মহাত্মা গান্ধীর সর্বোদয় চেতনা by এবনে গোলাম সামাদ
‘সর্বোদয়’ একটি বইয়ের নাম। ‘সর্বোদয়’ কথাটা গুজরাটি ভাষার। শব্দগত
অর্থে ‘সবার উন্নয়ন’। এই বইতে খুঁজে পাওয়া যায় মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধীর
সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক চিন্তা-চেতনার বিশেষ পরিচয়।
মোহন
দাস করমচাঁদ গান্ধী এ দেশের মানুষের কাছে সাধারণভাবে পরিচিতি পান মহাত্মা
গান্ধী হিসেবে। মহাত্মা গান্ধী তার ‘সর্বোদয়’ বইটি লিখেছেন ব্রিটিশ
দার্শনিক জন রাস্কিন (১৮১৯-১৯০০) লিখিত Unto this Last বই দ্বারা
অনুপ্রাণিত হয়ে। রাস্কিন ছিলেন বিলাতের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
সেখানে তিনি পড়েন চারুকলার ইতিহাস ও নন্দনতত্ত্ব। রাস্কিনের সময় বিলাতে
ঘটছিল কলকারখানার বিপ্লব (Industrial Revolution)। রাস্কিনের এটা পছন্দ ছিল
না। রাস্কিন তার Unto this Last বইতে কুটির শিল্প ও কৃষিনির্ভর অর্থনীতিকে
সমর্থন করেছেন। তিনি চেয়েছেন কুটির শিল্প ও কৃষিকর্মের উন্নতি বিধান করে
দেশের মানুষের দারিদ্র্য বিমোচন। মহাত্মা গান্ধী মনে করতেন বিরাট কলকারখানা
করতে যে পুঁজির প্রয়োজন, এ দেশের মানুষের তা নেই। অন্য দিকে, এই জনবহুল
উপমহাদেশে অধিকসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান করতে চাইলে বিরাট কলকারখানার
অর্থনীতি গড়ে তা সম্ভব হবে না। এ জন্য করতে হবে ক্ষুদ্র শিল্পের বিকাশ।
মহাত্মা গান্ধীর অনুসারীরা বলেন, কিছু বড় বড় কলকারখানা গড়া যেতে পারে
সরকারি উদ্যোগে। এসব কলকারখানা এমন সব যন্ত্রপাতি বানাবে, যা এ দেশের
দরিদ্ররা কিনতে পারবে স্বল্প পুঁজি দিয়ে এবং এসব যন্ত্রপাতি কাজে লাগিয়ে
তারা যা উৎপাদন করবে, তা বিক্রি করে সচ্ছল হওয়ার মতো আয় করতে সক্ষম হবে।
অন্য দিকে বড় বড় কলকারখানা সৃষ্টি করছে অতি উৎপাদনের সমস্যা। বড়
কলকারখানায় যা উৎপাদিত হচ্ছে, তা হয়ে দাঁড়াচ্ছে চাহিদার তুলনায় বেশি।
ফলে এসব কলকারখানায় উৎপাদিত দ্রব্য থাকছে অবিক্রীত হয়ে। জিনিসপত্র
অবিক্রীত থাকলে কারখানায় উৎপাদন স্থগিত করে রাখতে হচ্ছে। কারখানার উৎপাদন
বন্ধ করে রাখলে হাজার হাজার শ্রমিক হচ্ছে বেকার। দেখা দিচ্ছে ভয়াবহ
অর্থনৈতিক সঙ্কট। কৃষি ও কুটির শিল্পের অর্থনীতিতে এ রকম সঙ্কট সৃষ্টির
সম্ভাবনা থাকে না। যাকে বলে ব্যবসায় সঙ্কট অথবা বাণিজ্য মন্দা, অর্থনীতিতে
তার সূচনা হয়েছে শিল্প বিপ্লবের ফলে। শিল্প বিপ্লবের অর্থনীতিকে তাই
সাধারণভাবে গ্রহণ না করে কুটির শিল্প ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিকে অনুসরণ করাই
হবে শ্রেয়। যাকে সাধারণভাবে বলা হয় গান্ধীবাদী অর্থনীতি, তার লক্ষ্য হলো
বিকেন্দ্রিক ক্ষুদ্র শিল্প এবং কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক জীবন। গান্ধীজীর এই
চিন্তা-চেতনা মার্কসবাদীদের চিন্তা-চেতনা থেকে একেবারেই ভিন্ন। তারা চান
বিরাট কলকারখানা ও যৌথ খামার গড়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন। এসব কলকারখানা ও যৌথ
খামার গড়ার উদ্যোগ নেবে রাষ্ট্র। অন্য দিকে গান্ধীবাদীরা মনে করেন, এভাবে
রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কলকারখানা গড়তে হলে যে পুঁজির প্রয়োজন হবে, তা জোগাড়
করতে হবে জনসাধারণের ওপর কর বসিয়ে। এই কর প্রধানত হবে পরোক্ষ কর। বোঝা
শেষ পর্যন্ত বহন করতে হবে দরিদ্র জনসাধারণকেই। এতে মানুষের দারিদ্র্য
বাড়বে। ফলে দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব হবে না। কলকারখানার শ্রমজীবীদের বেতন
দিতে গিয়ে রাষ্ট্রের করতে হবে ঘাটতি ব্যয় (Deficit financing). যার
গোড়ার কথা হলো, রাষ্ট্র কর্তৃক নোট ছাপিয়ে ব্যয় করা। কিন্তু এটা করতে
গেলে হয়ে দাঁড়ায় এক ধরনের পরোক্ষ কর। ঘাটতি ব্যয়ের অর্থনীতি দারিদ্র্য
বিমোচন করে না, দারিদ্র্যের বিবর্ধন ঘটায় মাত্র। ১৯১৭ সালে ঘটে রুশ
বিপ্লব। কমিউনিস্টরা রাশিয়া ও তার সাথে যুক্ত আরো ১৪টি রিপাবলিকে গড়ে যৌথ
খামার। কিন্তু যৌথ খামারে যে খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়েছে, তা রাষ্ট্রীয়
কর্তৃপক্ষ নিয়ে গিয়ে সরবরাহ করেছে শহরের কলকারখানায় নিযুক্ত শ্রমিকদের।
ফলে গ্রামের মানুষ খেতে পায়নি। কৃষিজীবী মানুষকে থাকতে হয়েছে
অনাহারে-অর্ধাহারে। যতগুলো কারণে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়েছে, তার একটি
কারণ হলো কৃষি অর্থনীতিকে অবহেলা করে বিরাট কলকারখানার অর্থনীতিকে গড়ে
তোলার উদ্যোগ গ্রহণ। মার্কসবাদী অর্থনীতি আর গান্ধীবাদী অর্থনীতি, এ দুটোর
মধ্যে ফারাক যথেষ্ট। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর গান্ধীবাদী অর্থনীতিকে গ্রহণ
না করে চেয়েছে রাষ্ট্রিক কলকারখানার অর্থনীতি গড়তে। এ জন্য রাষ্ট্রকে
করতে হয়েছে প্রচুর ঘাটতি ব্যয়। বেড়েছে দ্রব্যমূল্য, আর সাধারণ মানুষের
ঘটতে পারেনি দারিদ্র্য বিমোচন। এসব হলো সাধারণভাবে ভারতে যারা এখনো নিজেদের
গান্ধীবাদী বলে দাবি করেন, তাদের বক্তব্য।
আমরা আমাদের দেশে চাচ্ছি
কলকারখানার বিপ্লব ঘটাতে। এর ফলে আমাদের দারিদ্র্য বিমোচন কতটা হবে, সেটা
নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ দারিদ্র্য বিমোচন করতে গেলে বাড়াতে হবে
কর্মসংস্থান। বাড়াতে হবে মাথাপিছু প্রকৃত আয়। যেটা হতে পারে বিকেন্দ্রিক
ক্ষুদ্র শিল্পনির্ভর অর্থনীতিকে গড়ে তুলতে পারার মধ্য দিয়ে, যা হবে মূলত
গ্রামনির্ভর। গ্রামে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলে বাড়বে খাদ্যশস্যের প্রকৃত
মূল্য। ফলে কৃষিজীবী মানুষও হতে পারবে সচ্ছল। গান্ধীজী কেবল অর্থনৈতিক
ব্যাপারেই চিন্তা করেননি। চিন্তা করেছেন, জীবনের নানা দিক নিয়েই। গান্ধীজী
মানুষকে যৌন জীবনে সংযত হতে বলেছেন। বলেছেন, জিতেন্দ্রিয় হতে। এ জন্য
অনেকে গান্ধীজীকে বলেছেন ‘সেকেলে’। বলেছেন, গান্ধীজী আধুনিক মনোবিজ্ঞান
সম্পর্কে একেবারেই অবগত নন। তার চিন্তা-চেতনা হলো সর্বতোভাবেই
বিজ্ঞানবিরোধী। তার কথামতো চলতে গেলে করতে হবে বিশেষভাবে যৌন অবদমন। তা
মানুষকে মানসিকভাবে করে তুলবে অসুস্থ। কিন্তু ভারত এখন হয়ে উঠেছে একটা
ক্ষতিকর, যৌন বিশৃঙ্খল দেশ, বিশেষ করে তার নগরজীবনে। ভারতের রাজধানী
দিল্লিতে এখন চলন্ত বাসে ঘটতে পারছে ভয়াবহ ধর্ষণের ঘটনা। এদিকে ১৯৭১ সালের
পর ভারত আমাদের কাছে হয়ে উঠেছে একটা আদর্শ দেশ। এ ক্ষেত্রে আমরাও যেন
চাচ্ছি ভারতকেই অনুসরণ করতে। মহাত্মা গান্ধী জন্মেছিলেন গুজরাটে। গুজরাটে
হিন্দু- মুসলমান দাঙ্গা প্রায়ই ঘটে। মহাত্মা গান্ধী চেয়েছেন
হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার অবসান। এ বিষয়ে তিনি ছিলেন খুবই আন্তরিক। ১৯৪৬
সালে তদানীন্তন অবিভক্ত বঙ্গের নোয়াখালী জেলায় শুরু হয় হিন্দু-মুসলিম
দাঙ্গা। গান্ধীজী ছুটে আসেন নোয়াখালীতে ৭ নভেম্বর। তিনি নোয়াখালী জেলার
বিভিন্ন স্থানে পদব্রজে ঘোরেন চার মাস ধরে। প্রধানত তার চেষ্টার ফলে
হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা থেমে যায়। এ সময় তার বয়স ছিল ৭৭ বছর। তিনি তার এই
বৃদ্ধ বয়সেও নোয়াখালী জেলার অনেক নদী পার হন দুই বা এক বাঁশের সাঁকোর
ওপর দিয়ে হেঁটে। এ সময় তিনি তার বক্তৃতায় কুরআন শরিফ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে
বলেছিলেন, ইসলাম ধর্মীয় জবরদস্তিতে বিশ্বাস করে না। মুসলমানদের ধর্মের
মর্মকথা আসলে অহিংসা। ইসলামের মর্মবাণী সহিংস রাজনীতির অনুকূল নয়। তিনি
ইসলামবিরোধী কোনো কথা একেবারেই উচ্চারণ করেননি। এ সময় তৎকালীন বাংলাদেশের
প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তিনি ব্যক্তি
গান্ধীজীকে করতেন গভীরভাবে শ্রদ্ধা। তিনি তার নিরাপত্তার সব ধরনের ব্যবস্থা
গ্রহণ করেছিলেন। তাই ঘটতে পারেনি গান্ধীজীর নিরাপত্তার কোনো অভাব।
গান্ধীজী পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেননি। কিন্তু পাকিস্তান হয়ে যাওয়ার
