ভারতের নতুন পার্লামেন্ট by গৌতম লাহিড়ী

লোকসভার সাবেক স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য পার্লামেন্ট পরিবর্তনের বিপক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন। তার আশঙ্কা দূর করতে ইতিমধ্যে লোকসভার সেক্রেটারি জেনারেল এন বিশ্বনাথ তাকে জানিয়েছেন, নতুন পার্লামেন্ট ভবন তৈরি হওয়ার অর্থ বর্তমান ভবনটি পরিত্যক্ত করা নয়।


বরং যাতে সুষ্ঠুভাবে রক্ষিত হয় তার জন্যই এ উদ্যোগ


রাজধানী দিলি্লতে এখন রাজনৈতিক মহলে এক অভিনব বিতর্ক শুরু হয়েছে। এই বিতর্কের বিষয় রাজনৈতিক নয়, ৮৫ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত পার্লামেন্ট ভবনের স্থানান্তরকরণ নিয়ে। অবিভক্ত ভারত থেকে আধুনিক ভারতের ক্ষমতার প্রাণকেন্দ্র এবং বহু ইতিহাসের সাক্ষী এই ছয় একর জমির ওপর গড়ে ওঠা বৃত্তাকার সংসদ ভবন নাকি বিপন্ন হয়ে পড়েছে, তাই প্রয়োজন নতুন পার্লামেন্ট ভবন। লোকসভার স্পিকার মীরা কুমার ইতিমধ্যেই একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গড়তে চলেছেন নতুন পার্লামেন্ট ভবনের স্থান নির্বাচনের জন্য। আপত্তি তুলে দিয়েছেন স্বয়ং কেন্দ্রীয় সংসদীয় মন্ত্রী পবন কুমার বনশাল। লোকসভা এবং রাজ্যসভা নিয়ে দু'কক্ষের সংসদ ভবন পরিবর্তনে তিনি নারাজ।
১৯১১ সালে ব্রিটিশশাসিত ভারতের রাজধানী স্থানান্তরিত হয় রাইসিনা হিলসে। যেখানে রাষ্ট্রপতি ভবন, পার্লামেন্ট এবং প্রশাসনিক দফতর নর্থ ব্লক ও সাউথ ব্লক। ১৯২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ডিউক অব কনাট (যার নামে এখন মধ্য দিলি্লর কনাট প্লেস) পার্লামেন্ট ভবনের শিলান্যাস করেন। বিশিষ্ট স্থপতি স্যার এডউইন লুটিয়েনস এবং হার্বাট বেকারকে পার্লামেন্ট ভবন নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আজও মধ্য দিলি্লকে লুটিয়েনস দিলি্ল নামে ডাকা হয়। ৫৬০ ফুট বৃত্তাকার ভিত্তির ওপর ভবনটি নির্মিত হতে সময় লাগে ছয় বছর। ১৯২৭ সালের জানুয়ারি মাসে গভর্নর জেনারেল লর্ড আরউইন সংসদ ভবনের উদ্বোধন করেছিলেন। কিছুদিন আগে কেন্দ্রীয় সরকারের পূর্ত বিভাগ এই সংসদ ভবনের বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে একটি রিপোর্ট তৈরি করে। তাতেই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, গত ৬৫ বছরে পার্লামেন্ট ভবনের রক্ষণাবেক্ষণ এবং এমনভাবে সম্প্রসারণ হয়েছে যে ভবনটির ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। স্যার লুটিয়েনস যখন ভবনটি তৈরি করেন তখন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা বা বৈদ্যুতিক সংযোগের এত ব্যাপকতা ছিল না। যে কোনো স্থাপত্যের যে স্থায়িত্ব থাকে তার বৃদ্ধি ঘটাতে হলে ভবনের ওপর চাপ কমাতে হয়। কেবল রক্ষণাবেক্ষণের দিক থেকেই নয়, ভবিষ্যতে বর্ধিত সংসদ সদস্যের সংখ্যার কথা বিবেচনাও গুরুত্ব পেয়েছে এই পার্লামেন্ট ভবনের সংস্কারে। ভারতের সংবিধানে বলা আছে, আগামী ২০২৬ সাল পর্যন্ত সংসদ সদস্যের সংখ্যা বাড়বে না। কিন্তু তারপর বাড়ানো হতে পারে। যদি বাড়ে তাহলে বর্তমান পার্লামেন্টে এত সদস্যের স্থান সংকুলান হবে না। লোকসভার সদস্য সংখ্যা নির্ধারিত হয় জনসংখ্যার ভিত্তিতে। সংবিধান অনুসারে লোকসভার আসন সংখ্যা নতুন সীমানা নির্ধারণ করে স্থির হবে ২০২৬ সালে। তখন প্রতিটি রাজ্যের জনসংখ্যার ভিত্তিতে লোকসভার আসন সংখ্যা নির্দিষ্ট হবে। বর্তমানের ৫৪৩ সংখ্যা যে তখন অনেক বাড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রাজ্যসভাকে যুক্ত করলে সংখ্যাটি ৭৭০। এ ছাড়া ভারতের রাজনীতিতে জাতীয় দলগুলো ধীরে ধীরে বিভক্ত হয়ে নতুন নতুন আঞ্চলিক দলের জন্ম দিচ্ছে। এসব রাজনৈতিক দলের দফতর এখন সংসদ ভবনে। তারও চাপ বাড়ছে। সংসদীয় প্রথারও বিবর্তন হয়ে চলেছে। আগে কখনও এত সংখ্যক কমিটি ছিল না। এখন সংসদীয় কমিটির সংখ্যাও বাড়ছে। তাদের জন্য স্থান প্রয়োজন। বর্তমান সংসদ ভবন এই চাপ কি সহ্য করতে পারবে_ এটাই মুখ্য প্রশ্ন। বেশ কিছুদিন ধরেই ভারতের সংসদে নারীদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর রাজনৈতিক চাপ তৈরি হচ্ছে। এ নিয়ে সর্বসম্মতি তৈরি না হওয়ায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শিবরাজ পাতিল প্রস্তাব দিয়েছিলেন লোকসভার সদস্য সংখ্যা ৩৩ শতাংশ বাড়িয়ে দেওয়া হোক এবং বাড়তি সংখ্যা কেবল নারীদের জন্য সংরক্ষিত হোক। তখনও কথা উঠেছিল, এই সংখ্যা বাড়ানো হলে সংসদ সদস্যদের বসার জায়গা হবে না বর্তমান লোকসভায়। সাবেক মন্ত্রীর সমাধান ছিল, বর্তমান পার্লামেন্টের যেটা সেন্ট্রাল হল সেটিকেই লোকসভা করে দেওয়া হোক। আর লোকসভা হোক রাজ্যসভা। কিন্তু যে সেন্ট্রাল হলে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের মধ্যরাতে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, সেই ঐতিহাসিক সেন্ট্রাল হলকে কেবল স্থান সংকুলানের নামে বদলে দেওয়া উচিত কি? এখন আবার সেই প্রশ্ন ঘুরে এসেছে। বর্তমান পার্লামেন্টকে 'ঐতিহ্যমণ্ডিত' স্থান আখ্যা দিয়ে বিকল্প পার্লামেন্ট তৈরি করা হোক। বিশেষ অধিবেশনের জন্য বর্তমান পার্লামেন্টকে ব্যবহার করা হোক। পৃথিবীর অন্য দেশে এ ধরনের বহু নজির আছে। অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরায় অবস্থিত পুরনো পার্লামেন্ট ভবন এখন 'অস্ট্রেলিয়ান গণতন্ত্রের মিউজিয়াম'। ১৯২৭ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ক্যানবেরায় তাদের পার্লামেন্ট ছিল। এটি ২০০৯ সালে মিউজিয়াম হিসেবে খোলা হয়। ১৯৮১ সাল থেকে নতুন ভবনের পরিকল্পনা হয়। তেমনি ১৯৬৫ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত সিঙ্গাপুরের পুরনো সংসদ ভবন এখন শিল্পকলা ঐতিহ্যের কেন্দ্র হিসেবে পরিবর্তিত হয়েছে। এই নজির দেখিয়েই নতুন পার্লামেন্ট ভবন নির্মাণের জন্য কিছুদিনের মধ্যে এক উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করতে চলেছেন স্পিকার। যাতে প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ, সংসদ সদস্য, নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এবং এ বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা থাকবেন। পার্লামেন্টের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি যৌথ কমিটি রয়েছে। এ কমিটি প্রাথমিক সুপারিশ করবে উচ্চ পর্যায়ের কমিটির কাছে। তারপর প্রস্তাবটি পেশ হবে সংসদে। যাতে দেশজুড়ে এক জাতীয় বিতর্কের সূচনা করা যায়_ ঐতিহ্যমণ্ডিত পার্লামেন্ট ভবনকে সুরক্ষিত করার জন্য কী কী করা উচিত। কেননা পার্লামেন্ট জনতার ইচ্ছা প্রতিফলিত করার প্রতিষ্ঠান। নাকি প্রকৃতির নিয়ম মেনে এ ভবনটিকে স্বাভাবিক মৃত্যুর পথে ঠেলে দেওয়া। লোকসভার সাবেক স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য পার্লামেন্ট পরিবর্তনের বিপক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন। তার আশঙ্কা দূর করতে ইতিমধ্যে লোকসভার সেক্রেটারি জেনারেল এন বিশ্বনাথ তাকে জানিয়েছেন, নতুন পার্লামেন্ট ভবন তৈরি হওয়ার অর্থ বর্তমান ভবনটি পরিত্যক্ত করা নয়। বরং যাতে সুষ্ঠুভাবে রক্ষিত হয় তার জন্যই এ উদ্যোগ।

গৌতম লাহিড়ী : সমকাল প্রতিনিধি, নয়াদিলি্ল
 

No comments

Powered by Blogger.