এই সময়-তরুণ-তরুণীরা কী চায়? by ফারুক ওয়াসিফ
তরুণেরা কী চায়? জানতে ঘর থেকে ‘দুই পা ফেলিয়া’ পাড়ার মোড়ে গেলাম। সামনেই একটা সাইবার ক্যাফে। আজকের দিনে ইন্টারনেট আর সচ্ছল তারুণ্য প্রায় সমার্থক। যাদের ঘরে ইন্টারনেট-কম্পিউটার নেই, সাইবার ক্যাফেই তাদের ভরসা।
সে রকম একটিতে ঢুকে গোটা পাঁচেক কম্পিউটারের সার্চ হিস্ট্রি ঘেঁটে দেখি, প্রধানত তিনটি জিনিস তারা খোঁজে। ফেসবুকে খোঁজে বন্ধু, জব সাইটে খোঁজে চাকরি, আর শেয়ার মার্কেটের ওয়েবসাইটে খোঁজে বাজারের হালচাল। প্রেম আর প্রতিষ্ঠাই তাহলে তারুণ্যের চাওয়ার এপিঠ-ওপিঠ?
তারুণ্য কী করে, জানতে খবরের কাগজ খুলি। সেখানে অজস্র তরুণের দীর্ঘ সারির ছবি। তারা রাত জেগে অপেক্ষা করছে ক্রিকেট বিশ্বকাপের একটি টিকিটের জন্য। এই টিকিট আনন্দ আর উত্তেজনার উৎসবে শামিল হওয়ার গেট পাস। হ্যাঁ, বেশিটাই তারা চায়। চায় বাংলাদেশ ক্রিকেট দল বিরাট কিছু করে দেখাক, গর্বে তাদের বুকটা ফুলে যাক। তারুণ্য জাতীয় আত্মমর্যাদার জন্য ক্ষুধার্ত। অন্য মাঠে মার খায়ে ক্রিকেটের মাঠে সেটাই তারা খুঁজছে।
আবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। পাশেই সেমি পাকা বস্তির মতো একসারি ঘর। সরু গলির দুই পাশে সারি সারি এক ঘরের সংসার। ১০ ফুট বাই ১০ ফুট ঘরগুলো আলাদা হলেও টিনের চাল একটাই। রাত ১০-১১টার পর সেই চালের ওপর চোরের মতো লুকিয়ে আড্ডা বসে। নিচে ঘর-বাজার একাকার, তাই টিনের চালই সই। সেখানে বসে হয়তো প্রেমালাপ করে, হয়তো বলিউডি নাচ অথবা উত্তেজক ছবি নিয়ে মাতে। একটু দূরে, পাঁচতলার চিলেকোঠা থেকে দলবদ্ধ গান ভেসে আসে। ছাদের একটা অংশ কাপড়ে ঘিরে নিয়ে বাল্ব জ্বেলে চৌকির ওপর মজমা বসিয়েছে বাড়িওয়ালার ছেলে। প্রায়ই মধ্যরাত পর্যন্ত সেখানে আড্ডা-গান-গাঁজা ইত্যাদি চলে। বেশির ভাগই জনপ্রিয় ব্যান্ড অথবা লোকসুরের বিচ্ছেদী সুর; সঙ্গে বাজে গিটার। যেন তাদের মনে অনেক হাহাকার, যেন তাদের কী যেন নেই। প্রেম-নেশা আর হুল্লোড়ে কি তারা শান্তি খোঁজে? তরুণের আত্মা আজ অশান্ত। সেই অশান্ত মনেরই প্রকাশ দেখি ধনীর দুলাল-দুলালীদের কারও কারও ইয়াবা সেবনে, কিংবা জঘন্য গর্জন তুলে শৌখিন স্পোর্টস কার হাঁকানোয়। এবং অল্প বয়সী তরুণদের নৃশংসতায়। এবং নারীর ওপর যৌন সন্ত্রাসে। এবং কিশোরী ও তরুণীদের আত্মহত্যায়। এবং মাদকের ওপর নির্ভরতায়।
