ভারত নারীকে ঘৃণা করে by পূবালী রায় চৌধুরী
ভারত নারী জাতিকে ঘৃণা করে। এই নগ্ন সত্য
দিয়েই শুরু আর শেষ করতে চাই দিল্লিতে বাসে ছাত্রী ধর্ষণের ভয়াবহ অপরাধে
আমার প্রতিক্রিয়া।
আমার
এই লেখা সে বর্বরতার শিকার, তরুণীটির উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত। যদি কোনো
ভারতীয় দাবি করে যে, এই ঘটনায় সে বিস্মিত এবং আরো দাবি করে, ভারতের
প্রাপ্তবয়স্করা মানসিকভাবে সুস্থ ও দায়িত্ববোধসম্পন্ন, তা হলে বলবÑ সে
ব্যক্তি (নারী বা পুরুষ) মিথ্যা বলছেন। যা সত্য, তা বলতেই হবে। যিনি ভারতের
মাটিতে বড় হয়েছেন, সংবাদপত্র পড়ে অর্জন করেছেন সচেতনতা, কিংবা
নিদেনপক্ষে চোখ দুটো খোলা রেখেছেন, তারা সবাই জানেনÑ ভারত নারীকে ঘৃণা করে।
যদি কেউ অন্য কথা বলেন, তাহলে তিনি মিথ্যা বলছেন। এই মিথ্যাচার ও
অস্বীকৃতি অব্যাহত আছে; অথচ ভারত সে দেশগুলোর একটি যেখানে নারীকে সবচেয়ে
বেশি ঘৃণা করা হয়। এই মিথ্যাচারের মাধ্যমেই দিল্লির বাসে সেই মেয়েটিকে
ধর্ষণ-নির্যাতন করা হলো; সে হলো নিষ্পেষিত ও ক্ষতবিক্ষত। আমরা মিথ্যা না
বললে তার ওপর সে হামলা সম্ভব হতো না।
প্রথমে স্বীকার করতে হয় সমস্যা থাকার কথা। তা না হলে সমাধান আসে না। ভারতীয় সংস্কৃতিতে নারীর প্রতি জঘন্য ঘৃণা বিদ্যমানÑ এটা আমরা যারা স্বীকার করি না, তারা সে মাদকাসক্তের মতো, যে জোর দিয়ে বলে, মাদকসেবনের দরুন তার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণই সে স্বীকার করে না। মাদকের কারণে তার বন্ধুত্ব, চাকরি, পারিবারিক শান্তিÑ সব কিছু চুরমার হয়ে যায়। তবুও সে তার আসক্তিজাত সোনালি মেঘের ভেলায় ভেসে বেড়ায়। বারবার জোরের সাথে বলে, ‘আমি ঠিকই আছি। কোনো সমস্যা নেই।’ সে চায়, অন্যরা তাকে নিয়ে না ভেবে বরং তাকে যেন নেশার মজা লুটতে দেয়।
জাতি হিসেবে আমরা যদি মেনে না নিই যে, নারীকে ঘৃণা করার একটা বিশাল সঙ্কটে আমরা ভুগছি যা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই, তা হলে বুঝতে হবেÑ সামাজিকভাবেই আমরা অসুস্থ। ব্যক্তি হিসেবে মাদকাসক্তের যে মানসিকতা, জাতি হিসেবে আমাদের অবস্থা তেমনই। ভারতে নারীর প্রতি ঘৃণা কালচারের মজ্জাগত। এটা যতবার অস্বীকার করা হবে, ততবার একজন নারীকে ধর্ষণ ও নির্যাতনের আঘাত হানা হবে। ভারতে নারীকে যে পরিস্থিতিতে, যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জীবন কাটাতে হয়, এতে তার নিগ্রহের অস্বীকৃতি মানে, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।
এখন সে রেকর্ড বদলানোর সময় এসেছে। গর্ভ থেকেই শুরু নারীর প্রতি আমাদের ঘৃণার। কারণ প্রতি বছর আমরা কয়েক মিলিয়ন গর্ভপাত ঘটাচ্ছি। ভারতে কন্যা মানেই বোঝা। এ দেশে পুত্রসন্তানের জন্য আকাক্সা যেন মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো একেবারে স্বাভাবিক ব্যাপার। একটা পুত্রের জন্ম লাভের জন্য আমরা প্রার্থনা করি, মানত করি, উপবাসে কাটাই, অমুক-তমুক দেবদেবীর কাছে মাথা নত করি। সব কিছু কেবল এ জন্য যে, আমরা যেন নিঃসন্তান না থাকি; অন্তত হিসাবের খরচের খাতা খুলতে না হয়, অর্থাৎ কন্যাশিশুর জন্ম না হয়। তাকে বোঝা মনে করেই ভারতে কন্যাকে মনে করা হয় ‘পরের ধন’Ñ সে অন্য কারো বাড়ির ‘সম্পদ’। জন্মের মুহূর্ত থেকেই সে নির্বাসিতা। তখন থেকেই মনে করা হয়, ওর আসল ঠিকানা তো শ্বশুরবাড়ি। নারীরা পণ্যতুল্য, তাই মনে করা হয় ‘সম্পদ’। যদি আসলেই কন্যাদের সম্পদ মনে করা হতো তাহলে আমাদের কাছ থেকে এমন মূল্যবান সম্পদ নেয়ার জন্য বরের পরিবারকে কেন এত কিছু দিতে হবে?
