স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ by অজয় রায়
(পূর্ব প্রকাশের পর) ১৯৭১ সালে পাক সামরিক জান্তার অপারেশন সার্চ লাইট বা বাংলাদেশের গণহত্যা শুরুর কিছক্ষণ আগে বঙ্গবন্ধু তাঁর সহকর্মী বিশেষ করে হাই কমান্ডের সদস্যদের তাঁর অবর্তমানে করণীয় সম্পর্কে যথারীতি নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর তরুণ সহকর্মী কুষ্টিয়ার এমপিএ ব্যারিস্টার
আমিরুল ইসলাম এবং ব্যারিস্টার কামাল হোসেন নিজ নিজ বাসায় না থেকে একটি নির্ধারিত বাসায় রাত কাটাবেন পরিস্থিতি অবলোকন করে পরদিন কর্তব্য নির্ধারণের জন্য। কিন্তু পথে ড. কামাল হোসেন নেমে গিয়েছিলেন পরদিন মিলিত হবার কথা বলে। কিন্তু অবিশ্বাস্য আর্মি অপারেশনের ভয়াবহতার কারণেই হোক বা অন্য যে কোন কারণেই হোক ড. কামাল হোসেন আর তাদের সাথে নির্ধারিত স্থানে যোগ দিতে পারেননি। ২৬শে মার্চ একটি বাসায় কাটিয়ে তাঁর ২৭শে মার্চ রায়ের বাজার হয়ে নদী পার হয়ে নবাবগঞ্জে এস পৌঁছান। অবশেষে পদ্মানদী পার হয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে দুজনে ফরিদপুর অতিক্রম করে কামারখালি-মাগুরা-ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া চুয়াডাঙ্গা হয়ে তাঁরা মেহেরপুরে পৌঁছে যান। পথে পথে তাজউদ্দীন আহমদ জনসভা করে গ্রামের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্দীপ্ত করতে থাকেন। এসব এলাকা তখনও মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে এবং এখানে মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, তৌফিক এলাহি ও মাহবুব প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা নেতৃবৃন্দের সাথে কর্মপন্থা নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ আলোচনায় বসেন। স্থির হয় নেতৃদ্বয় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে আমাদের সশস্ত্র সংগ্রামে ভারতের সামরিক সাহায্য ও রাজনৈতিক সমর্থন চাইবেন। এদের সহায়তায় ও সীমান্তের বিএসএফ অধিকর্তাদের সহযোগিতায় সীমান্ত অতিক্রম করে তাজউদ্দীন আহমদ ও আমিরুল ইসলাম ভারতের মাটিতে পদার্পণ করেন। তাঁদের সসম্মানে সীমান্তে বিএসএফ-এর অফিসারেরা যথযোগ্য সম্বর্ধনা জানিয়ে ছাউনিতে নিয়ে যান। সেখানে বিএসএফ-এর আঞ্চলিক প্রধান গোলক মজিমদার তাঁদের সাগ্রহে গ্রহণ করেন। ভারতে তাঁদের আগমনের উদ্দেশ্য গোলক মজুমদারকে জানালে তিনি বলেন যে এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ উর্ধতন কর্তৃপক্ষই সিদ্ধান্ত নেবেন, তবে তাঁর পক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের ছোটখাটো অস্ত্রসম্ভার দেয়া সম্ভব। দিল্লীতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে তাঁরা সাক্ষাৎ করতে পারেন এ ব্যাপারে তিনি তাঁদের কোলকাতা থেকে বিমানে দিল্লী যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন। এ উদ্দেশ্যে মজুমদার নিজে গাড়ী চালিয়ে নেতৃদ্বয়কে কোলকাতা বিমানবন্দরে নিয়ে আসেন। এখানেই সাক্ষাৎ হয় বিএসএফ প্রধান রুস্তমজীর সাথে। অবশেষে ৩১শে মার্চ কোলকাতায় পৌঁছলেন দুই আওয়ামী লীগ নেতা বিদ্ধস্ত অবস্থায় এবং এক বস্ত্রে। কোলকাতায় আসাম হাউজে এক রাত কাটিয়ে ১লা এপ্রিলে রাত দশটায় এক রুশ মালবাহী বিমানে রওয়ানা দিলেন তাজউদ্দীন দিল্লীর উদ্দেশে তরুণ সহকর্মী আমিরুল ইসলামকে সাথে নিয়ে, সঙ্গী হলেন গাইডরূপে বিএসএফ-এর অফিসার গোলক মজুমদার; উদ্দেশ্য প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করে আমাদের সংগামে ভারতের সামরিক সহায়তা ও ভারতের রাজনৈতিক সমর্থন ও সহানুভূতি আদায় করা। ইতিমধ্যেই তাজউদ্দীনের আগমন বার্তা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। পরদিন অর্থাৎ ২রা এপ্রিল ভোরে তাঁরা দিল্লী পৌঁছালেন, রাখা হলো বিএসএফ-এর অতিথি ভবনে। দিল্লীতে দুদিন অবস্থান করে অবশেষে বহু অকাক্সিক্ষত তাজউদ্দীন-ইন্দিরা একান্ত সাক্ষাৎ ঘটল ৪ঠা এপ্রিল তারিখে ইন্দিরার স্টাডিরুমে। ইন্দিরাজীর প্রথমেই জানতে চেয়েছিলেন শেখ মুজিব সম্পর্কে, “ঐড়ি রং ঝযবরশয গঁলরন, রং যব ধষষ ৎরমযঃ?”। তাজউদ্দীন আহমদের জবাব ছিল যে বাংলাদেশে ২৬শে মার্চ থেকেই স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে অনেকটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে। শেখ মুজিব সম্পর্কে ইন্দিরার উত্তর দিয়েছিলেন অসেকটা এরকমভাবে -Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman has sent us to you giving us some responsibility. Since the Pakistani Army crack-down in the dreadful night of 25th March we lost contact with him. But he has given us necessary instructions how to conduct the movement in his absence from his place and we believe that he is still providing the nation leadership তিনি প্রধানমন্ত্রীকে আরও জানালেন যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, ‘এবং এ যুদ্ধে আমাদের জিততে হবে এবং এজন্য চাই ভারতের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র ও সামরিক উপকরণ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। ভারত ছাড়াও আমার চাই পৃথিবীর সকল গণতন্ত্রকামী দেশের ও সাধারণ মানুষের সহায়তা ও সহানুভূতি।’ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নে যে আমরা সরকার গঠন করেছি কিনা, তাজউদ্দীনের তাৎক্ষণিক উত্তর ছিল যে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের সদস্যদের নিয়ে শেখ মুজিবের নির্দেশমতো ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছে এবং তিনি এই সরকারের প্রধান অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আলোচনায় সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং তাজউদ্দীনের বুদ্ধিমত্তায় দেশপ্রেম দেখে পরিতুষ্ট ও অভিভূত হন। তাজউদ্দীন আহমদকে ভারতের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহায়তা দানের প্রতিশ্রুতি দেন, শরণার্থীদের জন্য ভারতের সীমান্ত খুলে দেয়া ও শরণার্থীদের দেখভাল করার দায়িত্ব সম্পর্কে তাজউদ্দীন আহমদকে ইন্দিরাজী আশ্বস্ত করেন। এবং ভারতের মাটিতে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পরিচালনায় সহযোগিতার আশ্বাস দেন। এই সাক্ষাতের ভিত্তিতেই পরবর্তীকালে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে তাজউদ্দীন আহমদের বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।
এই আলোচনার পর পরই আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের সদস্যদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয় ১০ই এপ্রিল’ ৭১ সালে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি করে ৬-সদস্য বিশিষ্ট যুদ্ধকালীন একটি মন্ত্রিসভা ঘোষিত হয়। বস্তুত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বেই সরকারের সকল কাজকর্ম পরিচালিত হতো। তাঁর দায়িত্বে ছিল Ñ প্রতিরক্ষা, তথ্য ও বেতার, স্বাস্থ্য ও সমাজ কল্যাণ, শিক্ষা, স্থানীয় প্রশাসন, শ্রম, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পরিকল্পনা। এই মন্ত্রী পরিষদের অন্য সদস্যরা ছিলেন : সৈয়দ নজরুল ইসলাম, উপরাষ্ট্রপতি (রাষ্ট্রপতি- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, এবং তাঁর অবর্তমানে রাষ্ট্রপতির সকল দায়িত্ব পালন করবেন উপরাষ্ট্রপতি), ক্যাপ্টেন মনসুর আলী (অর্থ, জাতীয় রাজস্ব, বাণিজ্য ও শিল্প, পরিবহন), জনাব এ এইচ এম কামারুজ্জামান (স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং কৃষি ) ও খোন্দকার মোশতাক আহমেদ (পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদীয় বিষয়)। পরদিন অর্থাৎ ১১ই এপ্রিল তারিখে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ দেশবাসীর উদ্দেশে এক আবেগপূর্ণ ও ভাবগম্ভীর তাৎপর্যপূর্ণ ভাষণ দেন, যা সেদিন অবরুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষকে উদ্দীপ্ত করেছিল, মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিতে টনিকের মতো কাজ করেছিল জনগণের মনে, চেতনায় ও কর্ম-উদ্যমে। তাঁর ভাষণটি ছিল নিম্নরূপ :
স্বাধীন বাংলাদেশের বীর ভাইবোনেরা,
বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তিপাগল গণমানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পক্ষ থেকে আমি আপনাদেরকে আমার সংগ্রামী অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি তাঁদের যাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে গিয়ে তাঁদের মূল্যবান জীবন আহুতি দিয়েছেন। যতদিন বাংলার আকাশে চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা রইবে, যতদিন বাংলার মাটিতে মানুষ থাকবে, ততদিন মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামের বীর শহীদদের অমর স্মৃতি বাঙ্গালীর মানসপটে চির অম্লান থাকবে।
