গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও মানবিক সমাজের আকাঙ্ক্ষা by এ কে এম শাহনাওয়াজ

শিরোনামটিই বলে দেয় কেমন অসহায় দশায় আমরা নিপতিত। আমাদের রাষ্ট্র আজ গণতান্ত্রিক ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অমানবিকতার থাবায় বিক্ষত সমাজ। তাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে বিপন্ন জাতি।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে পাওয়া শক্তিই এখন সুন্দরের পথ খুঁজে পেতে শেষ ভরসা। আধুনিক জাতি, রাষ্ট্র ও সমাজ রাজনীতিবিচ্ছিন্ন হতে পারে না। রাজনীতিকে অস্বীকার করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্নপূরণও সম্ভব নয়। এ কারণে দেশ যখন নষ্ট রাজনীতির হাতে বন্দি হয়ে পড়ে, তখনই সব ক্ষেত্রে হতাশা নেমে আসে।
এ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া-আসা করা দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা নেই বললেই চলে। একমাত্র নির্বাচনে ভোট প্রদান ছাড়া আর কোনো দৃশ্যমান গণতান্ত্রিক আচরণ চিহ্নিত করার উপায় নেই। গণতন্ত্রহীনতা স্বৈরতন্ত্রকেই উৎসাহিত করে। এ কারণেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- উভয় দলে দলীয় প্রধানের হাতেই সব ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকে। এ অবস্থায় সুবিধাবাদই প্রশ্রয় পায়। দলীয়করণ প্রকট হয়ে দেখা দেয়। গণতান্ত্রিক চর্চা বিচ্ছিন্ন হওয়ায় নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দিতে টাকা প্রধান নিয়ামক হিসেবে শক্ত অবস্থান নেয়। এ সূত্রেই দুর্নীতি সর্বগ্রাসী রূপ নিতে থাকে। সন্ত্রাস আর নৈরাজ্যের বাড়বাড়ন্ত সমাজজীবনকে বিষময় করে তোলে।
সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও জাতির ভাগ্য নির্মাণের প্রাণকেন্দ্র সংসদ। সাধারণ ভোটার তাদের মূল্যবান ভোট দিয়ে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে সংসদে গিয়ে জনগণের জন্য কথা বলতে। সংসদ সদস্যরা আইন প্রণেতা। এ কারণে বিশেষ সম্মানিত অবস্থান রয়েছে তাঁদের। কিন্তু এ দেশের গণতন্ত্র বোধহীন 'গণতান্ত্রিক' দলগুলো কখনো গণতন্ত্রকে শক্ত অবস্থানে দাঁড়াতে দেয়নি। সংসদের মতো পবিত্র জায়গাকে রাজনৈতিক বিতর্ক নয়- যদি কখনো বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা অভিমান ভুলে সংসদে উপস্থিত থাকেন, তখন সংসদকক্ষ নিম্নমানের রাজনৈতিক ঝগড়ার কেন্দ্রে পরিণত হয়। কখনো কখনো আমাদের মান্যবর সংসদ সদস্যদের দায়িত্ব পালন ও তাঁদের দলীয় বক্তব্য শুনলে মনে হয় না, ভোটারদের প্রতি তাঁদের কোনো কমিটমেন্ট আছে। দলীয় ও ব্যক্তিগত স্বার্থচিন্তার বাইরে খুব একটা ভূমিকা রাখেন না তাঁরা।
রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণে গণতান্ত্রিক বোধহীনতার প্রকাশ রয়েছে পদে পদে। গণতন্ত্রের প্রথম পাঠ জনগণের সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করে নেওয়া, এর প্রতি শ্রদ্ধা স্থাপন করা- তা তো নির্বাসিতই হয়ে গেছে। বক্তৃতার মঞ্চ ছাড়া জনগণ উপেক্ষিত প্রকাশ্য রাজনৈতিক আচরণেও। এক সময় রাজনীতিকদের নির্বাচনের সময় জনগণকে প্রয়োজন পড়ত। বিএনপির শাসনামলে তাও হালকা হয়ে গিয়েছিল। নির্বাচন-নির্বাচন খেলার যাবতীয় আয়োজন সম্পন্ন হয়েছিল তখন। 'জনগণ' শুধু প্রতীক মাত্র। শেষবারের রাজত্বে নির্বাচনী রায় নিজ অনুকূলে রাখার সব কাজ সম্পন্ন করে নিশ্চিন্তে কালাতিপাত করছিলেন বিএনপি নেতা-নেত্রীরা। তারপর বিএনপির দুর্নীতিবাজ সব রক্তবীজ অসংখ্য বিএনপি-প্রাণ ভালো মানুষ কর্মী-সমর্থকদেরও ক্ষুব্ধ করে নিশ্চিন্ত মনে জাতির কলজে খুবলে যাবতীয় মধু আকণ্ঠ পান করছিল। যে ম্যানুফ্যাকচার্ড ভোটার তালিকার ওপর গোটা নির্ভরতা রেখে বিএনপির ক্ষমতাবান নেতা-নেত্রীরা প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে দুর্নীতি করে যাচ্ছিলেন আর চিরস্থায়ী ক্ষমতাবান ভেবে ধরাকে সরা জ্ঞান করছিলেন, মুহূর্তের উল্কাপতনে তাই প্রথম খুন হতে থাকে বিএনপি। ছবিযুক্ত নতুন ভোটার তালিকায় নির্বাচনের ঘোষণায় তাই অনিবার্য অশনিসংকেত