বলা হয়ে থাকে, মেয়ের বিয়েতে দেয়া যৌতুক তার নিরাপত্তার গ্যারান্টি, নিজেকে রক্ষা আর প্রয়োজনে কাজে লাগানোর জিনিস। এসব অজুহাত এত অন্তঃসারহীন যে, কথাগুলো বাদ দেয়া উচিত। কোনো নারীর বিয়ে ভেঙে গেলে ভারতের ক’টি পরিবারে তাদের মেয়েটিকে স্বেচ্ছায় গ্রহণ করা হয়? সে মেয়ে তখন বিষম মানসিক চাপে থাকে এবং শ্বশুরবাড়ির আচরণটি ওর জন্য অমর্যাদাকর হয়ে দাঁড়ায়।
নির্যাতনের ভয়ে সে থাকে ভীত। তবুও তাকে তোষামোদ করা হয়, ভয় দেখানো হয়, এমনকি বাধ্য করা হয় শ্বশুরদের পরিবারে ফিরে যেতে। সবার ধারণা তখন এমন, ‘ছি ছি! কী লজ্জা, পাড়াপড়শিরা কী বলবে?’ এমন পরিস্থিতিতে কত নারী যে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। আর ফিরে গিয়ে খুন হয়েছে; নতুবা আগের চেয়ে বেশি মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন ভোগ করেছে। কারণ তখন সেই নিপীড়কেরা এটা ভেবে মজা পেতে পারে যে, হতভাগিনীকে বাঁচানোর কেউ নেই।’ এসব কথা না জানার ভানটুকু পর্যন্ত করবেন না। ভারতের মিথ্যা ও ভাঁওতাবাজির পোশাক খুলে নারীর প্রতি ঘৃণার জঘন্য গর্বের স্বরূপ উন্মোচন করতে চাই।
কন্যাশিশু গর্ভে আসাকে নস্যাৎ করার অপকর্মের চমৎকার নাম হলো ‘পছন্দনীয়’ গর্ভপাত। পুত্রসন্তান পাওয়ার জন্য উপবাস, প্রার্থনা, মন্ত্র, পুরোহিতের পরামর্শÑ সব কিছুই করা হয়ে থাকে। কন্যা লাভের জন্য কোনো কিছুই করা হয় না। মনোভাবটা হলো, ‘ওই হতভাগিনীরা এমনিতেই যত জন্মাচ্ছে, সেটাই যথেষ্ট। ওদের আগমনের জন্য প্রার্থনা করার মতো বেকুব কেউ আছে নাকি?’
