বারবার ব্যর্থ কেন?-দায় নিতে নারাজ কর্তাব্যক্তিরা by তৌফিক মারুফ ও পার্থ সারথি দাস
নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর গত ২৩ বছরে চারটি মেয়াদ পূর্ণ করতে যাচ্ছে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা। এ সময়ে দেশে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ সহিংস ঘটনাগুলোর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যর্থতার দায় চেপেছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ওপর।
গত সোমবার ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের ওপর জামায়াত-শিবিরের হামলার পর আবার প্রশ্ন উঠেছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ভূমিকা ও দায়দায়িত্ব নিয়ে। সেই সূত্রেই আলোচনায় উঠে এসেছে পুরনো ঘটনাগুলোও।
বিশেষ করে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতার (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) ওপর গ্রেনেড হামলা, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট ৬৩টি জেলায় একযোগে প্রায় ৫০০ বোমা বিস্ফোরণ, ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহ, ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোর টাউন হল মাঠে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনে বোমা হামলা, ২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে সিপিবির জনসভায় বোমা হামলা, একই বছরের ১৪ এপ্রিল রমনা বটমূলে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রামুর ১২টি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধবিহার ও ৩০টির বেশি বসতবাড়িতে এবং ৩০ সেপ্টেম্বর উখিয়া ও টেকনাফে আরো সাতটি বিহার ও ১১টি বসতিতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা আবারও সামনে এসেছে। এসব ঘটনায় গোয়েন্দা ব্যর্থতা নিয়ে আগেও বিস্তর সমালোচনা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এসব ঘটনায় যদি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ব্যর্থ না হতো তাহলে জানমালের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ঠেকানো যেত।
এ সময়ের মধ্যে গোয়েন্দা তৎপরতার সাফল্যের দু-একটি ঘটনার মধ্যে ২০০১ সালে কোটালীপাড়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশস্থলে বোমা পুঁতে রাখার বিষয়টি আগেভাগে ধরে ফেলার ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য।
গত সোমবার পুলিশের ওপর জামায়াত-শিবিরের হামলার ঘটনাকে ওই দিনই এক অনুষ্ঠানে গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা বলে মন্তব্য করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর ওই দিনই দাবি করেন, এ ঘটনায় গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা নেই। তাঁর মতোই ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেন না বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা। তাঁরা বিষয়টিকে ব্যর্থতা না বলে আগাম তথ্য অনুসারে করণীয় ব্যবস্থা না দেওয়াকে দায়ী করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, গোয়েন্দাদের মধ্যে এক ধরনের দুর্বলতা লক্ষ করা যাচ্ছে। বহুদিন ধরেই এটা চোখে পড়ছে। কারণ হামলা হচ্ছে নতুন কৌশলে। অথচ গোয়েন্দা তৎপরতা মান্ধাতার আমলের। এখানে বিনিয়োগ দরকার। নতুন প্রশিক্ষণ দরকার। দরকার গবেষণার। আর এ জন্য নতুন করে চিন্তাভাবনার প্রয়োজন আছে। গোয়েন্দারা অনেক ক্ষেত্রেই আগাম তথ্য জানতে পারছে না।
এ প্রসঙ্গে ডিজিএফআইয়ের সাবেক প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) সাদিক হাসান রুমি কালের কণ্ঠকে বলেন, চোরাগোপ্তা হামলার আগাম খবর সংগ্রহ করা সহজ নয়, বরং কঠিন। এ জন্য সংস্থার মাঠকর্মীদের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়ে দিতে হবে। টার্গেট করে বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠীর মধ্যে সংস্থার লোক ঢুকিয়ে দিতে হবে। এসব এক দিনে সম্ভব নয়, এ জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার; না হলে নিরাপত্তাজনিত সংকট থাকবেই।
জেনারেল রুমি বলেন, 'আমি যেখানে কাজ করেছি, সেখানে সীমিত সম্পদ ও অপর্যাপ্ত মাঠকর্মী পেয়েছি। অন্য সংস্থাগুলোতেও লোকবলের সংকট রয়েছে। যদি পর্যাপ্তসংখ্যক মাঠকর্মী না থাকে, তাহলে লোকাল কর্নারগুলোতে লোক লাগানো সম্ভব হয় না। আর সেটা করতে না পারলে সব খবর আগাম পাওয়া মুশকিল হবে।'
বিষয়গুলোকে ব্যর্থতা হিসেবে দেখেন না র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, গোয়েন্দারা ব্যর্থ নয়। দেশে যেকোনো অঘটনের খবর গোয়েন্দারা আগেই জানতে পারে। বিশেষ করে র্যাব বরাবরই আগাম তথ্যের ভিত্তিতে সতর্ক থাকে। গত সোমবার জামায়াত-শিবিরের হামলার খবর আগেই জেনে নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সারা দেশে সকাল থেকে সতর্কাবস্থায় ছিল র্যাব। র্যাবের ওপর কোনো হামলা হয়নি। পুলিশকেও আগে বিষয়টি জানানো হয়েছিল। কিন্তু তারা হামলা প্রতিরোধ করতে পারেনি। এর দায় পুলিশকেই নিতে হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এর আগে বড় বড় অঘটন সংঘটনের তথ্য আগাম জানতে পেরে সরকারকে সতর্ক করা হয়। বিশেষ করে ২১ আগস্টের ঘটনাসহ বেশ কিছু আলোচিত ঘটনার আগাম তথ্য সে সময়ের সরকারকে জানানো হলেও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আর এ কারণেই হামলার ঘটনাগুলো ঘটছে।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কর্তারা যা-ই বলুন, জনসাধারণ এবং রাজনীতির বিশ্লেষকদের কাছে অনেক ঘটনাই গোয়েন্দা ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত। ক্ষেত্রবিশেষে সরকারের ব্যর্থতা বলেও তাঁরা মনে করেন। তেমনই কয়েকটি বহুল আলোচিত ঘটনার কথা এখানে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো :
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা : ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতার (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) জনসভায় গ্রেনেড হামলায় রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। শতাধিক আহত হন। মামলাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে জজ মিয়া নাটক সাজানো হয় বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মামলার অধিকতর তদন্ত হয়। এতে তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবর, হারিছ চৌধুরী, জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও মুফতি হান্নানের সহযোগী জঙ্গি নেতাসহ ৫২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলা : ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জঙ্গি সংগঠন জেএমবি প্রচলিত শাসন ও বিচার পদ্ধতি বাতিল করে 'আল্লাহর আইন কায়েমের' দাবি জানিয়ে ৬৩টি জেলায় একযোগে প্রায় ৫০০ বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে প্রচারপত্র ছড়ায়। ওই ঘটনায় সারা দেশে ১৫৯টি মামলা হয়। এসব মামলায় মোট আসামির সংখ্যা ৭৪৭ জন। তাদের মধ্যে ৬৪ জন এখনো পলাতক। ৯২টি মামলার রায় হয়েছে। তাতে ২৪৪ জনের সাজা হয়েছে। বিচারে অব্যাহতি পায় গ্রেপ্তার হওয়া ১১৫ জন। বাকি মামলাগুলো বিচারাধীন।
জেএমবির ব্যাপারে শুরুতে বেশ উদাসীন ছিল তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার। দেশব্যাপী বোমা হামলার পর সরকারের টনক নড়ে। এরপর জেএমবিবিরোধী অভিযান শুরু হয়। ২০০৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর থেকে পরের বছরের ২৬ এপ্রিলের মধ্যে শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইসহ জেএমবির শীর্ষস্থানীয় সাত নেতা ধরা পড়ে। ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ শায়খ রহমান, বাংলা ভাই ও সানিসহ পাঁচ জঙ্গিনেতার ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়।
বিডিআর বিদ্রোহ : ২০০৯ সালে ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ জন সেনা-কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। ওই বিদ্রোহে মোট ৩৪৪১টি অস্ত্র ও ৩৬ হাজার গুলি ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া ৭১টি ছোট অস্ত্র, পাঁচটি রাইফেল, একটি এসএমজি, ১৯৯টি আর্জেস গ্রেনেড খোয়া যায় এবং ১৮টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। ওই ঘটনায় সারা দেশে বিডিআরের (বিজিবি) ৫৭টি ইউনিটে বাহিনীর নিজস্ব আইনে বিচার শেষ হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকার পিলখানায় হত্যা, লুণ্ঠনসহ অন্যান্য অপরাধের বিচার চলছে দেশের প্রচলিত আইনে।
উদীচী হত্যাকাণ্ড : ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোর টাউন হল মাঠে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনের শেষ দিনে রাত ১টার কিছু পর বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। বর্বরোচিত ওই হামলায় প্রাণ হারায় ১০ জন। আহত হয় প্রায় ২০০ জন। সেই ঘটনায় ওই বছরের ১৪ ডিসেম্বর বিএনপি নেতা তরিকুল ইসলামসহ ২৪ জনের নামে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। উদীচী হত্যাকাণ্ড ও বিস্ফোরণ ঘটনার সঙ্গে জডিতদের শাস্তির মুখোমুখি করা এখনো সম্ভব হয়নি। মামলার ২৩ আসামি খালাস পান। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর উদীচী মামলার রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করে। ২০১১ সালের ৪ মে আপিলটি গ্রহণ করা হয়। মামলার পুনঃ তদন্তে গতি নেই।
