শিল্প ও সংগ্রামে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর by শান্তনু মজুমদার
(পূর্ব প্রকাশের পর) কলেজ জীবনেই লেখালেখির জন্য আলোচিত হতে শুরু করেন বি কে জাহাঙ্গীর। ১৯৫১ এর দিকে কলকাতা থেকে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘পরিচয়’ পত্রিকাতে তাঁর একটি গল্প ছাপা হয়; সে সময় এটা একটা বড় ঘটনা। গল্পের লেখক যে নিতান্ত এক কৈশোর উত্তীর্ণ তরুণ তা ভাবতে পারেননি সুভাষ;
ভেবেছিলেন হবে একজন প্রৌঢ় ব্যক্তি। সেভাবে সম্বোধন করেই ব্যাপক প্রশংসাপূর্ণ চিঠি পাঠিয়েছিলেন জাহাঙ্গীরকে। চিঠিতে ন্যাশনাল বুক এজেন্সি থেকে ‘পরিচয়’ এর কপি সংগ্রহ করার কথা বলা হয়। ‘কিন্তু ব্যাপারটা খুব একটা নিরাপদ ছিল না।’
একটা বইয়ের দোকানে যাবেন তাতে সমস্যা কি?
“কারণ হচ্ছে গোয়েন্দারা দোকানটার ওপরে নজর রাখতো; ওরা দোকানের সামনে একটা টুলে বসে থাকতো।” অনেক ভাবনা-চিন্তা করে শেষে দাউদ খান মজলিশকে নিয়ে ন্যাশনাল বুক এজেন্সিতে যাওয়া হয়। দাউদ “এটা সেটা বলে গোয়েন্দাদের ব্যস্ত রাখেন আর আমি সে ফাঁকে ‘পরিচয়’ কপি সংগ্রহ করে নিই।” পরবর্তী সময়ে ‘পরিচয়’ এ আরো লেখা ছাপা হয়।
এ সময় বন্ধুরা মিলে শহর চষে বেড়ানোর অভ্যাস গড়ে ওঠে; বাহন সাইকেল। টাকা-পয়সার টানাটানির ব্যাপারটা কলেজ জীবনেও সেভাবে সুরাহা হয়নি। “আমাদের বাড়ির অবস্থা ভাল ছিল না; হোস্টেলের পাওনা নিয়মিত দিতে পারতাম না। তবে সুপার সাইদুর রহমান এজন্য চাপ দিতেন না।”
ইনি তো শফিক রেহমানের বাবা?
“তাই। শফিকের সঙ্গে অবশ্য আমার তত ঘনিষ্ঠতা ছিল না। ঠাট্টা-তামাশাভরা ‘অচলপত্র’ পত্রিকা ছিল তার প্রিয়। তবে সে আমাদের বাসায় নিয়ে খাওয়া তো। সে সময় ভাল খাবারদাবার আমাদের কাছে বিশেষ একটা ব্যাপার ছিল আর কি।”
এটা আমাদের ইতিহাসের এমন এক সময় যখন পাকিস্তান নিয়ে বাঙালীদের মোহভঙ্গের সূচনা হচ্ছে। বিস্ময়কর কিন্তু সত্য পাকিস্তানের মোহ ভাঙিয়ে দেয়াতে বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব এসেছে বি কে জাহাঙ্গীরদের প্রজন্ম থেকে। পাকিস্তানপন্থী বাঙালী বুদ্ধিজীবী, যেমন ফররুখ আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান, তালিম হোসেন, মোফাখখারুল ইসলাম কিংবা রওশন ইয়াজদানীদের তুলনায় জাহাঙ্গীরদের প্রজন্ম কতইবা এদের বয়স তখন! কেউ স্কুল শেষ কলেজ; কেউ কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে।
আপনার বন্ধুরা সব কারা?
“সব নাম তো মনে করতে পারছি না। তবে আগের নামগুলোর সঙ্গে লিখুন সাঈদ আতিকুল্লাহ, মেডিক্যালের আহমেদ রফিক আর জামালউদ্দিন। চিত্রনায়িক শবনমের স্বামী রবিন ঘোষের ভাই অশোক ঘোষ তখন খুব বামপন্থী। সৈয়দ আলী আহসান একবার আমাদের সবার নামের তালিকা গবর্নরের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
কেন? কী কারণ?