২৫শে মার্চ মাঝরাতে ইয়াহিয়া খান তার রক্তলোলুপ সাঁজোয় বাহিনীকে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর লেলিয়ে দিয়ে যে নরহত্যা যজ্ঞের শুরু করেন তা প্রতিরোধের আহ্বান জানিয়ে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আপনারা সব কালের সব দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী মানুষের সাথে আজ একাত্ম। পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার দস্যুবাহিনীর বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ আপনারা গড়ে তুলেছেন তা এমন এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে যে পৃথিবীর সমস্ত স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে আপনাদের এ অভূতপূর্ব সংগ্রাম সর্বকালের প্রেরণার উৎস হয়ে রইল। প্রত্যেকদিনের সংগ্রামের দিনপঞ্জি আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করছে, বিশ্বের কাছে আমাদের গৌরব বৃদ্ধি করছে।
আপনাদের অদম্য সাহস ও মনোবল যা দিয়ে আপনারা রুখে দাঁড়িয়েছেন ইয়াহিয়ার ভাড়াটে দস্যদের বিরুদ্ধে, তার মধ্য দিয়ে আপনারা এইটেই প্রমাণ করেছেন যে যুদ্ধক্ষেত্রাস্তীর্ণ ধ্বংসাবশেষের মধ্য দিয়ে ধূলি-কাদা আর রক্তের ছাপ মুছে এক নতুন বাঙালী জাতি জন্ম নিল। পৃথিবীর কাছে আমরা ছিলাম এক শান্তিপ্রিয় মানুষ। বন্ধু-বাৎসল্যে, মায়া ও হাসি-কান্নায়, গান, সংস্কৃতি আর সৌন্দর্যের ছায়ায় গড়ে ওঠা আমরা ছিলাম পল্লী-বাংলার মানুষ। পৃথিবী ভাবত, আমরাও ভাবতাম যুদ্ধ ও রণডংকা আমাদের থেকে অনেক দূরে। কিন্তু আজ?
আমাদের মানবিক মূল্যবোধ ও আদর্শেও পতাকা সমুন্নত রেখে আমরা আবার প্রমাণ করেছি যে আমরা তীতুমীর-সূর্য্যসেনের বংশধর। স্বাধীনতার জন্যে যেমন আমরা জীবন দিতে পারি তেমনি আমাদের দেশ থেকে বিদেশী শত্রুসেনাদের চিরতরে হটিয়ে দিতেও সক্ষম। আমাদের অদম্য সাহস ও মনোবলের কাছে শত্রু যত প্রবল পরাক্রম হোক না কেন, পরাজয় বরণ করতে বাধ্য। আমরা যদি প্রথম আঘাত প্রতিহত করতে ব্যর্থ হতাম তাহলে নতুন স্বাধীন প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হয়তো কিছুদিনের জন্য হলেও পিছিয়ে যেত। আপনারা শত্রুসেনাদের ট্যাঙ্ক ও বোমারু বিমানের মোকাবিলা করেছেন এবং আপনাদের যার হাতে যে অস্ত্র ছিল তাই নিয়েই রুখে দাঁড়িয়েছেন এবং তাদেরকে পিছু হটে গিয়ে নিজ শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছেন। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ মুক্ত। বৈদেশিক সাংবাদিকেরা আজ স্বাধীন বাংলাদেশের যে কোন জায়গায় বিনা বাধায় ঘুরে বেড়াতে পারেন এবং আপনাদের এ বিজয়ের কথা তাঁরা বাইরের জগৎকে জানাচ্ছেন।
আজ প্রতিরোধ আন্দোলনের কথা গ্রাম বাংলার প্রতিটি ঘরে পৌঁছে গেছে। হাজার হাজার মানুষ আজকের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়েছেন। বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ই, পি, আর’র বীর বাঙালী যোদ্ধারা এই স্বাধীনতা সংগ্রামের যে যুদ্ধ তার পুরোভাগে রয়েছেন এবং তাদেরকে কেন্দ্র করে পুলিশ,আনসার, মোজাহিদ, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, ছাত্র, শ্রমিক ও অন্যান্য হাজার হাজার সংগ্রামী মানুষ এই যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে এদেরকে সমর কৌশলে পারদর্শী করা হয়েছে ও শত্রুদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া অস্ত্র ও গোলা-বারুদ দিয়ে বাংলার এ মুক্তিবাহিনীকে শত্রুদের মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। সাগর পারের বাঙালী ভাইয়েরা যে যেখানে আছেন আমাদেরকে অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য পাঠাচ্ছেন।
সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলে বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর খালেদ মোশারফকে আমরা সমর পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছি। খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে আমাদের মুক্তিবাহিনী অসীম সাহস ও কৃতিত্বের সাথে শত্রুর সাথে মোকাবেলা করেছেন এবং শত্রুসেনাদেরকে সিলেট ও কুমিল্লার ক্যান্টনমেন্ট ছাউনিতে ফিরে যেতে বাধ্য করেছেন। আমাদের মুক্তি বাহিনী শীঘ্রই শত্রুকে নিঃশেষ করে দেবার সংকল্প গ্রহণ করেছে। (চলবে)
এই আলোচনার পর পরই আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের সদস্যদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয় ১০ই এপ্রিল’ ৭১ সালে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি করে ৬-সদস্য বিশিষ্ট যুদ্ধকালীন একটি মন্ত্রিসভা ঘোষিত হয়। বস্তুত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বেই সরকারের সকল কাজকর্ম পরিচালিত হতো। তাঁর দায়িত্বে ছিল Ñ প্রতিরক্ষা, তথ্য ও বেতার, স্বাস্থ্য ও সমাজ কল্যাণ, শিক্ষা, স্থানীয় প্রশাসন, শ্রম, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পরিকল্পনা। এই মন্ত্রী পরিষদের অন্য সদস্যরা ছিলেন : সৈয়দ নজরুল ইসলাম, উপরাষ্ট্রপতি (রাষ্ট্রপতি- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, এবং তাঁর অবর্তমানে রাষ্ট্রপতির সকল দায়িত্ব পালন করবেন উপরাষ্ট্রপতি), ক্যাপ্টেন মনসুর আলী (অর্থ, জাতীয় রাজস্ব, বাণিজ্য ও শিল্প, পরিবহন), জনাব এ এইচ এম কামারুজ্জামান (স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং কৃষি ) ও খোন্দকার মোশতাক আহমেদ (পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদীয় বিষয়)। পরদিন অর্থাৎ ১১ই এপ্রিল তারিখে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ দেশবাসীর উদ্দেশে এক আবেগপূর্ণ ও ভাবগম্ভীর তাৎপর্যপূর্ণ ভাষণ দেন, যা সেদিন অবরুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষকে উদ্দীপ্ত করেছিল, মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিতে টনিকের মতো কাজ করেছিল জনগণের মনে, চেতনায় ও কর্ম-উদ্যমে। তাঁর ভাষণটি ছিল নিম্নরূপ :
স্বাধীন বাংলাদেশের বীর ভাইবোনেরা,
বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তিপাগল গণমানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পক্ষ থেকে আমি আপনাদেরকে আমার সংগ্রামী অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি তাঁদের যাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে গিয়ে তাঁদের মূল্যবান জীবন আহুতি দিয়েছেন। যতদিন বাংলার আকাশে চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা রইবে, যতদিন বাংলার মাটিতে মানুষ থাকবে, ততদিন মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামের বীর শহীদদের অমর স্মৃতি বাঙ্গালীর মানসপটে চির অম্লান থাকবে।
২৫শে মার্চ মাঝরাতে ইয়াহিয়া খান তার রক্তলোলুপ সাঁজোয় বাহিনীকে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর লেলিয়ে দিয়ে যে নরহত্যা যজ্ঞের শুরু করেন তা প্রতিরোধের আহ্বান জানিয়ে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আপনারা সব কালের সব দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী মানুষের সাথে আজ একাত্ম। পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার দস্যুবাহিনীর বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ আপনারা গড়ে তুলেছেন তা এমন এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে যে পৃথিবীর সমস্ত স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে আপনাদের এ অভূতপূর্ব সংগ্রাম সর্বকালের প্রেরণার উৎস হয়ে রইল। প্রত্যেকদিনের সংগ্রামের দিনপঞ্জি আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করছে, বিশ্বের কাছে আমাদের গৌরব বৃদ্ধি করছে।
আপনাদের অদম্য সাহস ও মনোবল যা দিয়ে আপনারা রুখে দাঁড়িয়েছেন ইয়াহিয়ার ভাড়াটে দস্যদের বিরুদ্ধে, তার মধ্য দিয়ে আপনারা এইটেই প্রমাণ করেছেন যে যুদ্ধক্ষেত্রাস্তীর্ণ ধ্বংসাবশেষের মধ্য দিয়ে ধূলি-কাদা আর রক্তের ছাপ মুছে এক নতুন বাঙালী জাতি জন্ম নিল। পৃথিবীর কাছে আমরা ছিলাম এক শান্তিপ্রিয় মানুষ। বন্ধু-বাৎসল্যে, মায়া ও হাসি-কান্নায়, গান, সংস্কৃতি আর সৌন্দর্যের ছায়ায় গড়ে ওঠা আমরা ছিলাম পল্লী-বাংলার মানুষ। পৃথিবী ভাবত, আমরাও ভাবতাম যুদ্ধ ও রণডংকা আমাদের থেকে অনেক দূরে। কিন্তু আজ?