সিপিবি সমাবেশে বোমা হামলা : ২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে সিপিবির জনসভায় বোমা হামলায় সাতজন নিহত ও অর্ধশত ব্যক্তি আহত হয়। এ ঘটনায় সিপিবির তৎকালীন সভাপতি মনজুরুল আহসান খান বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় মামলা করেন। মামলার তদন্তে নিশ্চিত হওয়া গেছে, জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) সদস্যরা পরিকল্পিতভাবে ওই হামলা চালায়। হামলাকারী জঙ্গি মুফতি মঈন উদ্দিন শেখ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার পর থেকেই বেরিয়ে আসতে শুরু করে হামলার মূল কাহিনী। ঘটনার পরিকল্পনাকারী ও হামলাকারী হিসেবে ছিল ১১ জঙ্গি। ঘটনার সঙ্গে জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও বাকিরা পলাতক।
রমনার বটমূলে হামলা : ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনার বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে বোমা হামলার ঘটনার যুগপূর্তি হতে চলেছে। ওই হত্যাকাণ্ডে ১০ ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটে। এ ঘটনায় রমনা থানায় দুটি মামলা হয়েছিল। সাত বছরের বেশি সময় ধরে মামলার তদন্ত হয়। একটি হত্যা ও অন্যটি বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলা। ২০০৮ সালের ৩০ নভেম্বর একই সঙ্গে মামলা দুটির অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। কিন্তু বিচার কচ্ছপগতিতে এগোচ্ছে।
রামু সহিংসতা : গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে হামলা চালিয়ে রামুর ১২টি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধবিহার ও ৩০টির বেশি বসতবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। পরের দিন ৩০ সেপ্টেম্বর উখিয়া ও টেকনাফে আরো সাতটি বিহার এবং ১১টি বসতিতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ ঘটনায় ১৯টি মামলায় ১৫ হাজার ১৮২ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৪৬৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে রামু থানায় দায়ের করা মামলার আসামি ৩২৩ জন, বাকিরা উখিয়া ও টেকনাফ থানায় দায়ের করা মামলার আসামি। বৌদ্ধ নেতাদের দাবি, প্রকৃত আসামিরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
বিশেষ করে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতার (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) ওপর গ্রেনেড হামলা, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট ৬৩টি জেলায় একযোগে প্রায় ৫০০ বোমা বিস্ফোরণ, ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহ, ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোর টাউন হল মাঠে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনে বোমা হামলা, ২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে সিপিবির জনসভায় বোমা হামলা, একই বছরের ১৪ এপ্রিল রমনা বটমূলে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রামুর ১২টি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধবিহার ও ৩০টির বেশি বসতবাড়িতে এবং ৩০ সেপ্টেম্বর উখিয়া ও টেকনাফে আরো সাতটি বিহার ও ১১টি বসতিতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা আবারও সামনে এসেছে। এসব ঘটনায় গোয়েন্দা ব্যর্থতা নিয়ে আগেও বিস্তর সমালোচনা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এসব ঘটনায় যদি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ব্যর্থ না হতো তাহলে জানমালের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ঠেকানো যেত।
এ সময়ের মধ্যে গোয়েন্দা তৎপরতার সাফল্যের দু-একটি ঘটনার মধ্যে ২০০১ সালে কোটালীপাড়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশস্থলে বোমা পুঁতে রাখার বিষয়টি আগেভাগে ধরে ফেলার ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য।
গত সোমবার পুলিশের ওপর জামায়াত-শিবিরের হামলার ঘটনাকে ওই দিনই এক অনুষ্ঠানে গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা বলে মন্তব্য করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর ওই দিনই দাবি করেন, এ ঘটনায় গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা নেই। তাঁর মতোই ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেন না বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা। তাঁরা বিষয়টিকে ব্যর্থতা না বলে আগাম তথ্য অনুসারে করণীয় ব্যবস্থা না দেওয়াকে দায়ী করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, গোয়েন্দাদের মধ্যে এক ধরনের দুর্বলতা লক্ষ করা যাচ্ছে। বহুদিন ধরেই এটা চোখে পড়ছে। কারণ হামলা হচ্ছে নতুন কৌশলে। অথচ গোয়েন্দা তৎপরতা মান্ধাতার আমলের। এখানে বিনিয়োগ দরকার। নতুন প্রশিক্ষণ দরকার। দরকার গবেষণার। আর এ জন্য নতুন করে চিন্তাভাবনার প্রয়োজন আছে। গোয়েন্দারা অনেক ক্ষেত্রেই আগাম তথ্য জানতে পারছে না।
এ প্রসঙ্গে ডিজিএফআইয়ের সাবেক প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) সাদিক হাসান রুমি কালের কণ্ঠকে বলেন, চোরাগোপ্তা হামলার আগাম খবর সংগ্রহ করা সহজ নয়, বরং কঠিন। এ জন্য সংস্থার মাঠকর্মীদের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়ে দিতে হবে। টার্গেট করে বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠীর মধ্যে সংস্থার লোক ঢুকিয়ে দিতে হবে। এসব এক দিনে সম্ভব নয়, এ জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার; না হলে নিরাপত্তাজনিত সংকট থাকবেই।
জেনারেল রুমি বলেন, 'আমি যেখানে কাজ করেছি, সেখানে সীমিত সম্পদ ও অপর্যাপ্ত মাঠকর্মী পেয়েছি। অন্য সংস্থাগুলোতেও লোকবলের সংকট রয়েছে। যদি পর্যাপ্তসংখ্যক মাঠকর্মী না থাকে, তাহলে লোকাল কর্নারগুলোতে লোক লাগানো সম্ভব হয় না। আর সেটা করতে না পারলে সব খবর আগাম পাওয়া মুশকিল হবে।'
বিষয়গুলোকে ব্যর্থতা হিসেবে দেখেন না র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, গোয়েন্দারা ব্যর্থ নয়। দেশে যেকোনো অঘটনের খবর গোয়েন্দারা আগেই জানতে পারে। বিশেষ করে র্যাব বরাবরই আগাম তথ্যের ভিত্তিতে সতর্ক থাকে। গত সোমবার জামায়াত-শিবিরের হামলার খবর আগেই জেনে নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সারা দেশে সকাল থেকে সতর্কাবস্থায় ছিল র্যাব। র্যাবের ওপর কোনো হামলা হয়নি। পুলিশকেও আগে বিষয়টি জানানো হয়েছিল। কিন্তু তারা হামলা প্রতিরোধ করতে পারেনি। এর দায় পুলিশকেই নিতে হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এর আগে বড় বড় অঘটন সংঘটনের তথ্য আগাম জানতে পেরে সরকারকে সতর্ক করা হয়। বিশেষ করে ২১ আগস্টের ঘটনাসহ বেশ কিছু আলোচিত ঘটনার আগাম তথ্য সে সময়ের সরকারকে জানানো হলেও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আর এ কারণেই হামলার ঘটনাগুলো ঘটছে।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কর্তারা যা-ই বলুন, জনসাধারণ এবং রাজনীতির বিশ্লেষকদের কাছে অনেক ঘটনাই গোয়েন্দা ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত। ক্ষেত্রবিশেষে সরকারের ব্যর্থতা বলেও তাঁরা মনে করেন। তেমনই কয়েকটি বহুল আলোচিত ঘটনার কথা এখানে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো :
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা : ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতার (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) জনসভায় গ্রেনেড হামলায় রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। শতাধিক আহত হন। মামলাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে জজ মিয়া নাটক সাজানো হয় বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মামলার অধিকতর তদন্ত হয়। এতে তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবর, হারিছ চৌধুরী, জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও মুফতি হান্নানের সহযোগী জঙ্গি নেতাসহ ৫২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলা : ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জঙ্গি সংগঠন জেএমবি প্রচলিত শাসন ও বিচার পদ্ধতি বাতিল করে 'আল্লাহর আইন কায়েমের' দাবি জানিয়ে ৬৩টি জেলায় একযোগে প্রায় ৫০০ বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে প্রচারপত্র ছড়ায়। ওই ঘটনায় সারা দেশে ১৫৯টি মামলা হয়। এসব মামলায় মোট আসামির সংখ্যা ৭৪৭ জন। তাদের মধ্যে ৬৪ জন এখনো পলাতক। ৯২টি মামলার রায় হয়েছে। তাতে ২৪৪ জনের সাজা হয়েছে। বিচারে অব্যাহতি পায় গ্রেপ্তার হওয়া ১১৫ জন। বাকি মামলাগুলো বিচারাধীন।
