। তদন্ত হোক। বিচার হোক। কাঁটাতারের কাঁটা দূর হোক। এ ধরনের উদ্যোগ দুই প্রতিবেশীর সম্পর্কের জন্য অপরিহার্য। করিডর বা তৃতীয় কোনো দেশের জল-স্থল দিয়ে নির্বিঘ্নে পণ্য চলাচলের সম্ভাব্য চিত্রটি সংশ্লিষ্ট দেশের জনগণের ওপর বেশি নির্ভর করে।
২০০৮ সালে শ্রীনিবাসনের বই বেরোয়, ঢাকায় তাঁর কর্মব্যস্ততা নিয়ে তিনি ডায়েরি লিখতেন। সেটারই সংকলন দি জামদানি রেভল্যুশন শীর্ষক ওই বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, দিল্লির পররাষ্ট্রমন্ত্রক কিংবা ভারত সরকারের অন্যান্য বিভাগে কর্মরত আমার মেধাবী সহকর্মীরা অগ্রাধিকার প্রদানে সময়ের তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তাকেই গুরুত্ব দেন। তবে সাধারণত তাঁদের অগ্রাধিকারে বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত হয় না।’ এখন দেখার বিষয় হলো, ২০১১ সালেও এর পুনরাবৃত্তি ঘটে কি না। মনমোহনের সফরে বাংলাদেশের জনগণের মন মোহন হয় কি না।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
ঢাকায় আমরা লক্ষ করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সরকারের দুই বছর পূর্তি ভাষণে ভারত প্রসঙ্গটি একেবারেই এড়িয়ে গেছেন।
এক বছর আগে এই কলামে লিখেছিলাম, ভারতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত ফলপ্রসূ ও হূদ্যতাপূর্ণ সফরের পর ট্রানজিটের মতো যেসব বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে, তা বাস্তবায়নের জন্য দরকার একটি দ্বিমুখী ইতিবাচক পরিবেশ। আর সে জন্য উগ্র ইসলামি মৌলবাদীসহ যারা দুই দেশের সম্পর্কের উন্নয়ন দেখতে চায় না, সেই শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার আগেই মনমোহনের ঢাকা সফর প্রত্যাশিত। এক বছর পর ১১ জানুয়ারি ভারতের টেলিগ্রাফ পত্রিকায় কৃষ্ণা শ্রীনিবাসনের লেখা পড়লাম। চিন্তাযুক্ত হলাম। তিনি ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। বাংলাদেশে হাইকমিশনার (১৯৮৯-৯২) ছিলেন। তাঁর মূল্যায়ন গুরুত্বপূর্ণ বৈকি। আসলে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আমাদের মনোভঙ্গির কোনো অমিল নেই। তিনি লিখেছেন, ‘এক বছর আগে শেখ হাসিনার সফরের মধ্য দিয়ে দুই প্রতিবেশীর সম্পর্কে এক নতুন ঊষার আশাবাদ তৈরি হয়েছিল। উভয় দেশ দৃশ্যত পারস্পরিক স্বার্থের বিষয়ে দারুণভাবে সচেতন এবং যথাসম্ভব নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী তার সুরক্ষা দিতেও বদ্ধপরিকর। কিন্তু সময়ের ধারাবাহিকতায় ঢাকায় একটা বিড় বিড় (অসন্তোষ) শুরু হয়েছে। এমনকি ভারতের শুভাকাঙ্ক্ষীদের মধ্যেও বলাবলি শুরু হয়েছে, বাংলাদেশ যখন ভারতের অগ্রাধিকারের প্রতি অনুকূল সাড়া দিয়েছে, তখন নয়াদিল্লি তার প্রয়োজন মেটানোর প্রতি অবহেলার সঙ্গে অমনোযোগী। এ ধরনের নেতিবাচকতা শেখ হাসিনা ওয়াজেদের ভবিষ্যৎ নির্বাচনী সম্ভাবনা ও রাজনৈতিক স্থিতির ওপর প্রভাব ফেলবে।’ ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব গুরুত্ব দিয়েছেন যে এ বিষয়ে দিল্লির উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত এবং প্রতিকারের জন্য তার দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। আমরা অবশ্য বলব এভাবে, ভারত বাংলাদেশের মানুষের মন জয় করবে।
