হামলায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেপ্তার জামায়াত-শিবিরকর্মী-আওয়ামী সনদে মুক্তি! by আশরাফ-উল-আলম
অতর্কিত হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলা থেকে জামায়াত-শিবিরকর্মীরা জামিন পেয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের সনদে। কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
যথেষ্ট যাচাই-বাছাই করেই এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় বলে ঢাকার পুলিশ দাবি করলেও স্থানীয় পুলিশ তদন্ত করে বলছে গ্রেপ্তারকৃতদের স্বভাব-চরিত্র ভালো।
গত বছর দায়ের করা বেশ কয়েকটি মামলার নথি থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। একসঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া অনেক আসামির মধ্যে সনদধারী কিছু আসামিকে জামিন দেওয়ার নজির থেকে কোনো কোনো মামলায় সব আসামিই জামিন পেয়ে যাচ্ছে। এমন সনদের পর পুলিশের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। তারা কি প্রকৃত আসামিদের গ্রেপ্তার করছে, না নিরীহ মানুষকে হয়রানি করছে?
এসব মামলায় গ্রেপ্তার আসামিদের কেউ বিএনপি বা ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত- এমন তথ্য কোনো মামলার নথিতে মেলেনি। এ ধরনের কোনো সনদও নেই। ঢালাও গ্রেপ্তার করলে অন্য দলের লোকও গ্রেপ্তার হতে পারত।
শুধু আওয়ামী লীগের সনদেই নয়, গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামায়াত-শিবিরকর্মীদের বিভিন্ন ধরনের সনদ দিয়ে কারাগার থেকে মুক্ত করা হচ্ছে। জামিনে বের হয়ে তারাই আবার হামলায় অংশ নিচ্ছে।
এদিকে এখন পর্যন্ত জামায়াত-শিবিরকর্মীদের অতর্কিত হামলার ঘটনায় গাড়ি ভাঙচুর, পুলিশ সদস্যদের মারধর করে তাঁদের কর্তব্যকাজে বাধাদান, ককটেল বিস্ফোরণ, ত্রাস সৃষ্টির অভিযোগে দায়ের করা মামলার একটিরও বিচার হয়নি। এসব ঘটনায় দেশে প্রচলিত দণ্ডবিধি আইন, বিস্ফোরক দ্রব্য আইন ও দ্রুত বিচার আইনে মামলা হচ্ছে।
জানা গেছে, কোনো ধরনের কর্মসূচি ছাড়াই গত এক বছরে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা সারা দেশে কমপক্ষে ৫০টি ছোটবড় হামলা করেছে। এর মধ্যে ১৭টি ভয়াবহ হামলার ঘটনা রয়েছে। ঢাকার পল্টন, রমনা, মতিঝিল ও শাহবাগসহ সুবিধামতো যেকোনো এলোকায় হঠাৎ জড়ো হয়ে গাড়ি ভাঙচুরসহ পুলিশের ওপর চড়াও হচ্ছে তারা। এসব ঘটনায় ৫০ জনেরও বেশি পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। আর এসব ঘটনায় অর্ধশতাধিক মামলা হয়েছে বিভিন্ন থানায়।
মামলাগুলোতে এ পর্যন্ত কতজন জামায়াত-শিবিরকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছে তার হিসাব নেই। তবে পল্টন, রমনা, মতিঝিল, শাহবাগসহ অন্যান্য থানা সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে চার শর বেশি আসামি গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের বেশির ভাগই বিভিন্ন কৌশলে ও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে জামিনে বেরিয়ে গেছে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, আসামিদের জামিন শুনানির সময় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের দেওয়া সনদ দেখিয়ে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট আসামি আওয়ামী লীগের সদস্য বা আওয়ামী লীগ সমর্থক। সে কখনো জামায়াত-শিবির করেনি। সুতরাং সে জামায়াত-শিবিরের হামলায় অংশ নিতে পারে না। আবার শিবিরকর্মীদের পক্ষে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সনদ দাখিল করে সামনে পরীক্ষার অজুহাত দেখিয়ে জামিন শুনানি করা হয়। কখনো মা-বাবা বা আত্মীয়স্বজনের অসুস্থতার সনদ দেখিয়ে জামিনের আবেদন করা হয়। এ ক্ষেত্রে আদালত নমনীয় হয়ে জামিন দেন। আবার পুলিশের দায়ের করা মামলায় কোনো আসামির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকার কারণে আদালত আইন অনুযায়ী জামিন দেন।