ভাইয়েরাই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। সাধারণত বোনেরা এর কিছু পায় না। আবেগ, পুষ্টি, শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কন্যার ওপর পুত্রের প্রাধান্য। কারণ ‘পুরুষ যে মূল্যবান।’ এই যে বৈষম্য, এ জন্য কিন্তু মা ও বাবা দু’জনই সমান দায়ী। গ্লাসভর্তি দুধ, বিদেশে পড়ার টাকা, বাড়িঘর এসব পায় পুত্রসন্তান। আর কন্যার জন্য যৌতুক ও ঠেলাধাক্কা। পুত্র সব ক্ষমতার মালিক, কন্যা তার দয়ার ওপর নির্ভরশীল।
কন্যার বিয়ে যেন একটা জুয়া খেলা। যদি স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির আচরণ ভালো হয়, মেয়েটা ভাগ্যবতী। তবে সে আচরণ মন্দ হলেও সে বাবার বাড়িতে ফিরতে পারবে না। ফিরলে তা হবে অবমাননাকর। ভারতে এখন কয়েক মিলিয়ন নারী ঘরের বাইরে কাজ করছেন। তবে তাদের অনেকেই যা আয় করেন, তা নিজেদের ও সন্তানদের জন্য পর্যাপ্ত নয়। আর কোনো নারী একা থাকলে সন্দেহের শিকার। এমনকি তাদের কাছে বাসাভাড়া দিতে মালিকেরা অস্বীকার করেন। তালাকের ক্ষেত্রে স্বামীর কাছ থেকে পাওনা আদায় তো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।
হ্যাঁ, এভাবেই চলছে। ভারতের বিশেষ করে হিন্দু সংস্কৃতি সেই কুখ্যাত মনুস্মৃতির যুগ থেকে নারীকে দেখে আসছে নিছক সম্পত্তি হিসেবে। মনে করা হয় না যে, নারীও একটি মানবিক সত্তা, যে নিজের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার রাখে। এত সমাজ সংস্কারক এলেন, গেলেন; তবুও এমন মনোভাব বদলায়নি ভারতে। নিজের দেহ ও মনের ওপর নারীর অধিকার নেই। তাদের হৃদয়, অন্তর, মস্তিষ্ক এমন এক সমাজ নিয়ন্ত্রণ করছে, যা চরম পিতৃতান্ত্রিক আর নারীবিদ্বেষী। এর প্রতিবাদ জানালে জবাব দেয়া হয় আরো ভণ্ডামি, আরো মিথ্যাচারের মাধ্যমে। মুখে বলা হয়, ‘অবস্থার উন্নতি হবে’ কিংবা ‘ব্যবস্থা নিতে সময় লাগবে’।
না, অবস্থার তো উন্নতি হচ্ছে না। আমরা নারী প্রধানমন্ত্রী, নারী প্রেসিডেন্ট এবং কয়েকজন নারী মুখ্যমন্ত্রী পেয়েছি। তবুও এত মিলিয়ন ভারতীয় নারীর ভাগ্য বাস্তবে বদলায়নি। আর এই সত্যও বদলে যায়নি যে, আমাদের দেশে ধর্ষণের শিকার যে নারী, সে লজ্জায় নীরব হয়ে যেতে হয়। কারণ ওই দুর্বৃত্ত নয়, নারীটিকেই ভারতের সমাজ এই অপরাধের জন্য দায়ী করে। এমনকি ওই নারীর পরিবার ও বন্ধুরাও তা করে থাকে। একই কারণে ভারতে ধর্ষণের বিপুল ঘটনা থেকে যায় অজানা। নারী অধিকারের একজন পুরুষ প্রবক্তা সম্প্রতি আমাকে বললেন, ভারতের কোটি কোটি মানুষের দৈনন্দিন আড্ডা-আলোচনায় ধর্ষণ ইস্যুটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। এটা নিয়ে হাসি-তামাশা ও মজা করা হয়। অথচ এটা নারীর জন্য নিদারুণ লজ্জা, নির্যাতন ও ট্র্যাজেডি। কেন নারী জন্ম নিল? তার অস্তিত্ব না থাকাই যেন ভালো ছিল।
একজন ভারতীয় নাগরিক আমাকে বললেন, ‘আমরা নারীকে সাহায্য করতে পারি কিভাবে?’ জবাব দিলাম, ‘প্রথমে আমাদের মিথ্যা বলা বন্ধ করা চাই।’ ভারত নারীকে ঘৃণা করে। এটাই সত্য, যতই কুৎসিত ও নগ্ন হোক কথাটা। ধর্ষিতাকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে ওর পায়ের কাছে ফুল নয়, এই সত্যটাকে রাখুন। বাজি ধরে বলতে পারি, সে এ কাজের প্রশংসা করবে। যদি সে বেঁচে যায়, আমরা তার কাছে ঋণী থাকব। যদি না বাঁচে, আমরা ঋণী থাকব নিজেদের কাছে। ঋণী থাকব নানা অপরাধের শিকার, অসংখ্য নারীর কাছে। এসব অপরাধ আমাদের মিথ্যাচারের অনিবার্য ও বিষাক্ত ফল। প্রথম দায়িত্বই হলো, সত্যকে স্বীকার করে নেয়া। সমস্যার স্বীকৃতি ছাড়া পরিস্থিতির পরিবর্তন শুরু হতে পারে না। তা হলেই আশা ও নিরাময়ের শুভ সূচনা সম্ভব। যদি এসব না হয়, তাহলে ধর্ষণের পরবর্তী ঘটনার অপেক্ষায় থাকুন। আমি নিশ্চিতÑ আরেকটি ধর্ষণ ঘটে গেছে ইতোমধ্যেই, ঠিক এই মুহূর্তে ভারতের কোথাও না কোথাও; আর তা হারিয়ে যাবে অজানা হিসেবে।
লেখক : ইনট্রেপিড রিপোর্ট-এর সহযোগী সম্পাদক
ভাষান্তর : মীযানুল করীম
প্রথমে স্বীকার করতে হয় সমস্যা থাকার কথা। তা না হলে সমাধান আসে না। ভারতীয় সংস্কৃতিতে নারীর প্রতি জঘন্য ঘৃণা বিদ্যমানÑ এটা আমরা যারা স্বীকার করি না, তারা সে মাদকাসক্তের মতো, যে জোর দিয়ে বলে, মাদকসেবনের দরুন তার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণই সে স্বীকার করে না। মাদকের কারণে তার বন্ধুত্ব, চাকরি, পারিবারিক শান্তিÑ সব কিছু চুরমার হয়ে যায়। তবুও সে তার আসক্তিজাত সোনালি মেঘের ভেলায় ভেসে বেড়ায়। বারবার জোরের সাথে বলে, ‘আমি ঠিকই আছি। কোনো সমস্যা নেই।’ সে চায়, অন্যরা তাকে নিয়ে না ভেবে বরং তাকে যেন নেশার মজা লুটতে দেয়।
জাতি হিসেবে আমরা যদি মেনে না নিই যে, নারীকে ঘৃণা করার একটা বিশাল সঙ্কটে আমরা ভুগছি যা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই, তা হলে বুঝতে হবেÑ সামাজিকভাবেই আমরা অসুস্থ। ব্যক্তি হিসেবে মাদকাসক্তের যে মানসিকতা, জাতি হিসেবে আমাদের অবস্থা তেমনই। ভারতে নারীর প্রতি ঘৃণা কালচারের মজ্জাগত। এটা যতবার অস্বীকার করা হবে, ততবার একজন নারীকে ধর্ষণ ও নির্যাতনের আঘাত হানা হবে। ভারতে নারীকে যে পরিস্থিতিতে, যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জীবন কাটাতে হয়, এতে তার নিগ্রহের অস্বীকৃতি মানে, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।
এখন সে রেকর্ড বদলানোর সময় এসেছে। গর্ভ থেকেই শুরু নারীর প্রতি আমাদের ঘৃণার। কারণ প্রতি বছর আমরা কয়েক মিলিয়ন গর্ভপাত ঘটাচ্ছি। ভারতে কন্যা মানেই বোঝা। এ দেশে পুত্রসন্তানের জন্য আকাক্সা যেন মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো একেবারে স্বাভাবিক ব্যাপার। একটা পুত্রের জন্ম লাভের জন্য আমরা প্রার্থনা করি, মানত করি, উপবাসে কাটাই, অমুক-তমুক দেবদেবীর কাছে মাথা নত করি। সব কিছু কেবল এ জন্য যে, আমরা যেন নিঃসন্তান না থাকি; অন্তত হিসাবের খরচের খাতা খুলতে না হয়, অর্থাৎ কন্যাশিশুর জন্ম না হয়। তাকে বোঝা মনে করেই ভারতে কন্যাকে মনে করা হয় ‘পরের ধন’Ñ সে অন্য কারো বাড়ির ‘সম্পদ’। জন্মের মুহূর্ত থেকেই সে নির্বাসিতা। তখন থেকেই মনে করা হয়, ওর আসল ঠিকানা তো শ্বশুরবাড়ি। নারীরা পণ্যতুল্য, তাই মনে করা হয় ‘সম্পদ’। যদি আসলেই কন্যাদের সম্পদ মনে করা হতো তাহলে আমাদের কাছ থেকে এমন মূল্যবান সম্পদ নেয়ার জন্য বরের পরিবারকে কেন এত কিছু দিতে হবে?
বলা হয়ে থাকে, মেয়ের বিয়েতে দেয়া যৌতুক তার নিরাপত্তার গ্যারান্টি, নিজেকে রক্ষা আর প্রয়োজনে কাজে লাগানোর জিনিস। এসব অজুহাত এত অন্তঃসারহীন যে, কথাগুলো বাদ দেয়া উচিত। কোনো নারীর বিয়ে ভেঙে গেলে ভারতের ক’টি পরিবারে তাদের মেয়েটিকে স্বেচ্ছায় গ্রহণ করা হয়? সে মেয়ে তখন বিষম মানসিক চাপে থাকে এবং শ্বশুরবাড়ির আচরণটি ওর জন্য অমর্যাদাকর হয়ে দাঁড়ায়।
নির্যাতনের ভয়ে সে থাকে ভীত। তবুও তাকে তোষামোদ করা হয়, ভয় দেখানো হয়, এমনকি বাধ্য করা হয় শ্বশুরদের পরিবারে ফিরে যেতে। সবার ধারণা তখন এমন, ‘ছি ছি! কী লজ্জা, পাড়াপড়শিরা কী বলবে?’ এমন পরিস্থিতিতে কত নারী যে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। আর ফিরে গিয়ে খুন হয়েছে; নতুবা আগের চেয়ে বেশি মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন ভোগ করেছে। কারণ তখন সেই নিপীড়কেরা এটা ভেবে মজা পেতে পারে যে, হতভাগিনীকে বাঁচানোর কেউ নেই।’ এসব কথা না জানার ভানটুকু পর্যন্ত করবেন না। ভারতের মিথ্যা ও ভাঁওতাবাজির পোশাক খুলে নারীর প্রতি ঘৃণার জঘন্য গর্বের স্বরূপ উন্মোচন করতে চাই।
কন্যাশিশু গর্ভে আসাকে নস্যাৎ করার অপকর্মের চমৎকার নাম হলো ‘পছন্দনীয়’ গর্ভপাত। পুত্রসন্তান পাওয়ার জন্য উপবাস, প্রার্থনা, মন্ত্র, পুরোহিতের পরামর্শÑ সব কিছুই করা হয়ে থাকে। কন্যা লাভের জন্য কোনো কিছুই করা হয় না। মনোভাবটা হলো, ‘ওই হতভাগিনীরা এমনিতেই যত জন্মাচ্ছে, সেটাই যথেষ্ট। ওদের আগমনের জন্য প্রার্থনা করার মতো বেকুব কেউ আছে নাকি?’
ভাইয়েরাই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। সাধারণত বোনেরা এর কিছু পায় না। আবেগ, পুষ্টি, শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কন্যার ওপর পুত্রের প্রাধান্য। কারণ ‘পুরুষ যে মূল্যবান।’ এই যে বৈষম্য, এ জন্য কিন্তু মা ও বাবা দু’জনই সমান দায়ী। গ্লাসভর্তি দুধ, বিদেশে পড়ার টাকা, বাড়িঘর এসব পায় পুত্রসন্তান। আর কন্যার জন্য যৌতুক ও ঠেলাধাক্কা। পুত্র সব ক্ষমতার মালিক, কন্যা তার দয়ার ওপর নির্ভরশীল।
কন্যার বিয়ে যেন একটা জুয়া খেলা। যদি স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির আচরণ ভালো হয়, মেয়েটা ভাগ্যবতী। তবে সে আচরণ মন্দ হলেও সে বাবার বাড়িতে ফিরতে পারবে না। ফিরলে তা হবে অবমাননাকর। ভারতে এখন কয়েক মিলিয়ন নারী ঘরের বাইরে কাজ করছেন। তবে তাদের অনেকেই যা আয় করেন, তা নিজেদের ও সন্তানদের জন্য পর্যাপ্ত নয়। আর কোনো নারী একা থাকলে সন্দেহের শিকার। এমনকি তাদের কাছে বাসাভাড়া দিতে মালিকেরা অস্বীকার করেন। তালাকের ক্ষেত্রে স্বামীর কাছ থেকে পাওনা আদায় তো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।