তবে আমাদের যে উদ্বেগ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, তা শ্রীনিবাসনের নিবন্ধের মধ্য দিয়ে ঢাকার গত কয়েক দিনের শৈত্যপ্রবাহের মতো যেন বেশ জাঁকিয়ে বসল। এর কারণ, শ্রীনিবাসন আমাদের পুরোনো কাসুন্দি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। আমরা বহুকাল আগে থেকে শুনে আসছি, ভারতীয় রাজনীতিকেরা বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল হলে হবে কী, তাঁরা শেষতক আমলাতন্ত্রের সঙ্গে পেরে ওঠেন না। তাঁদের চেয়ে অনুদার ও অমনোযোগী ভারতের আমলাতন্ত্র। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, দিল্লিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি যখন গভীর সন্তুষ্টি প্রকাশ করা হচ্ছে, তখন শ্রীনিবাসন আমাদের জানাচ্ছেন, ভারতীয় আমলাতন্ত্রই বাধা। তাঁর কথায়, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক গড়ার প্রয়োজনীয়তা ভারতের সব দলের কাছেই প্রার্থিত। তাদের উদ্দেশ্য অভিন্ন। ভারতের সরকার জেনে-শুনে বাংলাদেশ কিংবা আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষতির কারণ হবে না। কিন্তু এখানে অস্থিরতার একটা উৎস আছে, সেটা হলো, দুঃখজনকভাবে অমনোযোগী ভারতীয় আমলাতন্ত্র।’ তাঁর উক্তিতে আরও পরিষ্কার যে দিল্লির সাউথ ও নর্থ ব্লকে যাঁরা বাংলাদেশ ডেস্কের দায়িত্বে রয়েছেন, বাংলাদেশ নিয়ে ভাবার কিংবা মনোযোগী হওয়ার সময় তাঁদের নেই। এই যখন ভারতের আমলাতন্ত্রের অবস্থা, তখন আমাদের জানতে ইচ্ছে হয়, ভারতের উচ্চপর্যায়ের রাজনীতিকেরা কি তাহলে আমলাতন্ত্রকে বাগে রাখতে অসমর্থ? সেই প্রশ্নেরও একটি জবাব শ্রীনিবাসনের লেখায় আমরা পাই। তাতে আমরা সমস্যা হয়তো অনুধাবন করতে পারি, কিন্তু উদ্বেগ, খটকা তো কমেই না, বরং প্রকট হয়। শ্রীনিবাসন লিখেছেন, ‘নিস্পৃহ থাকাই হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের স্টাইল। কোনো কিছুতে তিনি সক্রিয় হতে চান না। তিনি তাঁর অধীনস্থদের মাধ্যমে নিজের ইচ্ছার রূপদানে অক্ষম। ভারতীয় আমলাতন্ত্রের জন্য সময়সীমার বিস্তৃতি হয়তো ২০১৩ সালে অনুষ্ঠেয় বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠান পর্যন্ত এবং তারা তাদের ব্যাপকভিত্তিক এজেন্ডার মধ্যে বাংলাদেশকেও স্রেফ অন্যতম একটা দেশ হিসেবে গণ্য করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের নেতাদের জন্য সময় দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে এবং সেটা শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময় গৃহীত সিদ্ধান্ত মাঠপর্যায়ে বাস্তবে রূপদানের প্রশ্নে জড়িত।’
