বিশেষ সাক্ষাৎকার-দুর্নীতিই আমাদের অর্থনীতি ও রাজনীতির প্রধান সমস্যা by মঈনুল ইসলাম
মঈনুল ইসলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর মঈনুল ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রের ভেন্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি লাভ করেন।
চোরাচালান, ঋণখেলাপি ও আঞ্চলিক সহযোগিতা নিয়ে গবেষণা করে খ্যাতিলাভকারী এই অর্থনীতিবিদ বর্তমান ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা কমিশনের প্যানেল অব ইকোনমিস্টসের অন্যতম সদস্য হিসেবেও কাজ করছেন। সাম্প্রতিক কালে দুর্নীতিসংক্রান্ত টিআইবির জরিপ প্রতিবেদন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। একই সঙ্গে আলোচনায় এসেছে সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযান, অর্থনীতিতে কালো টাকা, চোরাচালানের প্রভাব এবং শেয়ারবাজারের অস্থিরতার বিষয়টিও। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপচারিতায়্রএসব বিষয়ে তিনি আলোকপাত করেছেন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান
প্রথম আলো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কালো টাকার প্রভাব কতটা? কীভাবে এই প্রভাব কমানো যায়?
মঈনুল ইসলাম কালো টাকার নানা রকম সংজ্ঞা রয়েছে। কেউ এটাকে অবৈধ বা বেআইনি কার্যক্রম থেকে উদ্ভূত আয় হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন। অন্যরা আবার বৈধ বা অবৈধ যেভাবেই টাকাটা উপার্জিত হোক না কেন, যদি ওই টাকার ওপর প্রদেয় কর পরিশোধ না করা হয়, তাহলে ওই টাকাকে কালো টাকা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন। তবে সংজ্ঞার পার্থক্য সত্ত্বেও ঘুষ-দুর্নীতি, চোরাচালান, কালোবাজারি, চাঁদাবাজি, মার্জিন-কমিশন শিকার ইত্যাদি কার্যক্রম থেকে উদ্ভূত আয়কে কালো টাকা হিসেবে আখ্যায়িত করার যুক্তি রয়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো অর্থও যদি হুন্ডিপ্রক্রিয়ায় দেশে প্রবেশ করে, তাহলে ওই অর্থটাও কালো অর্থনীতির আয়তন বৃদ্ধি করে।
সুতরাং বাংলাদেশের অর্থনীতির একটা বিশাল অংশকে কালো অর্থনীতি বা সমান্তরাল অর্থনীতি হিসেবে অভিহিত করা যায়। কিন্তু এটা অর্থনীতির ‘কত শতাংশ’ তা প্রাক্কলন যাঁরা করছেন, তাঁরা কীভাবে বা কোন বিশ্লেষণপদ্ধতি অনুসরণে তা করছেন, সেটা না জেনে তাঁদের প্রাক্কলনকে ভালো বা খারাপ বলব না আমি। ‘বীরবলের কাক গণনা’র একটা দ্যোতনা ওগুলোতে তো রয়েছেই। তবে আমার ধারণা, কালো অর্থনীতির দৌরাত্ম্য কিংবা আয়তন কমছে না মোটেও। সেখানেই সরকারের ভূমিকা এবং যথাযথ নীতি প্রণয়নের প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবারের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার অনৈতিক ব্যবস্থাটা চালু রাখা কালো টাকাকে নিরাপদ ছত্রচ্ছায়া প্রদান মনে হয় আমার কাছে। ওটা বাতিল করার মাধ্যমেই সরকারের ‘কালো টাকা প্রতিরোধ’ প্রয়াসটা শুরু করতে হবে। এরপর আসবে দুর্নীতি দমন কমিশনকে সত্যিকার স্বাধীন, শক্তিশালী ও কার্যকর করার ব্যবস্থার কথা। বর্তমান সরকার এটাকে আক্ষরিক অর্থেই লক্ষ্যদন্তহীন ব্যাঘ্রে পরিণত করেছে। তারপর মানি লন্ডারিং আইন সংশোধনের প্রশ্নও আসবে, এনবিআরকেও দুর্নীতিমুক্ত করার কার্যকর প্রয়াস লাগবে। চোরাচালানকে যেসব বিষয় উৎসাহিত করছে, সেগুলোও যথাযথ নীতি পরিবর্তনের মাধ্যমে কমিয়ে আনা যায়। আমার বিভিন্ন গবেষণা পুস্তক এবং প্রবন্ধে সেগুলোর পথনির্দেশনা রয়েছে।
প্রথম আলো বলা হয়, যেকোনো দেশের অর্থনীতির বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে কালো টাকার প্রভাব থাকে। ধীরে ধীরে তা কমে যায়। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন কোন অবস্থায় আছে?
