রাষ্ট্রপতি ভবনের অন্দর মহলে
রাইসিনা হিলসের হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনলেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। আমজনতার জন্য রাষ্ট্রপতি ভবন উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত আগেই নিয়েছেন তিনি। এবার ফিরিয়ে আনলেন স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথা।
তার সিদ্ধান্ত দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু যে দরবার হলে প্রথম শপথ গ্রহণ করেন, সেই হলেই এবার থেকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হবে। প্রথম ভারতীয় গভর্নর জেনারেল রাজা গোপালাচারী এখানেই শপথ নিয়েছিলেন। এতদিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার শপথ হতো অশোকা হলে। রাইসিনা হিলসের প্রাণকেন্দ্র বৃত্তাকার দরবার দল ছিল উপেক্ষিত। জঞ্জাল-আবর্জনার স্তূপে পূর্ণ জয়সলমীরের পীত মার্বেলের চতুষ্কোণের স্তম্ভ চারটি ধুলার আস্তরণে ঢাকা পড়ে ছিল। তার নির্দেশে শুরু হয় সংস্কারযজ্ঞ। তারপর সেই বহু ইতিহাসের সাক্ষী ঝাঁ-চকচকে দরবার হল দেখানো হলো বাছাই করা মিডিয়াকে। উপস্থিত এই প্রতিবেদকও। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি নিজে এসে শোনালেন সেই অতীতের ইতিহাস। ১৮০ ফুট উঁচু রাষ্ট্রপতি ভবনের গম্বুজের প্রায় ১০০ ফুট নিচে ঝোলানো মনমোহনি ঝাড়বাতি থেকে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে চতুষ্কোণ দরবার হলে। বাকিংহাম রাজপ্রাসাদের আদলে তৈরি ঘোরানো ধূসর মার্বেল সিঁড়ি। তার পাশে গ্রিক স্থাপত্যের মতো বাতিস্তম্ভ। এগুলো তৈরি করেছিলেন স্থপতি লুটিয়েন। যিনি রাইসিনা হিলসেরও নির্মাতা। হলের একপ্রান্তে রয়েছে স্বর্ণযুগের সময়ে (গুপ্ত সাম্রাজ্য) নির্মিত গৌতম বুদ্ধের প্রস্তর মূর্তি। হলের প্রবেশদ্বারের বাইরে সম্রাট অশোকের সময়ের প্রস্তর ষাঁড়। ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটের পর যে মন্ত্রিসভা শপথ নেবে তাদের রাষ্ট্রপতি শপথ দেবেন এই দরবার হলে। এখন যেখানে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হয় সেই অশোকা হল হবে বিদেশি অতিথিদের জন্য ব্যাংকোয়েট হল।
অশোকা হল ব্রিটিশ আমলে ভাইসরয়দের বলরুম ছিল। ১০০ ফুট বাই ৬৫ ফুটের হলে রয়েছে কাঠের তৈরি নাচঘর। তার নিচে এক ফোয়ারা। বেলজিয়াম কাচের আরশি বিশাল ঝাড়বাতির রোশনাইয়ে আলোকিত। ওপরের প্রাচীরে অশ্বারোহী পারসিয়ার সম্রাট ফতে আলি শাহর ২২ ছেলে সমেত তৈলচিত্র। সম্রাট ঘোড়ার ওপর বসে শার্দূলের বুকে বর্শা বিঁধছেন। পেছনে গিরিমালা আর নীল হৃদ। পারসিয়ার সম্রাট নিজে রাজা চতুর্থ জর্জকে এ তৈলচিত্রটি উপহার দিয়েছিলেন। ইতালিয়ান চিত্রশিল্পী কলোনেলো এক বছর ধরে ওই পারসিয়ান চিত্রের আদলে ওপরের চারদিকে তৈলচিত্র আঁকেন।
রাষ্ট্রপতি ভবনের গ্রন্থাগার এতদিন অনাদরে পড়েছিল। তারও সংস্কার হলো। এটি কার্যত জাতীয় সম্পদ। রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রায় ২৪ হাজার অমূল্য গ্রন্থ রয়েছে। তার মধ্যে এখন গ্রন্থাগারে রাখা হয়েছে দুষ্প্রাপ্য ২ হাজার বই। প্রাচীন পুস্তকটি আঠারোশ সালের। ত্রিপুরা মহারাজা আলেকজান্ডার বিটসনের লিখিত টিপু সুলতানের সঙ্গে যুদ্ধ ও শ্রীরঙ্গপত্তনমের পতন শীর্ষক বইটি কোনো এক সময় তদানীন্তন গভর্নর জেনারেলকে উপহার দিয়েছিলেন। এখানে রয়েছে লর্ড কার্জনের স্বাক্ষরিত আঠারোশ সাত সালের ব্রিটিশ গ্যালারির চিত্রসংবলিত পুস্তক। রয়েছে জর্জ এলিয়টের সম্পূর্ণ রচনাবলি ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত। রাজা চতুর্থ জর্জ, রাজা চতুর্থ উইলিয়াম এবং রানী ভিকটোরিয়ার সময়ের স্মৃতিকথা। ১৮৪১ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত হাস্যরসের ব্রিটিশ সাপ্তাহিক 'পাঞ্চে'র সব ক'টি সংখ্যা রয়েছে এখানে। রয়েছে ভাইসরয়-গভর্নর জেনারেলদের বক্তৃতার সংকলন। লর্ড বাইরনের সবক'টি গ্রন্থমালা রয়েছে এ গ্রন্থাগারে। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি সংস্কারের পর আজ প্রথম এলেন গ্রন্থাগারে। পরে ঘরোয়া আলাপচারিতায় বলছিলেন, 'এখানকার সব বই পড়তেই আমার পাঁচ বছর কেটে যাবে।'
ব্যাংকোয়েট হল এবং অশোকা হলের মধ্যে সংযোগকারী 'লহিগয়া' বা লবি অন্যতম দর্শনীয় স্থান। জানালার বাইরে দেখা যায় ঐতিহাসিক মোগল গার্ডেন। ব্যাংকোয়েট হলে রয়েছে শাল কাঠের দেয়াল। এর ওপর ব্যালকনিতে রয়েছে সঙ্গীতকারদের বসার স্থান। নিচে বসে তাদের সুরধ্বনি শোনা যায়, কিন্তু দেখা যায় না। ধূসর ও নক্ষত্র খচিত মার্বেলের মেঝে। এক লম্বা টেবিলে ১০৪ জন একত্রে বসতে পারেন এ টেবিলে।
উন্মুক্ত করা হয়েছে লং ড্রইং রুম। এখানে লর্ড মাউন্টব্যাটেন মন্ত্রিসভার বৈঠক করতেন। পরবর্তী সময়েও রাজ্যপালদের বৈঠক হয়েছে। এখানেই আগামী এপ্রিল মাসে রাষ্ট্রপতি সব কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বৈঠক ডেকেছেন। উত্তরদিকের ড্রইং রুমে রাষ্ট্রপতি ভারত সফররত রাষ্ট্রপ্রধানদের স্বাগত বৈঠক করেন। বিপরীত প্রান্তে দক্ষিণ ড্রইং রুম ভারত সফররত রাষ্ট্রপ্রধানরা ভারতীয় গণ্যমান্যদের সঙ্গে মিলিত হন। এটি রাষ্ট্রপতি ভবনের অতিথি ভবনের সঙ্গে যুক্ত। আগে বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানরা এ অতিথি নিবাসেই উঠতেন। একসময় চার্লস-ডায়না, নিকিতা ক্রশ্চেভ বুলগানিনরা এখানেই রাতযাপন করতেন। সেই প্রথা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন রাষ্ট্রপতি সেই প্রথা আবার চালু করতে চান। সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভারত সফরে এসে এখানেই ছিলেন। সেই ট্রাডিশন ফের শুরু হলো।
লক্ষণীয়, উৎসাহী দর্শকরা অনলাইনে নাম লিপিবদ্ধ করে রাষ্ট্রপতি ভবন বিনামূল্যে দেখতে পারবেন সপ্তাহে তিন দিন। এ পর্যন্ত সাতশ' দর্শককে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এভাবে নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থাকা রাইসিনা হিলসকে জনতার জন্য খুলে দিয়ে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি 'জনতার রাষ্ট্রপতি' হয়ে উঠছেন।
গৌতম লাহিড়ী :সমকাল প্রতিনিধি, নয়াদিলি্ল
অশোকা হল ব্রিটিশ আমলে ভাইসরয়দের বলরুম ছিল। ১০০ ফুট বাই ৬৫ ফুটের হলে রয়েছে কাঠের তৈরি নাচঘর। তার নিচে এক ফোয়ারা। বেলজিয়াম কাচের আরশি বিশাল ঝাড়বাতির রোশনাইয়ে আলোকিত। ওপরের প্রাচীরে অশ্বারোহী পারসিয়ার সম্রাট ফতে আলি শাহর ২২ ছেলে সমেত তৈলচিত্র। সম্রাট ঘোড়ার ওপর বসে শার্দূলের বুকে বর্শা বিঁধছেন। পেছনে গিরিমালা আর নীল হৃদ। পারসিয়ার সম্রাট নিজে রাজা চতুর্থ জর্জকে এ তৈলচিত্রটি উপহার দিয়েছিলেন। ইতালিয়ান চিত্রশিল্পী কলোনেলো এক বছর ধরে ওই পারসিয়ান চিত্রের আদলে ওপরের চারদিকে তৈলচিত্র আঁকেন।
