শিল্পীর ভুবন- প্রাজ্ঞ চৈতন্যের পাঠ by সিলভিয়া নাজনীন
সভ্যতা বিনির্মাণের সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ায় ব্যক্তির পদবিক্ষেপ মলিন ধুলোয় আকীর্ণ হয়ে যায়; তবুও সৃষ্টিশীল মানুষ তাঁর সময়কে বিশেষায়িত করেন কালোত্তীর্ণতার মহিমায়। এ দেশের শিল্পজগতের সংবেদী অভিঘাতশিল্পী মুর্তজা বশীর তাঁর ৮০তম জন্মদিন অতিক্রম করেছেন। ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি ছবি আঁকছেন।
এই দীর্ঘ সময়ে বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে স্থিতধী এবং পরিপূর্ণ একজন শিল্পী মুর্তজা বশীর।
‘ছবি আঁকার জন্য কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই, কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, কোনো প্রতিজ্ঞা নেই—যখন আমার যা আঁকতে ইচ্ছে হয়েছে তা-ই এঁকেছি; কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয় বা ধরনে আবদ্ধ থাকিনি’—শল্পী মুর্তজা বশীর এভাবেই শিল্পসৃজনের আকাঙ্ক্ষার কথা বলছিলেন। ঢাকার মণিপুরীপাড়ায় একটি শান্ত-কোলাহলমুক্ত পথের শেষ প্রান্তের অ্যাপার্টমেন্টে শিল্পী মুর্তজা বশীরের শিল্পভুবন। সদা স্মিত হাস্যোময় শিল্পী মুর্তজা বশীর আনন্দ খুঁজে বেড়ান শিল্পের মধ্যে। তাই তিনি কখনো ছবি আঁকেন, আবার কখনো লেখালেখি আর গবেষণার মধ্যে হারিয়ে যান; কখনোবা ডাকটিকিট সংগ্রহ করেন, সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর আগ্রহের বিষয় দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর কাগজি মুদ্রা ও লেনিনবিষয়ক ডাকটিকিট সংগ্রহ। সর্বদাই তিনি ছুটেছেন একটি প্রশ্নের পেছনে—‘আমি কে, কোথা থেকে এসেছি!’ মাটি ও শিকড়ের দিকে চিরন্তন এই অভিব্যক্তিকে তিনি নিয়েছেন যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে। প্রথাগত পাশ্চাত্যমুখী ভাবনাবলয় থেকে বের হয়ে তিনি খুঁজে চলেছেন বাঙালি-মানুষের প্রকৃত পরিচয়।
দীর্ঘদিন শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় তিনি দেখেছেন আমাদের শিল্পশিক্ষার দুর্বলতাগুলো, সাধ্যমতো চেষ্টা করেও বাধাগুলো অতিক্রম করা যায়নি, তবে তিনি বিশ্বাস রাখেন পরবর্তী প্রজন্মের ওপর। প্রাচ্য অপেক্ষা পাশ্চাত্যের শিল্পকলার প্রতি আমাদের একাডেমিক মোহগ্রস্ততা তাঁকে ব্যথিত করে। শিল্প-শিক্ষার্থীদের তিনি বলেন প্রথমে নিজের অস্তিত্ব আর শিকড়ের সন্ধান করে নিজেকে জানতে হবে।
‘আমি নিজেও প্রথম জীবনে স্বপ্ন দেখেছি ইউরোপিয়ান হবার’—স্পষ্ট স্বীকারোক্তি শিল্পীর। তবে বাস্তব জীবনের সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা তাঁকে ফিরিয়ে এনেছে বাংলার শ্যামল প্রকৃতি ও সহজ মানুষের কাছে।
শিল্পকলার বিভিন্ন কথা প্রসঙ্গে শিল্পী মুর্তজা বশীর বলেন, তিনি বিমূর্ত শিল্পকলার ঘোরবিরোধী। আরও বলেন, আমেরিকাতেই বিমূর্ততার উৎপত্তি এবং বিকাশ—কারণ সেখানকার সমাজব্যবস্থা। বিচ্ছিন্নতাবোধ-একাকিত্ব, রাগ-ক্ষোভ-হতাশার বহিঃপ্রকাশ শিল্পীদের চিত্রপটে এসেছে বিমূর্ততায়। অথচ আমাদের এই একান্নবর্তী সমাজব্যবস্থা, আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ একজন শিল্পীকে কেন বিমূর্ততায় নিয়ে যায়, তা এখনো স্পষ্ট নয়। শিল্পীর মনস্তত্ত্ব জানা এ ক্ষেত্রে জরুরি হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আমাদের বিদ্যা, কাব্য, দর্শন সবই এক বৃহৎ পরিবারের অংশ।’ আমাদের শিল্পমাধ্যমগুলো আপাতদৃষ্টিতে আলাদা মনে হলেও প্রাচ্যদর্শন বলছে এরা একে অপরের পরিপূরক।