পর তিনি চেয়েছেন, ভারত-পাকিস্তান মৈত্রী। পাকিস্তান হওয়ার ঠিক পরপর ভারতে
বাঁধে ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। রাজধানী দিল্লির পথে মুসলিম মহিলাদের
বিবস্ত্র করে হাঁটতে বাধ্য করা হয়। করা হয় চূড়ান্ত অপমান। গান্ধীজী এসব
দেখে অনশন শুরু করেন এবং বলেন দাঙ্গা থামাতে। দিল্লিতে তিনি যখন করছিলেন
দাঙ্গা উপশমের জন্য একটি ধর্মসভায় প্রার্থনা অনুষ্ঠান; সে সময় উগ্র
হিন্দুত্ববাদী একজন যুবক তাকে গুলি করে। গান্ধীজী দিল্লিতে হলেন নিহত। সেটা
ছিল ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি। গান্ধীজী নোয়াখালীতে মারা যাননি, মারা
যাননি হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা উপশম করতে এসে। কিন্তু তিনি মারা যান ভারতের
রাজধানী দিল্লিতে। আর এ সময় স্বাধীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন
জওয়াহেরলাল নেহরু, যিনি মহাত্মা গান্ধীকে বলতেন বাপুজী। কিন্তু তিনি তার
বাপুজীকে রক্ষা করার জন্য করেননি কোনো ব্যবস্থা। এর ফলে ঘটতে পেরেছে
আততায়ীর গুলিতে গান্ধীজীর মৃত্যু। যে হিন্দু যুবক গান্ধীজীকে গুলি করে,
তার নাম ছিল নাথুরাম বিনায়ক গডসে। গডসেকে রিভলবারসহ জাপটে ধরেন একজন
মার্কিন সাংবাদিক, যিনি ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন। কোনো ভারতীয় পুলিশ নয়।
গান্ধীজীর মৃত্যু সেদিন সারা ভারতে সৃষ্টি করেছিল বিশেষ প্রতিক্রিয়া।
থেমেছিল ভয়াবহ দাঙ্গা, যা ভোলার নয়। আমি তখন স্কুলের ছাত্রজীবন শেষ করে
কলেজে উঠেছি। এই মৃত্যু আমার মনেও সৃষ্টি করেছিল গভীর প্রতিক্রিয়া, যার
একটি বিশেষ কারণও ছিল। আমি রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলাম না। কিন্তু আমার
সহোদরা ছিলেন রাজনীতির সাথে গভীরভাবে জড়িত। তিনি গান্ধীজীর ডাকে সাড়া
দিয়ে করেন অসহযোগ আন্দোলন। এই আন্দোলন করতে গিয়ে তাকে করতে হয় কারাবরণ।
সে যুগে মুসলিম পরিবারের একজন কন্যার পক্ষে এ রকম কারাবরণ ছিল খুবই বিরল
ঘটনা। গান্ধীবাদের একটা প্রভাব আমাদের পরিবারের ওপর ছিল। তাই ঘাতকের হাতে
তার মৃত্যু আমাকে বিশেষভাবে বিচলিত করেছিল। মহাত্মা গান্ধী রাজনীতি করতেন।
কিন্তু অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে তিনি ছিলেন অনেক ভিন্ন। তার ছিল
কঠোর নৈতিক জ্ঞান। তিনি চেয়েছেন নীতিচেতনাভিত্তিক রাজনীতি করতে। তিনি
অহিংস রাজনীতিতে আস্থাশীল ছিলেন। ব্র্রিটিশ শাসন অবসানের জন্য তিনি কোন
উগ্রপন্থা গ্রহণে আগ্রহী ছিলেন না। তার ডাকে সাড়া দিয়ে ব্রিটিশবিরোধী
রাজনীতি করতে গিয়ে জনতা, ভারতের বিহারে চৌরিচেরা নামক স্থানে থানায় আগুন
ধরায়। ফলে পুড়ে মরে কয়েকজন পুলিশ। গান্ধীজী এটা জানতে পেরে থামিয়ে দেন
তার আন্দোলন। তিনি বলেন, আন্দোলনে অগ্রসর হতে হবে অহিংস উপায়ে। হিংসার
আন্দোলনে তিনি আদৌ আস্থাশীল নন। বাংলা ভাষায় ‘হরতাল’ শব্দটি এসেছে গুজরাটি
ভাষা থেকে। মহাত্মা গান্ধী রাজনৈতিক আন্দোলনের কৌশল হিসেবে হরতালের
প্রবর্তন করেন। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, হরতাল হতে হবে শান্তিপূর্ণ। হরতালে
পিকেটিং করা চলবে। পিকেটিংয়ের লক্ষ্য হবে মানুষকে বুঝিয়ে হরতালে উদ্বুদ্ধ
করা; জোর করে মানুষকে হরতালে বাধ্য করা নয়। মহাত্মা গান্ধী আরো বলতেন, ঘন
ঘন হরতাল করা যাবে না। হরতাল করতে হবে অনেক ভেবেচিন্তে। এমন ইস্যুতে, যাতে
মানুষকে সহজে উদ্বুদ্ধ করা যাবে।’ তিনি ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও, এ রকম
মনোভাব হরতালের সময় অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন তার অনুসারীদের। আমাদের দেশে
এখন বলা হচ্ছে, ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে বেআইনি করতে। কিন্তু মহাত্মা গান্ধী
বলেছেন, রাজনীতি হতে হবে ধর্মভিত্তিক। কারণ ধর্ম মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করে
উৎসর্গের মনোভাব, যে মনোভাবকে বাদ দিয়ে মহৎ রাজনীতি হতে পারে না। ধর্মকে
বাদ দিয়ে মানুষ চাইতে পারে না পরার্থপর রাজনীতি করতে; চাইবে কেবল
আত্মস্বার্থেই রাজনীতি করতে। রাজনীতি হয়ে উঠবে কেবলই ক্ষমতার লড়াই। থাকবে
না সেখানে জনসেবার কোনো অনুপ্রেরণা। গান্ধীজী চান কংগ্রেসকে এক জনসেবামূলক
প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে। কিন্তু সেটা তার পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। মহাত্মা
গান্ধীর মৃত্যুর পর তার একজন ভাবশিষ্য আচার্য বিনোবা ভাবে বলেছিলেনÑ
‘রাজনীতি চাই না, চাই ‘লোকনীতি’। লোকনীতি বলতে তিনি বুঝিয়েছেন, দলবিহীন
গণতন্ত্রকে। কিন্তু বিনোবা ভাবের পক্ষে সম্ভব হয়নি ভারতে দলবিহীন গণতন্ত্র
প্রতিষ্ঠা করা। গান্ধীজী মনে করতেন মানবসমতা আনতে গেলে আনতে হবে মানুষে
মানুষে ক্ষমতার সমতা। রাষ্ট্র মানেই হলো, আমলা, পুলিশ, ফৌজ। ক্ষমতা চলে
যেতে চায় তাদেরই হাতে। তাই মানুষে মানুষে আসতে পারে না ক্ষমতার সমতা।
গান্ধীজী তাই চাননি রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সমাজজীবন। তিনি চেয়েছেন, স্বয়ংভর
গ্রামকেন্দ্রিক সমাজজীবন। হতে পারে, এটা একটা অবাস্তব জীবনদর্শন। কিন্তু
গান্ধীজী এ রকমই সমাজ জীবনদর্শন করেছিলেন পছন্দ। তার চিন্তা-চেতনা ছিল
কতকটা অ্যানার্কিস্টদেরই মতো। অ্যানার্কিস্টরা বলেনÑ রাষ্ট্রকেন্দ্রিক
