সূর্যালোক থেকে সৌরচুল্লি

বাড়ির মাথায় সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুত, বা সরাসরি জল গরম করা, এ সব জার্মানিতে ইতোমধ্যেই চালু। কিন্তু শুধুমাত্র সূর্যালোক থেকে আড়াই হাজার ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপ সৃষ্টি করা? এবার সেটাও সম্ভব করে ফেলেছেন বিজ্ঞানীরা। কোলোন-বন বিমানবন্দরে পাওয়া যাবে জার্মান বিমান ও মহাকাশযাত্রা কেন্দ্রের প্রাঙ্গণ।


তার ঠিক মাঝখানে একটি আট মিটার উঁচু ও সাত মিটার চওড়া আয়না, অর্থাৎ আয়নার কাঁচ বসানো দেয়াল। এটিকে পরিভাষায় বলে হেলিওস্ট্যাট। হেলিওস্ট্যাটটিকে কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে এমনভাবে নড়ানো-চড়ানো যায়, যাতে তার আয়নাগুলো থেকে প্রতিফলিত সূর্যালোক সবসময়েই একটি তথাকথিত কনসেনট্রেটরের উপরে গিয়ে পড়বে। নাম কনসেনট্রেটর, কেননা এর কাজ হল প্রতিফলিত সূর্যালোককে অধিশ্রয়ণবদ্ধ অর্থাৎ ফোকাস করা। কনসেনট্রেটরটি আসলে একটি অধিবৃত্ত বা প্যারাবোলা আকৃতির আয়না বা আয়নার সমষ্টি : তাতে ১৫৯টি ষড়ভুজ আয়না মৌমাছির চাকের পদ্ধতিতে লাগানো আছে। এই কনসেনট্রেটরের আয়তন এবং বাইরে হেলিওস্ট্যাটের আয়তন এক। কনসেনট্রেটরের আয়নাগুলোকে প্রতিবার নতুন করে বিন্যাস করার কোন প্রয়োজন নেই, সেগুলো আগে থেকেই এমনভাবে এ্যাডজাস্ট করা আছে যে, তারা একটি অধিশ্রয়ণবিন্দুর দিকে সূর্যালোক নিক্ষেপ করছে। এই ফোকাল পয়েন্টে একত্রিত, সমষ্টিবদ্ধ সূর্যরশ্মির তীব্রতা সাধারণের চেয়ে ৫,০০০ গুণ বেশি। ল্যাবরেটরির ভিতরে একটি এক্সপেরিমেন্টের প্রস্তুতি নিচ্ছেন ক্রিস্টিয়ান রেডার। একটি বায়ুশূন্য বাক্স, তার একদিকে কাচ লাগানো। মহাশূন্যযাত্রা সংক্রান্ত একটি কোম্পানি তাদের একটি পণ্য এই বাক্সে পরীক্ষা করতে চায়। পণ্যটি পরে একটি কৃত্রিম উপগ্রহে লাগানো হবে। কাজেই মহাশূন্যে বায়ুশূন্য অবস্থায় সেটি কি পরিমাণ সূর্যালোক ও তাপ সহ্য করতে পারে, সেটাই পরীক্ষা করে দেখা হবে। কিন্তু যেহেতু এই সোলার ওভেন বা সূর্যচুল্লীটি অতি তাড়াতাড়ি গরম হয়ে ওঠে, তাই মাত্র স্বল্পসময়ের জন্য পরীক্ষা চালানো হবে। এবং সেটা যখন আকাশ পুরোপুরি মেঘশূন্য। এ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সমস্যাটা সেখানেই, বললেন ক্রিস্টিয়ান রেডার : ‘কখনও-সখনও আমরা সারা সকালটা ধরে দেখি, মেঘ হচ্ছে কি হচ্ছে না। কি ধরনের পরীক্ষা করা হচ্ছে, তার ওপরেও সেটা নির্ভর করবে। গতবার আমাদের বলা ছিল, ৭০ সেকেন্ড সোলার ওভেনে রাখবে। এর পরের এক্সপেরিমেন্টে দশ সেকেন্ডের বেশি রাখলে চলবে না। আবার এমন এক্সপেরিমেন্টও আছে, যেখানে সারাদিন ধরে বস্তটিকে ওভেনে রাখতে হবে।’ জার্মান বিমান ও মহাকাশযাত্রা কেন্দ্র বা ডিএলআরের পদার্থবিদরা এভাবে মোটরগাড়ির বার্নিশ ইত্যাদি পরীক্ষা করে দেখেন। যেমন এক বছর ধরে সূর্যালোকে গাড়ি চললে বিশেষ করে অতিবেগুনি রশ্মির দরুণ গাড়ির রঙ বা বার্নিশের কি ক্ষতি হয়, সেটা জানার জন্য এক বছর ধরে পরীক্ষা চালানোর দরকার নেই। ডিএলআরের সোলার ওভেনে সেটা একদিনের মধ্যেই জানা যেতে পারে। এ কাজে সোলার ওভেনে ৩০০ থেকে ৫০০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপ উৎপন্ন করা হয়। তবে ডিএলআরের সোলার ওভেন তার চাইতে অনেক বেশি তাপমাত্রা সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখে, জানালেন সৌরশক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ গের্ড ডিবোভস্কি : ‘আমরা ২,৫০০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের তাপমাত্রা সৃষ্টি করতে পারি। মহাকাশযানগুলো পৃথিবীর বায়ুম-লে প্রবেশ করার সময় যে তাপ সৃষ্টি হয়, তা থেকে সুরক্ষার জন্য সেরামিক বা চীনামাটির টালি ব্যবহার করা হয়। সেগুলো এখানে খুবই সহজে টেস্ট করা যায়।’ সোলার ওভেনে ৮০০ থেকে ১,০০০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপে পানিকে বাষ্পে পরিণত করে সেই বাষ্প থেকে হাইড্রোজেন গ্যাস উৎপন্ন করা যায়। আবর্জনা পোড়ানো থেকে শুরু করে এ্যালুমিনিয়াম গলিয়ে পুনর্ব্যবহারের উপযোগী করা, এ সব কাজেই ডিএলআরের সূর্যচুল্লী কাজে লাগানো যেতে পারে। এবং এই সূর্যচুল্লী পদ্ধতিতে তাপ সৃষ্টি করে বাষ্পচালিত টারবাইন থেকে শিল্পপর্যায়ে বিদ্যুত উৎপাদন করা যেতে পারে, স্পেনের আলমেরিয়ায় ইতোমধ্যেই যা করা হচ্ছে। খেয়াল করতে হবে, সৌরশক্তি দিয়ে শুধুমাত্র বিদ্যুত উৎপাদন না করে, ডিএলআরের বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়াতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে চাইছেন, কেননা তা অনেক বেশি কার্যকর, যেমন হাইড্রোজেন গ্যাস উৎপাদনের ক্ষেত্রে। অপরদিকে টারবাইন চালানোর জন্যও সৌরশক্তির ব্যবহার অনেক বেশি কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
রাফিউল ইসলাম সরকার

No comments

Powered by Blogger.