আওয়ামী লীগের সনদ ও পুলিশের তদন্ত : গত বছরের ৫ নভেম্বর বিকেল পৌনে ৫টার দিকে মতিঝিলের বিআরটিসি বাস কাউন্টারের সামনে দু-তিন শ জামায়াত ও শিবিরকর্মী একটি বিআরটিসির বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেখানে লাঠিসোঁটা দিয়ে তারা অন্যান্য গাড়িও ভাঙচুর করে। ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে। এ ঘটনায় মতিঝিল থানায় মামলা হওয়ার পর লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার চর লরেঞ্চ গ্রামের মো. আলাউদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তার হওয়ার পর কমলনগর উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক ওমর ফারুক সাগর গত বছরের ৬ ডিসেম্বর একটি সনদ দেন। সনদে বলেন, আলাউদ্দিন চর লরেঞ্চ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করত এবং সে আওয়ামী পরিবারের সন্তান। মতিঝিল থানায়ও এই সনদ দাখিল করার পর লক্ষ্মীপুর থানাকে বিষয়টি তদন্ত করতে বলা হয়। সেখানকার পুলিশ তদন্ত করে জানায়, আসামির স্বভাব-চরিত্র ভালো এবং তার বিরুদ্ধে বিরূপ কিছু পাওয়া গেল না।
একই মামলায় গ্রেপ্তার হন সেলিম আশরাফ। তাঁর বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার কালিবৃত্তি গ্রামে। তাঁর বিষয়ে উপজেলা ছাত্রলীগের মাকসুদুর রহমান পাটোয়ারী সনদপত্র দেন। সনদে বলা হয়, সেলিম আশরাফ কুশাখালী ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় সদস্য। এই মামলার আসামিপক্ষের আইনজীবীদের সূত্রে জানা গেছে, বেশ কয়েকজন আসামিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা সনদ দেন। শুধু এই মামলায়ই নয়, ওই দিন একই থানা এলাকায় জামায়াত-শিবিরের অতর্কিত হামলার ঘটনায় চারটি মামলা হয়। চারটি মামলায় বেশ কয়েকজন আসামির পক্ষে এ ধরনের সনদ জমা হয়। জানা গেছে, এসব মামলায় শতাধিক আসামি গ্রেপ্তার হলেও বেশির ভাগ আসামি ইতিমধ্যে জামিন পেয়ে গেছে।
গত বছরের ৩০ এপ্রিল মগবাজার এলাকার শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়কে আদ্-দ্বীন হাসপাতালের সামনে জামায়াত-শিবির গাড়ি ভাঙচুর করে। ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে। এ ঘটনায় ১৩ জনকে আসামি করে রমনা থানায় মামলা করে পুলিশ। এ মামলার ১ নম্বর আসামি মো. মামুনকে গ্রেপ্তারের পর ঢাকার ৬৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি হাজি মো. আরমান একটি সনদ দিয়ে বলেন, মো. মামুন তাঁর ওয়ার্ডে বসবাসরত যুবলীগের একজন কর্মী। তিনি জামিন পান।
এই মামলায় গ্রেপ্তার গোলাম রহমান এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী বলে গত বছরের ১৯ জুন জামিন নেয় আদালত থেকে। অথচ জুন এইচএসসি পরীক্ষার মাস নয়। এর আগে ৭ মে আসামি সিদ্দিকুর রহমান ও আ. রশিদ জামিন পান ঢাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী পরিচয়ে।
গত বছরের ২৪ এপ্রিল মগবাজার চৌরাস্তার ফুট ওভারব্রিজের নিচে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা হয়। মামলার প্রধান আসামি ইমরানকে এইচএসসি পরীক্ষার্থী বিবেচনায় জামিন দেওয়া হয়।
