সব রাজনৈতিক দল তৃণমূলমুখী, লক্ষ্য নির্বাচন by উত্তম চক্রবর্তী

পরস্পরকে মোকাবেলায় হুমকি-ধমকির আড়ালে বড় সব রাজনৈতিক দলগুলোই এখন নির্বাচনীমুখী। সংঘাত-সংঘর্ষের মাধ্যমে শক্তি ক্ষয়ের পরিবর্তে আগামী নির্বাচনকে টার্গেট রেখে নিজ নিজ দলকে চাঙ্গা ও শক্তিশালী করার পাশাপাশি জনসমর্থন বৃদ্ধিই এখন বড় দলগুলোর মূল লক্ষ্য।


সাংগঠনিক তৎপরতা আরও জোরদারের মাধ্যমে আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতিকে এগিয়ে নিতে চাইছে তারা। এ লক্ষ্য পূরণেই রাজধানী থেকে তৃণমূলে ছুটছে রাজনৈতিক দলগুলো।
নিজ নিজ কৌশল ও পরিকল্পনা নিয়ে ছোট বড় সব দলই এখন তৃণমূলমুখী। স্থবির হয়ে থাকা নিজ নিজ দলকে চাঙ্গা ও শক্তিশালী করতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ অধিকাংশ বড় দলই যাচ্ছে তৃণমূলে। তৃণমূলে সভা-সমাবেশ, কর্মিসভা, জনসভা এমনকি মহাসমাবেশে আগামী নির্বাচন কোন্ পদ্ধতিতে হবে সে বিষয়ে জনসমর্থন সৃষ্টির পাশাপাশি সরকার ও বিরোধী দলের নেতিবাচক কর্মকা- জনগণের সামনে তুলে ধরতেই দলগুলোর এই তৃণমূল অভিযান। আর হঠাৎ করেই বড় দলগুলোর এই ‘তৃণমূল মিশন’ আগামী মাস থেকে সরগরম হয়ে উঠবে মাঠের রাজনীতি।
হঠাৎ করেই ‘ব্যাকগিয়ারে’ প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দ্বন্দ্ব ও বিবাদে বিপর্যস্ত দলটির সাংগঠনিক শক্তি। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে বিপর্যস্ত বিএনপির প্রধান শরিক জামায়াতে ইসলামীও। সরকারবিরোধী বড় কোন আন্দোলনে যাওয়ার মতো সাংগঠনিক শক্তি নেই এটা বুঝতে পেরেই আন্দোলনের পরিবর্তে তৃণমূল অভিযানের মাধ্যমে বিপর্যস্ত দলকে সংঘটিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটির হাইকমান্ড। ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ পক্ষে জনমত গঠনÑ মুখে এ কথাটি বললেও মূলত এখন থেকেই আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতিকে এগিয়ে নিতে চাইছে তারা। এতদিন সরকারবিরোধী কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচী দেয়ার হুমকি দিলেও শেষ পর্যন্ত দুই মাসব্যাপী গতানুগতিক কর্মসূচী ঘোষণা করেছে। যেসব কর্মসূচীর অধিকাংশই আগামী নির্বাচনকে টার্গেট করে দল গোছানো এবং জনসমর্থন আদায়।
অন্যদিকে সরকারী দল আওয়ামী লীগ তৃণমূল মিশন শুরু করেছে তিনটি টার্গেট পূরণে। প্রথমত, সরকার থেকে দলকে আলাদা করে প্রান্ত থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সংগঠনকে শক্তিশালী করে ঢেলে সাজানো। প্রায় এক কোটি নতুন সদস্য সংগ্রহে ব্যাপক অভিযান এবং বিরোধী দলকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলার পাশাপাশি সরকারের সাফল্যগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরা। এ লক্ষ্যে আগামী মাস থেকে আওয়ামী লীগ শুরু করছে প্রায় তিন মাসব্যাপী ব্যাপক তৃণমূল অভিযান।
শুধু আওয়ামী লীগ বা বিএনপিই নয়, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, সিপিবিসহ অন্য ছোটখাটো রাজনৈতিক দলগুলোও তৃণমূল থেকে সংগঠনকে শক্তিশালী করার পরিকল্পনা নিয়েছে। মহাজোটের প্রধান শরিক জাতীয় পার্টিও ঘোষণা করেছে দুই মাসব্যাপী তৃণমূল কর্মসূচী। আলাদা নির্বাচনের পক্ষে জনমত সৃষ্টির কথা বলা হলেও জাপা চাইছে গত নির্বাচনে বিজয়ী আসনগুলো ধরে রাখার পাশাপাশি সম্ভাবনাময় আসনগুলোতে নিজ দলের শক্তি বৃদ্ধি। নির্বাচনের ১৪ মাস আগেই রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে বেড়ে গেছে তৃণমূল নেতাদের কদর। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সংগঠনের প্রাণশক্তি তৃণমূল নেতাদের মূল্যায়নের আশ্বাসও দেয়া হচ্ছে সব দল থেকেই।
‘বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো’Ñ প্রবাদের মতোই অবস্থা হয়েছে বিএনপির। ঈদের পর কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি মেনে নিতে বাধ্য করা হবেÑ এমন হুমকি-ধমকি দেয়া হলেও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত ১৪ দলীয় জোটের বৈঠকে কার্যত কোন আন্দোলনের কর্মসূচীই ঘোষণা করতে পারেনি। জানা গেছে, বিপর্যস্ত সাংগঠনিক অবস্থার কথা চিন্তায় রেখে দলটির হাইকমান্ড চাইছে, সংঘাত-সংঘর্ষে জড়িয়ে সাংগঠনিক শক্তি ক্ষয় করার পরিবর্তে তৃণমূল মিশনের মাধ্যমে নির্বাচনী জোটকে শক্তিশালী এবং নির্বাচনীমুখী করে গড়ে তুলতে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দলটির হাইকমান্ডের মধ্যে একটি ধারণা রয়েছে যে সরকার বিরোধী দলকে বেকায়দায় ফেলতে হঠাৎ করেই আগামী নির্বাচন দিতে পারে। আর তেমন হলে বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। সে নির্বাচনে অংশ না নিলে একদিকে যেমন দল ভাঙ্গনের আশঙ্কা রয়েছে, অন্যদিকে নির্বাচনে অংশ নিলে প্রস্তুতি না থাকায় ভোটের ফল ভাল নাও হতে পারে। এই দুই আশঙ্কা থেকেই বিএনপিসহ নির্বাচনের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা ১৮ দলীয় জোটটি আন্দোলনের পরিবর্তে নির্বাচনী প্রস্তুতি হিসেবে সারাদেশে সংগঠনকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে।
আর এ টার্গেট থেকেই সরকারবিরোধী আন্দোলনের পরিবর্তে গতানুগতিক কর্মসূচী ঘোষণা করেছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন এই নির্বাচনী জোটটি। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার পুনর্বহালসহ বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ, সমাবেশ, মিছিল, গণসংযোগসহ দুই মাসব্যাপী কর্মসূচী দিয়েছে তারা। ৭ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত দেশব্যাপী এই কর্মসূচী চালাবে তারা। দলটির সূত্রগুলো বলছে, এই দুই মাসব্যাপী কর্মসূচীর মধ্যে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াও অংশ নেবেন। খালেদা জিয়াসহ জোটের শীর্ষ নেতারা দেশের বিভিন্নস্থানে সভা-সমাবেশ ও জনসভার নামে সরকারের নেতিবাচক দিক তুলে ধরার পাশাপাশি আগামী নির্বাচনে সমর্থন আদায়ের চেষ্টাও করবেন দেশবাসীর।
আন্দোলনের পরিবর্তে বিএনপির এই তৃণমূল মিশনের কৌশল প্রসঙ্গে দলটির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই নিজস্ব কৌশল থাকে। আমরা সারাদেশে দলকে গুছিয়ে আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। দলকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি জনসমর্থন আদায়ের মাধ্যমেই আমরা আস্তে আস্তে কঠোর কর্মসূচী ঘোষণা করব।
এদিকে ঘোষণা দিয়েই আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতির কাজ শুরু করেছে শাসক দল আওয়ামী লীগ। দলটির নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবেলার পরিবর্তে সাংগঠনিক তৎপরতা আরও জোরদারের মাধ্যমে আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতিকে এগিয়ে নিতে চান তাঁরা। সাংগঠনিক তৎপরতা জোরদার এবং ধারাবাহিক কাউন্সিলের মাধ্যমে সারাদেশে সংগঠনকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে ইতোমধ্যেই ব্যাপক কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়েছে দলটির সর্বোচ্চ পর্যায়ের বৈঠক থেকে। আগামী মাস থেকে শুরু করে ধারাবাহিক কাউন্সিলের মাধ্যমে তৃণমূলে সংগঠনকে শক্ত ভীতের ওপর দাঁড় করিয়ে আগামী নির্বাচনের জন্য দলকে এখন থেকেই প্রস্তুত করে তোলার টার্গেট নিয়েই মাঠে নামছেন দলটির নীতিনির্ধারক নেতারা।
সাংগঠনিক পুনর্গঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, বিরোধী দলের সরকারবিরোধী প্রচার ও সম্ভাব্য আন্দোলন মোকাবেলায় সংগঠনকে শক্তিশালী ও গতিশীল করতে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও পরিকল্পনা নিয়ে তাঁদের তৃণমূল মিশন শুরু হচ্ছে। মন্ত্রী ও দলীয় সংসদ সদস্যদের সঙ্গে তৃণমূল নেতাদের দূরত্ব কমানো, বিদ্যমান কোন্দল-দ্বন্দ্ব নিরসন, জেলা-উপজেলায় বর্ধিতসভা করে দলীয় সমস্যা চিহ্নিতকরণ, মাঠ পর্যায়ে সরকারের সাফল্যে ব্যাপকভাবে তুলে ধরা, বিরোধী দলের অপপ্রচারের জবাব দেয়া, ক্ষমতায় আসার পর চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিসহ অনৈতিক কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত নেতাকর্মীদের চিহ্নিত করে নিয়ন্ত্রণ ও সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সর্বশেষ দেশের তরুণ ও নারী ভোটারদের আওয়ামী লীগের পতাকাতলে শামিল করতে সদস্য সংগ্রহ অভিযান জোরদার করাই প্রথম যাত্রায় তৃণমূল মিশনে নেয়া পরিকল্পনায় প্রাধান্য পাবে।
ইতোমধ্যে তৃণমূল সম্মেলন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও সমন্বয় করার জন্য দলের অধিকাংশ সিনিয়র নেতা ও মন্ত্রীদের নিয়ে ১২ টিমও গঠন করা হয়েছে। আগামী মাসের শুরু থেকেই তাঁরা সারাদেশে সাংগঠনিক সফরের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে জনমত গঠনের পাশাপাশি তৃণমূল সম্মেলনের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার কাজে তদারকি করবেন। এ লক্ষ্যে জেলায় জেলায় বর্ধিতসভা, কর্মিসভা এবং সমাবেশ আয়োজন করার জন্যও কেন্দ্রীয় তরফে সারাদেশের নেতাদের কাছে চিঠিও পাঠানো হয়েছে।
দলের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তৃণমূল পর্যায়ে সম্মেলনের মাধ্যমে সর্বস্তরে সংগঠন গুছিয়ে নেয়ার জন্য ৬৬টি সাংগঠনিক জেলা, সাত মহানগর শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের চিঠির মাধ্যমে নির্দেশ দিয়েছেন। ওই নির্দেশের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিভিন্ন স্তরের সম্মেলনের বিষয়ে বিস্তারিত সাংগঠনিক কর্মসূচী তৃণমূল নেতাদের স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। শুধু সম্মেলনের প্রস্তুতিই নয়, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের নতুন সদস্য সংগ্রহ অভিযানকেও জোরদার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ-বিএনপির পাশাপাশি অন্য দলগুলোও বসে নেই। মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টিও ৩শ’ আসনেই দলকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে। আগামী মাস থেকে তৃণমূল পর্যায়ে গিয়ে অভিযান শুরুর ঘোষণাও দিয়েছে তারা। জাতীয় পার্টিকে মানুষের ঘরে ঘরে নিয়ে যেতে দলটির চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদ নিজেই আগামী মাস থেকে সারাদেশে সফর করবেন বলে জানা গেছে। দলটির একাধিক নেতার মতে, বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ না নিলে জাতীয় পার্টি এককভাবেই নির্বাচনে অংশ নেবে। আর নির্বাচনে অংশ নিলে মহাজোটেই থাকবে তারা। তবে মহাজোটে দুর্বল নয়, শক্তিশালী পার্টনার হয়ে থাকতে চায় দলটির নীতিনির্ধারকরা। তাই জাপাকে শক্তিশালী করতে দেশের প্রত্যেক জেলা-উপজেলায় সভা-সমাবেশ ও কর্মিসভা করবে তারা।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার জনকণ্ঠকে বলেন, আগামী তিন মাস ধরে জেলা ও বিভাগীয় শহরে দলীয় কার্যক্রম জোরদার করা হবে। এক সেপ্টেম্বর থেকে তিন-চার সদস্য বিশিষ্ট একটি কেন্দ্রীয় টিম দেশের বিভিন্ন স্থানে সফর করবেন। এ সময় জেলায় জেলায় কর্মীসভার আয়োজন করা হবে। তাছাড়া তৃণমূল পর্যায় থেকে দলকে শক্তিশালী করতে যা যা করা দরকার তাই করা হবে। পার্টির চেয়ারম্যান আগামী নবেম্বর মাসে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে জনসভা করবেন এবং এর মাধ্যমে দলকে চাঙ্গা করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.