“কারণ আমাদের ক্র্যাশ করে দিতে হবে, তাহলে পাকিস্তান বাঁচবে। ফররুখ আহমদ কি করেছিলেন তা শুনুন।”
কী করেছিলেন?
“তিনি আমাদের বামপন্থা প্রীতি ব্যঙ্গ করে ‘লালমিয়া বুটাভস্কি’ নাম দিয়ে ব্যঙ্গাত্মক এক লেখা লিখেছিলেন।”
কিন্তু এসব করেও পাকিস্তানপন্থী বাঙালী বুদ্ধিজীবীরা শেষাবধি টিকে থাকতে পারেননি। “রাজনৈতিকভাবে প্রচ- সচেতন মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক নতুন প্রজন্মটিই” পূর্ব পাকিস্তানে বুদ্ধিবৃত্তির মূলধারাতে পরিণত হয়ে যায়। অনেক সমস্যা যদিও সে সময়ে, পাকিস্তানপন্থীরা নয়া বুদ্ধিজীবীদের তুলনায় বয়স, ক্ষমতায় অনেক এগিয়ে। সরকারের সঙ্গে তাঁদের সরাসরি যোগাযোগ। কিন্তু নবগঠিত পাকিস্তানে নানাবিধ কারণে বাঙালীর মধ্যে ধূমায়িত হতে থাকা বঞ্চনার বোধ নিয়ে ভাবিত হবার ইচ্ছা বা সামর্থ্য কোনটাই এঁদের ছিল না। বি কে জাহাঙ্গীর বলেন, “এঁদের এজেন্ডা ছিল পাকিস্তান রক্ষা করা। আমরা এঁদের মতো ছিলাম না। সচেতনভাবে এঁদের বিরোধী ছিলাম।” এখানে আরেকটা ব্যাপারও উল্লেখ করলেন তিনি। সেটা হচ্ছে কলকাতা থেকে আসা মুসলিমদের প্রসঙ্গ। কলকাতা থেকে ঢাকায় আসা মুসলিমরা পাকিস্তানের পক্ষই নিয়েছিলেন; তাদের সঙ্গেও স্বভাবতই নয়া-বুদ্ধিজীবীদের ভাল সম্পর্ক হয়নি।
আর আপনাদের ভাবনাটা তখন কোন পথে এগুচ্ছিল?
“আগেই বলেছি আমি সরাসরি পলিটিক্স করতাম না কিন্তু আন্ডারগ্রাউন্ডের টাচে ছিলাম। খোকা রায়, রণেশ দাশগুপ্ত এরা লিডার। আর আমাদের বয়সীরা হচ্ছে পার্টির ভিত্তি। আমাদের মধ্যে তখন এই ধারণা জন্মাচ্ছে যে মুসলিম লীগকে সরিয়ে দেয়া দরকার; এদের জন্য প্রগতিশীলতা ব্যাহত হচ্ছে।”
শহরে বসে প্রকাশ্যে এমত আলাপ-আলোচনা সে আমলে ছিল সাংঘাতিক বিপজ্জনক। গোয়েন্দাদের নজরদারি সর্বত্র। একবার ঠিক হলো কতগুলো বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য ঢাকা থেকে রাজেন্দ্রপুরের বনভূমিতে চলে যাওয়া হবে। সাংস্কৃৃতিক কর্মকা-ের ধরনটা কেমন হবে, ঢাকার কলেজগুলোতে স্কুলগুলোতে সাংস্কৃতিক কর্মকা- কেমন করে ছড়িয়ে দেয়া যায় এসব ছিল আলোচ্য। এক সকালে জাহাঙ্গীররা গোয়েন্দাদের চোখে ফাঁকি দিতে সক্ষম হলেন। বন্ধুরা সব ট্রাকে চড়ে ঠিকঠিক রাজেন্দ্রপুর। ট্রাক ড্রাইভার ভাড়াও নেয়নি। আলাপ আলাপে সন্ধ্যা হয় হয় বি কে জাহাঙ্গীরদের। “এ সময় হন্তদন্ত হয়ে কোত্থেকে যেন ইন্টিলিজেন্স ব্রাঞ্চের এক লোক এসে হাজির। শুরুতে উলটাপালটা কথাবার্তা বললেও পরে বলে, আমি আপনাদের লোক। আপনারা এখন তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যান। আমি অফিসকে জানাব আপনাদের খুঁজে পাইনি।” তাই হলো তখনকার মতো। গোয়েন্দা পরামর্শ মেনে নিয়ে ট্রেনযোগে ঢাকা। ফেরার পথে অশোক দত্ত গান ধরেছিলেন ‘বজ্র মানিকেতে ঘেরা’, মনে আছে বি কে জাহাঙ্গীরের। রাজেন্দ্রপুরের আলোচনা সফল হয়েছিল। সেদিনের আলোচনার সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ১৯৫০ সালে জগন্নাথ কলেজে প্রথমবারের মতো ২৫ বৈশাখ পালিত হয়; সভাপতি ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। ‘এভাবেই আমাদের কাজের পরিধি বাড়তে থাকে।’
আপনি বামপন্থায় অনুরক্ত হয়ে পড়ার কথা বলেছেন? এগুলো কি বামপন্থা?
