ঈদসংখ্যা by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
আমার ছেলেবেলায় যদি শুনতাম, কোনো পরিবারের গিন্নি ঈদের মৌসুমে আবদার করছেন কর্তার কাছে, ‘একটা ঈদসংখ্যা নিয়ে আসবেন আমার জন্য’, নিশ্চয় মহা ধন্দে পড়তাম। ঈদসংখ্যা? এক, দুই থেকে ১০০-র মধ্যে কোনটি ঈদসংখ্যা? এটি কী খাদ্য, পরিধেয়, না ব্যবহার্য? কিন্তু এখন ঈদসংখ্যা নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি নেই।
একটি প্রথমত পাঠ্য এবং দ্বিতীয়ত দেখ্য অথবা দর্শনীয়। অথবা উল্টোটি, কে জানে।
আমার ছেলেবেলা অবশ্য এ রকম পাঠ্য (এবং দেখ্য) একটি ঈদসংখ্যা ছিল, তবে সেটিকে ‘ঈদসংখ্যা’ বলা হতো না, ‘ঈদ উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন’ ধরনের কিছু বলা হতো। সেটি ছিল বেগম পত্রিকার ঈদ উপহার। তখন সাদা-কালোর দিন; ‘আংশিক রঙিন’ পর্যন্তও মুদ্রণ-প্রযুক্তি এগোয়নি। বেগম পত্রিকাটি শিক্ষিত সব পরিবারের পাঠ্য ছিল, ঈদসংখ্যাটি তো বটেই। ঈদে বাড়তি আকর্ষণ ছিল কয়েক পৃষ্ঠাজুড়ে প্রায় সব লেখিকার (এটি প্রকৃতই ছিল লেখিকাদের কাগজ) পাসপোর্ট আকৃতির ছবি। সাদা-কালো, কিন্তু এসব ছবিই ছিল ঈদসংখ্যাটির দেখ্য আকর্ষণ। তখন ফ্যাশন-ট্যাশন নিয়ে কেউ ভাবত না, ফ্যাশন কথাটির বরং একটা খারাপ অর্থ ছিল (ফ্যাশন করাকে বেলেল্লাপনার প্রায় সমার্থক ধরা হতো)। ফলে বেগম-এর পাতায় কোনো মডেলের পদচারণ অথবা ক্যাটওয়াক ছিল না। গত শতকের ষাটের দশকের শুরুতে অবশ্য পরিবারগুলো কর্তাশাসিত ছিল। সিলেট শহরে কোনো গিন্নি নিজের শাড়ি কিনতে বাইরে গেছেন, এমনটি ভাবাও যেত না। দু-একজন যে এ রকম ভাবতেন না এবং দোকানে যেতেন না, তেমন নয়, কিন্তু তাঁরা পরিসংখ্যানের বিচারেও পড়তেন না। পরিসংখ্যানের গণ্ডিতে আসতে তাঁদের আরও ২০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে।
একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা আমাদের সমাজটাকে একটা বিরাট ধাক্কা দিয়ে পাল্টে দিল। স্বাধীন দেশে মেয়েরা স্বাধীন হবে, এ রকম একটা ধারণা থেকে সমাজের ভেতর একটা আন্দোলন শুরু হলো। দেশের অর্থনীতি মেয়েদের ঘরের বাইরে ডাকল, রাজনীতিও তাদের ডাকল, ডাকল নানা প্রতিষ্ঠানও। ফলে মেয়েরা গিন্নিপনার চার দেয়াল থেকে মুক্ত হতে শুরু করল। আমার এক অর্থনীতিবিদ বন্ধু বলে, আশির দশকে তৈরি পোশাকশিল্প মেয়েদের নিজেদের পায়ের ওপর দাঁড় করানোর একটা ব্যবস্থা করে দিল। এবং এর ফলে অর্থনীতি কিছুটা নারীবান্ধব হলো। এই নারীবান্ধবতা, তার মতে, ঈদের বাজার সৃষ্টিতে অবদান রাখল। আমার বন্ধুর কথাটি নিশ্চয় ঠিক। কারণ, এ বিষয়ে তার গবেষণা রয়েছে। সে বলে, একজন কর্তা ঈদের বাজারে গেলে কিপ্টার মতো খরচ করেন, একজন গিন্নি সে তুলনায় দরাজদিল। আর যদি ওই গিন্নি হন কর্মজীবী নারী, তাতে খরচটা দৈর্ঘ্যে প্রায় বাড়ে। খরচ বাড়া মানে ঈদের বাজার বাড়া। তৈরি পোশাকশিল্পে যেসব নারী কাজ করেন, তাঁরা নিজেদের জন্য খরচ করেন, পরিবারের জন্যও করেন। একই কথা খাটে করপোরেট জগতের যেসব নারী উচ্চ-মাঝারি আসনে কাজ করেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও। ফলে প্রতিবছর ঈদের বাজার বেড়েছে, ফ্যাশন তার বদনাম ঝেড়ে ঢুকে পড়েছে সেই বাজারে। পণ্যের বিস্তার ঘটেছে এবং পণ্যের কানে টান দিয়ে বিজ্ঞাপনের মাথাও এসেছে। এই পণ্যবাজারে, জমজমাট ঈদবাজারে, এখন ঈদসংখ্যাগুলোও অনেক পরিবারের ক্রয়-তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে।
সংক্ষেপে এই হলো ঈদসংখ্যার অর্থনীতি ও সমাজতত্ত্ব পরিচয়।
অর্থনীতি ইত্যাদির পর ইতিহাস বলে একটা বিষয় থাকে। সেই ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে ওই বেগম পত্রিকাটিই আমার প্রথমে চোখে পড়ে। হয়তো আরও দু-এক ঈদসংখ্যা ছিল, কিন্তু বাংলাদেশের দলবাজ ইতিহাসবিদদের মতো সেসব আমার চোখে পড়েনি। আমার মা বেগম কিনতেন, আমরা ছিলাম বেগম-এর দলে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত দেশ এবং অন্যান্য কিছু ম্যাগাজিনের পূজাসংখ্যা তখন সিলেটেও পাওয়া যেত। মা সেগুলো পড়তেন। এই পূজাসংখ্যাগুলোই পরে আমাদের ঈদসংখ্যাগুলোর আত্মপ্রকাশের পেছনে প্রেরণা জুগিয়েছে, কোনো সন্দেহ নেই। পরে, মানে স্বাধীনতার পরে। এ ব্যাপারে যদ্দুর মনে পড়ে, বিচিত্রা ছিল সবার আগে। শাহাদত চৌধুরীর সম্পাদনায় বিচিত্রা যখন বেরোতে থাকল, তরুণদের কাছে তা ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে দাঁড়াল। বিচিত্রাই প্রথম ফ্যাশন বিষয়টিকে আকর্ষণীয় করে তুলল। বিচিত্রার ঈদসংখ্যা পাঠকদের জানিয়ে দিল, ঈদের মৌসুমে আমরাও তাকিয়ে থাকতে পারি দুই মলাটের ভেতর সাহিত্য, মননশীলতা, সৃজন-ফ্যাশন-রন্ধনসহ বহুবিধ বিষয়ের একত্র হয়ে আমাদের হাতে পৌঁছে যাওয়ার জন্য। কলকাতায় পূজাসংখ্যা আছে, আমাদেরও ঈদসংখ্যা আছে—এ রকম আত্মশ্লাঘার একটা সুযোগ করে দিল বিচিত্রার ঈদসংখ্যা। আশির দশকে মোস্তফা জব্বার তাঁর নিপুণ পত্রিকা নিয়ে এ রকমই একটি আলোড়ন তুললেন। সেটিও তরুণদের কাছে প্রিয়তা পেয়েছিল।
তবে ঈদসংখ্যার প্রকৃত স্ফুরণের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে সাংবাদিকতার একটি পালাবদলের জন্য, যা ঘটেছে এরশাদ সরকারের পতন ও গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। এর আগেই অবশ্য আজকের কাগজ আত্মপ্রকাশ করে। এই সাহসী সংবাদপত্রটি জানিয়ে দিল, সত্যের মুখোমুখি হতে এখন সবাই প্রস্তুত। এরপর ভোরের কাগজ বেরুল, তারপর প্রথম আলো। এর পরের ২০ বছর তো সংবাদপত্রের জগতে একটা বিস্ফোরণের কাল। এখন সারা দেশে কত দৈনিক কাগজ বেরোয় তার হিসাব সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছেও আছে কি না কে জানে। দৈনিকের সঙ্গে আছে সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক নানা কাগজ ও ম্যাগাজিন। এগুলোর সঙ্গে সংবাদ ও ইত্তেফাক-এর মতো পুরোনো দৈনিক তো আছেই। দেশের অর্থনীতি যত বড় হচ্ছে, যত পণ্যপ্রবাহ এবং নতুন নতুন পণ্য যুক্ত হচ্ছে, সেই প্রবাহে (এবং পণ্যের সঙ্গে সেবা—এখন তো দেখি হাসপাতালগুলোও ঢুকে পড়েছে পণ্যবাজারে), তত কাগজগুলোর পায়ে শক্তি বাড়ছে। অনেক কাগজের মালিক বিরাট ব্যবসায়ী, ফলে এঁদের পায়ে এমনিতেই বেশ জোর। একই সঙ্গে বাড়ছে পাঠকসংখ্যা। কোনো কোনো কাগজ তাই দৌড়াচ্ছে, কোনোটা জোরে হাঁটছে, ১০-১৫ বছর ধরে এসব কাগজ ঈদসংখ্যা বের করছে। এবং কী সব ঈদসংখ্যা! ৫০০, ৭০০ পৃষ্ঠার, পেল্লাই আকারের, চাররঙা ঝলমলে ছাপাতে রীতিমতো নজরকাড়া।
দৈনিক পত্রিকাগুলো এখন প্রতিদিনই একটা ক্রোড়পত্র ছাপায়। কোনো দিন ফ্যাশন, কোনো দিন সাহিত্য, কোনো দিন নারী, খেলাধুলা, বিনোদন অথবা অন্য কোনো বিষয় নিয়ে দৈনিক পত্রিকার পাঠক এখন আশা করে, ঈদসংখ্যাগুলো যেন এসব বিষয়কে নিয়েই হয় এবং অনেক বড় পরিসরে। এ ছাড়া দৃশ্য মাধ্যমের তরক্কির যুগে বিনোদন, তথ্যপ্রযুক্তি এবং সামাজিক যোগাযোগ—এসব প্রচুর গুরুত্ব পাচ্ছে। ঈদসংখ্যাগুলোতে বিনোদনের, বিশেষ করে তারকাখচিত বিনোদনের, রয়েছে বিশেষ উপস্থিতি এবং রয়েছে বিজ্ঞাপনেরও। ঈদসংখ্যাগুলোর মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, কিন্তু এই বিজ্ঞাপনই তো সাহায্য করছে মোটামুটি বিদেশি এক প্যাকেট সিগারেটের দামে একটি ঈদসংখ্যা কিনতে। ফলে বিজ্ঞাপনকে মেনে নিচ্ছে পাঠক। আর এ তো টেলিভিশনের দর্শক-খেদানো বিজ্ঞাপন নয় যে এর থেকে হয় পালাতে হবে, না হয় এর কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে হবে।
তবে ঈদসংখ্যাগুলোতে এখনো সাহিত্যই প্রধান—সাহিত্যই জুড়ে থাকে এদের সিংহভাগ। এখন ঈদসংখ্যাগুলো নিজেরাই নিজেদের বিজ্ঞাপন দেয় এবং বিজ্ঞাপনে জানানো হয় কটা উপন্যাস, কটা গল্প, কটা কবিতা ইত্যাদি এবার ছাপা হলো। শুধু গল্প-উপন্যাস নয়, ঈদসংখ্যাগুলোর বিষয়-বৈচিত্র্যে আছে ভ্রমণকাহিনি থেকে নিয়ে অপ্রকাশিত কোনো পাণ্ডুলিপি অথবা চিঠি; কোনো বড়, প্রয়াত লেখকের আত্মজীবনী থাকে, স্মৃতিচারণা থাকে, প্রবন্ধ-নিবন্ধ থাকে, রম্য রচনা থাকে। কী থাকের পরিবর্তে কী থাকে না, তা-ই বোধ হয় বলা ভালো। তা ছাড়া প্রথম আলো, সমকাল, যুগান্তরসহ কিছু কাগজ ঈদের ঠিক দু-তিন দিন আগে একটা ছোট পরিসরে (ব্রডশিটে ৮, ম্যাগাজিন আকারে ৩২ পৃষ্ঠার) ঈদসংখ্যা ছেপে থাকে, ‘গরিবের ঈদসংখ্যা’ বলা হয়, যেহেতু এ জন্য পাঠককে কোনো পয়সা দিতে হয় না। এসব ঈদসংখ্যায় হাস্যকৌতুককে প্রাধান্য দেওয়া হয়, যদিও অন্যান্য বিষয়ও থাকে।
এই কয়েক বছর আগেও ঈদসংখ্যাগুলোতে ভারতীয় ঔপন্যাসিক-গল্পকারদের একটা বড় উপস্থিতি থাকত। এখন খুব কম ঈদসংখ্যাতেই এঁদের পাওয়া যায়। এটি একটি বড় ঘটনা, আমার বিবেচনায়। একসময় অনেক সম্পাদক ভাবতেন, দেশি লেখক দিয়ে ঈদসংখ্যা চালানো যাবে না। কিন্তু প্রথম আলো শুরু থেকেই এই স্রোতের বিপরীতে গেছে। দেখা গেছে, শুধু দেশি লেখকদের দিয়ে যে ঈদসংখ্যা চালানো যায়, তা নয়, বরং ভালোভাবেই চালানো যায়। এখন অন্যান্য ঈদসংখ্যাও এটি বুঝতে শুরু করেছে। বাজার তাদের বলছে, দেশিতে বরং লাভ বেশি। অথবা এ রকম কিছু। পাক্ষিক অন্যদিন প্রতিবছর তার ঈদসংখ্যায় ভারতীয় লেখকদের রাখত, একেবারে জোড়ায় জোড়ায়। এটি খারাপ কিছু নয়, তবে এঁদের লেখা যে খুব বিরাট মাপের কিছু হতো, দু-একজন বাদ দিলে, তেমন তো নয়। এবার অন্যদিন-এ শুধু এ দেশের পাঠকের কাছে প্রিয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আছেন। তবে এবারই গত ১২-১৩ বছরের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ে এর লেখক-তালিকায় হুমায়ূন আহমেদ নেই। তবে তিনি অন্যভাবে আছেন, যেমন আছেন অন্যান্য ঈদসংখ্যায়ও। তাঁর আঁকা ছবির প্রতিলিপি আছে অন্যদিন-এ, তাঁর ঘেটুপুত্র কমলা ছায়াছবির চিত্রনাট্য আছে। বাংলাদেশের পাঠক দৃষ্টিতে হুমায়ূন আহমেদের অবদান অবিস্মরণীয়—ঈদসংখ্যাগুলোকে দেশি লেখকমুখী করার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন সবার আগে। তাঁর অকালপ্রয়াণ আমাদের সাহিত্যে একটা শূন্যতা তৈরি করল, তাঁর অভাব আমরা সব সময় অনুভব করব। তবে তাঁর সৃষ্ট পাঠকেরা এখন সাহিত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন, তেমনটি হওয়ারও আশঙ্কা নেই। ফলে আগামী বছরগুলোতেও দেশি লেখকদের লেখায় সমৃদ্ধ ঈদসংখ্যা বিক্রি হবে এবং আমি নিশ্চিত, অনেক বেশি বিক্রি হবে।
আমাদের সাহিত্যে অনেক মেধাবী লেখক আছেন, তরুণদের থেকেও প্রতিবছর অনেক মেধাবী লেখক উঠে আসছেন। এবার যে পাঁচ-ছয়টি ঈদসংখ্যা আমি পেয়েছি, সেগুলো অল্প অল্প করে প্রতিদিনই প্রায় পড়ছি, সেগুলোতে অনেক উঁচু মানের লেখা আমি পড়েছি এবং পড়ে আনন্দিত হয়েছি। অনেক তরুণ লেখক মন নাড়া দেওয়ার মতো গল্প লিখেছেন, দুটি উপন্যাসও পড়তে বসে রেখে দিতে পারেনি। সাহিত্যের ভূমিটি যে শক্ত হচ্ছে আমাদের, প্রতিবছর, অল্প অল্প করে, তা ঈদসংখ্যাগুলো আমাদের নিয়মিত জানান দিয়ে যায়।
এবারের ঈদসংখ্যাগুলোর দিকে চোখ রাখলে বোঝা যাবে, বিষয় গৌরবের সঙ্গে আঙ্গিকের চমক দেখানোর পাশাপাশি কিছু ধারাবাহিকতার চর্চাও কোনো কোনোটি করেছে। প্রথম আলোর প্রচ্ছদ করেছেন কাইয়ুম চৌধুরী, অন্যদিন-এর শাহাবুদ্দিন, অনেক বছর ধরে তাঁরা তা করছেন। এই ধারাবাহিকতার বিষয়টির আমি প্রশংসা করি। বাংলাদেশ একটি অস্থির দেশ—এর নগর, ভূগোল, দৃশ্যপট এবং জীবন ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। তাই বলে সব খোলনলচে বদলে যাবে, তা তো নয়। এ জন্য ঐতিহ্যের খানিকটা অনুসরণ, একটা চর্চাকে কিছুটা ধরে রাখা একটা নিশ্চিতি দেয়। পাশাপাশি নতুনত্বের আকর্ষণটাও প্রয়োজন। এ দুইয়ে মিলেই তো ঈদসংখ্যা।
এবং ঈদসংখ্যার মানে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা এবং ম্যাগাজিনগুলোর বিশেষ, স্ফীতকায়, ক্রোড়পত্র। অথবা সে রকমই সবার সিদ্ধান্ত।
আমার ছেলেবেলা অবশ্য এ রকম পাঠ্য (এবং দেখ্য) একটি ঈদসংখ্যা ছিল, তবে সেটিকে ‘ঈদসংখ্যা’ বলা হতো না, ‘ঈদ উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন’ ধরনের কিছু বলা হতো। সেটি ছিল বেগম পত্রিকার ঈদ উপহার। তখন সাদা-কালোর দিন; ‘আংশিক রঙিন’ পর্যন্তও মুদ্রণ-প্রযুক্তি এগোয়নি। বেগম পত্রিকাটি শিক্ষিত সব পরিবারের পাঠ্য ছিল, ঈদসংখ্যাটি তো বটেই। ঈদে বাড়তি আকর্ষণ ছিল কয়েক পৃষ্ঠাজুড়ে প্রায় সব লেখিকার (এটি প্রকৃতই ছিল লেখিকাদের কাগজ) পাসপোর্ট আকৃতির ছবি। সাদা-কালো, কিন্তু এসব ছবিই ছিল ঈদসংখ্যাটির দেখ্য আকর্ষণ। তখন ফ্যাশন-ট্যাশন নিয়ে কেউ ভাবত না, ফ্যাশন কথাটির বরং একটা খারাপ অর্থ ছিল (ফ্যাশন করাকে বেলেল্লাপনার প্রায় সমার্থক ধরা হতো)। ফলে বেগম-এর পাতায় কোনো মডেলের পদচারণ অথবা ক্যাটওয়াক ছিল না। গত শতকের ষাটের দশকের শুরুতে অবশ্য পরিবারগুলো কর্তাশাসিত ছিল। সিলেট শহরে কোনো গিন্নি নিজের শাড়ি কিনতে বাইরে গেছেন, এমনটি ভাবাও যেত না। দু-একজন যে এ রকম ভাবতেন না এবং দোকানে যেতেন না, তেমন নয়, কিন্তু তাঁরা পরিসংখ্যানের বিচারেও পড়তেন না। পরিসংখ্যানের গণ্ডিতে আসতে তাঁদের আরও ২০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে।
একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা আমাদের সমাজটাকে একটা বিরাট ধাক্কা দিয়ে পাল্টে দিল। স্বাধীন দেশে মেয়েরা স্বাধীন হবে, এ রকম একটা ধারণা থেকে সমাজের ভেতর একটা আন্দোলন শুরু হলো। দেশের অর্থনীতি মেয়েদের ঘরের বাইরে ডাকল, রাজনীতিও তাদের ডাকল, ডাকল নানা প্রতিষ্ঠানও। ফলে মেয়েরা গিন্নিপনার চার দেয়াল থেকে মুক্ত হতে শুরু করল। আমার এক অর্থনীতিবিদ বন্ধু বলে, আশির দশকে তৈরি পোশাকশিল্প মেয়েদের নিজেদের পায়ের ওপর দাঁড় করানোর একটা ব্যবস্থা করে দিল। এবং এর ফলে অর্থনীতি কিছুটা নারীবান্ধব হলো। এই নারীবান্ধবতা, তার মতে, ঈদের বাজার সৃষ্টিতে অবদান রাখল। আমার বন্ধুর কথাটি নিশ্চয় ঠিক। কারণ, এ বিষয়ে তার গবেষণা রয়েছে। সে বলে, একজন কর্তা ঈদের বাজারে গেলে কিপ্টার মতো খরচ করেন, একজন গিন্নি সে তুলনায় দরাজদিল। আর যদি ওই গিন্নি হন কর্মজীবী নারী, তাতে খরচটা দৈর্ঘ্যে প্রায় বাড়ে। খরচ বাড়া মানে ঈদের বাজার বাড়া। তৈরি পোশাকশিল্পে যেসব নারী কাজ করেন, তাঁরা নিজেদের জন্য খরচ করেন, পরিবারের জন্যও করেন। একই কথা খাটে করপোরেট জগতের যেসব নারী উচ্চ-মাঝারি আসনে কাজ করেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও। ফলে প্রতিবছর ঈদের বাজার বেড়েছে, ফ্যাশন তার বদনাম ঝেড়ে ঢুকে পড়েছে সেই বাজারে। পণ্যের বিস্তার ঘটেছে এবং পণ্যের কানে টান দিয়ে বিজ্ঞাপনের মাথাও এসেছে। এই পণ্যবাজারে, জমজমাট ঈদবাজারে, এখন ঈদসংখ্যাগুলোও অনেক পরিবারের ক্রয়-তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে।
সংক্ষেপে এই হলো ঈদসংখ্যার অর্থনীতি ও সমাজতত্ত্ব পরিচয়।
অর্থনীতি ইত্যাদির পর ইতিহাস বলে একটা বিষয় থাকে। সেই ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে ওই বেগম পত্রিকাটিই আমার প্রথমে চোখে পড়ে। হয়তো আরও দু-এক ঈদসংখ্যা ছিল, কিন্তু বাংলাদেশের দলবাজ ইতিহাসবিদদের মতো সেসব আমার চোখে পড়েনি। আমার মা বেগম কিনতেন, আমরা ছিলাম বেগম-এর দলে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত দেশ এবং অন্যান্য কিছু ম্যাগাজিনের পূজাসংখ্যা তখন সিলেটেও পাওয়া যেত। মা সেগুলো পড়তেন। এই পূজাসংখ্যাগুলোই পরে আমাদের ঈদসংখ্যাগুলোর আত্মপ্রকাশের পেছনে প্রেরণা জুগিয়েছে, কোনো সন্দেহ নেই। পরে, মানে স্বাধীনতার পরে। এ ব্যাপারে যদ্দুর মনে পড়ে, বিচিত্রা ছিল সবার আগে। শাহাদত চৌধুরীর সম্পাদনায় বিচিত্রা যখন বেরোতে থাকল, তরুণদের কাছে তা ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে দাঁড়াল। বিচিত্রাই প্রথম ফ্যাশন বিষয়টিকে আকর্ষণীয় করে তুলল। বিচিত্রার ঈদসংখ্যা পাঠকদের জানিয়ে দিল, ঈদের মৌসুমে আমরাও তাকিয়ে থাকতে পারি দুই মলাটের ভেতর সাহিত্য, মননশীলতা, সৃজন-ফ্যাশন-রন্ধনসহ বহুবিধ বিষয়ের একত্র হয়ে আমাদের হাতে পৌঁছে যাওয়ার জন্য। কলকাতায় পূজাসংখ্যা আছে, আমাদেরও ঈদসংখ্যা আছে—এ রকম আত্মশ্লাঘার একটা সুযোগ করে দিল বিচিত্রার ঈদসংখ্যা। আশির দশকে মোস্তফা জব্বার তাঁর নিপুণ পত্রিকা নিয়ে এ রকমই একটি আলোড়ন তুললেন। সেটিও তরুণদের কাছে প্রিয়তা পেয়েছিল।
তবে ঈদসংখ্যার প্রকৃত স্ফুরণের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে সাংবাদিকতার একটি পালাবদলের জন্য, যা ঘটেছে এরশাদ সরকারের পতন ও গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। এর আগেই অবশ্য আজকের কাগজ আত্মপ্রকাশ করে। এই সাহসী সংবাদপত্রটি জানিয়ে দিল, সত্যের মুখোমুখি হতে এখন সবাই প্রস্তুত। এরপর ভোরের কাগজ বেরুল, তারপর প্রথম আলো। এর পরের ২০ বছর তো সংবাদপত্রের জগতে একটা বিস্ফোরণের কাল। এখন সারা দেশে কত দৈনিক কাগজ বেরোয় তার হিসাব সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছেও আছে কি না কে জানে। দৈনিকের সঙ্গে আছে সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক নানা কাগজ ও ম্যাগাজিন। এগুলোর সঙ্গে সংবাদ ও ইত্তেফাক-এর মতো পুরোনো দৈনিক তো আছেই। দেশের অর্থনীতি যত বড় হচ্ছে, যত পণ্যপ্রবাহ এবং নতুন নতুন পণ্য যুক্ত হচ্ছে, সেই প্রবাহে (এবং পণ্যের সঙ্গে সেবা—এখন তো দেখি হাসপাতালগুলোও ঢুকে পড়েছে পণ্যবাজারে), তত কাগজগুলোর পায়ে শক্তি বাড়ছে। অনেক কাগজের মালিক বিরাট ব্যবসায়ী, ফলে এঁদের পায়ে এমনিতেই বেশ জোর। একই সঙ্গে বাড়ছে পাঠকসংখ্যা। কোনো কোনো কাগজ তাই দৌড়াচ্ছে, কোনোটা জোরে হাঁটছে, ১০-১৫ বছর ধরে এসব কাগজ ঈদসংখ্যা বের করছে। এবং কী সব ঈদসংখ্যা! ৫০০, ৭০০ পৃষ্ঠার, পেল্লাই আকারের, চাররঙা ঝলমলে ছাপাতে রীতিমতো নজরকাড়া।
দৈনিক পত্রিকাগুলো এখন প্রতিদিনই একটা ক্রোড়পত্র ছাপায়। কোনো দিন ফ্যাশন, কোনো দিন সাহিত্য, কোনো দিন নারী, খেলাধুলা, বিনোদন অথবা অন্য কোনো বিষয় নিয়ে দৈনিক পত্রিকার পাঠক এখন আশা করে, ঈদসংখ্যাগুলো যেন এসব বিষয়কে নিয়েই হয় এবং অনেক বড় পরিসরে। এ ছাড়া দৃশ্য মাধ্যমের তরক্কির যুগে বিনোদন, তথ্যপ্রযুক্তি এবং সামাজিক যোগাযোগ—এসব প্রচুর গুরুত্ব পাচ্ছে। ঈদসংখ্যাগুলোতে বিনোদনের, বিশেষ করে তারকাখচিত বিনোদনের, রয়েছে বিশেষ উপস্থিতি এবং রয়েছে বিজ্ঞাপনেরও। ঈদসংখ্যাগুলোর মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, কিন্তু এই বিজ্ঞাপনই তো সাহায্য করছে মোটামুটি বিদেশি এক প্যাকেট সিগারেটের দামে একটি ঈদসংখ্যা কিনতে। ফলে বিজ্ঞাপনকে মেনে নিচ্ছে পাঠক। আর এ তো টেলিভিশনের দর্শক-খেদানো বিজ্ঞাপন নয় যে এর থেকে হয় পালাতে হবে, না হয় এর কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে হবে।
তবে ঈদসংখ্যাগুলোতে এখনো সাহিত্যই প্রধান—সাহিত্যই জুড়ে থাকে এদের সিংহভাগ। এখন ঈদসংখ্যাগুলো নিজেরাই নিজেদের বিজ্ঞাপন দেয় এবং বিজ্ঞাপনে জানানো হয় কটা উপন্যাস, কটা গল্প, কটা কবিতা ইত্যাদি এবার ছাপা হলো। শুধু গল্প-উপন্যাস নয়, ঈদসংখ্যাগুলোর বিষয়-বৈচিত্র্যে আছে ভ্রমণকাহিনি থেকে নিয়ে অপ্রকাশিত কোনো পাণ্ডুলিপি অথবা চিঠি; কোনো বড়, প্রয়াত লেখকের আত্মজীবনী থাকে, স্মৃতিচারণা থাকে, প্রবন্ধ-নিবন্ধ থাকে, রম্য রচনা থাকে। কী থাকের পরিবর্তে কী থাকে না, তা-ই বোধ হয় বলা ভালো। তা ছাড়া প্রথম আলো, সমকাল, যুগান্তরসহ কিছু কাগজ ঈদের ঠিক দু-তিন দিন আগে একটা ছোট পরিসরে (ব্রডশিটে ৮, ম্যাগাজিন আকারে ৩২ পৃষ্ঠার) ঈদসংখ্যা ছেপে থাকে, ‘গরিবের ঈদসংখ্যা’ বলা হয়, যেহেতু এ জন্য পাঠককে কোনো পয়সা দিতে হয় না। এসব ঈদসংখ্যায় হাস্যকৌতুককে প্রাধান্য দেওয়া হয়, যদিও অন্যান্য বিষয়ও থাকে।
এই কয়েক বছর আগেও ঈদসংখ্যাগুলোতে ভারতীয় ঔপন্যাসিক-গল্পকারদের একটা বড় উপস্থিতি থাকত। এখন খুব কম ঈদসংখ্যাতেই এঁদের পাওয়া যায়। এটি একটি বড় ঘটনা, আমার বিবেচনায়। একসময় অনেক সম্পাদক ভাবতেন, দেশি লেখক দিয়ে ঈদসংখ্যা চালানো যাবে না। কিন্তু প্রথম আলো শুরু থেকেই এই স্রোতের বিপরীতে গেছে। দেখা গেছে, শুধু দেশি লেখকদের দিয়ে যে ঈদসংখ্যা চালানো যায়, তা নয়, বরং ভালোভাবেই চালানো যায়। এখন অন্যান্য ঈদসংখ্যাও এটি বুঝতে শুরু করেছে। বাজার তাদের বলছে, দেশিতে বরং লাভ বেশি। অথবা এ রকম কিছু। পাক্ষিক অন্যদিন প্রতিবছর তার ঈদসংখ্যায় ভারতীয় লেখকদের রাখত, একেবারে জোড়ায় জোড়ায়। এটি খারাপ কিছু নয়, তবে এঁদের লেখা যে খুব বিরাট মাপের কিছু হতো, দু-একজন বাদ দিলে, তেমন তো নয়। এবার অন্যদিন-এ শুধু এ দেশের পাঠকের কাছে প্রিয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আছেন। তবে এবারই গত ১২-১৩ বছরের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ে এর লেখক-তালিকায় হুমায়ূন আহমেদ নেই। তবে তিনি অন্যভাবে আছেন, যেমন আছেন অন্যান্য ঈদসংখ্যায়ও। তাঁর আঁকা ছবির প্রতিলিপি আছে অন্যদিন-এ, তাঁর ঘেটুপুত্র কমলা ছায়াছবির চিত্রনাট্য আছে। বাংলাদেশের পাঠক দৃষ্টিতে হুমায়ূন আহমেদের অবদান অবিস্মরণীয়—ঈদসংখ্যাগুলোকে দেশি লেখকমুখী করার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন সবার আগে। তাঁর অকালপ্রয়াণ আমাদের সাহিত্যে একটা শূন্যতা তৈরি করল, তাঁর অভাব আমরা সব সময় অনুভব করব। তবে তাঁর সৃষ্ট পাঠকেরা এখন সাহিত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন, তেমনটি হওয়ারও আশঙ্কা নেই। ফলে আগামী বছরগুলোতেও দেশি লেখকদের লেখায় সমৃদ্ধ ঈদসংখ্যা বিক্রি হবে এবং আমি নিশ্চিত, অনেক বেশি বিক্রি হবে।
আমাদের সাহিত্যে অনেক মেধাবী লেখক আছেন, তরুণদের থেকেও প্রতিবছর অনেক মেধাবী লেখক উঠে আসছেন। এবার যে পাঁচ-ছয়টি ঈদসংখ্যা আমি পেয়েছি, সেগুলো অল্প অল্প করে প্রতিদিনই প্রায় পড়ছি, সেগুলোতে অনেক উঁচু মানের লেখা আমি পড়েছি এবং পড়ে আনন্দিত হয়েছি। অনেক তরুণ লেখক মন নাড়া দেওয়ার মতো গল্প লিখেছেন, দুটি উপন্যাসও পড়তে বসে রেখে দিতে পারেনি। সাহিত্যের ভূমিটি যে শক্ত হচ্ছে আমাদের, প্রতিবছর, অল্প অল্প করে, তা ঈদসংখ্যাগুলো আমাদের নিয়মিত জানান দিয়ে যায়।
এবারের ঈদসংখ্যাগুলোর দিকে চোখ রাখলে বোঝা যাবে, বিষয় গৌরবের সঙ্গে আঙ্গিকের চমক দেখানোর পাশাপাশি কিছু ধারাবাহিকতার চর্চাও কোনো কোনোটি করেছে। প্রথম আলোর প্রচ্ছদ করেছেন কাইয়ুম চৌধুরী, অন্যদিন-এর শাহাবুদ্দিন, অনেক বছর ধরে তাঁরা তা করছেন। এই ধারাবাহিকতার বিষয়টির আমি প্রশংসা করি। বাংলাদেশ একটি অস্থির দেশ—এর নগর, ভূগোল, দৃশ্যপট এবং জীবন ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। তাই বলে সব খোলনলচে বদলে যাবে, তা তো নয়। এ জন্য ঐতিহ্যের খানিকটা অনুসরণ, একটা চর্চাকে কিছুটা ধরে রাখা একটা নিশ্চিতি দেয়। পাশাপাশি নতুনত্বের আকর্ষণটাও প্রয়োজন। এ দুইয়ে মিলেই তো ঈদসংখ্যা।
এবং ঈদসংখ্যার মানে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা এবং ম্যাগাজিনগুলোর বিশেষ, স্ফীতকায়, ক্রোড়পত্র। অথবা সে রকমই সবার সিদ্ধান্ত।
No comments