রাজধানীর খিলক্ষেত থানায় দায়ের করা আমেরিকান দূতাবাসের গাড়ি ভাঙচুর মামলার আসামি সাইফুলের পক্ষে নড়াইল জেলার কচুয়া বাজার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইফুলকে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে একটি সনদ দেন। তাতে এই আসামিও জামিন পেয়েছেন।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সহসভাপতি আবদুর রাজ্জাক কালের কণ্ঠকে বলেন, পুলিশ সব সময় কিছু লোককে হয়রানি করার জন্য গ্রেপ্তার করে। আবার পুলিশের ভুলও হয়। এ কারণে নিরীহ লোকদের পক্ষে মামলার শুনানিতে যাই। জামায়াত-শিবিরের মামলা শুনানি করতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই চোখে পড়ে আসামিদের পক্ষ থেকে কিছু কাগজপত্র দাখিল করা হচ্ছে। এসব কাগজপত্রের মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতাদের কিছু সনদ দেখতে পাওয়া যায়। তবে ওই সনদগুলো সঠিক হতে পারে।
অ্যাডভোকেট মুনজুর আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমিও কয়েকটি মামলায় দেখেছি, আইনজীবীরা বলছেন, আসামি জামায়াত-শিবির করে না, আওয়ামী লীগ বা যুবলীগ বা ছাত্রলীগ করে।' এ কারণেই আসামিদের জামিন হয়। তা ছাড়া বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেই জামিন পেয়ে যাচ্ছে আসামিরা। তবে মামলা দায়েরের মধ্যে পুলিশের গাফিলতিও রয়েছে।
অ্যাডভোকেট রায়হান মোর্শেদ বলেন, সিরাজগঞ্জের দুজন আসামি ঢাকায় এসে জামায়াত-শিবিরের হামলার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছে। বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের করা এই দুই মামলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সনদ দিয়ে বলেছেন, তারা আওয়ামী লীগের লোক। রায়হান মোর্শেদ বলেন, তারা জামায়াতের হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল না বলে আসামিরা দাবি করেছে।
মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হায়াতুজ্জামান মোল্লা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'জামায়াত-শিবিরের নাশকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত আসামি গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে আমরা সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করি। তাৎক্ষণিকভাবে সন্দেহভাজন হিসেবে অনেককে আটক করা হলেও যাচাই-বাছাই করে ছেড়ে দিই। গত সোমবারও পাঁচজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে দু-একটা ভুল হতে পারে। ভুলের সংখ্যা বেশি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।'
সনদ নথিবদ্ধ হয় না : স্থানীয় আওয়ামী লীগ বা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা যেসব সনদ আদালতে দাখিল করেন তা সাধারণত নথিতে সংরক্ষিত থাকে না। এমনকি এসব সনদের বিষয়ে আদালত আদেশে কিছু উল্লেখও করেন না। কয়েকটি সনদ বিভিন্ন মামলার নথিতে ভুলবশত থেকে যাওয়ায় সেগুলো কালের কণ্ঠের হাতে রয়েছে। এ ছাড়া একাধিক আইনজীবী এসব সনদের কথা প্রতিবেদককে জানিয়েছেন।
আইনের ফাঁকফোকর : গত এক বছরে জামায়াত-শিবিরের হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় কোনো আসামির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নেই। শুধু কিছু আসামির নাম এজাহারে উল্লেখ করে বলা হয়, অমুকের নেতৃত্বে এজাহারনামীয় ও অজ্ঞাতপরিচয় আসামিরা গাড়ি পুড়িয়েছে, বা পুলিশের ওপর হামলা করেছে বা এই অপরাধ করেছে। কিন্তু কোন আসামি কী করেছে তার উল্লেখ থাকে না। এ কারণে আসামিরা সহজে জামিন পেয়ে যায়।
পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, ঘটনার পর প্রকৃত আসামিকে না ধরে তারা অনেক নিরীহ লোকদের মামলায় অন্তর্ভুক্ত করে। ঢাকা আইনজীবী সমিতির সহসভাপতি আবদুর রাজ্জাকও এ ধরনের অভিযোগ করেন।
বিচার হয় না : গত এক বছরে জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবের ঘটনায় দায়ের করা কোনো মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। ত্রাস সৃষ্টিকারী এসব ঘটনার দায়ে কাউকে শাস্তি পেতে হয়নি। এ মামলার পরিণতি কী হয় তার কোনো হিসাব কারো কাছে নেই। এসব মামলার তদারকির জন্যও পৃথক কোনো সেল নেই।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মো. আবদুল্লাহ আবুর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দ্রুত বিচার আইনে দায়ের করা মামলার বিচার দ্রুত হওয়া উচিত। কিন্তু কেন হচ্ছে না তা খোঁজ নিয়ে দেখা হচ্ছে। বিভিন্ন মামলায় আসামিদের পক্ষে আওয়ামী লীগ নেতাদের সনদ দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এভাবে সনদ দেওয়া রোধ করতে হবে। তবে তিনি বলেন, মামলাগুলোর নথি না দেখে বা কাগজপত্র না দেখে কিছু বলা ঠিক হবে না। তিনি আরো বলেন, দ্রুত বিচার করা না গেলে ওদের তাণ্ডব থামবে না, আরো বাড়বে। এ জন্য পুলিশকে উদ্যোগ নিতে হবে। তারা মামলা দায়ের করে। সুতরাং তাদের মামলা তদারকি করতে হবে।
মতিঝিল থানায় জামায়াত-শিবিরের হামলার ঘটনায় গত বছর এপ্রিলে দায়ের করা বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের দুটি মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয় গত বছর নভেম্বরে। এরপর বিচারের জন্য মামলা দুটি মহানগর দায়রা জজ আদালতে স্থানান্তর করা হয়। অভিযোগ আমলে নেওয়ার জন্য মহানগর দায়রা জজ তারিখ ধার্য করেন আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি। রমনা থানায় দায়ের করা দুটি মামলাও মহানগর দায়রা আদালতে স্থানান্তর করা হয়েছে এ মাসে। তবে এখনো কোনো আদেশ হয়নি। এভাবে এ মামলাগুলোর খোঁজখবর কেউ রাখে না।
এদিকে মতিঝিলে ভাঙচুর ও গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে গত বছরের ৫ নভেম্বর দায়ের করা একটি দ্রুত বিচার আইনের মামলায় দুই সপ্তাহের মধ্যেই চার্জশিট দেওয়া হয়। অথচ এখনো মামলার বিচার শুরু হয়নি। এভাবে দ্রুত বিচারের উদ্যোগেরও ঘাটতি রয়েছে বলে আইনজীবীরা জানান। উল্লেখ্য, দ্রুত বিচার আইনে চার্জশিট দাখিলের পর সর্বোচ্চ দুই মাসের মধ্যে তা নিষ্পত্তির বিধান রয়েছে।
গত বছর দায়ের করা বেশ কয়েকটি মামলার নথি থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। একসঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া অনেক আসামির মধ্যে সনদধারী কিছু আসামিকে জামিন দেওয়ার নজির থেকে কোনো কোনো মামলায় সব আসামিই জামিন পেয়ে যাচ্ছে। এমন সনদের পর পুলিশের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। তারা কি প্রকৃত আসামিদের গ্রেপ্তার করছে, না নিরীহ মানুষকে হয়রানি করছে?
এসব মামলায় গ্রেপ্তার আসামিদের কেউ বিএনপি বা ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত- এমন তথ্য কোনো মামলার নথিতে মেলেনি। এ ধরনের কোনো সনদও নেই। ঢালাও গ্রেপ্তার করলে অন্য দলের লোকও গ্রেপ্তার হতে পারত।
শুধু আওয়ামী লীগের সনদেই নয়, গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামায়াত-শিবিরকর্মীদের বিভিন্ন ধরনের সনদ দিয়ে কারাগার থেকে মুক্ত করা হচ্ছে। জামিনে বের হয়ে তারাই আবার হামলায় অংশ নিচ্ছে।
এদিকে এখন পর্যন্ত জামায়াত-শিবিরকর্মীদের অতর্কিত হামলার ঘটনায় গাড়ি ভাঙচুর, পুলিশ সদস্যদের মারধর করে তাঁদের কর্তব্যকাজে বাধাদান, ককটেল বিস্ফোরণ, ত্রাস সৃষ্টির অভিযোগে দায়ের করা মামলার একটিরও বিচার হয়নি। এসব ঘটনায় দেশে প্রচলিত দণ্ডবিধি আইন, বিস্ফোরক দ্রব্য আইন ও দ্রুত বিচার আইনে মামলা হচ্ছে।
জানা গেছে, কোনো ধরনের কর্মসূচি ছাড়াই গত এক বছরে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা সারা দেশে কমপক্ষে ৫০টি ছোটবড় হামলা করেছে। এর মধ্যে ১৭টি ভয়াবহ হামলার ঘটনা রয়েছে। ঢাকার পল্টন, রমনা, মতিঝিল ও শাহবাগসহ সুবিধামতো যেকোনো এলোকায় হঠাৎ জড়ো হয়ে গাড়ি ভাঙচুরসহ পুলিশের ওপর চড়াও হচ্ছে তারা। এসব ঘটনায় ৫০ জনেরও বেশি পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। আর এসব ঘটনায় অর্ধশতাধিক মামলা হয়েছে বিভিন্ন থানায়।
মামলাগুলোতে এ পর্যন্ত কতজন জামায়াত-শিবিরকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছে তার হিসাব নেই। তবে পল্টন, রমনা, মতিঝিল, শাহবাগসহ অন্যান্য থানা সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে চার শর বেশি আসামি গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের বেশির ভাগই বিভিন্ন কৌশলে ও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে জামিনে বেরিয়ে গেছে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, আসামিদের জামিন শুনানির সময় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের দেওয়া সনদ দেখিয়ে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট আসামি আওয়ামী লীগের সদস্য বা আওয়ামী লীগ সমর্থক। সে কখনো জামায়াত-শিবির করেনি। সুতরাং সে জামায়াত-শিবিরের হামলায় অংশ নিতে পারে না। আবার শিবিরকর্মীদের পক্ষে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সনদ দাখিল করে সামনে পরীক্ষার অজুহাত দেখিয়ে জামিন শুনানি করা হয়। কখনো মা-বাবা বা আত্মীয়স্বজনের অসুস্থতার সনদ দেখিয়ে জামিনের আবেদন করা হয়। এ ক্ষেত্রে আদালত নমনীয় হয়ে জামিন দেন। আবার পুলিশের দায়ের করা মামলায় কোনো আসামির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকার কারণে আদালত আইন অনুযায়ী জামিন দেন।
আওয়ামী লীগের সনদ ও পুলিশের তদন্ত : গত বছরের ৫ নভেম্বর বিকেল পৌনে ৫টার দিকে মতিঝিলের বিআরটিসি বাস কাউন্টারের সামনে দু-তিন শ জামায়াত ও শিবিরকর্মী একটি বিআরটিসির বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেখানে লাঠিসোঁটা দিয়ে তারা অন্যান্য গাড়িও ভাঙচুর করে। ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে। এ ঘটনায় মতিঝিল থানায় মামলা হওয়ার পর লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার চর লরেঞ্চ গ্রামের মো. আলাউদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তার হওয়ার পর কমলনগর উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক ওমর ফারুক সাগর গত বছরের ৬ ডিসেম্বর একটি সনদ দেন। সনদে বলেন, আলাউদ্দিন চর লরেঞ্চ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করত এবং সে আওয়ামী পরিবারের সন্তান। মতিঝিল থানায়ও এই সনদ দাখিল করার পর লক্ষ্মীপুর থানাকে বিষয়টি তদন্ত করতে বলা হয়। সেখানকার পুলিশ তদন্ত করে জানায়, আসামির স্বভাব-চরিত্র ভালো এবং তার বিরুদ্ধে বিরূপ কিছু পাওয়া গেল না।
একই মামলায় গ্রেপ্তার হন সেলিম আশরাফ। তাঁর বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার কালিবৃত্তি গ্রামে। তাঁর বিষয়ে উপজেলা ছাত্রলীগের মাকসুদুর রহমান পাটোয়ারী সনদপত্র দেন। সনদে বলা হয়, সেলিম আশরাফ কুশাখালী ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় সদস্য। এই মামলার আসামিপক্ষের আইনজীবীদের সূত্রে জানা গেছে, বেশ কয়েকজন আসামিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা সনদ দেন। শুধু এই মামলায়ই নয়, ওই দিন একই থানা এলাকায় জামায়াত-শিবিরের অতর্কিত হামলার ঘটনায় চারটি মামলা হয়। চারটি মামলায় বেশ কয়েকজন আসামির পক্ষে এ ধরনের সনদ জমা হয়। জানা গেছে, এসব মামলায় শতাধিক আসামি গ্রেপ্তার হলেও বেশির ভাগ আসামি ইতিমধ্যে জামিন পেয়ে গেছে।
গত বছরের ৩০ এপ্রিল মগবাজার এলাকার শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়কে আদ্-দ্বীন হাসপাতালের সামনে জামায়াত-শিবির গাড়ি ভাঙচুর করে। ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে। এ ঘটনায় ১৩ জনকে আসামি করে রমনা থানায় মামলা করে পুলিশ। এ মামলার ১ নম্বর আসামি মো. মামুনকে গ্রেপ্তারের পর ঢাকার ৬৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি হাজি মো. আরমান একটি সনদ দিয়ে বলেন, মো. মামুন তাঁর ওয়ার্ডে বসবাসরত যুবলীগের একজন কর্মী। তিনি জামিন পান।
এই মামলায় গ্রেপ্তার গোলাম রহমান এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী বলে গত বছরের ১৯ জুন জামিন নেয় আদালত থেকে। অথচ জুন এইচএসসি পরীক্ষার মাস নয়। এর আগে ৭ মে আসামি সিদ্দিকুর রহমান ও আ. রশিদ জামিন পান ঢাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী পরিচয়ে।
গত বছরের ২৪ এপ্রিল মগবাজার চৌরাস্তার ফুট ওভারব্রিজের নিচে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা হয়। মামলার প্রধান আসামি ইমরানকে এইচএসসি পরীক্ষার্থী বিবেচনায় জামিন দেওয়া হয়।
রাজধানীর খিলক্ষেত থানায় দায়ের করা আমেরিকান দূতাবাসের গাড়ি ভাঙচুর মামলার আসামি সাইফুলের পক্ষে নড়াইল জেলার কচুয়া বাজার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইফুলকে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে একটি সনদ দেন। তাতে এই আসামিও জামিন পেয়েছেন।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সহসভাপতি আবদুর রাজ্জাক কালের কণ্ঠকে বলেন, পুলিশ সব সময় কিছু লোককে হয়রানি করার জন্য গ্রেপ্তার করে। আবার পুলিশের ভুলও হয়। এ কারণে নিরীহ লোকদের পক্ষে মামলার শুনানিতে যাই। জামায়াত-শিবিরের মামলা শুনানি করতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই চোখে পড়ে আসামিদের পক্ষ থেকে কিছু কাগজপত্র দাখিল করা হচ্ছে। এসব কাগজপত্রের মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতাদের কিছু সনদ দেখতে পাওয়া যায়। তবে ওই সনদগুলো সঠিক হতে পারে।
অ্যাডভোকেট মুনজুর আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমিও কয়েকটি মামলায় দেখেছি, আইনজীবীরা বলছেন, আসামি জামায়াত-শিবির করে না, আওয়ামী লীগ বা যুবলীগ বা ছাত্রলীগ করে।' এ কারণেই আসামিদের জামিন হয়। তা ছাড়া বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেই জামিন পেয়ে যাচ্ছে আসামিরা। তবে মামলা দায়েরের মধ্যে পুলিশের গাফিলতিও রয়েছে।
অ্যাডভোকেট রায়হান মোর্শেদ বলেন, সিরাজগঞ্জের দুজন আসামি ঢাকায় এসে জামায়াত-শিবিরের হামলার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছে। বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের করা এই দুই মামলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সনদ দিয়ে বলেছেন, তারা আওয়ামী লীগের লোক। রায়হান মোর্শেদ বলেন, তারা জামায়াতের হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল না বলে আসামিরা দাবি করেছে।
মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হায়াতুজ্জামান মোল্লা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'জামায়াত-শিবিরের নাশকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত আসামি গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে আমরা সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করি। তাৎক্ষণিকভাবে সন্দেহভাজন হিসেবে অনেককে আটক করা হলেও যাচাই-বাছাই করে ছেড়ে দিই। গত সোমবারও পাঁচজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে দু-একটা ভুল হতে পারে। ভুলের সংখ্যা বেশি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।'
সনদ নথিবদ্ধ হয় না : স্থানীয় আওয়ামী লীগ বা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা যেসব সনদ আদালতে দাখিল করেন তা সাধারণত নথিতে সংরক্ষিত থাকে না। এমনকি এসব সনদের বিষয়ে আদালত আদেশে কিছু উল্লেখও করেন না। কয়েকটি সনদ বিভিন্ন মামলার নথিতে ভুলবশত থেকে যাওয়ায় সেগুলো কালের কণ্ঠের হাতে রয়েছে। এ ছাড়া একাধিক আইনজীবী এসব সনদের কথা প্রতিবেদককে জানিয়েছেন।
আইনের ফাঁকফোকর : গত এক বছরে জামায়াত-শিবিরের হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় কোনো আসামির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নেই। শুধু কিছু আসামির নাম এজাহারে উল্লেখ করে বলা হয়, অমুকের নেতৃত্বে এজাহারনামীয় ও অজ্ঞাতপরিচয় আসামিরা গাড়ি পুড়িয়েছে, বা পুলিশের ওপর হামলা করেছে বা এই অপরাধ করেছে। কিন্তু কোন আসামি কী করেছে তার উল্লেখ থাকে না। এ কারণে আসামিরা সহজে জামিন পেয়ে যায়।
পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, ঘটনার পর প্রকৃত আসামিকে না ধরে তারা অনেক নিরীহ লোকদের মামলায় অন্তর্ভুক্ত করে। ঢাকা আইনজীবী সমিতির সহসভাপতি আবদুর রাজ্জাকও এ ধরনের অভিযোগ করেন।
বিচার হয় না : গত এক বছরে জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবের ঘটনায় দায়ের করা কোনো মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। ত্রাস সৃষ্টিকারী এসব ঘটনার দায়ে কাউকে শাস্তি পেতে হয়নি। এ মামলার পরিণতি কী হয় তার কোনো হিসাব কারো কাছে নেই। এসব মামলার তদারকির জন্যও পৃথক কোনো সেল নেই।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মো. আবদুল্লাহ আবুর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দ্রুত বিচার আইনে দায়ের করা মামলার বিচার দ্রুত হওয়া উচিত। কিন্তু কেন হচ্ছে না তা খোঁজ নিয়ে দেখা হচ্ছে। বিভিন্ন মামলায় আসামিদের পক্ষে আওয়ামী লীগ নেতাদের সনদ দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এভাবে সনদ দেওয়া রোধ করতে হবে। তবে তিনি বলেন, মামলাগুলোর নথি না দেখে বা কাগজপত্র না দেখে কিছু বলা ঠিক হবে না। তিনি আরো বলেন, দ্রুত বিচার করা না গেলে ওদের তাণ্ডব থামবে না, আরো বাড়বে। এ জন্য পুলিশকে উদ্যোগ নিতে হবে। তারা মামলা দায়ের করে। সুতরাং তাদের মামলা তদারকি করতে হবে।
মতিঝিল থানায় জামায়াত-শিবিরের হামলার ঘটনায় গত বছর এপ্রিলে দায়ের করা বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের দুটি মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয় গত বছর নভেম্বরে। এরপর বিচারের জন্য মামলা দুটি মহানগর দায়রা জজ আদালতে স্থানান্তর করা হয়। অভিযোগ আমলে নেওয়ার জন্য মহানগর দায়রা জজ তারিখ ধার্য করেন আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি। রমনা থানায় দায়ের করা দুটি মামলাও মহানগর দায়রা আদালতে স্থানান্তর করা হয়েছে এ মাসে। তবে এখনো কোনো আদেশ হয়নি। এভাবে এ মামলাগুলোর খোঁজখবর কেউ রাখে না।
এদিকে মতিঝিলে ভাঙচুর ও গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে গত বছরের ৫ নভেম্বর দায়ের করা একটি দ্রুত বিচার আইনের মামলায় দুই সপ্তাহের মধ্যেই চার্জশিট দেওয়া হয়। অথচ এখনো মামলার বিচার শুরু হয়নি। এভাবে দ্রুত বিচারের উদ্যোগেরও ঘাটতি রয়েছে বলে আইনজীবীরা জানান। উল্লেখ্য, দ্রুত বিচার আইনে চার্জশিট দাখিলের পর সর্বোচ্চ দুই মাসের মধ্যে তা নিষ্পত্তির বিধান রয়েছে।
No comments