চারদিক-সহস্রাব্দের পাটাতনে by এম এম খালেকুজ্জামান

আমরা এখন ২০১১ সালে আছি। ২০০০ সাল থেকে ২০১০—এই দশক কেবল একবিংশ শতাব্দীর শুরুই নয়, কালপরিক্রমার বিচারে এই দশক আরেকটি নতুন সহস্রাব্দের পাটাতনি দশকও। একটু পেছন ফিরে দেখা যাক। দশক শেষে এসে পেছনে তাকালে দেখি, দিগন্তরেখা বদলে দেওয়া নাইন-ইলেভেন।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সামরিক তৎপরতা নাইন-ইলেভেন-পরবর্তী সংশ্লিষ্ট সামরিক কার্যক্রম।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের আগে ও পরের বিশ্বব্যবস্থা সম্পূর্ণ আলাদা। টুইন টাওয়ার ধ্বংসের মাধ্যমে শুধু ম্যানহাটানের দিগন্তরেখাই বদলে যায়নি, ওই হামলায় শুধু টাওয়ারটিই ধসে পড়েনি; ধসে পড়েছে পরাক্রমশালী আমেরিকার অপরাজেয় মিথটিও। ১৯ জন হামলাকারীসহ প্রায় তিন হাজার প্রাণের তাৎক্ষণিক তিরোধান-পরবর্তী ইতিহাস সুখকর নয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক যাবতীয় বিধি ও রাষ্ট্রাচার পায়ে দলে আফগানিস্তানকে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার মিশনে নামেন। সঙ্গে দোসর টনি ব্লেয়ার। যে যুদ্ধের বোঝা এখন বিষফোড়ার মতো বয়ে বেড়াচ্ছে আফগান জনগণ। অথচ এর আসল উদ্দেশ্য যে আমেরিকার অস্ত্র ব্যবসা আরও জোরদার করা, তা কে না জানে!
বিশ্বমন্দা...: ২০০৭ থেকে বিশাল অর্থনৈতিক মন্দা যেভাবে পৃথিবীকে গ্রাস করে, ১৯৩০ সালের পর বিশ্ব আর এমন মন্দার মুখোমুখি হয়নি। বিলিয়ন ডলারের বেইল আউট কার্যক্রমও ঠেকাতে পারেনি বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পতন। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বেড়েছে গত পাঁচ বছরে। ইউরোপ-আমেরিকাজুড়ে প্রায়ই সংবাদ শিরোনাম ছিল কর্মী ছাঁটাইয়ের খবর। অনিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদের চরম খেসারত দিতে হলো বিশ্ববাসীকে।
ওবামার শান্তি মুকুট: ওবামা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে থিয়োডর রুজভেল্ট ও উড্রো উইলসনের পর ২০০৯ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার জিতে আরেকবার বিস্মিত করেন বিশ্ববাসীকে। শান্তির বারতা নিয়ে ওবামা ক্ষমতারোহণের কিছুকাল পরই আফগানিস্তানের মাটিতে পা ফেলে আরও ২০ হাজার জোড়া বুট। ওদিকে ক্ষতবিক্ষত ছন্নছাড়া ইরাককে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খোঁড়া করার কাজটিও শেষ। তাই সেখান থেকে সেনা ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টিও তাই মহৎ করে তোলে ওবামার বিজয় মুকুটকে!
প্রকৃতির রোষানলে আধুনিক সভ্যতা: ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর। আর সব দিনের মতোই সমুদ্রতীরে ভিড় করেছিলেন পর্যটকেরা। জীবিকার তাগিদে মাছ শিকারে নৌকা নিয়ে গভীর থেকে গভীর সমুদ্রে চলে গিয়েছিলেন জেলেরা। অকস্মাৎ কেমন যেন ফুলে-ফেঁপে ওঠে সমুদ্রের মন। প্রবল জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় ভারত মহাসাগরের ১৪টি দেশের উপকূলের বিশাল এলাকাজুড়ে থাকা জনপদ। এত বড় ঢেউ কখনো দেখেনি কেউ। সুনামিতে মারা যায় এসব দেশের দুই লাখেরও বেশি মানুষ। ৯-১০ তলা বাড়ির সমান উঁচু বিশালকায় সেই জলদানব ধেয়ে আসে লোকালয়ের দিকে। ৮-১০ মিনিট ধরে চলে প্রলয়খেলা। পানি সরে গেলে দেখা গেল, পুরো জনপদ ধ্বংসপুরী; সর্বত্রই লাশ আর ভগ্নস্তূপ। এর ফলাফল এতটাই ভয়াবহ যে, পরিবেশবিজ্ঞানীরা জানিয়ে দিয়েছেন, লোনাপানি এত বেশি পরিমাণ এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে যে, ওই সব এলাকা চাষের উপযোগী হতে অন্তত দুই দশক সময় লাগবে। হাইতিতে ভূমিকম্পে প্রাণ হারায় আড়াই লাখেরও বেশি মানুষ। বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর আইলার ভয়াল আঘাতের ক্ষত উপকূলীয় এলাকার মানুষকে এখনো আতঙ্কিত করে। আমেরিকাকেও এই দশকে ভাসিয়ে দিয়ে যায় হারিকেন ক্যাটরিনার মতো ব্যাপক দুর্যোগ।
কোপেনহেগেন থেকে কানকুন: কার্বন নির্গমনের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত কিয়োটো প্রটোকলে স্বাক্ষর করেনি অন্যতম কার্বন নিঃসরণকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। আইলা, সিডর কিংবা ক্যাটরিনায় পর্যুদস্ত সবার আশা ছিল, কোপেনহেগেনে নিশ্চয়ই কার্যকর কিছু একটা হবে। কাজের কাজ যা হয়েছে, তা হলো ১৯৮টি দেশের ১০ হাজারেরও বেশি প্রতিনিধি ‘ক্লাইমেট কেলেঙ্কারি’র সাক্ষী হয়ে কানকুন সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আশা বুকে নিয়ে ডেনমার্ক ছেড়েছেন। সমঝোতা হয়েছে, কানকুনে উষ্ণায়ন রোধে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করতে হবে। কিন্তু নিঃসরণ রোধে কোনো কর্মকৌশল ঠিক করা হয়নি। সব দেখে-শুনে বলিভিয়ার তাই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া, ‘পরিবেশদূষণের মাধ্যমে গণহত্যা চালানোর অনুমোদন হচ্ছে স্বাক্ষরিত সমঝোতা।’
বন্ধুত্বের নীলাভ আহ্বান...: হারিয়ে যাওয়া বন্ধু, কুড়িয়ে পাওয়া বন্ধু—এ ধরনের নানা রকমের বন্ধুর এক মহাযজ্ঞ ফেসবুক। বন্ধুত্বের নীলাভ আমন্ত্রণে বন্ধুরা নিমেষে বন্ধুরও বন্ধু হয়ে যাচ্ছে। ২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরুর পর থেকেই তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যোগাযোগের এই সাইটটি। প্রতিদিন পিলে চমকানো হারে বাড়ছে ব্যবহারকারীর সংখ্যা। সারা বিশ্বে ৫০ কোটিরও বেশি ব্যবহারকারী। ডাক্তার বাবা আর মনোবিজ্ঞানী মায়ের ছেলে মার্ক জুকারবার্গ ২৬ বছর বয়সেই যুক্তরাষ্ট্রের কনিষ্ঠতম বিলিয়নিয়ারে পরিণত হয়েছেন। বিল গেটসের পর সবচেয়ে বড় আলোচিত আইটি ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন তিনি।
সাধু সাবধান: উইকিলিকস: বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্রনায়ক ও গদিনশিনদের গদিছাড়া করার উপক্রম করেছেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত উইকিলিকস এখন সবচেয়ে ভয়ংকর সাইবার অস্ত্র। গণতন্ত্রের অন্যতম শত্রু অস্বচ্ছতা ও গোপনীয়তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ঘুম কেড়ে নিয়েছেন ষড়যন্ত্রকামী ও গোপনীয়তাপ্রিয় রাষ্ট্রপ্রধানদের। কৈশোরিক হ্যাকিং প্রতিভার চূড়ান্ত রূপ প্রত্যক্ষ করছে পুরো পৃথিবী। এ বছরের এপ্রিলে মার্কিন অ্যাপাচে হেলিকপ্টার থেকে ইরাকি সেনা হত্যার দৃশ্য ইন্টারনেটে ছেড়ে প্রথম আলোচনায় আসে উইকিলিকস। আফগান যুদ্ধ-সংক্রান্ত ৭৬ হাজার ৯০০ গোপন নথি দ্বিতীয় অ্যাডভেঞ্চার এবং গত নভেম্বরে আড়াই লাখ কূটনৈতিক বার্তা ছেড়ে চলে আসে একালের সাইবার যুদ্ধের দামামা বাজাতে।
নাইন-ইলেভেন হামলা, বিশ্বমন্দার মতো নেতিবাচকতার বিপরীতে অজেয় তারুণ্যের প্রচণ্ড প্রকাশিত রূপ জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ কিংবা জুকারবার্গ প্রমুখ স্বাপ্নিক বয়ে আনতে পারেন যাবতীয় শুভাশুভ।
নতুন দশক আমাদের জন্য আরও নতুন কী খবর নিয়ে আসবে, কে জানে! তবে তা যেন সুখকর হয়, সে কামনা করছি সবাই।

No comments

Powered by Blogger.