“কট্টর অর্থে নয়। অন্য অর্থে দেখলে সেই সময়ে পাকিস্তানের পূর্ব অংশে মুক্তচিন্তার লেখালেখি করা, আলাপ-আলোচনা করা, গান-বাজনা করাটাই বৈপ্লবিক ব্যাপার। আর মনে রাখবেন আমাদের কার্যক্রমের ব্যাপারে পার্টি অবগত থাকত। আমাদের জন্য পার্টির নির্দেশনাও থাকত।
কলেজকালের আরেকটা বিষয় উল্লেখযোগ্য। কলেজ জীবনে এসে ঢাকার হিন্দু ছাত্রদের সঙ্গে পরিচয় বাড়তে থাকে বি কে জাহাঙ্গীরের; হিন্দু বাসাতে যাতায়াতের শুরু হয় এ সময়েই।
১৯৫২ সাল : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে
বাম রাজনীতি সংলগ্ন বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার চর্চা আর আন্দোলন করতে করতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন বি কে জাহাঙ্গীর। বছরটি ভাষার দাবিতে বাঙালীর রক্ত দেয়ার। ভর্তির অনেক আগে থেকেই অবশ্য আন্দোলন-সংগ্রামের পীঠস্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদচারণা। ‘এ কারণে অনেক আগে থেকেই অনেকে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মনে করতেন’, জানান তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে স্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে কর্মপরিধি। এ পর্যায়ে কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠা জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনা হিসাবে মানেন বি কে জাহাঙ্গীর। মানিক তখন প্রগতি লেখক সংঘের সভাপতি। কলকাতা থেকে গোপন পত্রে যোগাযোগ করেন জাহাঙ্গীরদের সঙ্গে। কার্জন হলের সিঁড়িতে বসে ‘উদ্বেলিত, উচ্ছ্বসিত’ জাহাঙ্গীররা মানিকের পত্র পড়তে বসেন গোপনে; সেখানে ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান ও আলাউদ্দিন আল আজাদ। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা মানিক বন্দোপাধ্যায়ের কাছ থেকে ‘চিঠি পাওয়া অনেক বড় ব্যাপার।’ মানিক জানিয়েছেন, তিনি ঢাকা আসতে ইচ্ছুক কিন্তু বাধা হচ্ছে পুলিশ। ‘প্রগতি লেখক সংঘের’ সম্মেলনে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণও জানানো হয়েছে চিঠিতে। ঢাকা থেকে সেবার যোগ দিয়েছিলেন আলাউদ্দিন আল আজাদ।
পুলিশ-গোয়েন্দা তৎপরতার প্রসঙ্গ আপনার কথাতে বার বার আসছে। এর মধ্যে কাজ করতেন কিভাবে সেটা একটু শুনতে চাই।
“সে সময় আমরা আড্ডার ছলে আলোচনাতে বসতাম। বসবার রকম একটা জায়গা ছিল ঠাঠারী বাজারে আনিসদের বাসা।” এটা ১৯৫১-এর দ্বিতীয় অর্ধের কথা।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান?
“হ্যাঁ। তিনি আমাদের বলয়ের মানুষ ছিলেন। একদিন আনিসদের বাসাতেই একটা ব্যাপার ঘটল। সেদিন উপস্থিত ছিলেন আবদুল গনি হাজারী, হাসান হাফিজুর রহমান, সরদার জয়েনউদ্দীন, আবদুস সামাদ। আবদুস সামাদ তখনো আবদুস সামাদ আজাদ হননি। কথাবার্তার একপর্যায়ে হাজারী বললেন, কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বার হতে চাইলে দরখাস্ত কর, বিবেচনা করা হবে।”
অনেকটা সময় পরে প্রস্তাবটা এসেছে দেখা যাচ্ছে। আপনি অবশ্য আগে বলেছেন যে পার্টি দীর্ঘদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করে পার্টি সেলে আগে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হতো। দরখাস্ত করার প্রস্তাব পেয়ে আপনার কেমন অনুভূতি হয়েছিল?
“খুশি লাগছিল। পার্টির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের পথ তৈরি সম্ভাবনাতে। দরখাস্ত কী লিখব হাজারীর কাছে জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, তুমি লেখ যে তুমি পার্টির আদর্শে বিশ্বাসী, পূর্ব বাংলার মুক্তি প্রত্যাশী তাই সদস্য হতে চাও।”
সপ্তাহখানেক পরে দরখাস্ত নিয়ে আনিসুজ্জামানের বাসাতে আবদুল গনি হাজারীর সঙ্গে সাক্ষাত। বি কে জাহাঙ্গীরের দরখাস্ত ‘কাব্যিক হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং আবার লিখতে বলা হয়।’ শেষমেশ পার্টি সদস্যপদ দিয়েছিল কিনা তা আর জানতে পারেননি। ঠিক সে সময়টাতে, ভাষা আন্দোলন তীব্রতর হচ্ছিল। ফলে সদস্যপদের মতো ব্যাপারগুলো সেভাবে আলোচনার মধ্যে থাকেনি। তবে সবাই ধরে নিচ্ছিল যে জাহাঙ্গীর ‘কমিউনিস্ট হয়ে গেছে।’ পার্টি একপর্যায়ে তাঁকে কাজে পাঠাতে শুরু করে। সে বছর নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে ঠাঠারি বাজারে যুবলীগের অফিসে নানান সংগঠনের মধ্যে একটি ধর্মঘট ডাক দেয়ার সম্ভাব্যতা আলোচনার জন্য কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের প্রতিনিধি হিসাবে পাঠানো হয়েছিল তাঁকে। রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাকে স্বীকৃতি আর কৃষক ফ্রন্টে রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের প্রতিবাদে ধর্মঘট করার আলোচনা হয় সেদিন। প্রথমে ধর্মঘটের পক্ষে সিদ্ধান্ত হলেও পরে সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি; কোন কোন সংগঠন পিছিয়ে যায়। (চলবে)
একটা বইয়ের দোকানে যাবেন তাতে সমস্যা কি?
“কারণ হচ্ছে গোয়েন্দারা দোকানটার ওপরে নজর রাখতো; ওরা দোকানের সামনে একটা টুলে বসে থাকতো।” অনেক ভাবনা-চিন্তা করে শেষে দাউদ খান মজলিশকে নিয়ে ন্যাশনাল বুক এজেন্সিতে যাওয়া হয়। দাউদ “এটা সেটা বলে গোয়েন্দাদের ব্যস্ত রাখেন আর আমি সে ফাঁকে ‘পরিচয়’ কপি সংগ্রহ করে নিই।” পরবর্তী সময়ে ‘পরিচয়’ এ আরো লেখা ছাপা হয়।
এ সময় বন্ধুরা মিলে শহর চষে বেড়ানোর অভ্যাস গড়ে ওঠে; বাহন সাইকেল। টাকা-পয়সার টানাটানির ব্যাপারটা কলেজ জীবনেও সেভাবে সুরাহা হয়নি। “আমাদের বাড়ির অবস্থা ভাল ছিল না; হোস্টেলের পাওনা নিয়মিত দিতে পারতাম না। তবে সুপার সাইদুর রহমান এজন্য চাপ দিতেন না।”
ইনি তো শফিক রেহমানের বাবা?
“তাই। শফিকের সঙ্গে অবশ্য আমার তত ঘনিষ্ঠতা ছিল না। ঠাট্টা-তামাশাভরা ‘অচলপত্র’ পত্রিকা ছিল তার প্রিয়। তবে সে আমাদের বাসায় নিয়ে খাওয়া তো। সে সময় ভাল খাবারদাবার আমাদের কাছে বিশেষ একটা ব্যাপার ছিল আর কি।”
এটা আমাদের ইতিহাসের এমন এক সময় যখন পাকিস্তান নিয়ে বাঙালীদের মোহভঙ্গের সূচনা হচ্ছে। বিস্ময়কর কিন্তু সত্য পাকিস্তানের মোহ ভাঙিয়ে দেয়াতে বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব এসেছে বি কে জাহাঙ্গীরদের প্রজন্ম থেকে। পাকিস্তানপন্থী বাঙালী বুদ্ধিজীবী, যেমন ফররুখ আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান, তালিম হোসেন, মোফাখখারুল ইসলাম কিংবা রওশন ইয়াজদানীদের তুলনায় জাহাঙ্গীরদের প্রজন্ম কতইবা এদের বয়স তখন! কেউ স্কুল শেষ কলেজ; কেউ কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে।
আপনার বন্ধুরা সব কারা?
“সব নাম তো মনে করতে পারছি না। তবে আগের নামগুলোর সঙ্গে লিখুন সাঈদ আতিকুল্লাহ, মেডিক্যালের আহমেদ রফিক আর জামালউদ্দিন। চিত্রনায়িক শবনমের স্বামী রবিন ঘোষের ভাই অশোক ঘোষ তখন খুব বামপন্থী। সৈয়দ আলী আহসান একবার আমাদের সবার নামের তালিকা গবর্নরের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
কেন? কী কারণ?
“কারণ আমাদের ক্র্যাশ করে দিতে হবে, তাহলে পাকিস্তান বাঁচবে। ফররুখ আহমদ কি করেছিলেন তা শুনুন।”
কী করেছিলেন?
“তিনি আমাদের বামপন্থা প্রীতি ব্যঙ্গ করে ‘লালমিয়া বুটাভস্কি’ নাম দিয়ে ব্যঙ্গাত্মক এক লেখা লিখেছিলেন।”
কিন্তু এসব করেও পাকিস্তানপন্থী বাঙালী বুদ্ধিজীবীরা শেষাবধি টিকে থাকতে পারেননি। “রাজনৈতিকভাবে প্রচ- সচেতন মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক নতুন প্রজন্মটিই” পূর্ব পাকিস্তানে বুদ্ধিবৃত্তির মূলধারাতে পরিণত হয়ে যায়। অনেক সমস্যা যদিও সে সময়ে, পাকিস্তানপন্থীরা নয়া বুদ্ধিজীবীদের তুলনায় বয়স, ক্ষমতায় অনেক এগিয়ে। সরকারের সঙ্গে তাঁদের সরাসরি যোগাযোগ। কিন্তু নবগঠিত পাকিস্তানে নানাবিধ কারণে বাঙালীর মধ্যে ধূমায়িত হতে থাকা বঞ্চনার বোধ নিয়ে ভাবিত হবার ইচ্ছা বা সামর্থ্য কোনটাই এঁদের ছিল না। বি কে জাহাঙ্গীর বলেন, “এঁদের এজেন্ডা ছিল পাকিস্তান রক্ষা করা। আমরা এঁদের মতো ছিলাম না। সচেতনভাবে এঁদের বিরোধী ছিলাম।” এখানে আরেকটা ব্যাপারও উল্লেখ করলেন তিনি। সেটা হচ্ছে কলকাতা থেকে আসা মুসলিমদের প্রসঙ্গ। কলকাতা থেকে ঢাকায় আসা মুসলিমরা পাকিস্তানের পক্ষই নিয়েছিলেন; তাদের সঙ্গেও স্বভাবতই নয়া-বুদ্ধিজীবীদের ভাল সম্পর্ক হয়নি।
আর আপনাদের ভাবনাটা তখন কোন পথে এগুচ্ছিল?