সমাজজীবনে মানব সমতা আসতে পারে না। মাথাভারী শাসনব্যবস্থায় শাসনের সাথে
আসে শোষণ। তখন সমাজ শ্রেণীবিহীন না হয়ে হয়ে উঠতে চায় আরো বেশি শ্রেণী
বৈষম্যমূলক।
ভারতে বেশ কিছু মার্কসবাদী এক সময় মার্কসবাদ পরিত্যাগ
করে গ্রহণ করেন গান্ধীবাদ। যারা মার্কসবাদ ছেড়ে গান্ধীবাদ গ্রহণ করেন,
তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ। জয়প্রকাশ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছাত্রাবস্থায় মানবেন্দ্রনাথ রায়ের লেখা পড়ে
মার্কসবাদী হন। যোগ দেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কমিউনিস্ট পার্টিতে। তিনি
অন্য মার্কসবাদীদের মতো মনে করেছিলেন, মহাত্মা গান্ধী সমাজ বিপ্লবের
বিরোধী। তিনি শোষণ ও অসাম্যের সমাজ কাঠামোকেই জিইয়ে রাখতে চান। কিন্তু
দেশে ফিরে হয়ে ওঠেন গান্ধীবাদী। যে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের লেখা তাকে
মার্কসবাদে দীক্ষিত করেছিল, সেই মানবেন্দ্রনাথ রায়ও পরিত্যাগ করেন
মার্কসবাদ। তিনি গান্ধীবাদী না হলেও বলেছেন, স্থানীয় চাহিদা অনুসারে বেকার
সমস্যার সমাধান করার জন্য ক্ষুদ্র শিল্পের বিকাশ হওয়া উচিত। মানবেন্দ্র
রায়ও মনে করেন, কৃষিনির্ভর ভারতের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে হবে।
মানুষের অর্থনৈতিক উৎপাদনের লক্ষ্য হতে হবে ব্যবহারযোগ্য দ্রব্য উৎপাদন করে
মানুষের প্রাত্যহিক প্রয়োজন পূরণ। কৃষিতে উৎপাদন বাড়িয়ে করতে হবে
অন্নসংস্থান। এ উপমহাদেশের মানুষের যে অবস্থা, তাতে ব্যয়বহুল কৃষি
যন্ত্রপাতি ব্যবহার সহজসাধ্য নয়।’ অর্থাৎ তার বাস্তব বক্তব্য এসে যায়
প্রায় গান্ধীবাদেরই কাছাকাছি। তবে তিনি ধর্মের জায়গায় বলেন মানবতাবোধের
কথা। মানবতাবোধ তার কাছে হয়ে ওঠে কার্যত একটা ধর্মবিশ্বাসেরই মতো। তিনি
বলেন, স্রষ্টা আছে কী নেই, তা নিয়ে বিতর্ক করা চলে কিন্তু মানুষের
অস্তিত্বকে নিয়ে নয়। মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য মানুষের হতে হবে
পরস্পরের সহযোগী; গলা কাটা প্রতিযোগী নয়। প্রতিযোগিতার অর্থনীতি মানবসংহতি
প্রদান করতে পারে না। পারে কেবলই বিরোধিতা এনে দিতে। বাংলাভাষী একজন কবি
বলেনÑ
শুনো মানুষ ভাই
সবার ওপর মানুষ সত্য
স্রষ্টা আছে কি নাই।
মানুষ
আছে। মানুষের অস্তিত্ব মানুষের কাছে কোনো তর্কের বিষয় নয়। মানুষের
অস্তিত্বকে শ্রদ্ধা করতে হবে। সমবেতভাবে টিকিয়ে রাখতে হবে মানুষের
অস্তিত্ব। জটিল দার্শনিক বিতর্কের মধ্যে গিয়ে আমরা কোনোভাবেই লাভবান হতে
পারব না।
মহাত্মা গান্ধী তার জীবনের একপর্যায়ে হয়ে ওঠেন বিখ্যাত
রুশ সাহিত্যিক লেভ তলস্তয়ের (১৮২৮-১৯১০) ভক্ত। শেষ জীবনে তলস্তয় বলেনÑ
মানুষের সমাজকে হতে হবে এমন, যেখানে আইন নয়, ভালোবাসা সমাজজীবনকে শাসন
করবে। মহাত্মা গান্ধী তলস্তয়কে একটি চিঠি লিখেন। এতে তিনি বলেনÑ আমি আপনার
ভাবশিষ্য হয়ে উঠেছি। মহাত্মা গান্ধীর চিঠির পর তলস্তয় বেশি দিন
বাঁচেননি। তলস্তয় কোনো কারণে তার গৃহ ত্যাগ করে বেরিয়ে যান। আর ঘরে
ফেরেননি। মারা যান রাশিয়ার একটি খুব ছোট রেলস্টেশনে, শীতে অনাহারে। এ সময়
তার ওভারকোটের পকেটে পাওয়া যায় একটিমাত্র গ্রন্থ। সেটি হলো, স্যার
আবদুল্লাহ আল মামুন আল সোহরাওয়ার্দীর সঙ্কলিত হাদিস গ্রন্থ। যার নাম The
Sayings of Muhammad. বলা হয়, তলস্তয় শেষ বয়সে ইসলামি চিন্তা-চেতনার
দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। শোনা যায়, স্যার আবদুল্লাহ আল মামুন আল
সোহরাওয়ার্দী সঙ্কলিত হাদিস মহাত্মা গান্ধীরও হতে পেরেছিল যথেষ্ট প্রিয়।
সে যাহোক, গান্ধীজী কখনো ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে কোনো বিরূপ মন্তব্য করেননি।
গুজরাটে জন্মেছিলেন স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী (১৮২৫-১৮৮৮)। তিনি গড়েন আর্য
সমাজ; যা ছিল ঘোর মুসলিমবিরোধী। তিনি বলেন, মুসলমানেরা বিধর্মী এবং বিদেশ
থেকে আগত। তাদের এই উপমহাদেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে।’ কিন্তু গান্ধীজী
ছিলেন মানব সমতাবাদী। তিনি হিন্দুধর্মের বর্ণব্যবস্থাকে সমর্থন করেননি।
চেয়েছেন অস্পৃশ্যতার অবসান। তিনি নি¤œবর্ণের হিন্দুদের আখ্যা দেন হরিজন।
হিন্দিতে হরিজন নামে প্রকাশ করেন পত্রিকা। তিনি তার একটি লেখায় বলেছেনÑ
বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বাংশ হলো মুসলিমপ্রধান। তিনি অভিমত দেন যে, ‘ইতিহাস
পাঠে জানা যায়, যাহারা অনেক দিন ঈমানদার (বিশ্বাসী) মুসলমানরূপে ভারতে
বাস করিতেছে, তাহাদের অধিকাংশই পূর্বে হিন্দু ছিল। এসলামের ভিতর তাহারা যে
ভ্রাতৃত্বের সন্ধান পাইয়াছিল, হিন্দু থাকিতে তাহারা তাহা কখনো পায় নাই।’
গান্ধীজী এ কথা বলেছিলেন ১৯২৪ সালে (অস্পৃশ্যের মুক্তি; শ্রী বিনয়কৃষ্ণ
সেন সঙ্কলিত, পৃষ্ঠা-১১৭। অভয় আশ্রম, কলকাতা; পৌষ-১৩৩২ বঙ্গাব্দ)।
গান্ধীজীর অভিমতের সাথে অনেকে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। কারণ ভারতের অনেক
অঞ্চলেই ছিল অস্পৃশ্য হিন্দু অধ্যুষিত। কিন্তু তারা ইসলাম গ্রহণ করেনি।
বাংলাদেশে অস্পৃশ্যরা কেন দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে গেল তার ব্যাখ্যা
গান্ধীজীর ধারণা দিয়ে সম্ভব নয়। গোটা দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ অস্পৃশ্য
হিন্দু এখনো ইসলাম গ্রহণের কোনো প্রয়োজনীয়তা দেখছে না। বাংলাদেশকে ধরতে
হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দেশ। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে দলে দলে বৌদ্ধরা
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে ইসলাম গ্রহণ করেছে। হতে পারে বাংলাদেশেও ঘটেছিল
অনুরূপ ঘটনা। হিন্দুরা নয়, বৌদ্ধদের ইসলাম গ্রহণই বাড়িয়েছে মুসলমানের
সংখ্যা। যে অঞ্চল নিয়ে এখন পাকিস্তান গঠিত, সেই অঞ্চলেও এক সময় ছিল
বৌদ্ধদের বাস। তারা গ্রহণ করেছিলেন ইসলাম। আর এই দুই মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল
নিয়েই গঠিত হতে পেরেছিল সাবেক পাকিস্তান রাষ্ট্র। গান্ধীজী পাকিস্তান
প্রতিষ্ঠার পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর
বিশেষভাবেই চেয়েছেন পাক-ভারত মৈত্রী।
১৯৭১ সালে ভারতের
প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্তান)
রাজনীতিতে পালন করেন বিশেষ ভূমিকা। আমাদের দেশের অনেকের ধারণা, ইন্দিরা
গান্ধী মহাত্মা গান্ধীর সাথে রক্তের সম্পর্কে গ্রথিত। কিন্তু এই ধারণার
কোনো ভিত্তি নেই। ইন্দিরা গান্ধীর পৈতৃক নাম ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী। তার
বিয়ে হয় ফিরোজ গান্ধীর সাথে। সেই থেকেই তার নামের সাথে যুক্ত হয় গান্ধী
পদবি। ফিরোজ গান্ধী হিন্দু ছিলেন না। তিনি ছিলেন পার্সিক (অগ্নি পূজারি)।
ইন্দিরা গান্ধীর সাথে পরে ফিরোজ গান্ধীর বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। কিন্তু
ইন্দিরার নামের সাথে থেকে যায় ‘গান্ধী’ পদবি। ইন্দিরা গান্ধীর পিতা পণ্ডিত
জওয়াহেরলাল নেহরু নিজেকে দাবি করতেন গান্ধীবাদী হিসেবে। কিন্তু তিনি
ছিলেন ব্রিটিশ ফেবিয়ান (Fabian) চিন্তা-চেতনার দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত।
তাকে আসলে চিহ্নিত করতে হয় ফেবিয়ান সোস্যালিস্ট হিসেবে। তিনি চেয়েছেন,
কেন্দ্রীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রিক পরিকল্পনামূলক অর্থনীতি। তিনি চাননি
মহাত্মা গান্ধীর মতো বিকেন্দ্রিক ক্ষুদ্র শিল্পের সমাজ গঠন করতে। আজকের
ভারত গান্ধীবাদী নয়। পণ্ডিত নেহেরুর মতো ফেবিয়ান সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার
দ্বারাও অনুপ্রাণিত নয় ভারত। আজকের ভারত অনুসরণ করতে চাচ্ছে ইউরো-মার্কিন
মুক্তবাজার অর্থনীতিকে। তাই আজকের ভারত কোনোভাবেই মহাত্মা গান্ধীর অনুসারক
নয়।
(বিশেষ দ্রষ্টব্য : এই রচনাটি মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে রচিত)
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
No comments