জেএমবির ব্যাপারে শুরুতে বেশ উদাসীন ছিল তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার। দেশব্যাপী বোমা হামলার পর সরকারের টনক নড়ে। এরপর জেএমবিবিরোধী অভিযান শুরু হয়। ২০০৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর থেকে পরের বছরের ২৬ এপ্রিলের মধ্যে শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইসহ জেএমবির শীর্ষস্থানীয় সাত নেতা ধরা পড়ে। ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ শায়খ রহমান, বাংলা ভাই ও সানিসহ পাঁচ জঙ্গিনেতার ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়।
বিডিআর বিদ্রোহ : ২০০৯ সালে ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ জন সেনা-কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। ওই বিদ্রোহে মোট ৩৪৪১টি অস্ত্র ও ৩৬ হাজার গুলি ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া ৭১টি ছোট অস্ত্র, পাঁচটি রাইফেল, একটি এসএমজি, ১৯৯টি আর্জেস গ্রেনেড খোয়া যায় এবং ১৮টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। ওই ঘটনায় সারা দেশে বিডিআরের (বিজিবি) ৫৭টি ইউনিটে বাহিনীর নিজস্ব আইনে বিচার শেষ হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকার পিলখানায় হত্যা, লুণ্ঠনসহ অন্যান্য অপরাধের বিচার চলছে দেশের প্রচলিত আইনে।
উদীচী হত্যাকাণ্ড : ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোর টাউন হল মাঠে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনের শেষ দিনে রাত ১টার কিছু পর বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। বর্বরোচিত ওই হামলায় প্রাণ হারায় ১০ জন। আহত হয় প্রায় ২০০ জন। সেই ঘটনায় ওই বছরের ১৪ ডিসেম্বর বিএনপি নেতা তরিকুল ইসলামসহ ২৪ জনের নামে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। উদীচী হত্যাকাণ্ড ও বিস্ফোরণ ঘটনার সঙ্গে জডিতদের শাস্তির মুখোমুখি করা এখনো সম্ভব হয়নি। মামলার ২৩ আসামি খালাস পান। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর উদীচী মামলার রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করে। ২০১১ সালের ৪ মে আপিলটি গ্রহণ করা হয়। মামলার পুনঃ তদন্তে গতি নেই।
সিপিবি সমাবেশে বোমা হামলা : ২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে সিপিবির জনসভায় বোমা হামলায় সাতজন নিহত ও অর্ধশত ব্যক্তি আহত হয়। এ ঘটনায় সিপিবির তৎকালীন সভাপতি মনজুরুল আহসান খান বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় মামলা করেন। মামলার তদন্তে নিশ্চিত হওয়া গেছে, জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) সদস্যরা পরিকল্পিতভাবে ওই হামলা চালায়। হামলাকারী জঙ্গি মুফতি মঈন উদ্দিন শেখ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার পর থেকেই বেরিয়ে আসতে শুরু করে হামলার মূল কাহিনী। ঘটনার পরিকল্পনাকারী ও হামলাকারী হিসেবে ছিল ১১ জঙ্গি। ঘটনার সঙ্গে জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও বাকিরা পলাতক।
রমনার বটমূলে হামলা : ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনার বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে বোমা হামলার ঘটনার যুগপূর্তি হতে চলেছে। ওই হত্যাকাণ্ডে ১০ ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটে। এ ঘটনায় রমনা থানায় দুটি মামলা হয়েছিল। সাত বছরের বেশি সময় ধরে মামলার তদন্ত হয়। একটি হত্যা ও অন্যটি বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলা। ২০০৮ সালের ৩০ নভেম্বর একই সঙ্গে মামলা দুটির অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। কিন্তু বিচার কচ্ছপগতিতে এগোচ্ছে।
রামু সহিংসতা : গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে হামলা চালিয়ে রামুর ১২টি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধবিহার ও ৩০টির বেশি বসতবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। পরের দিন ৩০ সেপ্টেম্বর উখিয়া ও টেকনাফে আরো সাতটি বিহার এবং ১১টি বসতিতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ ঘটনায় ১৯টি মামলায় ১৫ হাজার ১৮২ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৪৬৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে রামু থানায় দায়ের করা মামলার আসামি ৩২৩ জন, বাকিরা উখিয়া ও টেকনাফ থানায় দায়ের করা মামলার আসামি। বৌদ্ধ নেতাদের দাবি, প্রকৃত আসামিরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
No comments