তারুণ্যের ঠাট-বাট-চমক, তরুণ সেলিব্রেটির রূপ-কণ্ঠ আর পারফরম্যান্স ভিজুয়াল বিনোদনের প্রধান কাঁচামাল। তরুণেরাই আবার এই কালচার ইন্ডাস্ট্রির প্রধান ক্রেতা ও ভোক্তা। ফ্যাশনে বিপ্লব ঘটিয়েছে এরাই। আগেকার তরুণদেরও লাইফ নিয়ে চিন্তা ছিল, স্টাইল-সচেতনও ছিল কেউ কেউ। এখন লাইফটাই হয়ে যাচ্ছে একটা স্টাইল। স্টাইল ঠিক তো লাইফ ঠিক। লাইফ স্টাইলই তার ব্যক্তিত্ব, রুচি ও চিন্তাভাবনার প্রকাশ। আজকের তরুণেরা দেখতে ও দেখাতে চায়। তারা জানাতে চায়, তারা আছে। তারুণ্য চায় মনোযোগ, চায় গুরুত্ব, চায় প্রশংসা।
এই চাওয়াগুলোই সব নয়। কিন্তু নমুনা আকারে নিলেও এসব চাওয়ার যোগফল হিসাবে এক বড় চাওয়া দাঁড়িয়ে যায়। সেই চাওয়ার নাম মুক্তি ও গতি। অভাব থেকে, অসামর্থ্য থেকে, বিধিনিষেধ থেকে, সংকীর্ণতা থেকে তারা মুক্তি চায়। বিধিনিষেধের বাইরে তারা চায় জীবনের উদ্যাপন। মন ডানা মেলতে চায়, শরীর চায় উদ্দীপ্ত হতে, প্রেমে বা সংগ্রামে। কিন্তু উপযুক্ত পরিবেশ না পেয়ে তারুণ্যের শক্তি নিজের বিরুদ্ধেই যায়। তারা হয়ে ওঠে আত্মধ্বংসী সন্ত্রাসী বা মাদবসেবী। তাদের ভয় বা সাহস, নৈরাজ্য ও সন্ত্রাস, সেই সীমা ডিঙানো মুক্তির আকাঙ্ক্ষারই প্রকাশ।
সেই মুক্তি কোথায় মেলে? টেলিভিশন খুললেই দেখি, আরে! এই মুক্তির কথাই তো বলছে বেশির ভাগ বিজ্ঞাপন। মোবাইল বা ল্যাপটপ, জুতা বা জিনস, ত্বকের প্রসাধনসহ যাবতীয় পণ্য কেনার ফজিলত নাকি একটাই—আরও স্বাধীনতা, আরও মুক্তি, আরও সুখ। পণ্য নয় কোম্পানিগুলো নাকি মুক্তির জীবনদর্শনই ছড়িয়ে দিতে চায়। পণ্য সেবনে স্বাধীনতা বাড়বে, আনন্দও বাড়বে, মুক্তি চলে আসবে হাতের মুঠোয়। অর্থাৎ ক্রেতা বা কনজুমার হয়ে ওঠাই মুক্তির শর্ত বলছে বিজ্ঞাপনগুলো। বিশ্বাসও করছে অনেকে। ফুটপাত থেকে শপিং মল পর্যন্ত সবখানেই তারা খুঁজছে, বাচছে, কিনছে। মুক্তির দোকানে তাদের যাওয়া-আসা আর শেষ হয় না, কিন্তু শান্তি মেলে না, শান্তি কেবল বিলবোর্ডে আর বিজ্ঞাপনে।