মঈনুল ইসলাম আমি এ প্রশ্নে দ্বিমত পোষণ করছি। একটি দেশের রাষ্ট্রচরিত্র এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণেই কালো টাকা পৃষ্ঠপোষকতা পায়। অতএব, কালো টাকা এমনি এমনি কমে যাবে না। বাংলাদেশের সামরিক শাসকেরা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে কেনাবেচার রাজনীতি এবং আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রচরিত্রকে যেভাবে প্রাতিষ্ঠানিকতা দিয়েছে, সেখান থেকে দুই দশকের নির্বাচনী গণতন্ত্র এখনো বেরোতে পারছে না। কারণ, নির্বাচনও কালো টাকা এবং পেশিশক্তির কবল থেকে আজও মুক্ত হতে পারছে না। রাষ্ট্রচরিত্র এবং রাজনীতিকে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার দিকে নিয়ে যেতে না পারলে কালো টাকা থেকে জাতির মুক্তি মিলবে না।
প্রথম আলো দুর্নীতির সঙ্গে কালো টাকার একটি নিবিড় সম্পর্ক আছে। দুর্নীতি কমাতে হলে কালো টাকার দৌরাত্ম্যও কমাতে হবে। সে ক্ষেত্রে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে কি না?
মঈনুল ইসলাম দুর্নীতি দমন কার্যক্রমকে ভোঁতা করে তো কালো টাকা থেকে রেহাই মিলবে না। বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর গত দুই বছর যেভাবে দুর্নীতি দমন কমিশনকে অকার্যকর করে রেখেছে, সে জন্য জবাবদিহি করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যত সমালোচনাই করা হোক, এই একটি ক্ষেত্রে তারা কি একটা ‘ঝাঁকি’ দেয়নি? এখন তো আবার দুর্নীতিবাজেরা একে একে মামলা থেকে রেহাই পেয়ে ফেরেশতা বনে গেছেন। আর অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে কেন? বরং কালো অর্থনীতির কারণেই তো বাজার নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় চলে যাচ্ছে বারবার।
প্রথম আলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান সফল না হওয়ার জন্য অনেকে অর্থনীতিতে কালো টাকার প্রভাবের কথা বলেন। এ নিয়ে আপনার কাজও আছে। বিষয়টি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
মঈনুল ইসলাম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের পেছনে সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের রাজনৈতিক এজেন্ডা রয়েছে—এটা যখন পরিষ্কার হয়ে গেল, তখনই ওই অভিযান তার নৈতিক ভিত্তি হারিয়ে ফেলে। শুধু বেছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদদের পাকড়াও করা হলো, কিন্তু কোনো দুর্নীতিবাজ সামরিক কর্মকর্তাকে ধরা হলো না—তারা কি ফেরেশতা ছিল? দুর্নীতি দমন কমিশনকে সামনে রেখে যে মহাশক্তিধর ‘জাতীয় কমিটি’ অভিযানে নামল, তাদের জালে তো এদের কেউ ধরা পড়ল না? হরেক কিসিমের ‘কিংস পার্টি’ গঠনের এজেন্ডা, মাইনাস টু এজেন্ডা, বিরাজনৈতিকীকরণ এজেন্ডা—এসবই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুর্নীতি দমন অভিযানের বিশ্বাসযোগ্যতাকে বরবাদ করে দিয়েছিল।
প্রথম আলো সম্প্রতি টিআইবির দুর্নীতির জরিপ প্রতিবেদন নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। সরকারের বাইরে ব্যবসায়ীরাও মনে করেন, এতে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে আপনার মত কী?
মঈনুল ইসলাম আমি তা মনে করি না। দুর্নীতির সমস্যাকে কার্পেটের তলায় লুকিয়ে রাখলে বিশ্বের কেউ জানবে না, তা তো তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিপ্লবের এই যুগে চিন্তা করাটাই আহাম্মকি। দুর্নীতি এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির এক নম্বর সমস্যা। দুর্নীতি কমাতে চাইলে সমস্যাটি যে সংকটের সৃষ্টি করেছে, তা স্বীকার করে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে আহ্বান করব। সরকারের কেবিনেটে যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তাঁদের বাদ দিতে হবে। দলীয় নেতা-পাতিনেতা, যুবলীগ-ছাত্রলীগ-শ্রমিক লীগের ক্যাডারদের বেপরোয়া টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। ওই পথেই বাংলাদেশের ইমেজ উদ্ধার করতে হবে।
প্রথম আলো কালো টাকা সাদা করার পক্ষে-বিপক্ষে মত আছে। সরকার সীমিত পর্যায়ে কালো টাকা সাদা করার অনুমতি দিয়েছে। এতে কি অর্থনীতি চাঙা হবে বলে মনে করেন? সৎভাবে যাঁরা শোধ করেন, তাঁদের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ কর দিতে হয়। কিন্তু যাঁরা কর ফাঁকি দেন, তাঁদের জন্য এ সুবিধা দেওয়া কতটা যুক্তিসংগত?
মঈনুল ইসলাম কালো টাকা সাদা করার জন্য প্রতিবারের বাজেটে রাজস্বনীতি গ্রহণকে আমি ‘কালো টাকা লালননীতি’ বলে অভিহিত করে থাকি। আমার বিভিন্ন লেখায় বরাবরই আমি বলে আসছি, এ ধরনের নীতি সরকারের অনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এই নীতির মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়া গিয়েছিল সত্য, তবে সেটা ভয়ভীতি প্রদর্শনের কারণেই। কিন্তু বছরের পর বছর ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকার মালিকদের মানি লন্ডারিংয়ের সুযোগ দিয়ে অন্যদিকে মানি লন্ডারিং আইনের ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরোর’ এমন প্রহসনের কোনো নৈতিক বা যৌক্তিক ভিত্তি থাকতে পারে না। এ পথে অর্থনীতি কিংবা বিনিয়োগ চাঙা হওয়ারও কোনো কারণ নেই। কালো টাকাকে বৈধ বিনিয়োগে নিয়ে আসার বহু সফল নীতির প্রয়োগ নানা দেশে হচ্ছে, এ দেশেও পিপিপির মতো ব্যবস্থা জোরদার করে তা শুরু করা হয়েছে। কিন্তু কালো টাকাকে এ দেশে যেভাবে শেয়ারবাজারে ঢালাওভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, তার বিপজ্জনক ফল তো সাম্প্রতিক শেয়ারবাজারের ধস আমাদের দেখিয়ে দিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, এ দেশে ২৩ হাজারের বেশি কোটিপতি রয়েছেন। এনবিআরকে চ্যালেঞ্জ করছি, এঁদের কত শতাংশ কোটি টাকা কর প্রদানকারী, ‘সৎ করদাতা’, সে উপাত্তটা প্রকাশ করা হোক। কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা প্রায় সব করদাতার মধ্যেই থাকে, বিশ্বের সব দেশেরই জনগণের মধ্যে এ প্রবণতা রয়েছে কমবেশি। কিন্তু বৈদেশিক খয়রাতনির্ভরতা থেকে মুক্তি চাইলে এই প্রবণতাকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবেই। রাজস্ব বিভাগের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জেহাদ’ তো দেখলাম না!
প্রথম আলো শেয়ারবাজারের ওঠা-নামাকে কীভাবে দেখছেন? এটা কি স্বাভাবিক? ’৯৬-এর ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা আছে কি?
মঈনুল ইসলাম শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক ধস এবং এক ধাক্কায় সেটার বিপরীতে এক দিনের রেকর্ড ভাঙা উত্থান—দুটোই প্রমাণ করছে, এই বাজারে খেলোয়াড়েরা খেলছেন। এ রকমের ধস যে নামবেই, সেটা তো গত দুই বছরের ফাঁপা বেলুনের মতো সূচকের স্ফীতি থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু ব্যাংকের স্থায়ী আমানতকে নিরুৎসাহিত করে কালো টাকা, হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো রেমিট্যান্স এবং খোদ ব্যাংকগুলোকেই তো এ ফাটকা বাজারে মুনাফাবাজি করায় উৎসাহিত করেছে সরকার। সে দায়ভার কে নেবে? বেকার শিক্ষিত যুবকদের ‘পেশা’ হিসেবে শেয়ারের ফাটকা কারবারি বানিয়ে ফেলা হয়েছে। শেয়ারের কারবার ‘পেশা’ হয় কী করে? লুটেরা খেলোয়াড়দের হাত থেকে এ দেশের শেয়ারবাজার অদূর ভবিষ্যতে মুক্তি পাবে বলে মনে হয় না। তবে ওই খেলোয়াড়েরা নিজেদের স্বার্থেই বর্তমান ধসকে ১৯৯৬-এর পর্যায়ে যেতে দেবে না, তাও ঠিক।
প্রথম আলো অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের মধ্যে বড় ধরনের কোনো বিরোধ আছে কি? না থাকলে অর্থনৈতিক নীতির ব্যাপারে তারা মতৈক্যে আসতে পারছে না কেন?
মঈনুল ইসলাম বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াত হলো আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও শক্তিগুলোর ‘নেমেসিস’। তাই এ দুই ধারার রাজনীতির রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে মতৈক্যে আসার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত বলা চলে। ঘটনাক্রমে জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেলেও এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সুপরিকল্পিতভাবে নস্যাৎ করার সবচেয়ে বড় দায়ভারটি তাঁর ওপরই বর্তাবে। আরও যেটা গুরুতর, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের নায়কেরা যে বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটাতে যাচ্ছে, সেটা জিয়াউর রহমান ষড়যন্ত্রের পর্যায়েই জানা সত্ত্বেও এতে তাঁর নীরব সম্মতি ছিল, এখন সেটা প্রমাণিত সত্য। আর সবশেষে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ও শেখ হাসিনাকে হত্যার প্রয়াসের সঙ্গেও বিএনপি-জামায়াতের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা ছিল, তাও ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।
এ রকম প্রেক্ষাপটে দুই নেত্রীর ‘শত্রুতামূলক সম্পর্ক’কে শুধুই ব্যক্তিগত ঘৃণা-বিদ্বেষ-ঝগড়া মনে করা ঠিক হবে না। অর্থনৈতিক নীতির ব্যাপারেও বিএনপি-জামায়াত জোটকে দক্ষিণপন্থী বাজার মৌলবাদের অন্ধ অনুসারী বলা চলে। আওয়ামী লীগ এবং তাদের প্রগতিশীল বন্ধুরা অতখানি দক্ষিণপন্থী হতে পারবে না। এ সরকারকে অনেকেই ‘লেফট অব সেন্টার’ হিসেবেই বিচার করছেন। তবুও বলব, কৃষি, শিক্ষা, শিল্প ও সেফটি নেট ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নীতিগুলোকে বিএনপির আদাজল খেয়ে বিরোধিতা না করার বিষয়টি আমার কাছে মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তন মনে হয়েছে।
প্রথম আলো কালো টাকা রোধে সরকারের উদ্যোগই কি যথেষ্ট? এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো কীভাবে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে?