দেখা দেয় বিএনপির নির্বাচনে যাওয়ার প্রশ্নে। দৃশ্যত জোটবন্ধু জামায়াতে ইসলামীর ইচ্ছায়ই নির্বাচন নামের মরণফাঁদে (বিএনপি-জামায়াত জোটের জন্য) পা দিয়েছিল বিএনপি। তাই গত নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের এই হিসাব করতে কোনো ক্লেশ হয়নি যে নতুন ভোটার তালিকায় বিপুলসংখ্যক ভোটার যদি কোনো ধরনের চাপে না থেকে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে, তবে বিএনপি-জামায়াত বধ সম্পন্ন হবে। আর পরিস্থিতির সুবিধায় একমাত্র বিকল্প হিসেবে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট গণসমর্থন পেয়ে যাবে।
নিকট অতীতে রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে বা না থেকে আওয়ামী লীগও যে গণতান্ত্রিক আচরণের পরাকাষ্ঠা দেখাতে পেরেছে, সে কথা বলতে পারবে না ইতিহাস। জনকল্যাণের চেয়ে সন্ত্রাসী পোষণ অথবা দলীয় সন্ত্রাসীদের শাসন না করা আর দলীয়করণের সাংস্কৃতিক আচরণ প্রকাশ্যেই দেখিয়ে যাচ্ছে দলটি। আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার যুগে চাঁদাবাজি আর দখল-বাণিজ্য কম করেনি দলের সহযোগী সংগঠনের ক্যাডাররা। এ জন্য আওয়ামী নেতৃত্ব কোনো রকম অনুশোচনা প্রকাশ করেছে- এ কথা বোধ করি কেউ প্রমাণ করতে পারবে না। এভাবে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো গণমুখী না হয়ে দলমুখী হওয়ার সংস্কৃতিই বাঁচিয়ে রাখল। তারা কোনোভাবেই নিজেদের শোধরাতে পারেনি। তাই এখন গৎবাঁধা হয়ে গেছে দলীয় প্রতিক্রিয়া। সাধারণ মানুষের মুখস্থ হয়ে গেছে যে নির্বাচনে বিজয়ী দল বলবে- 'নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে' আর পরাজিত দল বলবে- 'স্থূল বা সূক্ষ্ম কারচুপির মাধ্যমে তাদের হারানো হয়েছে।' সরকার গঠনের অল্প দিন পরই বিরোধী দল অসহিষ্ণু হয়ে পড়বে। পাঁচ বছর ধরে জনগণের মনে আসন পাওয়ার মতো চেষ্টা, ক্ষমতা বা ধৈর্য- কোনোটাই তাদের থাকে না। তাই সরকার যাতে স্বস্তি না পায় সে ব্যবস্থা করতে থাকবে। জনগণ গ্রহণ করুক বা না করুক, শ্রাব্য-অশ্রাব্য ভাষায় বক্তৃতা-বিবৃতি দিতেই থাকবে। যতই হাস্যকর হোক, তবু দমে দমে সরকারকে পদত্যাগ করতে বলবে আর মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি করবে।
বিরোধী দলে থাকলে নানা ছুতানাতায় সংসদ বর্জন করা এখন একটি সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে কম্পিউটারকে সব সময় আপগ্রেড করা হয়। দলীয় নির্দেশে আমাদের বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যরা নিজেদের সংসদীয় আচরণকেও প্রতিদিন আপগ্রেড করে নিচ্ছেন। প্রথমে তাঁরা কিছু সময়ের জন্য ওয়াকআউট করতেন। তারপর দু-এক দিনের জন্য প্রতীকী সংসদ বর্জন করতেন। এখন করেন লাগাতার সংসদ বর্জন। বর্জনের কারণগুলো স্থূল হতে হতে এখন থলথলে চর্বিদার হয়ে গেছে। 'বিরোধী দলকে মাননীয় স্পিকার কথা বলতে দেন না'- এই গুরুতর অভিযোগে অতীতে আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয়েই লাগাতার সংসদ বর্জন করেছে। এবার অল্প সময় সংসদে থাকলেও বিরোধীদলীয় নেত্রীকে রেকর্ড পরিমাণ সময় ধরে কথা বলতে দেওয়ার পরও অভিযোগ একই রয়ে গেছে। অবশ্য নিকট অতীত ঘাঁটলেই দেখা যাবে, প্রধানত রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি বরাবর বহাল রেখেছে আমাদের গণতান্ত্রিক দলগুলো। আবার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে পরিণত না করে ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ অর্জনের জন্য সংসদকে ব্যবহার করতে সরকারি ও বিরোধী- দুই পক্ষই অসাধারণ ঐকমত্যে পৌঁছে যায়। অনেক কিছু গা-সওয়া করে ফেলতে হয় ঠিকই; কিন্তু দিনবদলের স্লোগান দিয়ে আমাদের আশাবাদী করে স্বপ্নচূড়ায় উঠিয়ে এই সরকারের সংসদ সদস্যদের অনেকের মধ্যেও 'অভিজাত' হওয়া আর স্বার্থ অর্জনের লোভ পুরোটাই কার্যকর রয়েছে। তাই সাধারণ মানুষের হতাশায় ডুবে যাওয়া ছাড়া তো কোনো পথ থাকে না! কান আর চোখে সমস্যাক্রান্ত আমাদের সংসদ সদস্যরা শুধু নিজেদের অর্জনটাই দেখছেন। গত নির্বাচনে সাধারণ ভোটারের গর্জন কি শোনেননি?
