চলে গেলেন নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমাযূন আহমেদ- রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতার শোক প্রকাশ
চলে গেলেন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। কোলন ক্যান্সারের সঙ্গে নিয়ত যুদ্ধে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত ১১টা ২০ মিনিটে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন (ইন্নালিল্লাহি... রাজিউন)। দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বেলভ্যু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন এবং সেখানেই তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
জননন্দিত এই কথাসাহিত্যিকের মৃত্যুর খবরে দেশ-বিদেশের বাংলাভাষীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এমএ মোমেন ও অন্য প্রকাশের প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম বৃহস্পতিবার রাতে স্থানীয় ম্যানহাটনের বেলভ্যু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হুমায়ুন আহমেদের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন।
তাঁর মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর। ১৯৪৮ সালের ১৩ নবেম্বর তিনি নেত্রকোনা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ড. মোমেন বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১১টার দিকে টেলিফোনে বলেন, একটু আগেই চিকিৎসকরা তাঁকে (হুমায়ূন) মৃত ঘোষণা করেছেন।
লেখকের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন, ছোট ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল, বন্ধু মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে ড. মোমেনও মৃত্যুর সময় হাসপাতালে ছিলেন। ক্যান্সারের চিকিৎসা নিতে যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার পর একুশে পদকজয়ী হুমায়ূনকে জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনের উপদেষ্টা নিয়োগ করে সরকার। হুমায়ূন যে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন, তা বুধবারই জানিয়েছিলেন ড. মোমেন।
একনিষ্ঠ ও বিশাল পাঠকশ্রেণী তৈরির মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদ ভূমিকা রেখেছেন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রবৃদ্ধিতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন ছাত্র হুমায়ূন আহমেদ দুই পক্ষে ছয় সন্তানের জনক। হুমায়ূনের বাবা পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান ১৯৭১ সালে শহীদ হন। তিন ভাই, দুই বোনের মধ্যে হুমায়ূন জ্যেষ্ঠ। এক ভাই জাফর ইকবাল জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক, ছোট ভাই আহসান হাবীব কার্টুনিস্ট।
১৯৮৪ সালে বিটিভিতে ‘এইসব দিনরাত্রি’র মধ্য দিয়ে ধারাবাহিকের নাট্যকার হিসেবে আবির্ভূত হন হুমায়ূন আহমেদ। একটি সাক্ষাতকারে লেখক হিসেবে নিজের জনপ্রিয়তার জন্য টিভি নাটকের অবদানের কথা বলেছেন হুমায়ূন। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত তাঁর লেখা জনপ্রিয় ধারাবাহিকের ভেতর রয়েছে ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’ ইত্যাদি। ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের ঘটনাপ্রবাহ দর্শকদের এতটাই আলোড়িত করেছিল যে তারা নায়কের ট্র্যাজিক পরিণতি মানতে না পেরে রাজধানীসহ দেশের কয়েকটি জায়গায় বিক্ষোভ পর্যন্ত করে। বেসরকারী টেলিভিশনের যুগ শুরু হলে হুমায়ূন আহমেদ নিজেই নাটক পরিচালনা শুরু করেন। এ পর্যায়ে অবশ্য আগের একক জনপ্রিয়তার আসন থেকে তাঁকে নেমে আসতে হয়।
সত্তর ও আশির দশকে বাংলাদেশের দীর্ঘ সামরিক শাসনের সময় হুমায়ূন ‘সামাজিক দ্বন্দ্বে’ অংশ নেননি বলে একটি সাক্ষাতকারে অভিযোগ করেন লেখক আহমদ ছফা। কিন্তু এ সময়ের মধ্যবিত্তের জীবনের নিস্পন্দ রোমান্টিকতাকে নিখুঁতভাবে তুলে এনেছেন প্রধানত তার সংলাপনির্ভর উপন্যাসমালায়। কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন, ‘অনেক উৎকৃষ্ট রচনাই অত্যন্ত জনপ্রিয়। হুমায়ূন আহমেদ আমাদের সস্তা চতুর্থ শ্রেণীর লেখকদের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছেন।’
হুমায়ূন আহমেদের দুই শতাধিক উপন্যাসের ভেতর ‘শ্রেষ্ঠ’গুলোকে আলাদা করা কঠিন। ছন্নছাড়া অথচ নিজস্ব দর্শনসমৃদ্ধ হিমু এবং আধিভৌতিক রহস্যের উন্মোচক মিসির আলী নামের দুই চরিত্র নিয়ে তাঁর বেশ ক’টি আলোচিত উপন্যাস রয়েছে।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকে হুমায়ূন আহমেদের নামটির সঙ্গে যুক্ত হয় চলচ্চিত্র পরিচালকের পরিচয়। ১৯৯৪ সালে মুক্তি পাওয়া অনুদানের ছবি ‘আগুনের পরশমণি’ আটটি শাখায় জিতে নেয় জাতীয় পুরস্কার। একই বছর একুশে পদক পান তিনি। পরবর্তী বছরগুলোয় তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠান নুহাশ চলচ্চিত্র ও ইমপ্রেস টেলিফিল্মের প্রযোজনায় আরও কয়েকটি ছবি বানান। সবশেষ কাজ করছেন ‘ঘেঁটুপুত্র কমলা’ নামের একটি ছবি নিয়ে।
উপন্যাস, টিভি নাটক ও চলচ্চিত্রের পাশাপাশি শিশুসাহিত্য এবং সায়েন্স ফিকশন রচয়িতা হিসেবেও হুমায়ূন আহমেদের নাম গুরুত্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। স¤প্রতি শিশুদের একটি গানের রিয়ালিটি শোতে বিচারক হিসেবেও দেখা গেছে তাঁকে।
হুমায়ূন আহমেদের পড়া প্রথম সাহিত্য ‘ক্ষীরের পুতুল’। যদিও তাঁর বাবার বিশাল লাইব্রেরী ছিল। কিন্তু সমস্ত বই তিনি তালাবদ্ধ করে রাখতেন। তিনি হয়ত ভেবেছিলেন তাঁর সন্তানদের এসব বই পড়ার সময় এখনও হয়নি। কিন্তু ‘ক্ষীরের পুতুল’ পড়ার পর তিনি তাঁর বাবার বইয়ের আলমারী থেকে বই চুরি করে লুকিয়ে পড়তে শুরু করলেন এবং একদিন বাবার হাতে ধরা পড়ে গেলেন। বাবা তাঁকে নিয়ে গেলেন সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে। বইয়ের এক বিশাল সংগ্রহ সেখানে। যেদিকে চোখ যায় শুধু বই আর বই। বাবা তাঁকে লাইব্রেরীর সদস্য করে দিলেন। সম্ভবত তিনিই ছিলেন এই লাইব্রেরীর সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। এভাবেই সাহিত্যের প্রতি হুমায়ূন আহমেদের জন্ম নেয় গভীর ভালবাসা।
যদিও হুমায়ূন আহমেদের প্রথম রচনা ‘নন্দিত নরকে’। তবে তারও বহু পূর্বে দিনাজপুরের জগদ্দলে থাকা অবস্থায় একটি কুকুরকে নিয়ে তিনি ‘বেঙ্গল টাইগার’ নামে একটি সাহিত্য রচনা করেছিলেন। ১৯৭২ সালে রচনা করেন ‘নন্দিত নরকে’। তারপর একে একে ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ‘রজনী’, ‘গৌরীপুর জংশন’, ‘অয়োময়’, ‘দূরে কোথাও’, ‘ফেরা’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘আমার আছে জল’, ‘অচিনপুর’, ‘এইসব দিনরাত্রি’সহ দুই শতাধিক উপন্যাসের স্রষ্টা হুমায়ূন আহমেদ।
কেবল অধ্যাপনা আর কথাসাহিত্যই নয়, চলচ্চিত্র নির্মাণেও হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন এক সুদক্ষ কারিগর। তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমণি’। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এ চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে আটটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নিয়েছিল। তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আরেকটি চলচ্চিত্র ‘শ্যামল ছায়া’ বিদেশী ভাষার ছবি ক্যাটাগরিতে অস্কার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। তাঁর অন্য কীর্তি ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘চন্দ্রকথা’ প্রভৃতি চলচ্চিত্র। এ চলচ্চিত্রগুলো কেবল প্রশংসাই কুড়ায়নি, মধ্যবিত্ত দর্শকদেরও হলমুখী করেছে।
টিভি নাট্যকার হিসেবেও হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন সমান জনপ্রিয়। আশির দশকের মাঝামাঝি তাঁর প্রথম টিভি নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’ তাঁকে এনে দিয়েছিল তুমুল জনপ্রিয়তা। তাঁর হাসির নাটক ‘বহুব্রীহি’ এবং ঐতিহাসিক নাটক ‘অয়োময়’ বাংলা টিভি নাটকের ইতিহাসে অনন্য সংযোজন। নাগরিক ধারাবাহিক ‘কোথাও কেউ নেই’-এর চরিত্র বাকের ভাই বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছিল টিভি দর্শকদের কাছে। নাটকের শেষে বাকের ভাইয়ের ফাঁসির রায় হলে ঢাকার রাজপথে বাকের ভাইয়ের মুক্তির দাবিতে মিছিল পর্যন্ত হয়েছিল। বাংলা নাটকের ইতিহাসে এমনটি আর কখনও হয়নি। এছাড়াও অসংখ্য বিটিভি ও প্যাকেজ নাটকের নির্মাতা তিনি। নাট্যকার-নির্দেশক দুই ভূমিকায়ই সমান সফল ছিলন হুমায়ূন আহমেদ। সফল শিল্পের আরেকটি শাখা চিত্রকলাতেও। তাঁর চিত্রশিল্পের স্বাক্ষর নিজ বাড়ির দেয়ালে টাঙ্গানো রয়েছে।
১৯৭৩ সালে গুলতেকিনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন হুমায়ূন আহমেদ। হুমায়ূন এবং গুলতেকিন দম্পতির চার ছেলেমেয়ে। দীর্ঘ ৩২ বছরের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটিয়ে ২০০৫ সালে ডিভোর্সের মাধ্যমে তাঁরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। এরপর তিনি অভিনেত্রী ও পরিচালক মেহের আফরোজ শাওনকে বিয়ে করেন। শাওন ১৯৯০ সাল থেকে টিভিতে অভিনয় শুরু করেন। পরবর্তীতে চলচ্চিত্রের সঙ্গেও যুক্ত হন।
হুমায়ূন আহমেদ ভালবাসতেন গাছপালাশোভিত সবুজ অরণ্যানীর ভেতর ঘুরে বেড়াতে, বিটোফেনের সুরের মতন টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনতে। এ বয়সে ও তাঁর সবুজের ভেতর হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হতো, ইচ্ছে হতো বৃষ্টির শব্দের ভেতর নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে। ইটকাঠের খাঁচায় বন্দী এ রাজধানী ঢাকা তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসত। তাই তিনি গাজীপুরের শালবনের ভেতর তৈরি করেছেন এক বিশাল নন্দনকানন ‘নুহাশ পল্লী’। তাঁর বেশিরভাগ সময়ই কাটত নুহাশ পল্লীর শালগজারির সাথে কথা বলে, বৃষ্টির শব্দের সাথে মিতালি করে।
উপন্যাস : নন্দিত নরকে, লীলাবতী, কবি, শঙ্খনীল কারাগার, মন্দ্রসপ্তক, দূরে কোথায়, সৌরভ, নী, ফেরা, কৃষ্ণপক্ষ, সাজঘর, বাসর, গৌরীপুর জংশন, নৃপতি, অমানুষ, বহুব্রীহি, এইসব দিনরাত্রি, দারুচীনি দ্বীপ, শুভ্র, নক্ষত্রের রাত, কোথাও কেউ নেই, আগুনের পরশমণি, শ্রাবণ মেঘের দিন, বৃষ্টি ও মেঘমালা, মেঘ বলেছে যাবো যাবো, জোছনা ও জননীর গল্প প্রভৃতি।
চলচ্চিত্র : আগুনের পরশমণি, শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, নয় নম্বর বিপদ সংকেত।
পুরস্কার : একুশে পদক (১৯৯৪), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৮১), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসূধন দত্ত পুরস্কার (১৯৮৭), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮)।
No comments