মঈনুল ইসলাম সরকারের বর্তমান উদ্যোগগুলো যথেষ্ট কার্যকর নয়। আরও বহু কিছু করতে হবে, যার কিছু কিছু ওপরের প্রশ্নগুলোর জবাবে বলেছি। ব্যাংকিং সিস্টেম পুরোনো খেলাপি ঋণের সমস্যাটাকে ‘আলোপিত ঋণে’ পরিণত করে লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে ফেলেছে। রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিরা written off ঋণ হজম করার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে ফেলেছে। এখন ব্যাংকঋণ যাচ্ছে শেয়ারবাজারের ফাটকা কারবারে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ব্যাংকগুলোর সরাসরি শেয়ারের ব্যবসা করার বিপজ্জনক কর্মকাণ্ড। অর্থবাজার ও পুঁজিবাজারের মিশন এবং কার্যক্রমের ফারাকটা ঠিকভাবে বুঝতে হবে। শেয়ারবাজারকে ‘ক্যাসিনো পুঁজিবাদের’ হাতিয়ার বানালে আমাদের অর্থনীতিতেও বিপদ ঘটবে বারবার।
প্রথম আলো সীমান্তে প্রহরা বসিয়ে কি চোরাচালান রোধ করা যায়? এ ক্ষেত্রে সরকারের কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন?
মঈনুল ইসলাম এ বিষয়ে অনেক গবেষণাকর্ম প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে বিশ্লেষণ ও পথনির্দেশ পাওয়া যাবে। চোরাচালান রোধের পদক্ষেপ সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু বললে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে। শুধু এটুকুই বলব, চোরাচালান ও বৈধ বাণিজ্য—দুটোরই প্রণোদনা যেহেতু মুনাফা আহরণ; অতএব এটাকে অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নের সমস্যা হিসেবে দেখাটাই যৌক্তিক। এটাকে প্রহরা বসিয়ে রোধ করা যাবে না; আরও অনেক দুর্নীতিবাজকে কোটিপতি বানানো হবে ওভাবে।
প্রথম আলো আমাদের অর্থনীতির প্রধান দুর্বল ও সবল দিক কী? অর্থনীতির আনুষ্ঠানিক খাতের বাইরে অনানুষ্ঠানিক খাতের উন্নয়নে কী করা উচিত বলে মনে করেন?
মঈনুল ইসলাম আমাদের অর্থনীতির ক্রমেই সবল হওয়ার লক্ষণগুলো ফুটে উঠছে। কৃষি খাতে সাফল্য এবং খাদ্যনিরাপত্তা অর্জন, শিক্ষা খাতে বৈষম্য নিরসনের উদ্দেশ্যে গৃহীত নতুন শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন, বৈদেশিক ঋণ ও খয়রাতের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের স্বস্তিকর অবস্থা, পাটের সুদিন ফিরে আসার ইঙ্গিত, নিটওয়্যার ও পোশাক খাতের রপ্তানির নাটকীয় প্রবৃদ্ধি—এগুলো সবই উন্নয়নের সুবাতাস বয়ে এনেছে অর্থনীতিতে। সবচেয়ে দুর্বল দিক হলো ক্রমবর্ধমান দুর্নীতির বিস্তার। আর অনানুষ্ঠানিক-আনুষ্ঠানিক খাতের বিষয়টা গতানুগতিকভাবে বিবেচনা করাটা ভুল। এ দেশের কৃষি, ছোট ও মাঝারি শিল্প, বাণিজ্য ও সেবা খাতের অধিকাংশ কার্যক্রমকেই অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির আওতায় ফেলা যাবে। বিষয়টা নিয়ে বিস্তৃত পরিসরে আলোচনা আবশ্যক।
প্রথম আলো ভারতকে ট্রানজিট ও বন্দরসুবিধা দেওয়া নিয়ে বিতর্ক চলছে। এতে বাংলাদেশ কতটা লাভবান হবে?
মঈনুল ইসলাম আমি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা সম্প্রসারণের একনিষ্ঠ সমর্থক। আল্লাহ তাআলা বাংলাদেশকে যে ভৌগোলিক অবস্থানগত সুবিধা দিয়েছেন, তা ব্যবহার না করাটা আল্লাহর নিয়ামতকে অস্বীকার করা। তবে ভৌত অবকাঠামো যথাযথভাবে উন্নয়ন না করে ট্রানজিট আমরা দিতে পারব না। প্রাথমিকভাবে ট্রানশিপমেন্ট চালু করতে হবে। আরেকটু যোগ করতে চাই, শুধু ভারতের কথা বলছেন কেন? নেপাল, ভুটান, চীন, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডকেও তো এ ধরনের আঞ্চলিক কানেকটিভিটি কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করার ইস্যু সামনে এসে গেছে! এ জন্য গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দিতেই হবে।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
মঈনুল ইসলাম ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান
প্রথম আলো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কালো টাকার প্রভাব কতটা? কীভাবে এই প্রভাব কমানো যায়?
মঈনুল ইসলাম কালো টাকার নানা রকম সংজ্ঞা রয়েছে। কেউ এটাকে অবৈধ বা বেআইনি কার্যক্রম থেকে উদ্ভূত আয় হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন। অন্যরা আবার বৈধ বা অবৈধ যেভাবেই টাকাটা উপার্জিত হোক না কেন, যদি ওই টাকার ওপর প্রদেয় কর পরিশোধ না করা হয়, তাহলে ওই টাকাকে কালো টাকা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন। তবে সংজ্ঞার পার্থক্য সত্ত্বেও ঘুষ-দুর্নীতি, চোরাচালান, কালোবাজারি, চাঁদাবাজি, মার্জিন-কমিশন শিকার ইত্যাদি কার্যক্রম থেকে উদ্ভূত আয়কে কালো টাকা হিসেবে আখ্যায়িত করার যুক্তি রয়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো অর্থও যদি হুন্ডিপ্রক্রিয়ায় দেশে প্রবেশ করে, তাহলে ওই অর্থটাও কালো অর্থনীতির আয়তন বৃদ্ধি করে।
সুতরাং বাংলাদেশের অর্থনীতির একটা বিশাল অংশকে কালো অর্থনীতি বা সমান্তরাল অর্থনীতি হিসেবে অভিহিত করা যায়। কিন্তু এটা অর্থনীতির ‘কত শতাংশ’ তা প্রাক্কলন যাঁরা করছেন, তাঁরা কীভাবে বা কোন বিশ্লেষণপদ্ধতি অনুসরণে তা করছেন, সেটা না জেনে তাঁদের প্রাক্কলনকে ভালো বা খারাপ বলব না আমি। ‘বীরবলের কাক গণনা’র একটা দ্যোতনা ওগুলোতে তো রয়েছেই। তবে আমার ধারণা, কালো অর্থনীতির দৌরাত্ম্য কিংবা আয়তন কমছে না মোটেও। সেখানেই সরকারের ভূমিকা এবং যথাযথ নীতি প্রণয়নের প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবারের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার অনৈতিক ব্যবস্থাটা চালু রাখা কালো টাকাকে নিরাপদ ছত্রচ্ছায়া প্রদান মনে হয় আমার কাছে। ওটা বাতিল করার মাধ্যমেই সরকারের ‘কালো টাকা প্রতিরোধ’ প্রয়াসটা শুরু করতে হবে। এরপর আসবে দুর্নীতি দমন কমিশনকে সত্যিকার স্বাধীন, শক্তিশালী ও কার্যকর করার ব্যবস্থার কথা। বর্তমান সরকার এটাকে আক্ষরিক অর্থেই লক্ষ্যদন্তহীন ব্যাঘ্রে পরিণত করেছে। তারপর মানি লন্ডারিং আইন সংশোধনের প্রশ্নও আসবে, এনবিআরকেও দুর্নীতিমুক্ত করার কার্যকর প্রয়াস লাগবে। চোরাচালানকে যেসব বিষয় উৎসাহিত করছে, সেগুলোও যথাযথ নীতি পরিবর্তনের মাধ্যমে কমিয়ে আনা যায়। আমার বিভিন্ন গবেষণা পুস্তক এবং প্রবন্ধে সেগুলোর পথনির্দেশনা রয়েছে।
প্রথম আলো বলা হয়, যেকোনো দেশের অর্থনীতির বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে কালো টাকার প্রভাব থাকে। ধীরে ধীরে তা কমে যায়। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন কোন অবস্থায় আছে?
মঈনুল ইসলাম আমি এ প্রশ্নে দ্বিমত পোষণ করছি। একটি দেশের রাষ্ট্রচরিত্র এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণেই কালো টাকা পৃষ্ঠপোষকতা পায়। অতএব, কালো টাকা এমনি এমনি কমে যাবে না। বাংলাদেশের সামরিক শাসকেরা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে কেনাবেচার রাজনীতি এবং আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রচরিত্রকে যেভাবে প্রাতিষ্ঠানিকতা দিয়েছে, সেখান থেকে দুই দশকের নির্বাচনী গণতন্ত্র এখনো বেরোতে পারছে না। কারণ, নির্বাচনও কালো টাকা এবং পেশিশক্তির কবল থেকে আজও মুক্ত হতে পারছে না। রাষ্ট্রচরিত্র এবং রাজনীতিকে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার দিকে নিয়ে যেতে না পারলে কালো টাকা থেকে জাতির মুক্তি মিলবে না।
প্রথম আলো দুর্নীতির সঙ্গে কালো টাকার একটি নিবিড় সম্পর্ক আছে। দুর্নীতি কমাতে হলে কালো টাকার দৌরাত্ম্যও কমাতে হবে। সে ক্ষেত্রে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে কি না?
মঈনুল ইসলাম দুর্নীতি দমন কার্যক্রমকে ভোঁতা করে তো কালো টাকা থেকে রেহাই মিলবে না। বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর গত দুই বছর যেভাবে দুর্নীতি দমন কমিশনকে অকার্যকর করে রেখেছে, সে জন্য জবাবদিহি করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যত সমালোচনাই করা হোক, এই একটি ক্ষেত্রে তারা কি একটা ‘ঝাঁকি’ দেয়নি? এখন তো আবার দুর্নীতিবাজেরা একে একে মামলা থেকে রেহাই পেয়ে ফেরেশতা বনে গেছেন। আর অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে কেন? বরং কালো অর্থনীতির কারণেই তো বাজার নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় চলে যাচ্ছে বারবার।
প্রথম আলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান সফল না হওয়ার জন্য অনেকে অর্থনীতিতে কালো টাকার প্রভাবের কথা বলেন। এ নিয়ে আপনার কাজও আছে। বিষয়টি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
মঈনুল ইসলাম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের পেছনে সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের রাজনৈতিক এজেন্ডা রয়েছে—এটা যখন পরিষ্কার হয়ে গেল, তখনই ওই অভিযান তার নৈতিক ভিত্তি হারিয়ে ফেলে। শুধু বেছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদদের পাকড়াও করা হলো, কিন্তু কোনো দুর্নীতিবাজ সামরিক কর্মকর্তাকে ধরা হলো না—তারা কি ফেরেশতা ছিল? দুর্নীতি দমন কমিশনকে সামনে রেখে যে মহাশক্তিধর ‘জাতীয় কমিটি’ অভিযানে নামল, তাদের জালে তো এদের কেউ ধরা পড়ল না? হরেক কিসিমের ‘কিংস পার্টি’ গঠনের এজেন্ডা, মাইনাস টু এজেন্ডা, বিরাজনৈতিকীকরণ এজেন্ডা—এসবই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুর্নীতি দমন অভিযানের বিশ্বাসযোগ্যতাকে বরবাদ করে দিয়েছিল।
প্রথম আলো সম্প্রতি টিআইবির দুর্নীতির জরিপ প্রতিবেদন নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। সরকারের বাইরে ব্যবসায়ীরাও মনে করেন, এতে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে আপনার মত কী?
মঈনুল ইসলাম আমি তা মনে করি না। দুর্নীতির সমস্যাকে কার্পেটের তলায় লুকিয়ে রাখলে বিশ্বের কেউ জানবে না, তা তো তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিপ্লবের এই যুগে চিন্তা করাটাই আহাম্মকি। দুর্নীতি এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির এক নম্বর সমস্যা। দুর্নীতি কমাতে চাইলে সমস্যাটি যে সংকটের সৃষ্টি করেছে, তা স্বীকার করে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে আহ্বান করব। সরকারের কেবিনেটে যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তাঁদের বাদ দিতে হবে। দলীয় নেতা-পাতিনেতা, যুবলীগ-ছাত্রলীগ-শ্রমিক লীগের ক্যাডারদের বেপরোয়া টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। ওই পথেই বাংলাদেশের ইমেজ উদ্ধার করতে হবে।
প্রথম আলো কালো টাকা সাদা করার পক্ষে-বিপক্ষে মত আছে। সরকার সীমিত পর্যায়ে কালো টাকা সাদা করার অনুমতি দিয়েছে। এতে কি অর্থনীতি চাঙা হবে বলে মনে করেন? সৎভাবে যাঁরা শোধ করেন, তাঁদের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ কর দিতে হয়। কিন্তু যাঁরা কর ফাঁকি দেন, তাঁদের জন্য এ সুবিধা দেওয়া কতটা যুক্তিসংগত?
মঈনুল ইসলাম কালো টাকা সাদা করার জন্য প্রতিবারের বাজেটে রাজস্বনীতি গ্রহণকে আমি ‘কালো টাকা লালননীতি’ বলে অভিহিত করে থাকি। আমার বিভিন্ন লেখায় বরাবরই আমি বলে আসছি, এ ধরনের নীতি সরকারের অনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এই নীতির মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়া গিয়েছিল সত্য, তবে সেটা ভয়ভীতি প্রদর্শনের কারণেই। কিন্তু বছরের পর বছর ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকার মালিকদের মানি লন্ডারিংয়ের সুযোগ দিয়ে অন্যদিকে মানি লন্ডারিং আইনের ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরোর’ এমন প্রহসনের কোনো নৈতিক বা যৌক্তিক ভিত্তি থাকতে পারে না। এ পথে অর্থনীতি কিংবা বিনিয়োগ চাঙা হওয়ারও কোনো কারণ নেই। কালো টাকাকে বৈধ বিনিয়োগে নিয়ে আসার বহু সফল নীতির প্রয়োগ নানা দেশে হচ্ছে, এ দেশেও পিপিপির মতো ব্যবস্থা জোরদার করে তা শুরু করা হয়েছে। কিন্তু কালো টাকাকে এ দেশে যেভাবে শেয়ারবাজারে ঢালাওভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, তার বিপজ্জনক ফল তো সাম্প্রতিক শেয়ারবাজারের ধস আমাদের দেখিয়ে দিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, এ দেশে ২৩ হাজারের বেশি কোটিপতি রয়েছেন। এনবিআরকে চ্যালেঞ্জ করছি, এঁদের কত শতাংশ কোটি টাকা কর প্রদানকারী, ‘সৎ করদাতা’, সে উপাত্তটা প্রকাশ করা হোক। কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা প্রায় সব করদাতার মধ্যেই থাকে, বিশ্বের সব দেশেরই জনগণের মধ্যে এ প্রবণতা রয়েছে কমবেশি। কিন্তু বৈদেশিক খয়রাতনির্ভরতা থেকে মুক্তি চাইলে এই প্রবণতাকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবেই। রাজস্ব বিভাগের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জেহাদ’ তো দেখলাম না!
প্রথম আলো শেয়ারবাজারের ওঠা-নামাকে কীভাবে দেখছেন? এটা কি স্বাভাবিক? ’৯৬-এর ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা আছে কি?
মঈনুল ইসলাম শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক ধস এবং এক ধাক্কায় সেটার বিপরীতে এক দিনের রেকর্ড ভাঙা উত্থান—দুটোই প্রমাণ করছে, এই বাজারে খেলোয়াড়েরা খেলছেন। এ রকমের ধস যে নামবেই, সেটা তো গত দুই বছরের ফাঁপা বেলুনের মতো সূচকের স্ফীতি থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু ব্যাংকের স্থায়ী আমানতকে নিরুৎসাহিত করে কালো টাকা, হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো রেমিট্যান্স এবং খোদ ব্যাংকগুলোকেই তো এ ফাটকা বাজারে মুনাফাবাজি করায় উৎসাহিত করেছে সরকার। সে দায়ভার কে নেবে? বেকার শিক্ষিত যুবকদের ‘পেশা’ হিসেবে শেয়ারের ফাটকা কারবারি বানিয়ে ফেলা হয়েছে। শেয়ারের কারবার ‘পেশা’ হয় কী করে? লুটেরা খেলোয়াড়দের হাত থেকে এ দেশের শেয়ারবাজার অদূর ভবিষ্যতে মুক্তি পাবে বলে মনে হয় না। তবে ওই খেলোয়াড়েরা নিজেদের স্বার্থেই বর্তমান ধসকে ১৯৯৬-এর পর্যায়ে যেতে দেবে না, তাও ঠিক।
প্রথম আলো অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের মধ্যে বড় ধরনের কোনো বিরোধ আছে কি? না থাকলে অর্থনৈতিক নীতির ব্যাপারে তারা মতৈক্যে আসতে পারছে না কেন?
মঈনুল ইসলাম বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াত হলো আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও শক্তিগুলোর ‘নেমেসিস’। তাই এ দুই ধারার রাজনীতির রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে মতৈক্যে আসার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত বলা চলে। ঘটনাক্রমে জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেলেও এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সুপরিকল্পিতভাবে নস্যাৎ করার সবচেয়ে বড় দায়ভারটি তাঁর ওপরই বর্তাবে। আরও যেটা গুরুতর, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের নায়কেরা যে বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটাতে যাচ্ছে, সেটা জিয়াউর রহমান ষড়যন্ত্রের পর্যায়েই জানা সত্ত্বেও এতে তাঁর নীরব সম্মতি ছিল, এখন সেটা প্রমাণিত সত্য। আর সবশেষে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ও শেখ হাসিনাকে হত্যার প্রয়াসের সঙ্গেও বিএনপি-জামায়াতের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা ছিল, তাও ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।
এ রকম প্রেক্ষাপটে দুই নেত্রীর ‘শত্রুতামূলক সম্পর্ক’কে শুধুই ব্যক্তিগত ঘৃণা-বিদ্বেষ-ঝগড়া মনে করা ঠিক হবে না। অর্থনৈতিক নীতির ব্যাপারেও বিএনপি-জামায়াত জোটকে দক্ষিণপন্থী বাজার মৌলবাদের অন্ধ অনুসারী বলা চলে। আওয়ামী লীগ এবং তাদের প্রগতিশীল বন্ধুরা অতখানি দক্ষিণপন্থী হতে পারবে না। এ সরকারকে অনেকেই ‘লেফট অব সেন্টার’ হিসেবেই বিচার করছেন। তবুও বলব, কৃষি, শিক্ষা, শিল্প ও সেফটি নেট ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নীতিগুলোকে বিএনপির আদাজল খেয়ে বিরোধিতা না করার বিষয়টি আমার কাছে মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তন মনে হয়েছে।
প্রথম আলো কালো টাকা রোধে সরকারের উদ্যোগই কি যথেষ্ট? এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো কীভাবে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে?
