ক্যানসার- পথের শেষে জীবনই পেতে চায় লীনা by ফারুক ওয়াসিফ
মৃত্যুরও পথ আছে। সেই পথটা কি ঢালু? মাধ্যাকর্ষণের মতো সেই ঢালু পথ মৃত্যুর দিকে অপ্রতিরোধ্যভাবে টানতেই থাকে? সজ্ঞানে সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করেও কোনোভাবেই সেই টান ছুটানো যায় না? বন্ধু নাহিদ জাহান লীনা সেই পথ দিয়ে বহুদিন হলো গড়াচ্ছে। গড়াচ্ছে তো গড়াচ্ছেই।
সবকিছু দিয়ে সেই মৃত্যুর ঢালে ঢলে পড়ে যাওয়া ঠেকাতে ঠেকাতে রক্তাক্ত হচ্ছে, যন্ত্রণার দিনরাত্রি পোহাচ্ছে, মনের সবটুকু জোর একত্র করে উঠে দাঁড়াতে চাইছে...তবু তার গড়িয়ে নামা থামানো যাবে কি? ক্যানসার কি এত বড় পরাশক্তি, যাকে হারানো যাবে না?
লীনা সংগ্রামী মানুষ। নিজে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পর গঠন করেছিল ‘অপরাজিত’ সংগঠন। ক্যানসারে আক্রান্তদের মনোবল জিইয়ে রাখা, পরামর্শ দেওয়া, চিকিৎসার প্রশ্নটিকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করার জন্য কাজ করে গেছে যত দিন পেরেছে। বয়স কতই-বা, ৩৫ বছর তো তরুণেরই বয়স। আরও নবীন তারুণ্যে সে অন্যের জন্য সংগ্রাম করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ন, সন্ত্রাস ও বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। মঙ্গা, বন্যা বা শীতে দুর্গত মানুষের জন্য সাহায্য জড়ো করেছে। আজ তাকে এর সবকিছু ছেড়ে জড়ো করতে হচ্ছে নিজের মনোবল। অসুখটার শুরুতে হাতের ঝাপটা দিয়ে বলত, ‘ক্যানসার হয়েছে তো কী? আমি অন্য সব সারভাইভারকে খুঁজে বের করছি। সবার জন্য অনেক কাজ করতে হবে।’ স্তন ক্যানসারের বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য সংসদ ভবনের সামনে শোভাযাত্রা হবে। লীনা তার অসুস্থ শরীর নিয়েও সেখানে উপস্থিত। নতুন কেউ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছে, তাকে কোথায় যেতে হবে, কী চিকিৎসা নিতে হবে—সব পরামর্শ দিতে লীনা হাজির। যেন লীনা হার মানতে জানে না। ক্যানসার যেন সত্যিই পরাজিত হবে লীনার কাছে। আমরা ভেবে নিয়েছি, জিতবে লীনা। ওর জয় আরও অনেকের ভরসা হবে। কিন্তু কে জানত, এত দীর্ঘ ও কঠিন হবে সেই সংগ্রাম?
চিকিৎসকের নিষেধ, ভারী কিছু তুলবেন না। চার বছরের মেয়ে আনা কি তা বোঝে? চোখে পানি নিয়ে লীনা বলে, ‘আনাকে একটু কোলে নিতে পারি না। মেয়েটা ছটফট করে।’ ছোট্ট মেয়ে আনার জন্য আরও কয়েকটি বছর বাঁচার ইচ্ছা কি খুব বেশি কিছু? ২০০৯ সালের অক্টোবর থেকে এই ইচ্ছায় স্তন ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু। যুদ্ধের ময়দানে যতক্ষণ তুমি দাঁড়িয়ে আছ, ততক্ষণ তুমি পরাজিত নও। লীনা দাঁড়িয়ে ছিল, ক্যানসারে আক্রান্ত বুকের এক পাশ কেটে ফেলতে হয়েছে। তবু সে আশাবাদী। পায়ের হাড়ে নতুন গজানো ক্যানসারের সার্জারি করিয়েছে, তবু সে আশাবাদী। প্রায় নির্মূল হওয়া ক্যানসার যখন আবার ফিরে এল, তখনো সন্তানের মুখ তাকে আশাবাদী করে তুলেছিল। দুই-দুটি বড় সার্জারি, অজস্র টেস্ট, টানা চার বছর ধরে কেমোথেরাপি, চাকরি ছেড়ে আয়ুর ঝুঁটি ধরে মৃত্যুপথযাত্রাকে জীবনযাত্রায় পরিণত করার জেদ।
কিন্তু এখন আমি জানি না, ওর সেই জেদ, সেই আশার শক্তির কতটুকু অবশিষ্ট আছে। স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে নেওয়া হয়েছে তাকে। কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু জানাতে হলে কাগজে লিখে জানায়। ওর স্বামী এনটিভির সাংবাদিক পলাশ একরকম জোর করেই হাসপাতালে এনেছে ওকে। পলাশও জানে, লীনাও জানে যে বাঁচানো সম্ভব, বাঁচা সম্ভব। কিন্তু যখন জীবনের অপর নাম হয়ে ওঠে টাকা, তখন সব সম্ভাবনার শিকড় শুকিয়ে যেতে চায়। কেবল অর্থের কাছে পরাজয়ের কোনো সান্ত্বনা নেই।