রাষ্ট্রপতি ভবনের গ্রন্থাগার এতদিন অনাদরে পড়েছিল। তারও সংস্কার হলো। এটি কার্যত জাতীয় সম্পদ। রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রায় ২৪ হাজার অমূল্য গ্রন্থ রয়েছে। তার মধ্যে এখন গ্রন্থাগারে রাখা হয়েছে দুষ্প্রাপ্য ২ হাজার বই। প্রাচীন পুস্তকটি আঠারোশ সালের। ত্রিপুরা মহারাজা আলেকজান্ডার বিটসনের লিখিত টিপু সুলতানের সঙ্গে যুদ্ধ ও শ্রীরঙ্গপত্তনমের পতন শীর্ষক বইটি কোনো এক সময় তদানীন্তন গভর্নর জেনারেলকে উপহার দিয়েছিলেন। এখানে রয়েছে লর্ড কার্জনের স্বাক্ষরিত আঠারোশ সাত সালের ব্রিটিশ গ্যালারির চিত্রসংবলিত পুস্তক। রয়েছে জর্জ এলিয়টের সম্পূর্ণ রচনাবলি ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত। রাজা চতুর্থ জর্জ, রাজা চতুর্থ উইলিয়াম এবং রানী ভিকটোরিয়ার সময়ের স্মৃতিকথা। ১৮৪১ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত হাস্যরসের ব্রিটিশ সাপ্তাহিক 'পাঞ্চে'র সব ক'টি সংখ্যা রয়েছে এখানে। রয়েছে ভাইসরয়-গভর্নর জেনারেলদের বক্তৃতার সংকলন। লর্ড বাইরনের সবক'টি গ্রন্থমালা রয়েছে এ গ্রন্থাগারে। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি সংস্কারের পর আজ প্রথম এলেন গ্রন্থাগারে। পরে ঘরোয়া আলাপচারিতায় বলছিলেন, 'এখানকার সব বই পড়তেই আমার পাঁচ বছর কেটে যাবে।'
ব্যাংকোয়েট হল এবং অশোকা হলের মধ্যে সংযোগকারী 'লহিগয়া' বা লবি অন্যতম দর্শনীয় স্থান। জানালার বাইরে দেখা যায় ঐতিহাসিক মোগল গার্ডেন। ব্যাংকোয়েট হলে রয়েছে শাল কাঠের দেয়াল। এর ওপর ব্যালকনিতে রয়েছে সঙ্গীতকারদের বসার স্থান। নিচে বসে তাদের সুরধ্বনি শোনা যায়, কিন্তু দেখা যায় না। ধূসর ও নক্ষত্র খচিত মার্বেলের মেঝে। এক লম্বা টেবিলে ১০৪ জন একত্রে বসতে পারেন এ টেবিলে।
উন্মুক্ত করা হয়েছে লং ড্রইং রুম। এখানে লর্ড মাউন্টব্যাটেন মন্ত্রিসভার বৈঠক করতেন। পরবর্তী সময়েও রাজ্যপালদের বৈঠক হয়েছে। এখানেই আগামী এপ্রিল মাসে রাষ্ট্রপতি সব কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বৈঠক ডেকেছেন। উত্তরদিকের ড্রইং রুমে রাষ্ট্রপতি ভারত সফররত রাষ্ট্রপ্রধানদের স্বাগত বৈঠক করেন। বিপরীত প্রান্তে দক্ষিণ ড্রইং রুম ভারত সফররত রাষ্ট্রপ্রধানরা ভারতীয় গণ্যমান্যদের সঙ্গে মিলিত হন। এটি রাষ্ট্রপতি ভবনের অতিথি ভবনের সঙ্গে যুক্ত। আগে বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানরা এ অতিথি নিবাসেই উঠতেন। একসময় চার্লস-ডায়না, নিকিতা ক্রশ্চেভ বুলগানিনরা এখানেই রাতযাপন করতেন। সেই প্রথা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন রাষ্ট্রপতি সেই প্রথা আবার চালু করতে চান। সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভারত সফরে এসে এখানেই ছিলেন। সেই ট্রাডিশন ফের শুরু হলো।
লক্ষণীয়, উৎসাহী দর্শকরা অনলাইনে নাম লিপিবদ্ধ করে রাষ্ট্রপতি ভবন বিনামূল্যে দেখতে পারবেন সপ্তাহে তিন দিন। এ পর্যন্ত সাতশ' দর্শককে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এভাবে নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থাকা রাইসিনা হিলসকে জনতার জন্য খুলে দিয়ে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি 'জনতার রাষ্ট্রপতি' হয়ে উঠছেন।
গৌতম লাহিড়ী :সমকাল প্রতিনিধি, নয়াদিলি্ল
No comments