আমাদের মানবিক মূল্যবোধ ও আদর্শেও পতাকা সমুন্নত রেখে আমরা আবার প্রমাণ করেছি যে আমরা তীতুমীর-সূর্য্যসেনের বংশধর। স্বাধীনতার জন্যে যেমন আমরা জীবন দিতে পারি তেমনি আমাদের দেশ থেকে বিদেশী শত্রুসেনাদের চিরতরে হটিয়ে দিতেও সক্ষম। আমাদের অদম্য সাহস ও মনোবলের কাছে শত্রু যত প্রবল পরাক্রম হোক না কেন, পরাজয় বরণ করতে বাধ্য। আমরা যদি প্রথম আঘাত প্রতিহত করতে ব্যর্থ হতাম তাহলে নতুন স্বাধীন প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হয়তো কিছুদিনের জন্য হলেও পিছিয়ে যেত। আপনারা শত্রুসেনাদের ট্যাঙ্ক ও বোমারু বিমানের মোকাবিলা করেছেন এবং আপনাদের যার হাতে যে অস্ত্র ছিল তাই নিয়েই রুখে দাঁড়িয়েছেন এবং তাদেরকে পিছু হটে গিয়ে নিজ শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছেন। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ মুক্ত। বৈদেশিক সাংবাদিকেরা আজ স্বাধীন বাংলাদেশের যে কোন জায়গায় বিনা বাধায় ঘুরে বেড়াতে পারেন এবং আপনাদের এ বিজয়ের কথা তাঁরা বাইরের জগৎকে জানাচ্ছেন।
আজ প্রতিরোধ আন্দোলনের কথা গ্রাম বাংলার প্রতিটি ঘরে পৌঁছে গেছে। হাজার হাজার মানুষ আজকের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়েছেন। বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ই, পি, আর’র বীর বাঙালী যোদ্ধারা এই স্বাধীনতা সংগ্রামের যে যুদ্ধ তার পুরোভাগে রয়েছেন এবং তাদেরকে কেন্দ্র করে পুলিশ,আনসার, মোজাহিদ, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, ছাত্র, শ্রমিক ও অন্যান্য হাজার হাজার সংগ্রামী মানুষ এই যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে এদেরকে সমর কৌশলে পারদর্শী করা হয়েছে ও শত্রুদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া অস্ত্র ও গোলা-বারুদ দিয়ে বাংলার এ মুক্তিবাহিনীকে শত্রুদের মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। সাগর পারের বাঙালী ভাইয়েরা যে যেখানে আছেন আমাদেরকে অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য পাঠাচ্ছেন।
সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলে বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর খালেদ মোশারফকে আমরা সমর পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছি। খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে আমাদের মুক্তিবাহিনী অসীম সাহস ও কৃতিত্বের সাথে শত্রুর সাথে মোকাবেলা করেছেন এবং শত্রুসেনাদেরকে সিলেট ও কুমিল্লার ক্যান্টনমেন্ট ছাউনিতে ফিরে যেতে বাধ্য করেছেন। আমাদের মুক্তি বাহিনী শীঘ্রই শত্রুকে নিঃশেষ করে দেবার সংকল্প গ্রহণ করেছে। (চলবে)
No comments