শিল্প সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে কি না, তা সম্পর্কে শিল্পী মুর্তজা বশীর কিছু বলেননি; তবে তিনি মনে করেন শিল্প মানুষের রুচি পরিবর্তনে সহায়ক। বাংলাদেশের শিল্পভুবনে বিশেষ পরিবর্তন ঘটেছে দ্বিবার্ষিক এশিয়ান শিল্পকলা প্রদর্শনীর শুরু হওয়ার পর থেকেই। এ সময় বিভিন্ন দেশের শিল্পী-শিল্পকর্ম-শিল্পবোদ্ধা-সমালোচকদের সঙ্গে এ দেশের শিল্পী ও শিল্পপ্রেমীদের ভাবনা-দৃষ্টিভঙ্গির প্রত্যক্ষ আদান-প্রদান ঘটে ব্যাপকভাবে।
শিল্পী মুর্তজা বশীরের পারিবারিক অবস্থান তাঁকে জীবনের সব ক্ষেত্রে সাহস জুগিয়েছে; জীবনের গভীর সংকটকে খুব সহজেই উতরে গিয়েছেন শিল্পের প্রতি তীব্র ভালোবাসা আর কর্মনিষ্ঠার মাধ্যমে। ব্যক্তির সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় ইতিহাস জানার তাগিদ থেকেই জীবনের সফলতার মূলমন্ত্র পাঠ করেছেন এই শিল্পী। তবে এই প্রজন্ম শিল্পী মুর্তজা বশীরের ছবি কীভাবে পাঠ করছে, তা জানার তীব্র ইচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি।
শিল্পী মুর্তজা বশীর: জন্ম ১৯৩২ সালের ১৭ আগস্ট, ঢাকায়। ১৯৪৯-৫৪ সাল পর্যন্ত গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস, বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে শিল্পশিক্ষা গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে আর্ট অ্যাপ্রিসিয়েশন বিষয়ে আশুতোষ জাদুঘর, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কোর্স করেন। ১৯৫৬-৫৮ সালে ফ্রেস্কো পেইন্টিং বিষয়ে একাডেমি অব ফাইন আর্টস, ফ্লোরেন্স এবং ১৯৭২-৭৩ সালে এচিং অ্যান্ড অ্যাকুয়াটেন্টে ইকোল দো বোজার্ট, প্যারিস থেকে শিক্ষা লাভ করেন। ১৯৯৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
‘ছবি আঁকার জন্য কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই, কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, কোনো প্রতিজ্ঞা নেই—যখন আমার যা আঁকতে ইচ্ছে হয়েছে তা-ই এঁকেছি; কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয় বা ধরনে আবদ্ধ থাকিনি’—শল্পী মুর্তজা বশীর এভাবেই শিল্পসৃজনের আকাঙ্ক্ষার কথা বলছিলেন। ঢাকার মণিপুরীপাড়ায় একটি শান্ত-কোলাহলমুক্ত পথের শেষ প্রান্তের অ্যাপার্টমেন্টে শিল্পী মুর্তজা বশীরের শিল্পভুবন। সদা স্মিত হাস্যোময় শিল্পী মুর্তজা বশীর আনন্দ খুঁজে বেড়ান শিল্পের মধ্যে। তাই তিনি কখনো ছবি আঁকেন, আবার কখনো লেখালেখি আর গবেষণার মধ্যে হারিয়ে যান; কখনোবা ডাকটিকিট সংগ্রহ করেন, সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর আগ্রহের বিষয় দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর কাগজি মুদ্রা ও লেনিনবিষয়ক ডাকটিকিট সংগ্রহ। সর্বদাই তিনি ছুটেছেন একটি প্রশ্নের পেছনে—‘আমি কে, কোথা থেকে এসেছি!’ মাটি ও শিকড়ের দিকে চিরন্তন এই অভিব্যক্তিকে তিনি নিয়েছেন যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে। প্রথাগত পাশ্চাত্যমুখী ভাবনাবলয় থেকে বের হয়ে তিনি খুঁজে চলেছেন বাঙালি-মানুষের প্রকৃত পরিচয়।