মঈনুল ইসলাম সরকারের বর্তমান উদ্যোগগুলো যথেষ্ট কার্যকর নয়। আরও বহু কিছু করতে হবে, যার কিছু কিছু ওপরের প্রশ্নগুলোর জবাবে বলেছি। ব্যাংকিং সিস্টেম পুরোনো খেলাপি ঋণের সমস্যাটাকে ‘আলোপিত ঋণে’ পরিণত করে লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে ফেলেছে। রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিরা written off ঋণ হজম করার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে ফেলেছে। এখন ব্যাংকঋণ যাচ্ছে শেয়ারবাজারের ফাটকা কারবারে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ব্যাংকগুলোর সরাসরি শেয়ারের ব্যবসা করার বিপজ্জনক কর্মকাণ্ড। অর্থবাজার ও পুঁজিবাজারের মিশন এবং কার্যক্রমের ফারাকটা ঠিকভাবে বুঝতে হবে। শেয়ারবাজারকে ‘ক্যাসিনো পুঁজিবাদের’ হাতিয়ার বানালে আমাদের অর্থনীতিতেও বিপদ ঘটবে বারবার।
প্রথম আলো সীমান্তে প্রহরা বসিয়ে কি চোরাচালান রোধ করা যায়? এ ক্ষেত্রে সরকারের কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন?
মঈনুল ইসলাম এ বিষয়ে অনেক গবেষণাকর্ম প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে বিশ্লেষণ ও পথনির্দেশ পাওয়া যাবে। চোরাচালান রোধের পদক্ষেপ সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু বললে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে। শুধু এটুকুই বলব, চোরাচালান ও বৈধ বাণিজ্য—দুটোরই প্রণোদনা যেহেতু মুনাফা আহরণ; অতএব এটাকে অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নের সমস্যা হিসেবে দেখাটাই যৌক্তিক। এটাকে প্রহরা বসিয়ে রোধ করা যাবে না; আরও অনেক দুর্নীতিবাজকে কোটিপতি বানানো হবে ওভাবে।
প্রথম আলো আমাদের অর্থনীতির প্রধান দুর্বল ও সবল দিক কী? অর্থনীতির আনুষ্ঠানিক খাতের বাইরে অনানুষ্ঠানিক খাতের উন্নয়নে কী করা উচিত বলে মনে করেন?
মঈনুল ইসলাম আমাদের অর্থনীতির ক্রমেই সবল হওয়ার লক্ষণগুলো ফুটে উঠছে। কৃষি খাতে সাফল্য এবং খাদ্যনিরাপত্তা অর্জন, শিক্ষা খাতে বৈষম্য নিরসনের উদ্দেশ্যে গৃহীত নতুন শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন, বৈদেশিক ঋণ ও খয়রাতের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের স্বস্তিকর অবস্থা, পাটের সুদিন ফিরে আসার ইঙ্গিত, নিটওয়্যার ও পোশাক খাতের রপ্তানির নাটকীয় প্রবৃদ্ধি—এগুলো সবই উন্নয়নের সুবাতাস বয়ে এনেছে অর্থনীতিতে। সবচেয়ে দুর্বল দিক হলো ক্রমবর্ধমান দুর্নীতির বিস্তার। আর অনানুষ্ঠানিক-আনুষ্ঠানিক খাতের বিষয়টা গতানুগতিকভাবে বিবেচনা করাটা ভুল। এ দেশের কৃষি, ছোট ও মাঝারি শিল্প, বাণিজ্য ও সেবা খাতের অধিকাংশ কার্যক্রমকেই অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির আওতায় ফেলা যাবে। বিষয়টা নিয়ে বিস্তৃত পরিসরে আলোচনা আবশ্যক।
প্রথম আলো ভারতকে ট্রানজিট ও বন্দরসুবিধা দেওয়া নিয়ে বিতর্ক চলছে। এতে বাংলাদেশ কতটা লাভবান হবে?
মঈনুল ইসলাম আমি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা সম্প্রসারণের একনিষ্ঠ সমর্থক। আল্লাহ তাআলা বাংলাদেশকে যে ভৌগোলিক অবস্থানগত সুবিধা দিয়েছেন, তা ব্যবহার না করাটা আল্লাহর নিয়ামতকে অস্বীকার করা। তবে ভৌত অবকাঠামো যথাযথভাবে উন্নয়ন না করে ট্রানজিট আমরা দিতে পারব না। প্রাথমিকভাবে ট্রানশিপমেন্ট চালু করতে হবে। আরেকটু যোগ করতে চাই, শুধু ভারতের কথা বলছেন কেন? নেপাল, ভুটান, চীন, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডকেও তো এ ধরনের আঞ্চলিক কানেকটিভিটি কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করার ইস্যু সামনে এসে গেছে! এ জন্য গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দিতেই হবে।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
মঈনুল ইসলাম ধন্যবাদ।
No comments