ভারতীয় কূটনীতিকেরা প্রকাশ্যে ও ঘরোয়াভাবে আমাদের বোঝাতে চাইতেন, ট্রানজিটও তাঁদের অগ্রাধিকার নয়; বন্দরসহ অন্য আর কিছুই তেমন নয়; তাঁদের সর্বোচ্চ উদ্বেগ ও সংবেদনশীলতার জায়গা তাঁদের জাতীয় নিরাপত্তা। সোজা কথায়, উত্তর-পূর্ব ভারতের কথিত স্বাধীনতাকামী লোকদের সশস্ত্র সংগ্রামে বাংলাদেশের ভূমি যাতে ব্যবহূত না হয়, তা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশ সেটা করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের পর ভারতের সব মহল থেকে আমরা সন্তুষ্টির কথাই শুনে আসছি। সমপ্রতি ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার বলেন, বিচ্ছিন্নতাবাদবিরোধী অভিযান এখন অবশিষ্ট পর্যায়ে।
২০০৯ সালে বাংলাদেশে গ্রেপ্তার হওয়া আসামের উলফা নেতা অরবিন্দ রাজখোয়া সরকারের সম্মতিতে জামিনে বেরিয়ে বীরোচিতভাবে সভা করছেন। এমনকি কারাবন্দী অনুপ চেটিয়াকে ঢাকা থেকে এখন ভারতই তাদের দেশে নিতে কৌশলগত কারণে দেরি করতে পারে। অরবিন্দ ১১ জানুয়ারি কথিতমতে চীনে থাকা পরেশ বড়ুয়া ও অনুপের বাড়িতে যান। শ্রীনিবাসন লিখেছেন, ‘ভারতীয় স্বার্থ রক্ষায় শেখ হাসিনা রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়েছেন। সে জন্য উচ্চ প্রশংসা তাঁর প্রাপ্য এবং তাঁকে তাঁর সাহসের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে।’
আমাদের গণমাধ্যম যখন উলফাকে সন্ত্রাসী, বিচ্ছিন্নতাবাদী বলতে ছাড়ে না। তখন কিন্তু আমরা দেখি, পিটিআই উলফা চেয়ারম্যানের সভার খবর, তাঁর মুমূর্ষু মাকে দেখতে যাওয়া সমীহ ভরে পরিবেশন করছে। ৩০ বছর আগে যেখানে উলফার জন্ম হয়েছিল, সেখানকার মানুষ গান্ধীভক্ত মুক্তিযোদ্ধা উমাকান্তের ছেলে অরবিন্দকে সংবর্ধনা দিয়েছেন। কিন্তু মানিক সরকার যেমনটা সেদিন বললেন যে দুই দেশের গহিন অরণ্যই বাধা। বিদ্রোহীরা তাড়া খেলে তারা এখনো বাংলাদেশে পালিয়ে যায়। আবার ঢুকে সহিংস ঘটনা ঘটায়। অরণ্য ও দুর্গম অঞ্চল বাধা ঠিকই, কিন্তু বিদ্রোহের কারণ ও তা দমনে সেটাই একমাত্র বাধা নয়। পারমাণবিক শক্তিধর উদীয়মান বিশ্বশক্তি ভারতের কাছে অনেকটাই অচেনা পশ্চাৎপদ উত্তর-পূর্বাঞ্চল। বিদ্রোহ দমন শুধু বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতার ওপর নির্ভর করেনি এবং করবে না। সেখানে অনুন্নয়ন ও অনগ্রসরতার যে সমস্যা, তা বহুপক্ষীয়ভাবে সমাধান করতে হবে। আর সে জন্য বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানকে নিয়ে যে ধরনের উদ্যোগ দরকার, তার কোনো আলামত এখনো আমরা দেখি না। বিপরীতে যদি বলা হয়, বাংলাদেশ একাই ভারতকে ট্রানজিট দেয়নি, ভারতও বাংলাদেশকে দিয়েছে, সেটা কিন্তু তুলনীয় হতে পারে না। এমনকি শুল্ক দিলেও নয়। সবাইকে নিয়ে বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প হলে সবাইকে সবার টেকসই শুল্ক দেওয়া হবে। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিজোরাম, সিকিম ও অরুণাচল প্রদেশে জল, তাপ বা গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎ প্রকল্পে বাংলাদেশ আগ্রহ দেখাচ্ছে। শ্রীনিবাসন লিখেছেন, ‘এ ধরনের প্রকল্প খুবই কাঙ্ক্ষিত। অথচ ভারতীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় একটা সভা পর্যন্ত করতে পারছে না।’ ভারতীয় আমলাতন্ত্রের এই উদাসীনতা শুধু বাংলাদেশিদের নয়, উত্তর-পূর্ব ভারতের শান্তি আলোচনার সাফল্য দেখতে আগ্রহী মহলের কাছেও অনভিপ্রেত বলে গণ্য হওয়ার কথা। মেঘালয়ে জন্ম নেওয়া বাঙালি মেয়ে অরুন্ধতী রায় মাওবাদী নন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সশস্ত্র মাওবাদীদের কর্মকাণ্ডে তিনি দেশপ্রেম দেখেন। তাঁদের প্রতি তাঁর সমর্থন ব্যক্ত করেন।
তিস্তা নদীর পানির হিস্যা প্রশ্নে আমরা শুনছি, ১৫ বছর মেয়াদি একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তির বিষয়ে কথাবার্তা চলছে। এতটা নির্দিষ্ট সুখবর এই প্রথম জানা গেল। কিন্তু প্রথমেই খটকা জাগে, ভারতের অসাধারণ সহযোগিতা ও শুভেচ্ছায় বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের চার দশক পর এসে কেন এমন একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে গঙ্গা চুক্তির মেয়াদের চেয়ে কম মেয়াদি চুক্তি হবে। শ্রীনিবাসনের মন্তব্য, ’শেখ হাসিনার সফরের পর দ্বিতীয় শুষ্ক মৌসুম সমাগত। কিন্তু কোনো অন্তর্বর্তীকালীন তিস্তা চুক্তি হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ, যে রাজ্য সবচেয়ে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের সঙ্গে কি নয়াদিল্লি এ পর্যন্ত আলোচনা করেছে? কলকাতা সরকার সব ইস্যুতেই নিষ্ক্রিয়। হয়তো রাজ্যের নির্বাচন পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করতে চায়। কিন্তু এ ধরনের যুক্তিতর্কের কোনো মূল্য বাংলাদেশের জনগণের বোঝার কথা নয়।’
শ্রীনিবাসন আমলাতন্ত্রের কথা বলছিলেন। ১০ জানুয়ারি তাঁর নিবন্ধ প্রকাশের ঠিক এক দিন আগে দ্য হিন্দু পত্রিকায় সন্দ্বীপ দীক্ষিতের একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করা ‘সূত্রগুলোর’ বরাতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। আমরা ধারণা করতে পারি, এই সূত্র আমলাতান্ত্রিক। সে কারণে দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলো ভারতের আমলাতন্ত্র কীভাবে দেখছে, এটা হয়তো তার একটা প্রতিফলন। ‘সূত্রগুলো’ বলেছে, ’বিরোধ নিয়ে ৩৮ বছর কাটানোর পর তুলনামূলকভাবে সীমান্ত সমস্যার সুরাহা করা গুরুত্বপূর্ণ। উভয় পক্ষ ছিটমহল-সংক্রান্ত তথ্যবিনিময় শেষ করার অভ্যন্তরীণ সময়সীমা নির্ধারণ করেছে। ভারতে বাংলাদেশের প্রায় ৯০টি এবং বাংলাদেশে ভারতের প্রায় ১০৫টি ছিটমহল রয়েছে। এই সূত্র আরও জানাচ্ছে, অপদখলীয় এলাকার বিষয়ে আমাদের মধ্যে কোনো অনুমোদিত তালিকা পর্যন্ত নেই। এই প্রথম একটি সম্মত তালিকা প্রণয়নের দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এটা ঠিক হলেই বাস্তবে ভূখণ্ডের বিনিময়ের প্রশ্ন আসবে।’ সেটা কবে?
