কারণ একই- গার্মেন্টসে শ্রমিক মারা যাচ্ছে by ফিরোজ মান্না
নব্বই দশক থেকে গার্মেন্টস সেক্টরে একের পর এক অগ্নিকাণ্ড ও ভবন ধসের মতো ঘটনা ঘটতে শুরম্ন করেছে। এতে ৫ শ'র বেশি শ্রমিক নিহত হয়েছে। আহত শ্রমিকের সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
নিহত-আহত কোন শ্রমিকই সরকার ও মালিক পৰের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ পায়নি। ৰতিপূরণ পেলেও তার পরিমাণ উল্লেখ করার মতো ছিল না। একটা ঘটনা ঘটলে সরকার ও মালিক পৰ ঘটা করে তদন্ত কমিটি গঠন করে দেয়। কিন্তু কোন তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি। রিপোর্ট প্রকাশ হলেও যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি। এ কারণে গার্মেন্টস মালিক পৰ শ্রমিকদের কাজের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি না করেই কারখানায় উৎপাদন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কাজের পরিবেশের ব্যাপারে শ্রমিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন সময় আন্দোলন-সংগ্রাম করলেও মালিক পৰ কখনই কর্ণপাত করেনি। মালিকদের কাছ থেকে লাভবান হয়ে কলকারখানা, অধিদফতর থেকেও গার্মেন্টসগুলো পরিদর্শন করা হয় না। ফলে দুর্ঘটনা ঘটলেও মালিকদের তেমন কোন অসুবিধায় পড়তে হয়নি।গার্মেন্টস শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ হলে তাঁরা বলেন, শ্রমিকদের মানুষ মনে না করে জীবজন্তু ভাবাই হচ্ছে মালিকদের মানসিকতা। শ্রমিকরা দরিদ্র পরিবার থেকে আসে বলে তাদের মানুষ ভাবার দরকার মনে করে না মালিকরা। গাজীপুরে গরিব এ্যান্ড গরিব সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে আগুনে পুড়ে ২১ শ্রমিকের মৃতু্যর ঘটনার প্রতিবাদে সংগঠনগুলো শুক্রবার ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে মিছিল সমাবেশ করেছে। গাজীপুরের ঘটনায় গার্মেন্টস শ্রমিক সংগঠনগুলো ৰোভে ফেটে পড়ছে। তারা এ ঘটনায় দায়ীদের দৃষ্টানত্মমূলক শাসত্মি দাবি করেছে। একই সঙ্গে নিহত-আহত শ্রমিকদের সম্মানজনক ৰতিপূরণ চেয়েছে। তা না হলে বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দেয়া হবে বলে তারা জানিয়েছে। গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মাশরেফা মিশু জনকণ্ঠকে জানান, ৯০ দশক থেকে গার্মেন্টসে আগুন এবং ভবন ধসের কারণে ৫ শ'র বেশি শ্রমিক নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে কয়েক হাজার। নিহত-আহত কাউকে সরকার ও মালিক পৰ থেকে কোন ৰতিপূরণ দেয়া হয়নি। শুধু আশ্বাস দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রামে গার্মেন্টসে আগুনে পুড়ে শতাধিক শ্রমিকের মৃতু্য ঘটে। আগুনের শুরম্নটা হয়েছিল মীরপুরের সারাকা গার্মেন্টস দিয়ে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরসহ বেশ কয়েকটি গার্মেন্টস শিল্প এলাকায় কম করে হলেও ২০টি অগি্নকা-ের ঘটনা ঘটেছে। সাভারের স্পেক্ট্ররা এবং ঢাকার তেজগাঁও শিল্প এলাকায় ফিনিক্স গার্মেন্টস ধসে শতাধিক শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটেছিল। কিনত্ম কোন দুর্ঘটনার শিকার শ্রমিক পরিবার ৰতিপূরণ পায়নি।