একুশে টিভির প্রথম যুগের সাংবাদিক ছিল লীনা। পরে কাজ করেছে সিএসবিতে, এনটিভিতে। লীনারা সঞ্চয় বা সম্পত্তিহীন মধ্যবিত্ত। সেসব শেষ করে করে আজ অর্থের অভাবে অর্থহীন হয়ে পড়ছে সবকিছু।
জানি, অজস্র মানুষ এভাবে লড়াই করছে। অর্থের অভাবে বিনা চিকিৎসায় হাজারো-লাখো জীবন অকালে ঝরে যাচ্ছে। খাদ্যের ভেজাল, চিকিৎসার ভুল, পরিবেশের দূষণ আর মুনাফাকেন্দ্রিক ব্যবসার খেসারত দিচ্ছে মানুষ। যত ব্যাধি তত বাণিজ্য আর তত প্রতারণা। সমষ্টির ভোগান্তির ব্যক্তিগত প্রতিকারের দায় তবু বিপদ যার, তার একারই। এই তো সরকারব্যবস্থা, জীবনব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নির্দেশ। অনেকের জন্য পারিনি, কিন্তু এত কাছের, এত মূল্যবান একটি জীবনের জন্য স্বার্থপর হতে রাজি আছি। বলতে রাজি আছি, কেউ আছেন? আমাদের পাশে দাঁড়ান। লীনা-পলাশের বুকের ধন আনার পাশে দাঁড়ান, ওর দিকে তাকান। লীনাকে সিঙ্গাপুরে নিতে হবে, ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা প্রয়োজন। সরকার যে দায়িত্ব নেয় না, সেই দায়িত্বের কিছুটা কি আপনি নেবেন?
সময় চলে যাচ্ছে, আর সংক্ষিপ্ত ও যন্ত্রণাকর হয়ে উঠছে লীনার জীবনযাত্রা। আসুন, লীনার পাশে দাঁড়াই। ও এত দিন অন্যের দায়িত্ব নিয়েছে। এখন ওর দায়িত্বটা শুধু নয়, ক্যানসারের মতো নিরাময়যোগ্য রোগে কেউ যাতে অসহায় বোধ না করে, সেই দায়িত্ব নেওয়ার দায়ও লীনা আমাদের ওপর তুলে দিয়েছে। এটুকু কি আমরা পারব না?
সাহায্য পাঠাবার ঠিকানা: স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, অ্যাকাউন্ট নাম: নাহিদ জাহান, অ্যাকাউন্ট নম্বর: ১৮৩৪১১০৪৪০১, সুইফট কোড: SCBLBDDX। পলাশের মোবাইল নম্বর: +৮৮০১৭১৩২২৯২০৭।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
farukwasif@yahoo.com
লীনা সংগ্রামী মানুষ। নিজে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পর গঠন করেছিল ‘অপরাজিত’ সংগঠন। ক্যানসারে আক্রান্তদের মনোবল জিইয়ে রাখা, পরামর্শ দেওয়া, চিকিৎসার প্রশ্নটিকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করার জন্য কাজ করে গেছে যত দিন পেরেছে। বয়স কতই-বা, ৩৫ বছর তো তরুণেরই বয়স। আরও নবীন তারুণ্যে সে অন্যের জন্য সংগ্রাম করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ন, সন্ত্রাস ও বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। মঙ্গা, বন্যা বা শীতে দুর্গত মানুষের জন্য সাহায্য জড়ো করেছে। আজ তাকে এর সবকিছু ছেড়ে জড়ো করতে হচ্ছে নিজের মনোবল। অসুখটার শুরুতে হাতের ঝাপটা দিয়ে বলত, ‘ক্যানসার হয়েছে তো কী? আমি অন্য সব সারভাইভারকে খুঁজে বের করছি। সবার জন্য অনেক কাজ করতে হবে।’ স্তন ক্যানসারের বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য সংসদ ভবনের সামনে শোভাযাত্রা হবে। লীনা তার অসুস্থ শরীর নিয়েও সেখানে উপস্থিত। নতুন কেউ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছে, তাকে কোথায় যেতে হবে, কী চিকিৎসা নিতে হবে—সব পরামর্শ দিতে লীনা হাজির। যেন লীনা হার মানতে জানে না। ক্যানসার যেন সত্যিই পরাজিত হবে লীনার কাছে। আমরা ভেবে নিয়েছি, জিতবে লীনা। ওর জয় আরও অনেকের ভরসা হবে। কিন্তু কে জানত, এত দীর্ঘ ও কঠিন হবে সেই সংগ্রাম?