একটি মোবাইল ফোন বা ফেসওয়াশ তাকে স্বাচ্ছন্দ্য দিচ্ছে হয়তো, কিন্তু সে ঠেকে যাচ্ছে অর্থনীতি ও রাজনীতির কাঁটাতারে। যেমন করে সীমান্তের কাঁটাতারে আটকে গিয়েছিল দরিদ্র কিশোরী ফেলানী। তেমনই দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংকীর্ণ সিঁড়িতে তারুণ্যের গতি আটকে যায়। মেধার স্বীকৃতি, পরিশ্রমের মর্যাদা সেখানে কতটা? অথচ দুনিয়াকে প্রভাবিত করা ফেসবুক, গুগল, উইকিপিডিয়া, উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতারা কিন্তু তরুণ। টাইম ম্যাগাজিন-এর পাঠক জরিপে সেরা ব্যক্তিত্ব হয়েছেন একজন তরুণ—ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জ্যাকারবার্গ। আমেরিকার তরুণ ভোটাররা প্রেসিডেন্ট হিসেবে যাঁকে বেছে নিয়েছেন, তিনিও কিন্তু ভাবমূর্তিতে তরুণ। যে নতুন সাহসী দুনিয়া সৃষ্টি হয়েছে, তা অনেকাংশে তরুণদের আইডিয়া ও মেধারই ফল। তরুণদের আস্থায় না নিলে ভালো-মন্দ কোনো দিনবদলই সম্ভব নয়।
মহাজোট সরকার নিজেদের তরুণদের সরকার বলে গর্ব করে। গত নির্বাচনে ৭০ শতাংশ তরুণ ভোটারের অনেকের সমর্থন তারা পেয়েছিল। কিন্তু সেসব বেকার তরুণ-তরুণীর চাকরি ও কর্মসংস্থান, সেসব কম মজুরির শ্রমজীবীর ন্যায্য অধিকার, সেসব মধ্যবিত্ত তরুণের সুযোগ বাড়ানো, সেসব উচ্চবিত্তের উদ্যোক্তা তারুণ্যের জন্য সুযোগ কি খুব একটা বেড়েছে? সাইবার ক্যাফের ওই অনুসন্ধান তালিকা কেবল নিম্নমধ্যবিত্ত তরুণের চাওয়াকে প্রকাশ করছে। ওই তথ্যটিই বলছে, তাদের আনন্দ, বিনোদন, ফ্যাশন, বন্ধুত্ব, প্রেম, যৌনতা—সবই প্রয়োজন, কিন্তু তার তলায় প্রয়োজন মোটামুটি একটা প্রতিষ্ঠার সুযোগ। কিন্তু কোনো পোশাক, কোনো আড্ডা, কোনো বিশ্বকাপ, কোনো উত্তেজক বিনোদন, কোনো সঙ্গ তাকে এটা দিতে পারে না। এটা দিতে পারে সরকার ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা। অথচ সরকার কেবল তাদের আনুগত্য চায়, রাজনীতি কেবল তাদের মিছিল-ভোট-পেশিশক্তি চায়, বাজার চায় তাকে ক্রেতা বানাতে। ফ্যাশন-টেলিভিশন-তথ্যপ্রযুক্তির কর্তারা চায় তরুণের আসক্তি। সাংস্কৃতিক পণ্যের এই পুরো জগৎটাই তরুণদের সৃষ্টি। তাহলেও তরুণের আকাঙ্ক্ষার পালে হাওয়া দেওয়ার কাজ কজনা করে?