হ্যাঁ, এভাবেই চলছে। ভারতের বিশেষ করে হিন্দু সংস্কৃতি সেই কুখ্যাত মনুস্মৃতির যুগ থেকে নারীকে দেখে আসছে নিছক সম্পত্তি হিসেবে। মনে করা হয় না যে, নারীও একটি মানবিক সত্তা, যে নিজের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার রাখে। এত সমাজ সংস্কারক এলেন, গেলেন; তবুও এমন মনোভাব বদলায়নি ভারতে। নিজের দেহ ও মনের ওপর নারীর অধিকার নেই। তাদের হৃদয়, অন্তর, মস্তিষ্ক এমন এক সমাজ নিয়ন্ত্রণ করছে, যা চরম পিতৃতান্ত্রিক আর নারীবিদ্বেষী। এর প্রতিবাদ জানালে জবাব দেয়া হয় আরো ভণ্ডামি, আরো মিথ্যাচারের মাধ্যমে। মুখে বলা হয়, ‘অবস্থার উন্নতি হবে’ কিংবা ‘ব্যবস্থা নিতে সময় লাগবে’।
না, অবস্থার তো উন্নতি হচ্ছে না। আমরা নারী প্রধানমন্ত্রী, নারী প্রেসিডেন্ট এবং কয়েকজন নারী মুখ্যমন্ত্রী পেয়েছি। তবুও এত মিলিয়ন ভারতীয় নারীর ভাগ্য বাস্তবে বদলায়নি। আর এই সত্যও বদলে যায়নি যে, আমাদের দেশে ধর্ষণের শিকার যে নারী, সে লজ্জায় নীরব হয়ে যেতে হয়। কারণ ওই দুর্বৃত্ত নয়, নারীটিকেই ভারতের সমাজ এই অপরাধের জন্য দায়ী করে। এমনকি ওই নারীর পরিবার ও বন্ধুরাও তা করে থাকে। একই কারণে ভারতে ধর্ষণের বিপুল ঘটনা থেকে যায় অজানা। নারী অধিকারের একজন পুরুষ প্রবক্তা সম্প্রতি আমাকে বললেন, ভারতের কোটি কোটি মানুষের দৈনন্দিন আড্ডা-আলোচনায় ধর্ষণ ইস্যুটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। এটা নিয়ে হাসি-তামাশা ও মজা করা হয়। অথচ এটা নারীর জন্য নিদারুণ লজ্জা, নির্যাতন ও ট্র্যাজেডি। কেন নারী জন্ম নিল? তার অস্তিত্ব না থাকাই যেন ভালো ছিল।
একজন ভারতীয় নাগরিক আমাকে বললেন, ‘আমরা নারীকে সাহায্য করতে পারি কিভাবে?’ জবাব দিলাম, ‘প্রথমে আমাদের মিথ্যা বলা বন্ধ করা চাই।’ ভারত নারীকে ঘৃণা করে। এটাই সত্য, যতই কুৎসিত ও নগ্ন হোক কথাটা। ধর্ষিতাকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে ওর পায়ের কাছে ফুল নয়, এই সত্যটাকে রাখুন। বাজি ধরে বলতে পারি, সে এ কাজের প্রশংসা করবে। যদি সে বেঁচে যায়, আমরা তার কাছে ঋণী থাকব। যদি না বাঁচে, আমরা ঋণী থাকব নিজেদের কাছে। ঋণী থাকব নানা অপরাধের শিকার, অসংখ্য নারীর কাছে। এসব অপরাধ আমাদের মিথ্যাচারের অনিবার্য ও বিষাক্ত ফল। প্রথম দায়িত্বই হলো, সত্যকে স্বীকার করে নেয়া। সমস্যার স্বীকৃতি ছাড়া পরিস্থিতির পরিবর্তন শুরু হতে পারে না। তা হলেই আশা ও নিরাময়ের শুভ সূচনা সম্ভব। যদি এসব না হয়, তাহলে ধর্ষণের পরবর্তী ঘটনার অপেক্ষায় থাকুন। আমি নিশ্চিতÑ আরেকটি ধর্ষণ ঘটে গেছে ইতোমধ্যেই, ঠিক এই মুহূর্তে ভারতের কোথাও না কোথাও; আর তা হারিয়ে যাবে অজানা হিসেবে।
লেখক : ইনট্রেপিড রিপোর্ট-এর সহযোগী সম্পাদক
ভাষান্তর : মীযানুল করীম
No comments