এদিকে, গরিব এ্যান্ড গরিব সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে যখন আগুন লাগে তখন ধোঁয়া বের হওয়ার পথ না থাকা প্রাণহানির মূল কারণ বলে জানিয়েছে প্রত্যদর্শীরা। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বেশির ভাগ মৃতদেহ আগুনে জ্বলসে যায়। এ থেকে ধারণা করা হচ্ছে ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে তাদের মৃতু্য হয়েছে। আগুনের ঘটনাটি ঘটে দোতলায়। কিন্তু বেশির ভাগ শ্রমিক মারা গেছে তিনতলার। দোতলার আগুনে উপর তলায় ধেঁাঁয়া আচ্ছন্ন হয়ে যায়। ধোঁয়া বের হওয়ার জায়গা না থাকায় শ্রমিকরা দম আটকে মারা যায়।
গরিব এ্যান্ড গরিব সোয়েটার কারখানায় আগুনে এ্যাক্রলিক পুড়ে বিষাক্ত ধোঁয়া উৎপন্ন হওয়ায় শ্বাসরোধে এত বেশি মৃতু্য হয়েছে বলে জনকণ্ঠকে জানান, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু নাঈম মোঃ শাহিদুউলস্নাহ। গরিব এ্যান্ড গরিব সোয়েটার কারখানার আগুনের ঘটনাটি মোহাম্মদপুরে জাপান গার্ডেন সিটির ঘটনার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। কারণ আগুনের ধর্ম হচ্ছে যখন কোথাও আগুন লাগে তখন উপরের দিকে বিষাক্ত কার্বন মনো-অক্সসাইড গ্যাস উঠতে থাকে। এই গ্যাসে মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে এক সময় মারা যায়। ভবনে আগুন লাগলে ভবনের সিঁড়ি দিয়ে ধোঁয়া উপরের দিকে উঠে। তাই আগুন লাগলে উপরের দিকে না উঠে নিচের দিকে নেমে আসা বুদ্ধিমানের কাজ। এ দিকে মানুষকে সচেতন করতে হবে। তাছাড়া প্রতি বহুতল ভবনে একটি তলা ফ্রি রাখতে হবে যেন আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ সেখানে আশ্রয় নিতে পারেন। বিল্ডিং কোড এবং ইমারত নির্মাণ বিধিমালা মেনে ভবন নির্মাণ না করার কারণেই বার বার আগুনে ব্যাপক জানমালের ৰ্য়ৰতি হচ্ছে। এখান থেকে মুক্তি পেতে হলে আইন মেনে সব কিছু করতে হবে। একই সঙ্গে মানুষকে সচেতন হতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, জাপান গার্ডেন সিটির পস্ন্যান পাস হয়েছে কুপরিকল্পিতভাবে। এটা অপরিকল্পিত না বলাই ভাল হবে। সুপরিকল্পিতভাবে নগরায়ন না হলে ঢাকা বসবাসের উপযোগী থাকবে না। সুপরিকল্পিত নগর গড়ার জন্য কঠোর আইন আছে। বিল্ডিং কোড ও আবাসিক ভবন নির্মাণের ৰেত্রে বিধিমালা রয়েছে। এই বিধিমালা ও বিল্ডিং কোড মেনে চলতে হবে। শুধু জাপান গার্ডেন সিটিই নয়, ঢাকার অনেক বহুতল ভবনই ঝঁকিপূর্ণ। যে কোন সময় জাপান গার্ডেন সিটির মতো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। জাপান গার্ডেন সিটির পস্ন্যান যথানিয়মে পাস হয়নি। প্রভাব খাটিয়ে জাপান গার্ডেন সিটির পস্ন্যান পাস করা হয়েছে। গরিব এ্যান্ড গরিব গার্মেন্টস ভবনও অপরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই কারখানার অনুমোদন বাতিল করার দাবি উঠেছে। গাজীপুর সদরের ভোগড়া এলাকায় ওই সোয়েটার কারখানায় বৃহস্পতিবার রাতে অগি্নকা-ে ২১ শ্রমিক প্রাণ হারায়, যার মধ্যে ১৬ জনই নারী। সাততলা ওই ভবনের দ্বিতীয় তলায় আগুন লাগে। আগুন লাগার পরপরই মেন সুইচ বন্ধ করে দিলে পুরো কারখানায় বিদু্যত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। অন্ধকারের মধ্যে কালো ধোঁয়ায় চোখ খুলে রাখা যায়নি। তিনতলা থেকে নিচে নামার মূল পথটি তখন বন্ধ থাকায় অনেকেই নামতে পারেনি। জরম্নরী নির্গমন পথের পাশেই দোতলায় জ্বলছিল আগুন। ফলে সেদিক দিয়ে বের হওয়ারও উপায় ছিল না।
