সময়চিত্র- বিএনপি: কৌশলী, নাকি অকর্মণ্য by আসিফ নজরু
এবিএম মূসা দেশের বয়োজ্যেষ্ঠ এবং শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক। আশি পেরোনো তারুণ্যেও এখনো তিনি দেশের পরিস্থিতি নিয়ে মূল্যবান বক্তব্য দেন। কয়েক দিন আগে এক টিভি টক শোতে তিনি বললেন, বিএনপি এখনই সরকারবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ছে না কৌশলগত কারণে।
তাঁর মতে, আওয়ামী লীগই বরং অধীর হয়ে ভাবছে, বিএনপি কেন আন্দোলনে যাচ্ছে না!
এবিএম মূসার ইঙ্গিত স্পষ্ট। কথা ছিল ঈদের পরই বিএনপি দেশব্যাপী সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেমে পড়বে। কিন্তু ২৬ আগস্টের দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠক শেষে জানা গেল যে আপাতত বিএনপি কেবল সাংগঠনিক সফর এবং ছোটখাটো বিক্ষোভ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। বিএনপি জানিয়েছে, তারা বড় ধরনের আন্দোলনে ডিসেম্বরের আগে যাচ্ছে না। মনে হতে পারে, এটি তাদের একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত। আবার অন্য বিবেচনায় এ জন্য অনেকে বিরোধী দলকে অকর্মণ্যও ভাবতে পারে।
বিএনপি কৌশলগত কোনো সিদ্ধান্তের কথা স্পষ্ট করে বলেনি। শিগগিরই আন্দোলন শুরু করলে সামনে কোরবানির ঈদ এবং স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা আন্দোলনের গতিচ্ছেদ এবং এ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে বিরূপ ধারণা তৈরি হতে পারে। আন্দোলনে পিছিয়ে আসার যুক্তি হিসেবে এটিই বলা হচ্ছে এখন। কিন্তু এটি খুব গ্রহণযোগ্য যুক্তি নয়। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে আন্দোলন শুরু করলে জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে এসএসসি পরীক্ষার কথা ভাবতে হবে, এরপর আন্দোলন শুরু করলে এইচএসসি পরীক্ষার সমস্যা থাকবে। বিএনপি সম্ভবত এখনই আন্দোলন করছে না; বরং অনুচ্চারিত কোনো কৌশলের কারণে। কিন্তু বিএনপির জন্য সমস্যা হচ্ছে, বেশি দেরি করলে দলটির আন্দোলন-ক্ষমতা খর্ব হতে পারে এবং এ নিয়ে মানুষের মনে অনাস্থা তৈরি হতে পারে।
২.
কৌশলের কথা আসে এ জন্য যে বিএনপি এখনই তীব্র আন্দোলন করলে তা আওয়ামী লীগের জন্য ভালো হতে পারত। আন্দোলন তীব্র হলে নাশকতামূলক ঘটনার আশঙ্কা থাকে বেশি। বাংলাদেশে সরকারগুলো কখনো কখনো নিজেরা অনুপ্রবেশকারীদের দিয়ে নাশকতা ঘটিয়ে বিরোধী নেতাদের দায়ী, গ্রেপ্তার ও নাজেহাল করে। সুশক্ত আন্দোলন না হলে এই প্রক্রিয়ায় তা দমনও করা যায়। আবার কখনো কখনো বিরোধী দলই এমন ঘটনা ঘটিয়ে থাকে আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধির জন্য। যে-ই ঘটাক, এ ধরনের ঘটনা, ব্যাপক নাশকতা হলে হয় সরকারের পতন পর্যন্ত আন্দোলনকে টেনে নিতে হয় অথবা আপাতত যুদ্ধবিরতি ঘটিয়ে সত্যিকারের গণ-আন্দোলনের জন্য শক্তি সংহত করতে হয়।
সত্যিকার গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা বা এভাবে সরকারের পতন ঘটানো অবশ্য সহজসাধ্য নয়। বাংলাদেশে এরশাদ-পরবর্তী সময়ে কেবল একবারই ১৯৯৬ সালে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা গেছে। সেই আন্দোলনও হয়তো সফল হতো না যদি আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপিকে নিঃসঙ্গ করে দিতে না পারত। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বর্তমানে আওয়ামী লীগকে একইভাবে নিঃসঙ্গ করার মতো পরিস্থিতি দেশে বিরাজ করছে না; বরং যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং সরকারের শক্ত নীতির কারণে বিএনপির সবচেয়ে বড় সহযোগী শক্তি জামায়াত এখন অনেকাংশে দুর্বল হয়ে পড়েছে। আন্দোলন করতে হলে বিএনপিকে মূলত এককভাবেই তা করতে হবে। সেটি করার মতো জনসমর্থন বিএনপির রয়েছে, তার ইঙ্গিত ১২ মার্চের সমাবেশে দেখা গেছে। বিএনপির প্রথম সারির অধিকাংশ নেতা কারারুদ্ধ থাকার পর ১১ জুনের কর্মসূচিতেও ব্যাপক জনসমাগম হয়েছে। কিন্তু জনসমর্থনকে একটি যৌক্তিক পরিণতিতে টেনে নেওয়ার সময় ঠিক এখনই কি না, তা নিয়ে বিএনপির মধ্যে বিভ্রান্তি রয়েছে।
এখনই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লে বিএনপির প্রথম সারির নেতাদের আবারও কারারুদ্ধ করার মতো কঠোরতা সরকার দেখাবে, তা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সচিবালয়ে ককটেল বিস্ফোরণ এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে গাড়ি পোড়ানোর যে দুটো প্রায়-অবিশ্বাস্য মামলায় বিএনপির প্রথম সারির নেতাদের কারাবন্দী করা হয়েছিল, তার বিচারিক সুরাহা এখনো হয়নি। শিগগিরই আন্দোলনের পথে গেলে তাঁরা দণ্ডিত হয়ে সামনের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হতে পারেন। কঠোর আন্দোলনকে মোকাবিলা করার জন্য সরকার একপর্যায়ে এমনকি খালেদা জিয়াকেও গ্রেপ্তার বা গৃহবন্দী করতে পারে।
এসব বিবেচনা করলে মনে হতে পারে যে এখনই আন্দোলনে না গিয়ে বিএনপি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হলে বিএনপিকে আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে দেশে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতেই হবে। বিরোধী দল অকর্মণ্য ও শক্তিহীন—এমন ধারণা বিরাজ করলে আন্তর্জাতিক মহল তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্য অর্থবহ চাপ প্রয়োগ করবে না এবং আওয়ামী লীগ তাতে নতি স্বীকার করবে না।
৩.
বিএনপির আন্দোলন-ক্ষমতা সম্পর্কে অনেকের মূল্যায়ন খুব ইতিবাচক নয়। আমি নিজে প্রায়ই বলি, বিএনপি হচ্ছে মূলত সমর্থকদের দল, আওয়ামী লীগ কর্মীদের। এর মানে এই নয় যে বিএনপির কর্মী নেই তেমন। বিএনপির কর্মীবাহিনী রয়েছে, তবে তা আওয়ামী লীগের মতো বিশাল, কমিটেড ও পোড় খাওয়া নয়। আশির শেষ দিকে ও নব্বই দশকের প্রথম দিকে বিএনপির অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং বিশাল একটি ছাত্রসংগঠন ছিল। কিন্তু নেতৃত্ব নির্বাচনে মারাত্মক ভুল, আঞ্চলিকীকরণ এবং ছাত্রদলকে নিয়ন্ত্রণকারী বিএনপির কোনো কোনো নেতার নৈতিক অধঃপতনের জন্য ছাত্রদল একটি ক্ষয়িষ্ণু শক্তিতে পরিণত হয়। মূল দল এবং অন্যান্য অঙ্গসংগঠনে নিয়মিত কাউন্সিল অনুষ্ঠান এবং গণতান্ত্রিকভাবে নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণেও দলের অনেক কর্মী নিষপ্রভ হয়ে পড়ে। সর্বশেষ ওয়ান-ইলেভেনকেন্দ্রিক বিভাজনের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির আন্দোলনের শক্তি আরও কমে যায়।
বলা যায়, দেশ পরিচালনায় বর্তমান সরকারের একের পর এক ব্যর্থতার কারণে বিএনপির পক্ষে সাম্প্রতিক সময়ে পুনরায় ব্যাপক জনসমর্থন অর্জন করা সম্ভব হয়। এই জনসমর্থনের প্রমাণ শুধু দলের বড় কর্মসূচিগুলোতে নয়, গত তিন বছরের বিভিন্ন নির্বাচনে দেখা গেছে। একদিকে দ্রব্যমূল্য, ছাত্রলীগের সন্ত্রাস, শেয়ার মার্কেটে ধস, দুর্নীতি এবং ভারতের প্রতি নতজানু নীতির কারণে সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ মানুষের নেতিবাচক সমর্থন বিএনপি পেয়েছে, অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের কোন্দল তাদের অবশিষ্ট শক্তিকে খণ্ডিত করেছে। স্থানীয় নির্বাচন তো বটেই, পেশাজীবীদের কিছু নির্বাচনে এমন কিছু অভাবিত ফলাফল ঘটেছে, যা এককথায় নজিরবিহীন (যেমন—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট নির্বাচনে সব কটি আসনে এবং বার কাউন্সিল নির্বাচনে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিএনপিপন্থীদের বিজয়)। কিন্তু এসব সাফল্য বা জনপ্রিয়তার পুনরুত্থান বিএনপির জন্য মূল্যহীন হয়ে পড়বে যদি আগামী সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত না হয়। এ ধরনের নির্বাচন নিশ্চিত করার সক্ষমতা দলীয় সরকারের যতটা রয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি রয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মোকাবিলা করার জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপিকে অংশ নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তবে সর্বদলীয় কোনো সরকারের পক্ষেও সম্ভবত সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করা সম্ভব হবে না কয়েকটি কারণে। প্রথমত, বাংলাদেশের সংবিধান মোতাবেক দেশের শাসনক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত বলে এ পদে শেখ হাসিনা (বা আওয়ামী লীগের অন্য কেউ) থাকলে নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপির কোনো মন্ত্রীর পক্ষে জনপ্রশাসন ও পুলিশকে পুনর্বিন্যাস করা সম্ভব হবে না। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনকালীন সরকারে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে কোনো নতুন সিদ্ধান্ত (যেমন—নির্বাচনকেন্দ্রে সেনা মোতায়েন) অন্যদের পক্ষে গ্রহণ করা সহজসাধ্য হবে না। তৃতীয়ত, এ ধরনের পরিস্থিতিতে নির্বাচনকালীন সরকার থেকে বিএনপির কোনো মন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়ে পদত্যাগ করলে দেশে যে সংঘাত সৃষ্টি হবে, তাতে নির্বাচন ভন্ডুল হতে পারে এবং অরাজনৈতিক কোনো শক্তি ক্ষমতায় আসতে পারে।
বিএনপিকে তাই ভবিষ্যতে ক্ষমতায় যেতে হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে বাস্তবায়ন করতে হবে। এ জন্য বিএনপিকে রাজপথে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলার উপযুক্ত সময় বেছে নিতে হবে। বাংলাদেশে ঐতিহাসিকভাবে সরকারের শেষ ছয় মাসে জনগণের মধ্যে রাস্তায় নেমে আসার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগের তা না জানার কথা নয়। কাজেই আওয়ামী লীগ পরিস্থিতি আগেই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার জন্য বিএনপি নেতাদের কারারুদ্ধ করা বা হঠাৎ আগাম নির্বাচনের ঘোষণাও দিতে পারে। এমন পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বিএনপিকে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিএনপিকে একই সঙ্গে প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক মহলগুলোর আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হবে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে জঙ্গিবাদের প্রত্যাবর্তন ঘটবে না, ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলোকে কোনো রকম মদদ দেওয়া হবে না এবং আন্তর্জাতিক পুঁজির স্বার্থ ক্ষুণ্ন করা হবে না—এই মর্মে ভারত, আমেরিকা ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে যথেষ্টভাবে আশ্বস্ত করতে পারলেই কেবল সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য চাপ প্রয়োগে এরা আন্তরিক হবে।
৪.
সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশের পরিস্থিতির নাটকীয় উন্নতি হবে—এটি ভাবার কারণ নেই। বিএনপির নেত্রী ২০০৬ সালে তাঁদের কিছু ভুলের কথা স্বীকার করেছেন। কিন্তু সেসব ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না, দুর্নীতি-সন্ত্রাস-দলীয়করণের ব্যাধিতে বিএনপির আগামী সরকারও আক্রান্ত হবে না কিংবা ক্ষমতায় গিয়ে বিএনপি আওয়ামী লীগের ওপর প্রতিশোধস্পৃহায় নেমে পড়বে না—এমন কোনো আশাবাদ বিএনপি এখনো সৃষ্টি করতে পারেনি। এর পরও আগামী নির্বাচন আগের চারটি নির্বাচনের মতো সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হলে গণতন্ত্রের একটি মৌলিক শর্ত অন্তত পূরণ হবে। গণতন্ত্রের স্বার্থে জাতীয় নির্বাচনে জনগণের প্রকৃত রায়ের প্রতিফলন নিশ্চিত করার মূল্যও কম নয়।
সুষ্ঠুভাবে এমন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠায় পর্যাপ্ত চাপ প্রয়োগ বা উপযুক্ত সমঝোতা সৃষ্টিতে বিএনপিকে সফল হতে হবে। না হলে চূড়ান্ত বিচারে বিএনপি একটি অকর্মণ্য বিরোধী দল হিসেবে বিবেচিত হবে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এবিএম মূসার ইঙ্গিত স্পষ্ট। কথা ছিল ঈদের পরই বিএনপি দেশব্যাপী সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেমে পড়বে। কিন্তু ২৬ আগস্টের দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠক শেষে জানা গেল যে আপাতত বিএনপি কেবল সাংগঠনিক সফর এবং ছোটখাটো বিক্ষোভ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। বিএনপি জানিয়েছে, তারা বড় ধরনের আন্দোলনে ডিসেম্বরের আগে যাচ্ছে না। মনে হতে পারে, এটি তাদের একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত। আবার অন্য বিবেচনায় এ জন্য অনেকে বিরোধী দলকে অকর্মণ্যও ভাবতে পারে।
বিএনপি কৌশলগত কোনো সিদ্ধান্তের কথা স্পষ্ট করে বলেনি। শিগগিরই আন্দোলন শুরু করলে সামনে কোরবানির ঈদ এবং স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা আন্দোলনের গতিচ্ছেদ এবং এ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে বিরূপ ধারণা তৈরি হতে পারে। আন্দোলনে পিছিয়ে আসার যুক্তি হিসেবে এটিই বলা হচ্ছে এখন। কিন্তু এটি খুব গ্রহণযোগ্য যুক্তি নয়। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে আন্দোলন শুরু করলে জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে এসএসসি পরীক্ষার কথা ভাবতে হবে, এরপর আন্দোলন শুরু করলে এইচএসসি পরীক্ষার সমস্যা থাকবে। বিএনপি সম্ভবত এখনই আন্দোলন করছে না; বরং অনুচ্চারিত কোনো কৌশলের কারণে। কিন্তু বিএনপির জন্য সমস্যা হচ্ছে, বেশি দেরি করলে দলটির আন্দোলন-ক্ষমতা খর্ব হতে পারে এবং এ নিয়ে মানুষের মনে অনাস্থা তৈরি হতে পারে।
২.
কৌশলের কথা আসে এ জন্য যে বিএনপি এখনই তীব্র আন্দোলন করলে তা আওয়ামী লীগের জন্য ভালো হতে পারত। আন্দোলন তীব্র হলে নাশকতামূলক ঘটনার আশঙ্কা থাকে বেশি। বাংলাদেশে সরকারগুলো কখনো কখনো নিজেরা অনুপ্রবেশকারীদের দিয়ে নাশকতা ঘটিয়ে বিরোধী নেতাদের দায়ী, গ্রেপ্তার ও নাজেহাল করে। সুশক্ত আন্দোলন না হলে এই প্রক্রিয়ায় তা দমনও করা যায়। আবার কখনো কখনো বিরোধী দলই এমন ঘটনা ঘটিয়ে থাকে আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধির জন্য। যে-ই ঘটাক, এ ধরনের ঘটনা, ব্যাপক নাশকতা হলে হয় সরকারের পতন পর্যন্ত আন্দোলনকে টেনে নিতে হয় অথবা আপাতত যুদ্ধবিরতি ঘটিয়ে সত্যিকারের গণ-আন্দোলনের জন্য শক্তি সংহত করতে হয়।
সত্যিকার গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা বা এভাবে সরকারের পতন ঘটানো অবশ্য সহজসাধ্য নয়। বাংলাদেশে এরশাদ-পরবর্তী সময়ে কেবল একবারই ১৯৯৬ সালে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা গেছে। সেই আন্দোলনও হয়তো সফল হতো না যদি আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপিকে নিঃসঙ্গ করে দিতে না পারত। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বর্তমানে আওয়ামী লীগকে একইভাবে নিঃসঙ্গ করার মতো পরিস্থিতি দেশে বিরাজ করছে না; বরং যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং সরকারের শক্ত নীতির কারণে বিএনপির সবচেয়ে বড় সহযোগী শক্তি জামায়াত এখন অনেকাংশে দুর্বল হয়ে পড়েছে। আন্দোলন করতে হলে বিএনপিকে মূলত এককভাবেই তা করতে হবে। সেটি করার মতো জনসমর্থন বিএনপির রয়েছে, তার ইঙ্গিত ১২ মার্চের সমাবেশে দেখা গেছে। বিএনপির প্রথম সারির অধিকাংশ নেতা কারারুদ্ধ থাকার পর ১১ জুনের কর্মসূচিতেও ব্যাপক জনসমাগম হয়েছে। কিন্তু জনসমর্থনকে একটি যৌক্তিক পরিণতিতে টেনে নেওয়ার সময় ঠিক এখনই কি না, তা নিয়ে বিএনপির মধ্যে বিভ্রান্তি রয়েছে।
এখনই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লে বিএনপির প্রথম সারির নেতাদের আবারও কারারুদ্ধ করার মতো কঠোরতা সরকার দেখাবে, তা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সচিবালয়ে ককটেল বিস্ফোরণ এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে গাড়ি পোড়ানোর যে দুটো প্রায়-অবিশ্বাস্য মামলায় বিএনপির প্রথম সারির নেতাদের কারাবন্দী করা হয়েছিল, তার বিচারিক সুরাহা এখনো হয়নি। শিগগিরই আন্দোলনের পথে গেলে তাঁরা দণ্ডিত হয়ে সামনের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হতে পারেন। কঠোর আন্দোলনকে মোকাবিলা করার জন্য সরকার একপর্যায়ে এমনকি খালেদা জিয়াকেও গ্রেপ্তার বা গৃহবন্দী করতে পারে।
এসব বিবেচনা করলে মনে হতে পারে যে এখনই আন্দোলনে না গিয়ে বিএনপি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হলে বিএনপিকে আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে দেশে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতেই হবে। বিরোধী দল অকর্মণ্য ও শক্তিহীন—এমন ধারণা বিরাজ করলে আন্তর্জাতিক মহল তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্য অর্থবহ চাপ প্রয়োগ করবে না এবং আওয়ামী লীগ তাতে নতি স্বীকার করবে না।
৩.
বিএনপির আন্দোলন-ক্ষমতা সম্পর্কে অনেকের মূল্যায়ন খুব ইতিবাচক নয়। আমি নিজে প্রায়ই বলি, বিএনপি হচ্ছে মূলত সমর্থকদের দল, আওয়ামী লীগ কর্মীদের। এর মানে এই নয় যে বিএনপির কর্মী নেই তেমন। বিএনপির কর্মীবাহিনী রয়েছে, তবে তা আওয়ামী লীগের মতো বিশাল, কমিটেড ও পোড় খাওয়া নয়। আশির শেষ দিকে ও নব্বই দশকের প্রথম দিকে বিএনপির অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং বিশাল একটি ছাত্রসংগঠন ছিল। কিন্তু নেতৃত্ব নির্বাচনে মারাত্মক ভুল, আঞ্চলিকীকরণ এবং ছাত্রদলকে নিয়ন্ত্রণকারী বিএনপির কোনো কোনো নেতার নৈতিক অধঃপতনের জন্য ছাত্রদল একটি ক্ষয়িষ্ণু শক্তিতে পরিণত হয়। মূল দল এবং অন্যান্য অঙ্গসংগঠনে নিয়মিত কাউন্সিল অনুষ্ঠান এবং গণতান্ত্রিকভাবে নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণেও দলের অনেক কর্মী নিষপ্রভ হয়ে পড়ে। সর্বশেষ ওয়ান-ইলেভেনকেন্দ্রিক বিভাজনের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির আন্দোলনের শক্তি আরও কমে যায়।
বলা যায়, দেশ পরিচালনায় বর্তমান সরকারের একের পর এক ব্যর্থতার কারণে বিএনপির পক্ষে সাম্প্রতিক সময়ে পুনরায় ব্যাপক জনসমর্থন অর্জন করা সম্ভব হয়। এই জনসমর্থনের প্রমাণ শুধু দলের বড় কর্মসূচিগুলোতে নয়, গত তিন বছরের বিভিন্ন নির্বাচনে দেখা গেছে। একদিকে দ্রব্যমূল্য, ছাত্রলীগের সন্ত্রাস, শেয়ার মার্কেটে ধস, দুর্নীতি এবং ভারতের প্রতি নতজানু নীতির কারণে সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ মানুষের নেতিবাচক সমর্থন বিএনপি পেয়েছে, অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের কোন্দল তাদের অবশিষ্ট শক্তিকে খণ্ডিত করেছে। স্থানীয় নির্বাচন তো বটেই, পেশাজীবীদের কিছু নির্বাচনে এমন কিছু অভাবিত ফলাফল ঘটেছে, যা এককথায় নজিরবিহীন (যেমন—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট নির্বাচনে সব কটি আসনে এবং বার কাউন্সিল নির্বাচনে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিএনপিপন্থীদের বিজয়)। কিন্তু এসব সাফল্য বা জনপ্রিয়তার পুনরুত্থান বিএনপির জন্য মূল্যহীন হয়ে পড়বে যদি আগামী সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত না হয়। এ ধরনের নির্বাচন নিশ্চিত করার সক্ষমতা দলীয় সরকারের যতটা রয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি রয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মোকাবিলা করার জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপিকে অংশ নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তবে সর্বদলীয় কোনো সরকারের পক্ষেও সম্ভবত সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করা সম্ভব হবে না কয়েকটি কারণে। প্রথমত, বাংলাদেশের সংবিধান মোতাবেক দেশের শাসনক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত বলে এ পদে শেখ হাসিনা (বা আওয়ামী লীগের অন্য কেউ) থাকলে নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপির কোনো মন্ত্রীর পক্ষে জনপ্রশাসন ও পুলিশকে পুনর্বিন্যাস করা সম্ভব হবে না। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনকালীন সরকারে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে কোনো নতুন সিদ্ধান্ত (যেমন—নির্বাচনকেন্দ্রে সেনা মোতায়েন) অন্যদের পক্ষে গ্রহণ করা সহজসাধ্য হবে না। তৃতীয়ত, এ ধরনের পরিস্থিতিতে নির্বাচনকালীন সরকার থেকে বিএনপির কোনো মন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়ে পদত্যাগ করলে দেশে যে সংঘাত সৃষ্টি হবে, তাতে নির্বাচন ভন্ডুল হতে পারে এবং অরাজনৈতিক কোনো শক্তি ক্ষমতায় আসতে পারে।
বিএনপিকে তাই ভবিষ্যতে ক্ষমতায় যেতে হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে বাস্তবায়ন করতে হবে। এ জন্য বিএনপিকে রাজপথে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলার উপযুক্ত সময় বেছে নিতে হবে। বাংলাদেশে ঐতিহাসিকভাবে সরকারের শেষ ছয় মাসে জনগণের মধ্যে রাস্তায় নেমে আসার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগের তা না জানার কথা নয়। কাজেই আওয়ামী লীগ পরিস্থিতি আগেই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার জন্য বিএনপি নেতাদের কারারুদ্ধ করা বা হঠাৎ আগাম নির্বাচনের ঘোষণাও দিতে পারে। এমন পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বিএনপিকে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিএনপিকে একই সঙ্গে প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক মহলগুলোর আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হবে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে জঙ্গিবাদের প্রত্যাবর্তন ঘটবে না, ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলোকে কোনো রকম মদদ দেওয়া হবে না এবং আন্তর্জাতিক পুঁজির স্বার্থ ক্ষুণ্ন করা হবে না—এই মর্মে ভারত, আমেরিকা ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে যথেষ্টভাবে আশ্বস্ত করতে পারলেই কেবল সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য চাপ প্রয়োগে এরা আন্তরিক হবে।
৪.
সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশের পরিস্থিতির নাটকীয় উন্নতি হবে—এটি ভাবার কারণ নেই। বিএনপির নেত্রী ২০০৬ সালে তাঁদের কিছু ভুলের কথা স্বীকার করেছেন। কিন্তু সেসব ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না, দুর্নীতি-সন্ত্রাস-দলীয়করণের ব্যাধিতে বিএনপির আগামী সরকারও আক্রান্ত হবে না কিংবা ক্ষমতায় গিয়ে বিএনপি আওয়ামী লীগের ওপর প্রতিশোধস্পৃহায় নেমে পড়বে না—এমন কোনো আশাবাদ বিএনপি এখনো সৃষ্টি করতে পারেনি। এর পরও আগামী নির্বাচন আগের চারটি নির্বাচনের মতো সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হলে গণতন্ত্রের একটি মৌলিক শর্ত অন্তত পূরণ হবে। গণতন্ত্রের স্বার্থে জাতীয় নির্বাচনে জনগণের প্রকৃত রায়ের প্রতিফলন নিশ্চিত করার মূল্যও কম নয়।
সুষ্ঠুভাবে এমন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠায় পর্যাপ্ত চাপ প্রয়োগ বা উপযুক্ত সমঝোতা সৃষ্টিতে বিএনপিকে সফল হতে হবে। না হলে চূড়ান্ত বিচারে বিএনপি একটি অকর্মণ্য বিরোধী দল হিসেবে বিবেচিত হবে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments