বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব ও মহামানবতায় by গোলাম মোসত্মফা
হযরত মুহম্মদের জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য : বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও মহামানবতার আদর্শ প্রচার। শুধু আরববাসীদিগের জন্যই তিনি আসেন নাই, শুধু মুসলমানদিগের মধ্যেই তিনি একতা ও ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করিয়া সস্তুষ্ট হন নাই, তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক মিলন প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত।
ধর্ম, জাতি এবং দেশ বিভিন্ন হইলেও মানুষই যে মূলতঃ এক পরিবারভুক্ত, সকলেরই উৎসমুখ যে এক, সকল মানুষের অনত্মরে যে একটা নিগূঢ় আত্মীয়তার যোগসূত্র আছে এবং তাহারা যে পরস্পর ভাই-ভাই ু এই কথা দুনিয়ার একজন মহাপুরম্নষই হাতে-কলমে শিৰা দিয়া গিয়াছেন এবং তিনি হইতেছেন মুহম্মদ।এই সম্বন্ধে আলস্নাহ্র বিধানও অত্যনত্ম সুস্পষ্ট। কোরআন বলিতেছে : "সমসত্ম মানবম-লী এক জাতি।" ২:২১৩
অন্যত্র আছে :
"হে লোকসকল, নিশ্চয়ই তোমাদিগকে একই পুরম্নষ ও একই নারী হইতে সৃজন করিয়াছি, এবং বিভিন্ন গোত্র ও পরিবারে বিভক্ত করিয়াছি_ যাহাতে তোমরা পরস্পরকে চিনিতে পারো। নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আলস্নাহ্র নিকট অধিকতর সম্মানার্হ যিনি অপরের প্রতি নিজের কর্তব্য সম্বন্ধে সজাগ।" ৪৯:১৩
বস্তুতঃ ইসলামকে যাঁহারা একটুও চিনেন, তাঁহারা বলিবেন, মহমানবতাই তাহার আদর্শ, বিশ্বভ্রাতৃত্বই তাহার স্বপ্ন। হিন্দী, আরবী, আফগানী, কাফ্রী, নিগ্রো, চীনা, ইউরোপীয়_ বিশ্বের সর্বদেশের সর্বজাতীয় লোককে একত্র করিয়া একই মিলন সূত্রে আবদ্ধ করিবার মত বিরাট মন এবং পরিকল্পনা জগতে আর কাহার হইয়াছে? এত বড় শক্তিই বা কাহার? ইহা স্বপ্ন্ নহে, সত্য! আজ পর্যনত্ম কাবা-শরীফে প্রতি বৎসর একবার করিয়া এই মহামিলন সাধিত হয়। পবিত্র হজ্বের দিনে সকলেরই এক ধ্যান, এক ধারণা; এক বেশ, এক ভূষা; এক বাণী, এক লৰ্য_ সবাই মিলিয়া সেদিন মুহম্মদ 'মুহম্মদ' ছিলেন কি_ না।
এক। হযরত মুহম্মদের পূর্বে এই বিশ্বমানবতাবোধ একেবারেই অচিনত্ম্য ছিল না কি?
স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রে
স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র ইসলামের মজ্জাগত। অবশ্য স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র সম্বন্ধে ইসলামের ধারণা একটু স্বতন্ত্র। যে-অর্থে সাধারণতঃ আমরা এই দুইটি কথাকে বুঝি, ইসলামের ধারণা ঠিক তাহা নহে। কেবলমাত্র রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক হিসাবে স্বাধীনভাবে রাষ্ট্র চালনা করিবার নামই স্বাধীনতা নহে, অথবা ভোট দ্বারা সভ্য নির্বাচন করিবার নামও গণতন্ত্র নহে। মানুষের মনোরাজ্যে যেখানে থাকে শত প্রকারের বন্ধন, ছোট-বড়-ইতর-ভদ্রের প্রভেদ, জঘন্য জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতার অভিশাপ, সেখানে গণতন্ত্রের বুলি একটা নিষ্ঠুর বিদ্রূপের মতই মনে হয়। এমন মাথাগনতি গণতন্ত্র ইসলামের কাম্য নহে। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের গোড়ার কথা হইল ধর্ম ও কর্মে মানুষের সমঅধিকার প্রদান। সব মানুষই সমান এবং সকলের ধর্মে-কর্মে সমঅধিকার আছে, এই নীতি গ্রহণ না করিলে প্রকৃত স্বাধীনতা বা গণতন্ত্র লাভ করা অসম্ভব। মুক্তি-সাধনার পথে সর্বাগ্রে তাই আমাদিগকে স্বীকার করিতে হয় আলস্নাহ্্র একত্ববাদকে। আমাদের উৎপত্তি বা উৎস মুখ যে এক, এই কথা না মানিলে মানুষে মানুষে কখনো সমতা আসিতে পারে না। এক পিতার সনত্মানদের মধ্যে যেমন আপনা-আপনি ভ্রাতৃত্ববোধ জন্মে, তেমনি আমরাও যদি স্বীকার করি যে, আমাদের সকলের 'রব' এক, তবে আমরাও পরস্পর ভাই-ভাই হইতে পারি। ইসলামের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র এই সত্য বুনিয়াদের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত। আলস্নাহ এক এবং প্রত্যেক মানুষের মৌলিক অধিকার সমান। ইসলাম এই দুইটি কথাই মানুষকে শিখাইয়াছে। ব্যক্তিত্বের স্বাধীনতা এবং স্বাতন্ত্র্য তাহার প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাহার কাছে কোন বর্ণবৈষম্য নাই; কৌলিন্যপ্রথা নাই। এখানে কর্ম দ্বারা, সাধনার দ্বারা মানুষকে বড় হইতে হয়_ বংশ-মর্যাদা বা জাতিভেদ দ্বারা নহে।
No comments