গরিব এ্যান্ড গরিব সোয়েটার কারখানার পরিচালক চৌধুরী কুদরত এলাহী জানান, আগুন লাগার সময় কারখানায় ৩২ শ্রমিক কাজ করছিলেন, যার মধ্যে ১৭ নারী। কয়েক শ্রমিক আগুন নেভানোর জন্য তিনতলায় গিয়ে আটকা পড়ে যায়। আর সাত তলার নারী কর্মীরা আতঙ্কে বেসামাল হয়ে পড়ে। এতে হুড়োহুড়িতে আরও কয়েক শ্রমিক মারা গেছে।
এদিকে শ্রমিকদের অভিযোগ, তিনতলা থেকে জরম্নরী নির্গমনের সিঁড়ি বেয়ে সাততলায় উঠতে চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলার জরম্নরী নির্গমন পথের দরজায় তালা ছিল। তবে সাততলা ও তিন তলার জরম্নরী নির্গমন পথ খোলা ছিল। সোয়েটার ফ্যাক্টরিগুলোতে অ্যাক্রেলিক কেমিক্যাল উপাদান থাকে প্রচুর পরিমাণে, এগুলো পুড়লে মারাত্মক টঙ্কি (বিষাক্ত) ধোঁয়া উৎপন্ন হয়। এই ধোঁয়া অন্য যে কোন ধোঁয়ার চেয়ে বিষাক্ত। কারখানাগুলোতে তাপ ও ধোঁয়া বের হওয়ার পর্যাপ্ত পথ থাকে না। এক সময় পুরো ভবনটি বিষাক্ত গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয়ে এত মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।
এ ঘটনার জন্য কারখানা মালিকদের উদাসীনতাকে দায়ী করা হয়েছে। গরিব মানুষদের জীবন নিয়ে ফ্যাক্টরি মালিকদের আকাশচুম্বী নেগলিজেন্সি রয়েছে। তারা ফায়ার প্রটেকশন ব্যবস্থা কার্যকর রাখে না। আগুন লাগলে কি করতে হবে তা শেখানো হয় না। গরিব এ্যান্ড গরিব কারখানায় আগুনে ঝলসে ২১ শ্রমিকের মৃতু্যতে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন নানা কর্মসূচী পালন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে, বিল্পবী নারী সংহতি, সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন, গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি, গণসংহতি আন্দোলন, জাতীয় শ্রমিক লীগ, গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, বাংলাদেশ মানবাধিকার বাসত্মবায়ন সংস্থা, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন (টাফ)।
অন্যদিকে, গরিব এ্যান্ড গরিব সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে আগুনে মৃত ২১ শ্রমিকের মৃতু্যতে গভীর শোক প্রকাশ করেছে তৈরি পোশাক শিল্পের সংগঠন বিজিএমইএ। বিজিএমইএর পৰ থেকে জানানো হয় অগি্নকা-ের ঘটনায় আহত শ্রমিকদের চিকিৎসা প্রদানে সবের্াচ্চ ব্যবস্থা নেয়া এবং নিহত প্রত্যেক পরিবারকে ২ লাখ টাকা করে দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। এছাড়া নিহতের পরিবারের সদস্যদের পোশাক শিল্পে চাকরির ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। অগি্নকা-ের কারণ অনুসন্ধানে বিজিএমইএ পৰ থেকে সাবেক সহসভাপতি এবং বর্তমান পরিচালক আতিকুলস্না ইসলামকে প্রধান করে ৬ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি আগামী তিন দিনের মধ্যে রিপোর্ট পেশ করবে। এছাড়া তিন দিনের শোক পালনের কর্মসূচী ঘোষণা করেছে বিজিএমইএ। প্রত্যেক কারখানায় কালো পতাকা উত্তোলন করার অনুরোধ জানানো হয়।
এদিকে, সরকারের পৰ থেকে শ্রমমন্ত্রী খন্দকার ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন শোক প্রকাশ করেছে। মন্ত্রণালয় ওই কারখানায় কিভাবে আগুন লেগেছে তা তদনত্ম করার কথাও জানিয়েছে। তদনত্মে দোষী প্রমাণিত হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে, গরিব এ্যান্ড গরিব কোম্পানির পৰ থেকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হক ভুইয়া শ্রমিকদের মৃতু্যতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
No comments