২০০৪ সালের এক হিসাবে (বাংলাদেশের যুবদারিদ্র্য: আবুল বারকাত) ১৮-৩৫ বছরের বয়সকে যুব ধরে নিলে তিন ভাগের এক ভাগ হয় যুব জনসংখ্যা। কিন্তু তাদের জন্য বাজেটের তিন ভাগের এক ভাগ বরাদ্দ করা হয় কি? তাদের প্রায় ৮০ শতাংশের বাস গ্রামে। মোট বেকারদের ৮৬ শতাংশই যুববয়সী, আবার মোট যুবকদের ২৭ শতাংশই বেকার। তাদের মুক্তির পথ তো বিজ্ঞাপনগুলো বাতলে দেবে না। জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ এবং সত্যিকার গণতন্ত্র না হলে আলাদা করে তারুণ্যের মুক্তি ঘটবে না। এখানেই সকল শ্রেণীর তরুণদের স্বার্থ জনগণের সার্বিক স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত। আমাদের যে তরুণেরা বিশ্বের বড় বড় ভবন বানাচ্ছে, শহর পরিষ্কার রাখছে, কারখানায় আর খামারে খাটছে, বাংলাদেশকে নতুন করে গড়বার সুযোগ কি তারা পাবে না? এই সুযোগ যে বাংলাদেশি তরুণ-তরুণী পাশ্চাত্যে যোগ্যতার ঝলক দেখাচ্ছে, তাদের কি কোনো দিন দুঃখী স্বদেশটাকে সুখী করার কাজে লাগানো যাবে? এই সুযোগ একাত্তরের পরেও তারা পায়নি। ভবিষ্যতে পাবে কি না, সেই প্রশ্ন তোলা রইল। এসব ছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশের কী অর্থ, কী পরিচয়?
তরুণেরা অপেক্ষা করছে আর ধৈর্য হারাচ্ছে। যে যুবকটি ঘটি-বাটি বেচে প্রবাসে গিয়েও মার খাচ্ছে কিংবা যে যুবতীটি গার্মেন্ট কারখানায় কাজ করেও মানুষের মতো জীবন পাচ্ছে না, যে প্রতিভা উপেক্ষিত হচ্ছে, তাদের তৃপ্তি আর রাজনীতির ডিজিটাল মুক্তি অথবা বিজ্ঞাপনী মুক্তি এক জিনিস নয়। সেই মুক্তি সাইবার দুনিয়ার অলিগলি, শপিং মল বা টিনের চাল বা চিলেকোঠায় নেই। নকল চাওয়ার রাংতা-চমক খুলে আসল চাওয়াগুলো চিনে নিতে হবে তাদের।
সম্প্রতি ব্রিটিশ কাউন্সিল বাংলাদেশের তারুণ্যের ওপর ‘নেক্সট জেনারেশন’ নামে একটি জরিপ প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশ তরুণই সমাজসেবায় আগ্রহী। অন্যদিকে তাদের ৭৪ শতাংশই রাজনীতির প্রতি উদাসীন। ৯৮ বনাম ৭৪ আসলে বর্তমান রাজনীতির গভীর সংকটটিই তুলে ধরছে। যে সমাজসেবায় ইচ্ছুক, তার তো রাজনীতিই করার কথা! বিদ্যমান রাজনীতি সমাজসেবার অন্তরায়। অন্যভাবে বললে, এই ৯৮ শতাংশই আসলে অন্য রাজনীতি চান। কেননা, এই রাজনীতি ও অর্থনীতি সুযোগ ও সম্ভাবনার দুয়ার যেভাবে আটকে রাখে, তা তারুণ্যকে হতাশ করে দেয়। তারা এতই হতাশ, দেশের মাটিতে উপযুক্ত কর্মসংস্থান ও সুযোগ মিলবে না বলে তাদের ৪১ শতাংশই সুযোগ পেলে দেশ ছাড়ার প্রথম প্লেনে সিট পেতে চাইবে। যে তারুণ্য মুক্তিযুদ্ধ করেছে, যে দেশের মাটিতে লাখো তরুণ মুক্তিযোদ্ধার কবর, যে দেশের ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে তরুণের রক্তদানের দাগ, সেই দেশের অর্ধেক তরুণের চোখে স্বদেশের থেকে প্রবাসই যদি বেশি পছন্দের হয়, সেখানে দেশ চালানো প্রবীণদের ভাবিত হওয়া দরকার।
কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, কেবলই ব্যক্তির মৃত্যু করে দিয়ে আমরাও মরে গেছি আজ। তেমনই কেবলই স্বপ্নের মৃত্যু করে দিলে, বাস্তবও মরে যাবে একদিন। দেশটা হয়ে পড়বে আশার সমাধিক্ষেত্র। সেই সমাধিতে শোকের পাথরে লেখা হবে এপিটাফ: ‘এই সেই স্বাধীন দেশ, যার বয়স অধিকাংশ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার আয়ুর থেকে বেশি। অথচ সেই সব নিহত তরুণের স্বপ্নের সমান তা হতে পারেনি।’ পারবে কি কোনো দিন?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
তারুণ্য কী করে, জানতে খবরের কাগজ খুলি। সেখানে অজস্র তরুণের দীর্ঘ সারির ছবি। তারা রাত জেগে অপেক্ষা করছে ক্রিকেট বিশ্বকাপের একটি টিকিটের জন্য। এই টিকিট আনন্দ আর উত্তেজনার উৎসবে শামিল হওয়ার গেট পাস। হ্যাঁ, বেশিটাই তারা চায়। চায় বাংলাদেশ ক্রিকেট দল বিরাট কিছু করে দেখাক, গর্বে তাদের বুকটা ফুলে যাক। তারুণ্য জাতীয় আত্মমর্যাদার জন্য ক্ষুধার্ত। অন্য মাঠে মার খায়ে ক্রিকেটের মাঠে সেটাই তারা খুঁজছে।
আবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। পাশেই সেমি পাকা বস্তির মতো একসারি ঘর। সরু গলির দুই পাশে সারি সারি এক ঘরের সংসার। ১০ ফুট বাই ১০ ফুট ঘরগুলো আলাদা হলেও টিনের চাল একটাই। রাত ১০-১১টার পর সেই চালের ওপর চোরের মতো লুকিয়ে আড্ডা বসে। নিচে ঘর-বাজার একাকার, তাই টিনের চালই সই। সেখানে বসে হয়তো প্রেমালাপ করে, হয়তো বলিউডি নাচ অথবা উত্তেজক ছবি নিয়ে মাতে। একটু দূরে, পাঁচতলার চিলেকোঠা থেকে দলবদ্ধ গান ভেসে আসে। ছাদের একটা অংশ কাপড়ে ঘিরে নিয়ে বাল্ব জ্বেলে চৌকির ওপর মজমা বসিয়েছে বাড়িওয়ালার ছেলে। প্রায়ই মধ্যরাত পর্যন্ত সেখানে আড্ডা-গান-গাঁজা ইত্যাদি চলে। বেশির ভাগই জনপ্রিয় ব্যান্ড অথবা লোকসুরের বিচ্ছেদী সুর; সঙ্গে বাজে গিটার। যেন তাদের মনে অনেক হাহাকার, যেন তাদের কী যেন নেই। প্রেম-নেশা আর হুল্লোড়ে কি তারা শান্তি খোঁজে? তরুণের আত্মা আজ অশান্ত। সেই অশান্ত মনেরই প্রকাশ দেখি ধনীর দুলাল-দুলালীদের কারও কারও ইয়াবা সেবনে, কিংবা জঘন্য গর্জন তুলে শৌখিন স্পোর্টস কার হাঁকানোয়। এবং অল্প বয়সী তরুণদের নৃশংসতায়। এবং নারীর ওপর যৌন সন্ত্রাসে। এবং কিশোরী ও তরুণীদের আত্মহত্যায়। এবং মাদকের ওপর নির্ভরতায়।