আমরা লক্ষ করি, দ্য হিন্দুর বর্ণিত প্রতিবেদনের সূত্রগুলো ‘পারস্পরিক গিভ অ্যান্ড টেক’ বা দেওয়া-নেওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। সূত্রগুলো বলেছে, ইতিহাস যা রেখে দিয়ে গেছে, সে বিষয়ে পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়া হওয়া উচিত। এই ’সূত্রগুলো’ বেরুবাড়ী-বিষয়ক প্রশ্নে কথাটি বলেছে। উভয় পক্ষ এখন নাকি সম্মত যে বেরুবাড়ীতে যে লাইনটি টানা হয়েছে, তা ছিল ঐতিহাসিকভাবে একতরফা। এই উপমহাদেশে ঐতিহাসিকভাবে কে, কখন, কোথায় কী একতরফা করেছিল, তার ঝাঁপি খোলা আর প্যান্ডোরার বক্স খোলা একই কথা। সুতরাং এ নিয়ে কোনো মন্তব্য নয়। শুধু এটুকুই বলব, দুই দেশের দীর্ঘ স্থলসীমান্তের যে তিনটি স্থানের প্রায় সাড়ে ছয় কিলোমিটার জায়গা চিহ্নিত করা হয়নি, তা কখনো আমলা পর্যায়ে সুরাহা হতে পারে বলে বিশ্বাস করি না।
আমরা অস্বস্তির সঙ্গেই লক্ষ করি যে দুই দেশের সম্পর্কে নতুন প্রভাত আসার প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তিকল্পে আন্তর্জাতিক সালিস আদালতে গিয়েছে। উইকিলিকসের প্রকাশিত তথ্য থেকে আমরা জানতে পারছি, আমাদের সমুদ্র উপকূলবর্তী ব্লকে অনুসন্ধানকাজ চালাতে মার্কিন কোম্পানিগুলো সতর্ক।
বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় মার্কিন তেল কোম্পানিগুলোর অনুসন্ধানকাজ ব্যাহত হয়েছিল। মার্কিন অধ্যাপক মার্কাস ফ্রান্ডা লিখেছেন, ‘ভারতীয় নৌবাহিনী শক্তি প্রদর্শনের পর মার্কিন তেল কোম্পানিগুলো বঙ্গোপসাগরে তাদের কাজ গুটিয়ে নিয়েছিল।’ তিন দশক পর এসে কনোকো ফিলিপসের আগ্রহ সম্পর্কে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীকে বলেছেন, উপকূলের যে ব্লকটি সম্পর্কে কোনো বিরোধ নেই, সেটি দিয়ে প্রথম কাজ শুরু করতে চায় কনোকো ফিলিপস। আমরা এটুকু বুঝতে পারি, আন্তর্জাতিক আদালত থেকে রায় পাওয়া না গেলে আমাদের সমুদ্র সম্পদ আহরণের প্রচেষ্টা ব্যাহত হতে থাকবে। মনমোহনের সফরে তাতে হয়তো কোনো পরিবর্তন আনবে না।
অগ্রজ সাংবাদিক সাজ্জাদ শরিফ যদিও জানালেন, গত বছর ভারত সফরকালে বাংলাদেশি সাংবাদিকদের প্রণব মুখার্জি বলেছিলেন, ’বাংলাদেশের বিষয়ে মি. মনমোহনের বিশেষ আগ্রহ আছে।’ ভারতীয় কর্মকর্তাদের কথায়, বাংলাদেশি সাংবাদিকদের মনে হয়েছে, মি. মনমোহনের একটি স্টাইল হলো, তিনি কোনো দেশে নিছক প্রীতি সফরে যান না। যেখানেই যান, তা তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ কথায় আশাবাদ জাগে। কিন্তু সে জন্য পরিবেশ লাগে। এবং তা আকস্মিক তৈরি হয় না।
শ্রীনিবাসন আমলাতান্ত্রিক যে চিত্র তুলে ধরেছেন, তার কিছুটা আমরাও খালি চোখে দেখি। বিএসএফের গুলিতে নিষ্পাপ ফেলানীর মর্মস্পর্শী হত্যাকাণ্ডও তার একটি দৃষ্টান্ত। হয়তো আগের তুলনায় সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপকতা কমেছে, কিন্তু দেখার বড় বিষয় অন্যত্র। শ্রীনিবাসনের নিবন্ধে বলা হয়েছে, ‘সীমান্ত সমস্যার নিষ্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ রাইফেলস ও বিএসএফের মধ্যে সংঘর্ষ অব্যাহত থাকবে।’ তিনি এ জন্য সিলেট-তামাবিল সেক্টরের সাম্প্রতিক ঘটনার দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন। তিনি কারণ দেখান যে সীমান্তের একদিকে কিংবা উভয় দিকে সর্বদাই এমন মহল থাকবে, যারা তাদের স্বার্থে অনিষ্ট করে যাবে। সাধারণভাবে তাঁর কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু আমরা মনে করি না যে সীমানা চিহ্নিত হলেই মানুষ মারা বন্ধ হবে। সীমান্তে বিএসএফের হত্যাকাণ্ড বস্তুত আমাদের দেশের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তুলনীয়। ওই সব হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রেও প্রায়ই ক্রসফায়ার কিংবা এনকাউন্টারের মতোই গল্প সাজানো হয়। আমরা অবাক বিস্ময়ে ভাবি, ভারতের শক্তিশালী সুশীল সমাজ ও মানবাধিকারকর্মীরা কেন ভারতীয় সীমান্তের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে মানবাধিকারের লঙ্ঘন হিসেবে দেখতে ব্যর্থ হন। ভারতের মূল ধারার গণমাধ্যমকেও ঠিক তেমনটা সচকিত বলে মনে হয় না। আমরা মনে করি, দ্বিপক্ষীয় সব হিসাব-নিকাশ এবং দেওয়া-নেওয়ার কূটনীতির ঊর্ধ্বে মানবিক সম্পর্কের উন্নয়নের বিষয়টি গুরুত্বের দাবি রাখে। টাইমস অব ইন্ডিয়ায় ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১০ একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘কাশ্মীরে কিশোর হত্যার দায়ে ১৪ বিএসএফ সদস্য বরখাস্ত’। বিএসএফ কমান্ডার আর কে বারদি ওই তরুণকে নাকি গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনিও বরখাস্ত হন। ১৬ বছরের কাশ্মীরি কিশোর জাহিদ ফারুক শাহকে হত্যার দায়ে ১৫ জনকে বরখাস্তের পর আনুষ্ঠানিক তদন্ত চলে। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৫ জনের বিরুদ্ধে বিএসএফের নেতৃত্বাধীন জেনারেল কোর্ট অব ইনকোয়ারি চলাচালে তাঁদের বরখাস্ত করা হয়, যাতে তদন্তকাজে বিঘ্ন না ঘটে। অথচ এই বিএসএফ বাংলাদেশ সীমান্তে ব্যাপকভিত্তিক হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। কিন্তু তার কখনো তদন্ত অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। বিএসএফের ইন্সপেক্টর জেনারেল সম্প্রতি কলকাতায় দাবি করেছেন যে তাঁদের বাহিনী বিরাট সংযমের পরিচয় দিয়ে চলেছে। কিন্তু তাঁর নিজস্ব প্রাক্কলন অনুযায়ী, গত চার মাসে গুলিবর্ষণের ২০টি ঘটনা ঘটেছে, যা তাঁর মতে অপরিমিত ও অগ্রহণযোগ্য। ভারতীয় আইনে যা দণ্ডনীয়।
আমরা মনেপ্রাণে চাই, মনমোহনের আসন্ন সফর একটি মাইলফলক হয়ে থাকুক। সে জন্য জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কের জায়গা ও ভিতটা পাকাপোক্ত হওয়া দরকার। ফেলানী হত্যাকাণ্ডের দায়ে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের এখনই বরখাস্ত করা হোক। তদন্ত হোক। বিচার হোক। কাঁটাতারের কাঁটা দূর হোক। এ ধরনের উদ্যোগ দুই প্রতিবেশীর সম্পর্কের জন্য অপরিহার্য। করিডর বা তৃতীয় কোনো দেশের জল-স্থল দিয়ে নির্বিঘ্নে পণ্য চলাচলের সম্ভাব্য চিত্রটি সংশ্লিষ্ট দেশের জনগণের ওপর বেশি নির্ভর করে।
২০০৮ সালে শ্রীনিবাসনের বই বেরোয়, ঢাকায় তাঁর কর্মব্যস্ততা নিয়ে তিনি ডায়েরি লিখতেন। সেটারই সংকলন দি জামদানি রেভল্যুশন শীর্ষক ওই বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, দিল্লির পররাষ্ট্রমন্ত্রক কিংবা ভারত সরকারের অন্যান্য বিভাগে কর্মরত আমার মেধাবী সহকর্মীরা অগ্রাধিকার প্রদানে সময়ের তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তাকেই গুরুত্ব দেন। তবে সাধারণত তাঁদের অগ্রাধিকারে বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত হয় না।’ এখন দেখার বিষয় হলো, ২০১১ সালেও এর পুনরাবৃত্তি ঘটে কি না। মনমোহনের সফরে বাংলাদেশের জনগণের মন মোহন হয় কি না।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments