চারুশিল্প- একটি জনপদ এবং শিল্প by জাফরিন গুলশান

চারদিকে কৌতূহলী মানুষের ভিড়। উৎসুক দৃষ্টি, মাথায় তাদের নানা চিন্তার উঁকিঝুঁকি। কী হচ্ছে এখানে? আসল ব্যাপার হলো, এখানকার বাসিন্দা বা কর্মসূত্রে যাঁরা প্রতিদিন এখানে আসছেন, তাঁরা বেশির ভাগই খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। নিম্নবিত্ত এসব মানুষের পক্ষে দৃশ্যশিল্পের তাত্ত্বিক গঠন বোঝার মতো অবস্থা নেই।


কাজেই এখানে অয়োজিত ‘বেগুনবাড়ি: জীবন, শিল্প, প্রক্রিয়া’ শিরোনামের স্বল্পকালীন প্রদর্শনীটি তাঁদের অনেকখানিই বোধের বাইরের বিষয়। প্রদর্শনীটির আয়োজন করা হয়েছে একটি করাতকলের ভেতরে, যাকে অনেকে সোজাসুজি স-মিল বলেন। প্রায় পাঁচ কাঠা জমিতে গড়া এই কাঠচেরাইয়ের কলে প্রতিদিন কাঠ চেরাই হচ্ছে। ব্যবসায়িক প্রয়োজনেই এই স-মিল ঘিরে নানা লোকের সমাগম, চলাচল। এখানে উদয়াস্ত পরিশ্রম করেই জীবিকা নির্বাহ করেন এক দল শ্রমিক। তাঁদের জীবন আর সমাজের অন্য দশজন উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত কিংবা এই প্রদর্শনী দেখতে আসা শিল্পমনা লোকজন, বুদ্ধিজীবী কিংবা শিল্পবোদ্ধাদের জীবনের সঙ্গে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। তার পরও মানুষ একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কিত নানা কারণে। কোনো না কোনোভাবে জীবন, পরিবেশ ও সময় পরস্পরকে প্রভাবিত করে।
তেজগাঁও শিল্প এলাকায় কোনো এক সময়ে বেগুনবাড়ির জন্ম এবং তখনো বাণিজ্যিক কারণে শ্রমিক শ্রেণীর লোকজনের নিত্য যাওয়া-আসার জায়গা হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সময়ের নানা প্রয়োজন খাটো হয়ে এসেছে। গত কয়েক যুগে এই এলাকাজুড়ে নানা রকম পরিবর্তন সংগঠিত হয়েছে। পরিবর্তনের চলমান এই প্রক্রিয়া শহরের অন্য অঞ্চলের চেয়ে বেগুনবাড়িতে অনেক বেশি স্পষ্ট। বেগুনবাড়ি-হাতিরঝিল এলাকায় চলছে নানা রকম কর্মযজ্ঞ। এ এলাকা সাজছে নতুন রূপে। কালের বির্বতন ও জীবনের তাগিদে এ অঞ্চলে ঘটে যাওয়া পরিবর্তন নিয়েই ব্যতিক্রমী এই প্রদর্শনী। কয়েক ঘণ্টার এই প্রদর্শনী মূলত ইনস্টলেশনধর্মী। চারজন শিল্পীর প্রত্যেকেই স-মিলের অভ্যন্তরের পরিবেশ ও উপকরণকে কাজে লাগিয়ে একটি সমন্বিত চিন্তাকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে নান্দনিক অভিজ্ঞতায় উপস্থাপন করেছেন।
তৌফিকুর রহমান, অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের একজন। তিনি আয়োজন করেছেন গাছের লম্বা গুঁড়ির মধ্যে লালশাকের কম্পোজিশন। আর স-মিলের চারধারে সবুজ শাক। যখন ধারালো করাতকলটি চালু হলো। বিকট শব্দ। সবুজ শাক আর কলের ঘূর্ণমান ধারালো ব্লেড, সঙ্গে তীব্র ওই শব্দ, সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে অদ্ভুত এক আবহ। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামার পর আলোর পরিবর্তন ঘটল। পুরো দৃশ্যে নতুন মাত্রা যোগ হলো যেন।
শিল্পী নাসিমা হক জানান, তিনি যে ফিগারটি বানিয়েছেন, সেটি মূলত মাদারফিগার হিসেবে তৈরি করেছেন। কিন্তু স্তূপ করা গাছের গুঁড়ির ওপর ওটা রাখার পর একে একটি মথের (শুয়োপোকা) মতো লাগছে, যা আসলে তাঁর নিজের কাছেই দারুণ এক অভিজ্ঞতা। অর্থাৎ নির্দিষ্ট বস্তু এবং স্থান শিল্পীর মূল চিন্তাকেও নিয়ন্ত্রণ করে কখনো কখনো; এবং স্বতঃস্ফূর্ত উপায়ে নতুন শিল্পচিন্তার দ্বারও উন্মোচিত করতে পারে দর্শকের সামনে।
বেগুনবাড়ি পাকিস্তান আমলে ঢাকার প্রধান শিল্প এলাকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বর্তমানে বেগুনবাড়ি-হাতির ঝিল প্রকল্পের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের ফলে আরেকটি পরিবর্তনের হাওয়ার মুখে পড়েছে। মেসার্স সনোয়ার ট্রেডার্সের (স-মিল) মালিক খন্দকার সানোয়ার জানালেন, হয়তো তিনিও ২২ বছরের স-মিল বন্ধ করে নতুন কোনো ব্যবসা করবেন তখন। নতুন পরিবেশে হয়তো বা তখন নতুন ব্যবসায়িক সম্ভাবনার পথ খুলবে তাঁর জন্য। খন্দকার সানোয়ারের ঔদার্য ও শিল্পের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন মনোভাব এই শিল্প আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
নাসিমুল খবির বস্তুর দৃশ্যগত অভিজ্ঞতা পরিবর্তনকে গুরুত্বারোপ করেছেন। কাঠের গুঁড়ির ভারী ওজন হালকা হয়ে যায়, যখন এটিকে আদ্যোপান্ত খবরের কাগজে মোড়ানো হয়। খবরের কাগজের বিনোদনমূলক খবরগুলোকেই বেশি তুলে ধরেছেন এই চিন্তা থেকে যে, উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যগত অভিজ্ঞতা ঘটছে বেগুনবাড়ির মানুষের জীবনে। হালকা বিনোদনে ঝুঁকছে শহরের মানুষ।
দীর্ঘ এক লাল কাপড় যেন অনেক কথা বলছে। লাল গুরুত্বপূর্ণ একটি রং। বেগুনবাড়ির মানুষ এবং বয়ে চলা কর্মময় জীবনও যেন শিল্পেরই একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়াকেই উপস্থাপন করলেন লালা রুখ সেলিম।
প্রদর্শনীটি ২৫ আগস্ট বিকেল পাঁচটা থেকে রাত নয়টা অবধি চলেছে। স্থানীয় জনগণের সঙ্গে দৃশ্যশিল্পের বিশেষত নাগরিক চারুশিল্পের দূরত্ব সত্ত্বেও সবার অংশগ্রহণ ভালো লাগার মতোই ছিল।

No comments

Powered by Blogger.