“আগেই বলেছি আমি সরাসরি পলিটিক্স করতাম না কিন্তু আন্ডারগ্রাউন্ডের টাচে ছিলাম। খোকা রায়, রণেশ দাশগুপ্ত এরা লিডার। আর আমাদের বয়সীরা হচ্ছে পার্টির ভিত্তি। আমাদের মধ্যে তখন এই ধারণা জন্মাচ্ছে যে মুসলিম লীগকে সরিয়ে দেয়া দরকার; এদের জন্য প্রগতিশীলতা ব্যাহত হচ্ছে।”
শহরে বসে প্রকাশ্যে এমত আলাপ-আলোচনা সে আমলে ছিল সাংঘাতিক বিপজ্জনক। গোয়েন্দাদের নজরদারি সর্বত্র। একবার ঠিক হলো কতগুলো বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য ঢাকা থেকে রাজেন্দ্রপুরের বনভূমিতে চলে যাওয়া হবে। সাংস্কৃৃতিক কর্মকা-ের ধরনটা কেমন হবে, ঢাকার কলেজগুলোতে স্কুলগুলোতে সাংস্কৃতিক কর্মকা- কেমন করে ছড়িয়ে দেয়া যায় এসব ছিল আলোচ্য। এক সকালে জাহাঙ্গীররা গোয়েন্দাদের চোখে ফাঁকি দিতে সক্ষম হলেন। বন্ধুরা সব ট্রাকে চড়ে ঠিকঠিক রাজেন্দ্রপুর। ট্রাক ড্রাইভার ভাড়াও নেয়নি। আলাপ আলাপে সন্ধ্যা হয় হয় বি কে জাহাঙ্গীরদের। “এ সময় হন্তদন্ত হয়ে কোত্থেকে যেন ইন্টিলিজেন্স ব্রাঞ্চের এক লোক এসে হাজির। শুরুতে উলটাপালটা কথাবার্তা বললেও পরে বলে, আমি আপনাদের লোক। আপনারা এখন তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যান। আমি অফিসকে জানাব আপনাদের খুঁজে পাইনি।” তাই হলো তখনকার মতো। গোয়েন্দা পরামর্শ মেনে নিয়ে ট্রেনযোগে ঢাকা। ফেরার পথে অশোক দত্ত গান ধরেছিলেন ‘বজ্র মানিকেতে ঘেরা’, মনে আছে বি কে জাহাঙ্গীরের। রাজেন্দ্রপুরের আলোচনা সফল হয়েছিল। সেদিনের আলোচনার সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ১৯৫০ সালে জগন্নাথ কলেজে প্রথমবারের মতো ২৫ বৈশাখ পালিত হয়; সভাপতি ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। ‘এভাবেই আমাদের কাজের পরিধি বাড়তে থাকে।’
আপনি বামপন্থায় অনুরক্ত হয়ে পড়ার কথা বলেছেন? এগুলো কি বামপন্থা?
“কট্টর অর্থে নয়। অন্য অর্থে দেখলে সেই সময়ে পাকিস্তানের পূর্ব অংশে মুক্তচিন্তার লেখালেখি করা, আলাপ-আলোচনা করা, গান-বাজনা করাটাই বৈপ্লবিক ব্যাপার। আর মনে রাখবেন আমাদের কার্যক্রমের ব্যাপারে পার্টি অবগত থাকত। আমাদের জন্য পার্টির নির্দেশনাও থাকত।
কলেজকালের আরেকটা বিষয় উল্লেখযোগ্য। কলেজ জীবনে এসে ঢাকার হিন্দু ছাত্রদের সঙ্গে পরিচয় বাড়তে থাকে বি কে জাহাঙ্গীরের; হিন্দু বাসাতে যাতায়াতের শুরু হয় এ সময়েই।
১৯৫২ সাল : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে
বাম রাজনীতি সংলগ্ন বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার চর্চা আর আন্দোলন করতে করতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন বি কে জাহাঙ্গীর। বছরটি ভাষার দাবিতে বাঙালীর রক্ত দেয়ার। ভর্তির অনেক আগে থেকেই অবশ্য আন্দোলন-সংগ্রামের পীঠস্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদচারণা। ‘এ কারণে অনেক আগে থেকেই অনেকে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মনে করতেন’, জানান তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে স্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে কর্মপরিধি। এ পর্যায়ে কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠা জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনা হিসাবে মানেন বি কে জাহাঙ্গীর। মানিক তখন প্রগতি লেখক সংঘের সভাপতি। কলকাতা থেকে গোপন পত্রে যোগাযোগ করেন জাহাঙ্গীরদের সঙ্গে। কার্জন হলের সিঁড়িতে বসে ‘উদ্বেলিত, উচ্ছ্বসিত’ জাহাঙ্গীররা মানিকের পত্র পড়তে বসেন গোপনে; সেখানে ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান ও আলাউদ্দিন আল আজাদ। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা মানিক বন্দোপাধ্যায়ের কাছ থেকে ‘চিঠি পাওয়া অনেক বড় ব্যাপার।’ মানিক জানিয়েছেন, তিনি ঢাকা আসতে ইচ্ছুক কিন্তু বাধা হচ্ছে পুলিশ। ‘প্রগতি লেখক সংঘের’ সম্মেলনে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণও জানানো হয়েছে চিঠিতে। ঢাকা থেকে সেবার যোগ দিয়েছিলেন আলাউদ্দিন আল আজাদ।
পুলিশ-গোয়েন্দা তৎপরতার প্রসঙ্গ আপনার কথাতে বার বার আসছে। এর মধ্যে কাজ করতেন কিভাবে সেটা একটু শুনতে চাই।
“সে সময় আমরা আড্ডার ছলে আলোচনাতে বসতাম। বসবার রকম একটা জায়গা ছিল ঠাঠারী বাজারে আনিসদের বাসা।” এটা ১৯৫১-এর দ্বিতীয় অর্ধের কথা।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান?
“হ্যাঁ। তিনি আমাদের বলয়ের মানুষ ছিলেন। একদিন আনিসদের বাসাতেই একটা ব্যাপার ঘটল। সেদিন উপস্থিত ছিলেন আবদুল গনি হাজারী, হাসান হাফিজুর রহমান, সরদার জয়েনউদ্দীন, আবদুস সামাদ। আবদুস সামাদ তখনো আবদুস সামাদ আজাদ হননি। কথাবার্তার একপর্যায়ে হাজারী বললেন, কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বার হতে চাইলে দরখাস্ত কর, বিবেচনা করা হবে।”
অনেকটা সময় পরে প্রস্তাবটা এসেছে দেখা যাচ্ছে। আপনি অবশ্য আগে বলেছেন যে পার্টি দীর্ঘদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করে পার্টি সেলে আগে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হতো। দরখাস্ত করার প্রস্তাব পেয়ে আপনার কেমন অনুভূতি হয়েছিল?
“খুশি লাগছিল। পার্টির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের পথ তৈরি সম্ভাবনাতে। দরখাস্ত কী লিখব হাজারীর কাছে জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, তুমি লেখ যে তুমি পার্টির আদর্শে বিশ্বাসী, পূর্ব বাংলার মুক্তি প্রত্যাশী তাই সদস্য হতে চাও।”
সপ্তাহখানেক পরে দরখাস্ত নিয়ে আনিসুজ্জামানের বাসাতে আবদুল গনি হাজারীর সঙ্গে সাক্ষাত। বি কে জাহাঙ্গীরের দরখাস্ত ‘কাব্যিক হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং আবার লিখতে বলা হয়।’ শেষমেশ পার্টি সদস্যপদ দিয়েছিল কিনা তা আর জানতে পারেননি। ঠিক সে সময়টাতে, ভাষা আন্দোলন তীব্রতর হচ্ছিল। ফলে সদস্যপদের মতো ব্যাপারগুলো সেভাবে আলোচনার মধ্যে থাকেনি। তবে সবাই ধরে নিচ্ছিল যে জাহাঙ্গীর ‘কমিউনিস্ট হয়ে গেছে।’ পার্টি একপর্যায়ে তাঁকে কাজে পাঠাতে শুরু করে। সে বছর নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে ঠাঠারি বাজারে যুবলীগের অফিসে নানান সংগঠনের মধ্যে একটি ধর্মঘট ডাক দেয়ার সম্ভাব্যতা আলোচনার জন্য কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের প্রতিনিধি হিসাবে পাঠানো হয়েছিল তাঁকে। রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাকে স্বীকৃতি আর কৃষক ফ্রন্টে রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের প্রতিবাদে ধর্মঘট করার আলোচনা হয় সেদিন। প্রথমে ধর্মঘটের পক্ষে সিদ্ধান্ত হলেও পরে সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি; কোন কোন সংগঠন পিছিয়ে যায়। (চলবে)
No comments