গ্রামের ঋণগ্রহীতা ও সঞ্চয়কারী উভয়ই প্রতারিত by ড. আর এম দেবনাথ

রমজান-পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক খাতে বেশ ভাটা পড়ে। এবার তা নয়। এবার খবর আছে ‘হলমার্ক’ নামীয় একটি প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতির। খবর আছে ‘ডেস্টিনির’। খবর আছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের। খবর আছে কম্পট্রোলার এ্যান্ড একাউন্টেন্ট জেনারেলের অফিসের। খবর আছে পদ্মা সেতুর। খবর আছে বিটিআরসির। খবর আছে অর্থপাচারের।


বাহুল্য সবই বড় বড় খবর। তোলপাড় করা খবর। লিখতে গেলে প্রতিটি বিষয়ে আলাদা আলাদাভাবে লিখতে হয়। কিন্তু এত সুযোগ কোথায়? সুযোগের অভাবে আমি তাই নিরীহ একটা বিষয় বেছে নিয়েছি। নিয়েছি মানে নিতে উৎসাহিত হয়েছি। হয়েছি একজন রিকশাওয়ালার কথায়। দু’দিন আগে বাসা থেকে বেরিয়েছি টেনিস কোর্টের আঙ্গিনায় যাব বলে। সেখানে রিকশা যায় না। তবু এক রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম যাবে কী না। ও এক কথায় রাজি হয়ে গেল। আমি তো অবাক তার সাহস দেখে। জিজ্ঞেস করলাম ভাড়া কত, কিভাবে সে যাবে। ও বলল যাব স্যার, আপনি উঠুন না। আর ভাড়া? বলল আপনি খুশি হয়ে যা দেন, স্যার। তুমি টেনিস কোর্ট চেন তো? চিনি স্যার। তোমার বাড়ি কোথায়? গাইবান্ধা। ঈদে বাড়ি যাওনি? না স্যার। আমি কিছুটা বিস্মিত। জিজ্ঞেস করলাম কেন? ও বলল, স্যার আমার টাকার দরকার। তাই মন্দার বাজারেও ঢাকায় আছি। কী অসুবিধা তোমার? ও বলল, স্যার অনেক দেনা হয়ে গেছে। দুই এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছি ৪০ হাজার টাকা। কেন? একটা নিয়েছি ঘরের জন্য, আরেকটা নিয়েছে একটা ভ্যান গাড়ির জন্য। ভ্যান গাড়ির ঋণ বুঝলাম, ঘর করার জন্য এনজিও তোমাকে ঋণ দিল? রিকশাওয়ারা বলল, তাদের দেশের এনজিওরা ওসব প্রশ্ন করে না। তারা সব কিছুর জন্যই ঋণ দেয়। একটা ঋণ নিয়েছে সে তার নিজের নামে, আরেকটা স্ত্রীর নামে। সপ্তাহে সপ্তাহে কিস্তি দিতে হয়। তার হিসাব ঠিক বুঝলাম না। মাসে চার কিস্তিতে তার ৫ হাজার টাকা ঋণ পরিশোধ করতে হয়। গ্রামের সবারই এক অবস্থা। এক ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে তারা আরেকটা ঋণ নেয়। দিনে দিনে দেনা বাড়ে। কিন্তু ওর সমস্যা হয়ে গেছে। রিকশাওয়ালা ইতোমধ্যে দুটো ঋণ নিয়ে নিয়েছে। সমস্যা হতো না। কিন্তু গ-গোল বেধেছে ভ্যান গাড়ি নিয়ে। ভ্যান গাড়িটি দুর্ঘটনা কবলিত হয়ে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। এটা ভাড়ায় চলত। গ্রামের এক ছেলে ভাড়া নিত। দিনে পাওয়া যেত ৮০ টাকা। সেই রোজগার এখন বন্ধ। অথচ কিস্তির টাকার মাফ নেই। এনজিওর লোকেরা সদলবলে আসে। থাকে স্থানীয় টাউট বাটপাররা। ওরা টাকা আদায়ে এনজিওকে সাহায্যে করে। এরা জোরজবরদস্তি করে। এসব কারণে সে এবার ঈদে বাড়ি যায়নি। ইতোমধ্যে দু’তিনটি কিস্তি সে পরিশোধ করতে পারেনি। তার ঘুম এখন হারাম। স্ত্রী খবর পাঠিয়েছে টাকা নিয়ে বাড়ি যেতে। এ কারণেই সে এখন ঢাকায় যত বেশি টাকা রোজগার করা যায় সেই চেষ্টায় আছে। জিজ্ঞেস করলাম, এখন দিনে কত পাও? পাওয়া যেত ভালই। কিন্তু ঈদের পর বাজার এখনও জমেনি। তাই আগের রোজগার নেই। নিয়মিত ‘ক্ষেপ’ পেলে দিনে সব খরচের পরেও তার ৪০০ টাকার মতো থাকে। এই রোজগারের ওপরই এখন সংসার চালানো এবং কিস্তির টাকা দেয়া। খুব কষ্টে আছি স্যার। রাতে ঘুম হয় না। স্যার ঋণ নেয়াটা আমার ঠিক হয়নি।
রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম তাদের এলাকার প্রায় সকলের অবস্থাই এই রকম। সবাই কিস্তির জন্য উদ্বিগ্ন থাকে। কোন কারণে যদি রোজগার কম হয়, দিনে কাজ পাওয়া না যায় তাহলে তাদের বিপদ। কারণ কিস্তি মার যেতে পারবে না। মুখে মুখে কিস্তির কথা। এই বিষয়টি আমি নিজেও জেনে এসেছি। গত দু’মাস আগে গিয়েছিলাম পীরগঞ্জে। সেখানে এক চায়ের স্টলে অনেক শ্রমজীবী মানুষের সাথে কথা হয়। এদের কেউ রিকশা চালায়, কেউ ভ্যান গাড়ি চালায়, কেউ ইটভাঁটিতে কাজ করে, কেউ করে দিনমজুরি, কেউ বাজারে বোঝা বহন করে। আশ্চর্র্য, প্রায় সবাই ঋণী। তারা ঋণ নিয়েছে বিভিন্ন এনজিও থেকে। এক এনজিও থেকে ঋণ নয়। তারা অনেকেই দুই-তিন এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছে। আশ্চর্য, এনজিওগুলো এ ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করে নাÑতাই আমাকে জানানো হলো। দেখা যাচ্ছে এরা এই ঋণপ্রাপ্তির প্রক্রিয়ায় দিন দিন অধিকতর ঋণগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের কী আর্থিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে? আমার মনে হয় না। ঘটনাটা ঘটছে এমন : তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি নেই, তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভোগের জন্য ঋণ নিচ্ছে। উৎপাদনমূলক কাজে নয়। ফলে ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। কিস্তি পরিশোধের দুশ্চিন্তা বাড়ছে এবং বোঝা যাচ্ছে ঋণ দেয়া কোন একটা এনজিও বন্ধ করলে সমস্ত গ্রামীণ ঋণ কার্যক্রম স্তব্ধ হয়ে পড়বে। সবাই ঋণে ঋণে জর্জরিত। আর্থিক অবস্থার উন্নতি নেই। সবাই বেঁচে আছে, সবার নাক-ই জলের একটু উপরে। একটা মাত্র ঢেউয়ে তারা প্রাণ হারাতে পারে। একেই কী আমরা বলছি দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠছে লোক! আমি এসব বিষয় এখন আর বেশি বুঝি না। গ্রামের মানুষ শুধু ঋণ নিয়েই প্রতারিত হচ্ছে না। তারা বেশি হারে সুদ দিচ্ছে, দিন দিন তাদের ঋণের বোঝা বাড়ছে। অথচ আর্থিক অবস্থার কোন উন্নতি হচ্ছে না। মাটির ঘরের পরিবর্তে টিনের ঘর হয়েছে অনেকের, কিন্তু রোজগার সেভাবে বাড়েনি। এই অবস্থায় পড়ে বহু লোক পড়ছে প্রলোভনে। তাদের সামনে উপস্থাপন করা হচ্ছে বিশাল ভবিষ্যতের স্বপ্নের কথা। একটা গাছ ১০০ টাকা দিয়ে আজ কিনলে ছয় মাস পরে পাওয়া যাবে ৬টা গাছ। ১০০ টাকা দিলে এক বছর পরে সোনা পাওয়া যাবে চার আনা। কোম্পানি দক্ষিণ আফ্রিকায় সোনার খনি আবিষ্কার করেছে। সপ্তাহে সপ্তাহে টাকা জমালে এক বছরে টাকা দ্বিগুণ হবে। ত্রৈমাসিক কিস্তিতে বীমা করলে ১০ বছর পরে পাওয়া যাবে এত টাকা। যত সব লোভনীয় প্রস্তাব। গ্রামের মানুষ দুঃখে-কষ্টে থেকে থেকে, ঋণগ্রস্ত হয়ে, অসুখ- বিসুখে ভুগে এসব লোভের কাছে আত্মসমর্পণ করছে। এসব করছে গ্রামেরই এক শ্রেণীর লোক, শিক্ষিত লোক, শহরের সাথে যোগাযোগ আছে এমন লোক। এদের অস্ত্র হচ্ছে ‘সমবায়’, এদের অস্ত্র হচ্ছে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানি, এদের অস্ত্র হচ্ছে বীমা কোম্পানি, এদের অস্ত্র হচ্ছে নানা নামের এনজিও। এরা মানুষের কাছে ‘স্বপ্ন’ বিক্রি করে। এভাবে এরা লাখ লাখ লোককে প্রতারিত করে হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দিচ্ছে। এতে গ্রামের সঞ্চয় হ্রাস পাচ্ছে। আজ থেকে কুড়ি বছর আগে মোট ব্যাংক আমানতে গ্রামীণ আমানতের পরিমাণ যা ছিল আজকের দিনে তা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। ডাকঘর সঞ্চয়ও হ্রাস পাচ্ছে। গ্রামের মানুষ যা কিছু সঞ্চয় করছে তা লুট করে নিয়ে নিচ্ছে কিছু সংখ্যক প্রতারক এনজিও, এমএলএম কোম্পানি, বীমা ও সমবায় প্রতিষ্ঠান। একদিকে গ্রামের সাধারণ মানুষ দিন দিন বেশি বেশি করে ঋণগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে তার যা কিছু সঞ্চয় হচ্ছে তা লুট করে নিয়ে নিচ্ছে প্রতারকরা। অথচ সরকার বলছে দেশে কোন আইন নেই, এদের বিচার করার। কী অদ্ভুত ব্যাপার, লাখ লাখ মানুষকে প্রতারিত করে কিছু প্রতিষ্ঠান ও প্রভাবশালী লোক হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দিচ্ছে, মারা টাকা বিদেশে পাচার করছে আর সরকার বলছে বিচার করার আইন নেই! অতএব, বুঝহ সুজন!

লেখক : সাবেক অধ্যাপক, বিআইবিএম

No comments

Powered by Blogger.