স্বাধীনতার পর থেকে, বিশেষ করে ১৯৭৫-এর পর থেকে জনপ্রতিনিধিত্বের দর্শনটা পাল্টে গেল। গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যে দেশ স্বাধীন হলো, সে দেশের গণতন্ত্রের চর্চাকারী ঐতিহ্যবাহী দলের অপরিণামদর্শী দুর্বল নেতৃত্ব বিরুদ্ধ স্রোতের মুখে ঐতিহ্য আর আদর্শ থেকে আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে পারলেন না। প্রথমে সামরিক শাসন, তারপর এর বেসামরিক লেবাস দেখে তাঁরা যেন হতাশ হয়ে পড়লেন। সে সময় থেকে এ দেশের রাজনীতি হয়ে গেল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার নামাবরণে ক্ষমতায় পৌঁছার প্রতিযোগিতার রাজনীতি। গণতন্ত্র আর পূর্ণ অবয়ব নিয়ে দাঁড়াতে পারল না। জেনারেলরা সেনা ছাউনি থেকে এসে প্রথমে ক্ষমতা দখল করলেন, পরে উর্দি খুলে নতুন দলের নাম আর দর্শন প্রচার করে বেসামরিক হয়ে গেলেন। রাজনীতির মাঠের সুবিধাবাদী ও সুবিধা-অন্বেষী মানুষগুলোকে দলে ভেড়াতে পারলেন সহজেই। তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত এর বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ল। রাজনীতির নামে ছাত্রসমাজের একাংশের আদর্শের মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলা হলো। পেশাজীবী সংগঠনগুলোর নৈতিকতার ভিত্তি গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো। এরই মধ্যে কথাসর্বস্ব হয়ে যাওয়া বাম দলগুলোর মধ্যে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার মানসিক বল আর অবশিষ্ট রইল না। অন্যদিকে গড্ডালিকায় গা ভাসাল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগ। এখন বড় দলগুলোর একটাই মোক্ষ হলো নির্বাচন-নির্বাচন খেলার মধ্য দিয়ে কিভাবে ক্ষমতায় পৌঁছা যায়। প্রতিযোগিতার গতি এত দ্রুত যে জনদরদি নেতা হয়ে ভোটারের মনোরঞ্জনের মতো ফুরসত কারো হাতে থাকল না।
তার পরও আমরা বিশ্বাস করতে চাই, আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের একটি বড় অংশ প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। তাঁরা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থকে অতিক্রম করে গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চান। ক্ষমতার রাজনীতির বাস্তবতার ভেতর থেকেও বিপন্ন গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদায় ফিরিয়ে আনতে চান। প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক শক্তির সদম্ভ বেড়ে ওঠার অশুভ তৎপরতাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিংড়ানো তীক্ষ্ন রশ্মি দিয়ে ঝলসে দিতে চান। দেশের সাধারণ মানুষের বড় অংশও এই সুন্দরের প্রতীক্ষায় উদ্বাহু। তাই এখন সবার সামনে সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে আসন্ন নির্বাচন। আমরা প্রত্যাশা করতে চাই, নির্বাচনকে সামনে রেখে আমাদের রাজনীতি এবার গণমুখী হবে। যে দলের রাজনীতিকরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নিজেদের মধ্যে চৈতন্য ফিরিয়ে আনতে পারবেন, বুকের ভেতর দেশপ্রেম অনুভব করবেন, ক্ষুদ্র ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থ ভুলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত হবেন- গণমানুষের সামনে তাঁরাই হবেন আস্থাবান। এ অবস্থা অমানবিকতার অবসান ঘটিয়ে মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাকে অনেকটাই পূর্ণ করতে পারবে। ইতিহাসের ঘটনার বলয় কখনো স্থবির থাকেনি। আবর্তনের মধ্য দিয়ে সুন্দর সকাল ফিরে পাওয়া তাই অসম্ভব কোনো স্বপ্নকল্পনা নয়।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawazju@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.