তারুণ্যের ঠাট-বাট-চমক, তরুণ সেলিব্রেটির রূপ-কণ্ঠ আর পারফরম্যান্স ভিজুয়াল বিনোদনের প্রধান কাঁচামাল। তরুণেরাই আবার এই কালচার ইন্ডাস্ট্রির প্রধান ক্রেতা ও ভোক্তা। ফ্যাশনে বিপ্লব ঘটিয়েছে এরাই। আগেকার তরুণদেরও লাইফ নিয়ে চিন্তা ছিল, স্টাইল-সচেতনও ছিল কেউ কেউ। এখন লাইফটাই হয়ে যাচ্ছে একটা স্টাইল। স্টাইল ঠিক তো লাইফ ঠিক। লাইফ স্টাইলই তার ব্যক্তিত্ব, রুচি ও চিন্তাভাবনার প্রকাশ। আজকের তরুণেরা দেখতে ও দেখাতে চায়। তারা জানাতে চায়, তারা আছে। তারুণ্য চায় মনোযোগ, চায় গুরুত্ব, চায় প্রশংসা।
এই চাওয়াগুলোই সব নয়। কিন্তু নমুনা আকারে নিলেও এসব চাওয়ার যোগফল হিসাবে এক বড় চাওয়া দাঁড়িয়ে যায়। সেই চাওয়ার নাম মুক্তি ও গতি। অভাব থেকে, অসামর্থ্য থেকে, বিধিনিষেধ থেকে, সংকীর্ণতা থেকে তারা মুক্তি চায়। বিধিনিষেধের বাইরে তারা চায় জীবনের উদ্যাপন। মন ডানা মেলতে চায়, শরীর চায় উদ্দীপ্ত হতে, প্রেমে বা সংগ্রামে। কিন্তু উপযুক্ত পরিবেশ না পেয়ে তারুণ্যের শক্তি নিজের বিরুদ্ধেই যায়। তারা হয়ে ওঠে আত্মধ্বংসী সন্ত্রাসী বা মাদবসেবী। তাদের ভয় বা সাহস, নৈরাজ্য ও সন্ত্রাস, সেই সীমা ডিঙানো মুক্তির আকাঙ্ক্ষারই প্রকাশ।
সেই মুক্তি কোথায় মেলে? টেলিভিশন খুললেই দেখি, আরে! এই মুক্তির কথাই তো বলছে বেশির ভাগ বিজ্ঞাপন। মোবাইল বা ল্যাপটপ, জুতা বা জিনস, ত্বকের প্রসাধনসহ যাবতীয় পণ্য কেনার ফজিলত নাকি একটাই—আরও স্বাধীনতা, আরও মুক্তি, আরও সুখ। পণ্য নয় কোম্পানিগুলো নাকি মুক্তির জীবনদর্শনই ছড়িয়ে দিতে চায়। পণ্য সেবনে স্বাধীনতা বাড়বে, আনন্দও বাড়বে, মুক্তি চলে আসবে হাতের মুঠোয়। অর্থাৎ ক্রেতা বা কনজুমার হয়ে ওঠাই মুক্তির শর্ত বলছে বিজ্ঞাপনগুলো। বিশ্বাসও করছে অনেকে। ফুটপাত থেকে শপিং মল পর্যন্ত সবখানেই তারা খুঁজছে, বাচছে, কিনছে। মুক্তির দোকানে তাদের যাওয়া-আসা আর শেষ হয় না, কিন্তু শান্তি মেলে না, শান্তি কেবল বিলবোর্ডে আর বিজ্ঞাপনে।
একটি মোবাইল ফোন বা ফেসওয়াশ তাকে স্বাচ্ছন্দ্য দিচ্ছে হয়তো, কিন্তু সে ঠেকে যাচ্ছে অর্থনীতি ও রাজনীতির কাঁটাতারে। যেমন করে সীমান্তের কাঁটাতারে আটকে গিয়েছিল দরিদ্র কিশোরী ফেলানী। তেমনই দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংকীর্ণ সিঁড়িতে তারুণ্যের গতি আটকে যায়। মেধার স্বীকৃতি, পরিশ্রমের মর্যাদা সেখানে কতটা? অথচ দুনিয়াকে প্রভাবিত করা ফেসবুক, গুগল, উইকিপিডিয়া, উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতারা কিন্তু তরুণ। টাইম ম্যাগাজিন-এর পাঠক জরিপে সেরা ব্যক্তিত্ব হয়েছেন একজন তরুণ—ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জ্যাকারবার্গ। আমেরিকার তরুণ ভোটাররা প্রেসিডেন্ট হিসেবে যাঁকে বেছে নিয়েছেন, তিনিও কিন্তু ভাবমূর্তিতে তরুণ। যে নতুন সাহসী দুনিয়া সৃষ্টি হয়েছে, তা অনেকাংশে তরুণদের আইডিয়া ও মেধারই ফল। তরুণদের আস্থায় না নিলে ভালো-মন্দ কোনো দিনবদলই সম্ভব নয়।
মহাজোট সরকার নিজেদের তরুণদের সরকার বলে গর্ব করে। গত নির্বাচনে ৭০ শতাংশ তরুণ ভোটারের অনেকের সমর্থন তারা পেয়েছিল। কিন্তু সেসব বেকার তরুণ-তরুণীর চাকরি ও কর্মসংস্থান, সেসব কম মজুরির শ্রমজীবীর ন্যায্য অধিকার, সেসব মধ্যবিত্ত তরুণের সুযোগ বাড়ানো, সেসব উচ্চবিত্তের উদ্যোক্তা তারুণ্যের জন্য সুযোগ কি খুব একটা বেড়েছে? সাইবার ক্যাফের ওই অনুসন্ধান তালিকা কেবল নিম্নমধ্যবিত্ত তরুণের চাওয়াকে প্রকাশ করছে। ওই তথ্যটিই বলছে, তাদের আনন্দ, বিনোদন, ফ্যাশন, বন্ধুত্ব, প্রেম, যৌনতা—সবই প্রয়োজন, কিন্তু তার তলায় প্রয়োজন মোটামুটি একটা প্রতিষ্ঠার সুযোগ। কিন্তু কোনো পোশাক, কোনো আড্ডা, কোনো বিশ্বকাপ, কোনো উত্তেজক বিনোদন, কোনো সঙ্গ তাকে এটা দিতে পারে না। এটা দিতে পারে সরকার ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা। অথচ সরকার কেবল তাদের আনুগত্য চায়, রাজনীতি কেবল তাদের মিছিল-ভোট-পেশিশক্তি চায়, বাজার চায় তাকে ক্রেতা বানাতে। ফ্যাশন-টেলিভিশন-তথ্যপ্রযুক্তির কর্তারা চায় তরুণের আসক্তি। সাংস্কৃতিক পণ্যের এই পুরো জগৎটাই তরুণদের সৃষ্টি। তাহলেও তরুণের আকাঙ্ক্ষার পালে হাওয়া দেওয়ার কাজ কজনা করে?
২০০৪ সালের এক হিসাবে (বাংলাদেশের যুবদারিদ্র্য: আবুল বারকাত) ১৮-৩৫ বছরের বয়সকে যুব ধরে নিলে তিন ভাগের এক ভাগ হয় যুব জনসংখ্যা। কিন্তু তাদের জন্য বাজেটের তিন ভাগের এক ভাগ বরাদ্দ করা হয় কি? তাদের প্রায় ৮০ শতাংশের বাস গ্রামে। মোট বেকারদের ৮৬ শতাংশই যুববয়সী, আবার মোট যুবকদের ২৭ শতাংশই বেকার। তাদের মুক্তির পথ তো বিজ্ঞাপনগুলো বাতলে দেবে না। জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ এবং সত্যিকার গণতন্ত্র না হলে আলাদা করে তারুণ্যের মুক্তি ঘটবে না। এখানেই সকল শ্রেণীর তরুণদের স্বার্থ জনগণের সার্বিক স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত। আমাদের যে তরুণেরা বিশ্বের বড় বড় ভবন বানাচ্ছে, শহর পরিষ্কার রাখছে, কারখানায় আর খামারে খাটছে, বাংলাদেশকে নতুন করে গড়বার সুযোগ কি তারা পাবে না? এই সুযোগ যে বাংলাদেশি তরুণ-তরুণী পাশ্চাত্যে যোগ্যতার ঝলক দেখাচ্ছে, তাদের কি কোনো দিন দুঃখী স্বদেশটাকে সুখী করার কাজে লাগানো যাবে? এই সুযোগ একাত্তরের পরেও তারা পায়নি। ভবিষ্যতে পাবে কি না, সেই প্রশ্ন তোলা রইল। এসব ছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশের কী অর্থ, কী পরিচয়?