দীর্ঘদিন শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় তিনি দেখেছেন আমাদের শিল্পশিক্ষার দুর্বলতাগুলো, সাধ্যমতো চেষ্টা করেও বাধাগুলো অতিক্রম করা যায়নি, তবে তিনি বিশ্বাস রাখেন পরবর্তী প্রজন্মের ওপর। প্রাচ্য অপেক্ষা পাশ্চাত্যের শিল্পকলার প্রতি আমাদের একাডেমিক মোহগ্রস্ততা তাঁকে ব্যথিত করে। শিল্প-শিক্ষার্থীদের তিনি বলেন প্রথমে নিজের অস্তিত্ব আর শিকড়ের সন্ধান করে নিজেকে জানতে হবে।
‘আমি নিজেও প্রথম জীবনে স্বপ্ন দেখেছি ইউরোপিয়ান হবার’—স্পষ্ট স্বীকারোক্তি শিল্পীর। তবে বাস্তব জীবনের সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা তাঁকে ফিরিয়ে এনেছে বাংলার শ্যামল প্রকৃতি ও সহজ মানুষের কাছে।
শিল্পকলার বিভিন্ন কথা প্রসঙ্গে শিল্পী মুর্তজা বশীর বলেন, তিনি বিমূর্ত শিল্পকলার ঘোরবিরোধী। আরও বলেন, আমেরিকাতেই বিমূর্ততার উৎপত্তি এবং বিকাশ—কারণ সেখানকার সমাজব্যবস্থা। বিচ্ছিন্নতাবোধ-একাকিত্ব, রাগ-ক্ষোভ-হতাশার বহিঃপ্রকাশ শিল্পীদের চিত্রপটে এসেছে বিমূর্ততায়। অথচ আমাদের এই একান্নবর্তী সমাজব্যবস্থা, আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ একজন শিল্পীকে কেন বিমূর্ততায় নিয়ে যায়, তা এখনো স্পষ্ট নয়। শিল্পীর মনস্তত্ত্ব জানা এ ক্ষেত্রে জরুরি হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আমাদের বিদ্যা, কাব্য, দর্শন সবই এক বৃহৎ পরিবারের অংশ।’ আমাদের শিল্পমাধ্যমগুলো আপাতদৃষ্টিতে আলাদা মনে হলেও প্রাচ্যদর্শন বলছে এরা একে অপরের পরিপূরক।
শিল্প সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে কি না, তা সম্পর্কে শিল্পী মুর্তজা বশীর কিছু বলেননি; তবে তিনি মনে করেন শিল্প মানুষের রুচি পরিবর্তনে সহায়ক। বাংলাদেশের শিল্পভুবনে বিশেষ পরিবর্তন ঘটেছে দ্বিবার্ষিক এশিয়ান শিল্পকলা প্রদর্শনীর শুরু হওয়ার পর থেকেই। এ সময় বিভিন্ন দেশের শিল্পী-শিল্পকর্ম-শিল্পবোদ্ধা-সমালোচকদের সঙ্গে এ দেশের শিল্পী ও শিল্পপ্রেমীদের ভাবনা-দৃষ্টিভঙ্গির প্রত্যক্ষ আদান-প্রদান ঘটে ব্যাপকভাবে।
শিল্পী মুর্তজা বশীরের পারিবারিক অবস্থান তাঁকে জীবনের সব ক্ষেত্রে সাহস জুগিয়েছে; জীবনের গভীর সংকটকে খুব সহজেই উতরে গিয়েছেন শিল্পের প্রতি তীব্র ভালোবাসা আর কর্মনিষ্ঠার মাধ্যমে। ব্যক্তির সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় ইতিহাস জানার তাগিদ থেকেই জীবনের সফলতার মূলমন্ত্র পাঠ করেছেন এই শিল্পী। তবে এই প্রজন্ম শিল্পী মুর্তজা বশীরের ছবি কীভাবে পাঠ করছে, তা জানার তীব্র ইচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি।
শিল্পী মুর্তজা বশীর: জন্ম ১৯৩২ সালের ১৭ আগস্ট, ঢাকায়। ১৯৪৯-৫৪ সাল পর্যন্ত গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস, বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে শিল্পশিক্ষা গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে আর্ট অ্যাপ্রিসিয়েশন বিষয়ে আশুতোষ জাদুঘর, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কোর্স করেন। ১৯৫৬-৫৮ সালে ফ্রেস্কো পেইন্টিং বিষয়ে একাডেমি অব ফাইন আর্টস, ফ্লোরেন্স এবং ১৯৭২-৭৩ সালে এচিং অ্যান্ড অ্যাকুয়াটেন্টে ইকোল দো বোজার্ট, প্যারিস থেকে শিক্ষা লাভ করেন। ১৯৯৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
No comments