বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৪৯৭ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন।আশরাফুল হক, বীর প্রতীক সাহসী এক মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশের ভেতরে প্রাথমিক অবস্থান থেকে রাতে আশরাফুল হকসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা রওনা হন লক্ষ্যস্থলে। মেঘমুক্ত আকাশ। রাতের অন্ধকার তেমন গাঢ় নয়।
আবছা অন্ধকারে দূরের অনেক কিছু চোখে পড়ে। তাই মুক্তিযোদ্ধারা সবাই সতর্ক। আশরাফুল হক সবার আগে। তাঁর পেছনে সহযোদ্ধারা। সারিবদ্ধভাবে সবাই এগিয়ে যান। তাঁদের কাছে অস্ত্র বলতে দুটি এলএমজি, বাকি সব স্টেনগান ও রাইফেল। আর কিছু হ্যান্ডগ্রেনেড।
তাঁরা আটগ্রাম ডাকবাংলোতে আক্রমণ করবেন। সিলেট জেলার জকিগঞ্জ থানার (বর্তমানে উপজেলা) অন্তর্গত আটগ্রাম। প্রসিদ্ধ এক এলাকা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেখানে সরকারি ডাকবাংলোতে ছিল পাকিস্তানি সেনা, ইপিসিএএফ ও তাদের সহযোগী কিছু রাজাকার। সব মিলে ৫৫-৬০ জন।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক অবস্থান ছিল আটগ্রামের অদূরে নাতানপুরে। যাওয়ার আগে সেখানে তাঁরা তিনটি দলে বিভক্ত হন। একটি দলের নেতৃত্বে থাকেন দুর্ধর্ষ আশরাফুল হক। অপর দুই দলের একটির নেতৃত্ব মাহবুবুর রব সাদী (বীর প্রতীক) এবং অপরটির নেতৃত্ব দেন নিজাম উদ্দীন (বীর উত্তম ও শহীদ)।
রাত একটায় একটি দল অবস্থান নেয় কারাবাল্লা গ্রামে। বাকি দুই দল স্রোতস্বিনী কুশিয়ারা নদী অতিক্রম করে রাত যখন দুইটা, তখন একটি দল ডান দিকে এবং অপর দল বাম দিকে এগিয়ে যায়। আশরাফুল হক তাঁর দল নিয়ে ডান দিকে আঁকাবাঁকা পথ ধরে হেঁটে একসময় নিঃশব্দে এবং নির্বিঘ্নেই পৌঁছান লক্ষ্যস্থল ডাকবাংলোর কাছে। জিরো আওয়ার অর্থাৎ আক্রমণের নির্ধারিত সময় ছিল রাত চারটা। তার আগেই তাঁদের সব প্রস্তুতি শেষ হয়।
ভারত থেকে দূরপাল্লার গোলাবর্ষণ শেষ হওয়ামাত্র আশরাফুল হক সহযোদ্ধাদের নিয়ে প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করেন। অন্যান্য দলও একই সময় আক্রমণ শুরু করে। তাঁরা চারদিক থেকে পাকিস্তানি সেনা ও ইপিসিএএফদের ওপর বৃষ্টির মতো গুলি করতে করতে অগ্রসর হন। গুলির খই ফুটতে থাকে ডাকবাংলোতে।
প্রবল আক্রমণে পাকিস্তানি সেনা ও ইপিসিএএফরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। রাজাকাররা শুরুতেই পালিয়ে যায়। পাকিস্তানি সেনা ও ইপিসিএএফরা মরিয়া হয়ে আক্রমণ প্রতিরোধ করেও ব্যর্থ হয়। তিন ঘণ্টা পর তাদের সেই প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। এরপর তারা রণেভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু এর মধ্যেই নিহত হয় তাদের অনেক। যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে শত্রুদের ১৮টি মৃতদেহ পান। এ ঘটনা ১৯৭১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর।
আটগ্রাম ডাকবাংলোর যুদ্ধ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিরাট এক সাফল্য। অবশ্য এই সাফল্য ছিনিয়ে আনতে গিয়ে আটজন মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ হন। আর আহত হন আশরাফুল হকসহ সাতজন। যুদ্ধের একপর্যায়ে প্রথমে তাঁর হাতের আঙুলে এবং পরে বাঁ পায়ে গুলি লাগে। এর পরও তিনি যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে যাননি। সহযোদ্ধাদের পাশে থেকে তাঁদের মনোবল জোগান।
কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার আধা ঘণ্টা বা এর কিছু আগে তাঁর কোমরে শেলের স্প্লিন্টার লাগে। এতে তিনি গুরুতর আহত হন। তখন সহযোদ্ধারা তাঁকে দ্রুত পাঠিয়ে দেন ভারতে। সেখানে তাঁর চিকিৎসা হয় প্রথমে গৌহাটি হাসপাতালে। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়। সুস্থ হয়ে ৩ ডিসেম্বর তিনি পুনরায় যুদ্ধে যোগ দেন।
আশরাফুল হক ১৯৭১ সালে রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেন ৪ নম্বর সেক্টরের জালালপুর সাবসেক্টরসহ সিলেটের বিভিন্ন স্থানে। যুদ্ধে তিনি অগ্রভাগে থাকতেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য আশরাফুল হককে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩৫০।