তরুণেরা অপেক্ষা করছে আর ধৈর্য হারাচ্ছে। যে যুবকটি ঘটি-বাটি বেচে প্রবাসে গিয়েও মার খাচ্ছে কিংবা যে যুবতীটি গার্মেন্ট কারখানায় কাজ করেও মানুষের মতো জীবন পাচ্ছে না, যে প্রতিভা উপেক্ষিত হচ্ছে, তাদের তৃপ্তি আর রাজনীতির ডিজিটাল মুক্তি অথবা বিজ্ঞাপনী মুক্তি এক জিনিস নয়। সেই মুক্তি সাইবার দুনিয়ার অলিগলি, শপিং মল বা টিনের চাল বা চিলেকোঠায় নেই। নকল চাওয়ার রাংতা-চমক খুলে আসল চাওয়াগুলো চিনে নিতে হবে তাদের।
সম্প্রতি ব্রিটিশ কাউন্সিল বাংলাদেশের তারুণ্যের ওপর ‘নেক্সট জেনারেশন’ নামে একটি জরিপ প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশ তরুণই সমাজসেবায় আগ্রহী। অন্যদিকে তাদের ৭৪ শতাংশই রাজনীতির প্রতি উদাসীন। ৯৮ বনাম ৭৪ আসলে বর্তমান রাজনীতির গভীর সংকটটিই তুলে ধরছে। যে সমাজসেবায় ইচ্ছুক, তার তো রাজনীতিই করার কথা! বিদ্যমান রাজনীতি সমাজসেবার অন্তরায়। অন্যভাবে বললে, এই ৯৮ শতাংশই আসলে অন্য রাজনীতি চান। কেননা, এই রাজনীতি ও অর্থনীতি সুযোগ ও সম্ভাবনার দুয়ার যেভাবে আটকে রাখে, তা তারুণ্যকে হতাশ করে দেয়। তারা এতই হতাশ, দেশের মাটিতে উপযুক্ত কর্মসংস্থান ও সুযোগ মিলবে না বলে তাদের ৪১ শতাংশই সুযোগ পেলে দেশ ছাড়ার প্রথম প্লেনে সিট পেতে চাইবে। যে তারুণ্য মুক্তিযুদ্ধ করেছে, যে দেশের মাটিতে লাখো তরুণ মুক্তিযোদ্ধার কবর, যে দেশের ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে তরুণের রক্তদানের দাগ, সেই দেশের অর্ধেক তরুণের চোখে স্বদেশের থেকে প্রবাসই যদি বেশি পছন্দের হয়, সেখানে দেশ চালানো প্রবীণদের ভাবিত হওয়া দরকার।
কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, কেবলই ব্যক্তির মৃত্যু করে দিয়ে আমরাও মরে গেছি আজ। তেমনই কেবলই স্বপ্নের মৃত্যু করে দিলে, বাস্তবও মরে যাবে একদিন। দেশটা হয়ে পড়বে আশার সমাধিক্ষেত্র। সেই সমাধিতে শোকের পাথরে লেখা হবে এপিটাফ: ‘এই সেই স্বাধীন দেশ, যার বয়স অধিকাংশ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার আয়ুর থেকে বেশি। অথচ সেই সব নিহত তরুণের স্বপ্নের সমান তা হতে পারেনি।’ পারবে কি কোনো দিন?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
No comments