চিকিৎসকের নিষেধ, ভারী কিছু তুলবেন না। চার বছরের মেয়ে আনা কি তা বোঝে? চোখে পানি নিয়ে লীনা বলে, ‘আনাকে একটু কোলে নিতে পারি না। মেয়েটা ছটফট করে।’ ছোট্ট মেয়ে আনার জন্য আরও কয়েকটি বছর বাঁচার ইচ্ছা কি খুব বেশি কিছু? ২০০৯ সালের অক্টোবর থেকে এই ইচ্ছায় স্তন ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু। যুদ্ধের ময়দানে যতক্ষণ তুমি দাঁড়িয়ে আছ, ততক্ষণ তুমি পরাজিত নও। লীনা দাঁড়িয়ে ছিল, ক্যানসারে আক্রান্ত বুকের এক পাশ কেটে ফেলতে হয়েছে। তবু সে আশাবাদী। পায়ের হাড়ে নতুন গজানো ক্যানসারের সার্জারি করিয়েছে, তবু সে আশাবাদী। প্রায় নির্মূল হওয়া ক্যানসার যখন আবার ফিরে এল, তখনো সন্তানের মুখ তাকে আশাবাদী করে তুলেছিল। দুই-দুটি বড় সার্জারি, অজস্র টেস্ট, টানা চার বছর ধরে কেমোথেরাপি, চাকরি ছেড়ে আয়ুর ঝুঁটি ধরে মৃত্যুপথযাত্রাকে জীবনযাত্রায় পরিণত করার জেদ।
কিন্তু এখন আমি জানি না, ওর সেই জেদ, সেই আশার শক্তির কতটুকু অবশিষ্ট আছে। স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে নেওয়া হয়েছে তাকে। কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু জানাতে হলে কাগজে লিখে জানায়। ওর স্বামী এনটিভির সাংবাদিক পলাশ একরকম জোর করেই হাসপাতালে এনেছে ওকে। পলাশও জানে, লীনাও জানে যে বাঁচানো সম্ভব, বাঁচা সম্ভব। কিন্তু যখন জীবনের অপর নাম হয়ে ওঠে টাকা, তখন সব সম্ভাবনার শিকড় শুকিয়ে যেতে চায়। কেবল অর্থের কাছে পরাজয়ের কোনো সান্ত্বনা নেই।
একুশে টিভির প্রথম যুগের সাংবাদিক ছিল লীনা। পরে কাজ করেছে সিএসবিতে, এনটিভিতে। লীনারা সঞ্চয় বা সম্পত্তিহীন মধ্যবিত্ত। সেসব শেষ করে করে আজ অর্থের অভাবে অর্থহীন হয়ে পড়ছে সবকিছু।
জানি, অজস্র মানুষ এভাবে লড়াই করছে। অর্থের অভাবে বিনা চিকিৎসায় হাজারো-লাখো জীবন অকালে ঝরে যাচ্ছে। খাদ্যের ভেজাল, চিকিৎসার ভুল, পরিবেশের দূষণ আর মুনাফাকেন্দ্রিক ব্যবসার খেসারত দিচ্ছে মানুষ। যত ব্যাধি তত বাণিজ্য আর তত প্রতারণা। সমষ্টির ভোগান্তির ব্যক্তিগত প্রতিকারের দায় তবু বিপদ যার, তার একারই। এই তো সরকারব্যবস্থা, জীবনব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নির্দেশ। অনেকের জন্য পারিনি, কিন্তু এত কাছের, এত মূল্যবান একটি জীবনের জন্য স্বার্থপর হতে রাজি আছি। বলতে রাজি আছি, কেউ আছেন? আমাদের পাশে দাঁড়ান। লীনা-পলাশের বুকের ধন আনার পাশে দাঁড়ান, ওর দিকে তাকান। লীনাকে সিঙ্গাপুরে নিতে হবে, ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা প্রয়োজন। সরকার যে দায়িত্ব নেয় না, সেই দায়িত্বের কিছুটা কি আপনি নেবেন?
সময় চলে যাচ্ছে, আর সংক্ষিপ্ত ও যন্ত্রণাকর হয়ে উঠছে লীনার জীবনযাত্রা। আসুন, লীনার পাশে দাঁড়াই। ও এত দিন অন্যের দায়িত্ব নিয়েছে। এখন ওর দায়িত্বটা শুধু নয়, ক্যানসারের মতো নিরাময়যোগ্য রোগে কেউ যাতে অসহায় বোধ না করে, সেই দায়িত্ব নেওয়ার দায়ও লীনা আমাদের ওপর তুলে দিয়েছে। এটুকু কি আমরা পারব না?
সাহায্য পাঠাবার ঠিকানা: স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, অ্যাকাউন্ট নাম: নাহিদ জাহান, অ্যাকাউন্ট নম্বর: ১৮৩৪১১০৪৪০১, সুইফট কোড: SCBLBDDX। পলাশের মোবাইল নম্বর: +৮৮০১৭১৩২২৯২০৭।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
farukwasif@yahoo.com
No comments