আশরাফুল হক স্বাধীনতার পর ক্ষুদ্র ব্যবসা করতেন। ১৯৯৬ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ৪১ বাদুড়তলা, কান্দিরপাড়ে। উত্তরাধিকারীরা বর্তমানে এই ঠিকানায়ই বসবাস করেন। তাঁর বাবার নাম হাবিবুল হক, মা আঞ্জুমান আরা বেগম। স্ত্রী শাহীন সুলতানা। তাঁদের চার ছেলে ও এক মেয়ে।
সূত্র: শাহীন সুলতানা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৪।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
তাঁরা আটগ্রাম ডাকবাংলোতে আক্রমণ করবেন। সিলেট জেলার জকিগঞ্জ থানার (বর্তমানে উপজেলা) অন্তর্গত আটগ্রাম। প্রসিদ্ধ এক এলাকা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেখানে সরকারি ডাকবাংলোতে ছিল পাকিস্তানি সেনা, ইপিসিএএফ ও তাদের সহযোগী কিছু রাজাকার। সব মিলে ৫৫-৬০ জন।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক অবস্থান ছিল আটগ্রামের অদূরে নাতানপুরে। যাওয়ার আগে সেখানে তাঁরা তিনটি দলে বিভক্ত হন। একটি দলের নেতৃত্বে থাকেন দুর্ধর্ষ আশরাফুল হক। অপর দুই দলের একটির নেতৃত্ব মাহবুবুর রব সাদী (বীর প্রতীক) এবং অপরটির নেতৃত্ব দেন নিজাম উদ্দীন (বীর উত্তম ও শহীদ)।
রাত একটায় একটি দল অবস্থান নেয় কারাবাল্লা গ্রামে। বাকি দুই দল স্রোতস্বিনী কুশিয়ারা নদী অতিক্রম করে রাত যখন দুইটা, তখন একটি দল ডান দিকে এবং অপর দল বাম দিকে এগিয়ে যায়। আশরাফুল হক তাঁর দল নিয়ে ডান দিকে আঁকাবাঁকা পথ ধরে হেঁটে একসময় নিঃশব্দে এবং নির্বিঘ্নেই পৌঁছান লক্ষ্যস্থল ডাকবাংলোর কাছে। জিরো আওয়ার অর্থাৎ আক্রমণের নির্ধারিত সময় ছিল রাত চারটা। তার আগেই তাঁদের সব প্রস্তুতি শেষ হয়।
ভারত থেকে দূরপাল্লার গোলাবর্ষণ শেষ হওয়ামাত্র আশরাফুল হক সহযোদ্ধাদের নিয়ে প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করেন। অন্যান্য দলও একই সময় আক্রমণ শুরু করে। তাঁরা চারদিক থেকে পাকিস্তানি সেনা ও ইপিসিএএফদের ওপর বৃষ্টির মতো গুলি করতে করতে অগ্রসর হন। গুলির খই ফুটতে থাকে ডাকবাংলোতে।
প্রবল আক্রমণে পাকিস্তানি সেনা ও ইপিসিএএফরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। রাজাকাররা শুরুতেই পালিয়ে যায়। পাকিস্তানি সেনা ও ইপিসিএএফরা মরিয়া হয়ে আক্রমণ প্রতিরোধ করেও ব্যর্থ হয়। তিন ঘণ্টা পর তাদের সেই প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। এরপর তারা রণেভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু এর মধ্যেই নিহত হয় তাদের অনেক। যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে শত্রুদের ১৮টি মৃতদেহ পান। এ ঘটনা ১৯৭১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর।
আটগ্রাম ডাকবাংলোর যুদ্ধ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিরাট এক সাফল্য। অবশ্য এই সাফল্য ছিনিয়ে আনতে গিয়ে আটজন মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ হন। আর আহত হন আশরাফুল হকসহ সাতজন। যুদ্ধের একপর্যায়ে প্রথমে তাঁর হাতের আঙুলে এবং পরে বাঁ পায়ে গুলি লাগে। এর পরও তিনি যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে যাননি। সহযোদ্ধাদের পাশে থেকে তাঁদের মনোবল জোগান।
কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার আধা ঘণ্টা বা এর কিছু আগে তাঁর কোমরে শেলের স্প্লিন্টার লাগে। এতে তিনি গুরুতর আহত হন। তখন সহযোদ্ধারা তাঁকে দ্রুত পাঠিয়ে দেন ভারতে। সেখানে তাঁর চিকিৎসা হয় প্রথমে গৌহাটি হাসপাতালে। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়। সুস্থ হয়ে ৩ ডিসেম্বর তিনি পুনরায় যুদ্ধে যোগ দেন।
আশরাফুল হক ১৯৭১ সালে রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেন ৪ নম্বর সেক্টরের জালালপুর সাবসেক্টরসহ সিলেটের বিভিন্ন স্থানে। যুদ্ধে তিনি অগ্রভাগে থাকতেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য আশরাফুল হককে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩৫০।
আশরাফুল হক স্বাধীনতার পর ক্ষুদ্র ব্যবসা করতেন। ১৯৯৬ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ৪১ বাদুড়তলা, কান্দিরপাড়ে। উত্তরাধিকারীরা বর্তমানে এই ঠিকানায়ই বসবাস করেন। তাঁর বাবার নাম হাবিবুল হক, মা আঞ্জুমান আরা বেগম। স্ত্রী শাহীন সুলতানা। তাঁদের চার ছেলে ও এক মেয়ে।
সূত্র: শাহীন সুলতানা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৪।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments