টোকাই ছিনতাইকারীঃ ‘ধরা খুব মুশকিল, চোখের পলকে নাই হয়ে যায়’ by ইমরান আলী
বুধবার বেলা ১২টা। সড়ক দুর্ঘটনায় শাহবাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যানবাহন চলাচল বন্ধের কারণে প্রচণ্ড যানজট। কারওয়ান বাজারে ট্রাফিক সিগন্যালে শত শত গাড়ি আটকে আছে।
ঠিক এমন সময় ৪ জন টোকাইয়ের একটি দল সিএনজিচালিত অটোরিকশার যাত্রী এক নারীর ব্যাগ নিয়ে দৌঁড় দেয়। লোকজন ধাওয়া করে ধরে ফেলে দুইজনকে। শুরু হয় গণধোলাই। একপর্যায়ে আসে পুলিশও।
পুলিশ তাদের হ্যান্ডকাপ পরিয়ে নিয়ে যায় তেজগাঁও থানায়। পরে জানা গেল যে নারীর ব্যাগটি ছিনতাই হয়েছে, তার নাম সালমা বেগম। থাকেন রাজধানীর শেওড়াপাড়া এলাকায়। পুলিশ তাকে এ ঘটনায় মামলা করতে বললেও তিনি রাজি হননি।
সালমা বেগম জানালেন, ব্যাগের মধ্যে দুই হাজার টাকা ও মোবাইল ফোন সেটসহ ব্যাংকের কিছু কাগজপত্র ছিল।
এই চিত্র যে শুধু কারওয়ান বাজারের, তা নয়। পুরো রাজধানী জুড়েই টোকাই ছিনতাইকারীরা সুযোগ বুঝে জ্যামে দাঁড়ানো গাড়ি থেকে ব্যাগ, মোবাইল ফোন, স্বর্ণের চেইন ছিনতাই করে আসছে। এদের বিরুদ্ধে পুলিশের কোনো ভূমিকা না থাকায় প্রতিদিনই তারা বাস ও অটোরিকশাযাত্রীদের জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিচ্ছে। এদের কাছে অসহায় যাত্রীরা।
কারওয়ান বাজারে দায়িত্বপালনকারী তেজগাঁও থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মামুনুর রশিদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘এদের ধরা খুব মুশকিল। চোখের পলকে এরা নাই হয়ে যায়’।
তিনি জানালেন, টোকাইরা খুবই সংঘবদ্ধ। এরা টার্গেট করে থাকে কখন গাড়ি সিগন্যালে পড়বে। ঠিক তখনই টার্গেট অনুযায়ী কাজ সেরে সটকে পড়ে। এদের অধিকাংশই মাদকাসক্ত। যার কারণে এরা মাদকের টাকা সংগ্রহ করতে চুরি-ছিনতাই করে।
তিনি জানান, আটক দুই ছিনতাইকারী হলো রাসেল ও মিজান। পুলিশ ও সাংবাদিকদের রাসেল জানায়, সে কারওয়ান বাজার ফলের আড়তের কাছের একটি ক্লাবে থাকে। সেখানে তার মতো আরও ৫/৭ জন রয়েছে। যারা এই কাজ করে থাকে। দিনে ও রাতে উভয় সময়েই কাজ করে। রাতের বেলায় গাড়ি থেকে তারা সবজি চুরি করে। চলন্ত গাড়ি থেকেও নামিয়ে নেয়। পরে তা কারওয়ান বাজারেই বিক্রি করে।
আটক মিজান জানায়, রাতের বেলায় কারওয়ান বাজারে যে সবজির ট্রাক আসে, সেখান থেকে বিভিন্ন ধরনের সবজি নামিয়ে নেয় তারা। শুধুমাত্র কারওয়ান বাজারেই তাদের ১৫ জনের একটি গ্রুপ রয়েছে। যারা দিনের বেলায় কারওয়ান বাজারের দু’পাশের রাস্তায় অবস্থান করে। এছাড়া তারা এফডিসি রোডেও মাঝে-মধ্যে অবস্থান নেয়। ছিনতাই করা মালামাল তারা বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কারওয়ান বাজার রোড, মহাখালি রোড, রামপুরা রোড, গুলিস্থান, কাকরাইল, মতিঝিল, পল্টন, বিজয়নগর, আজিমপুর নিউমার্কেট সড়ক ও গাবতলীসহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে এই টোকাই ছিনতাইকারী চক্র সক্রিয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর বড় টোকাই ছিনতাইকারী গ্রুপটি রয়েছে ফকিরাপুলে। এই গ্রুপটি ফকিরারপুল, শান্তিনগর, বিজয়নগর, গুলিস্থান, পল্টন এবং মতিঝিল এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। দিনের বেলায় এরা এসব এলাকায় অবস্থান করলে রাতে ফকিরাপুলের পানির ট্যাংকির কাছে জড়ো হয়। সেখান থেকে রাতে তারা চুরি ছিনতাই করতে বের হয়।
জানা যায়, ফকিরাপুলে কিরণ নামে এক টোকাই এদের নেতৃত্ব দেয়। তার নেতৃত্বেই এখানকার টোকাইরা চলে। দিনে যে সব কাজ করে সেগুলো তার কাছে জমা দেয় টোকাইরা।
এছাড়া মালিবাগ মৌচাক এলাকায় এই টোকাই চক্রের বেশ কেয়কটি গ্রুপ চুরি ছিনতাই করে আসছে।
ভুক্তভোগীরা জানান, বাস অথবা অটোরিকশা যাত্রীদের ব্যাগ, মোবাইল ফোন ও সোনার চেইন ছিনতাই ছাড়াও এরা গাড়ির লুকিং গ্লাস, মোটরসাইকেলের সঙ্গে থাকা হেলমেট চুরি করে। পল্টন, মতিঝিল এলাকায় গাড়ির লুকিং গ্লাস ও হেলমেট চুরির প্রবণতা বেশি বলে জানা গেছে।
টোকাই চক্রের দৌরাত্ম্যের ব্যাপারে মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হায়াতুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, টোকাইরা এসব অপরাধ করে থাকে। কিন্তু ওদের বিরুদ্ধে কার্যত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়না। কেউ এদের বিরুদ্ধে মামলা করে না। আবার থানায় নিয়ে এলেও নানা সমস্যা দেখা দেয়। কারণ এরা মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে ঝামেলায় পড়তে হয়।
তিনি জানান, ধরা পড়ার এমনতিই গণধোলাইয়ের শিকার হয়। এরপর পুলিশ তাদের চড় থাপ্পড় দিয়ে এসব কাজ না করার শর্তে ছেড়ে দেয়। পরে তারা আবারও অপরাধ করে। তিনি বলেন, তারপরও আমরা এটি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি।
পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম সারোয়ার বাংলানিউজকে বলেন, আমরা টোকাই চক্রের অপরাধ রোধে সচেষ্ট রয়েছি। তাদের নিয়ে কিছু ঝামেলা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ধরা পড়ার পর মারধর দিয়ে সাধারণত এদের ছেড়ে দেওয়া হয়। পরে তারা আবারও অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওমর ফারুক বাংলানিউজকে বলেন, টোকাই নিয়ে আমরাও সমস্যাই থাকি। বেশিরভাগ সময় রাতের বেলায় এরা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে।
তিনি বলেন, টহল টিমকে নির্দেশ দেওয়া রয়েছে, যখনই কোনো টোকাই এ ধরনের কাজ করবে, তখনই তাকে আটক করে থানায় নিয়ে আসতে হবে। এছাড়া গতিবিধি সন্দেহ হলেও থানায় নিয়ে আসার নির্দেশ রয়েছে বলে জানান তিনি।
সার্বিক বিষয়ে ডিএমপির জয়েন্ট কমিশনার (ক্রাইম) আব্দুল জলিল মণ্ডল বাংলানিউজকে বলেন, টোকাইরা মাদকসক্ত হওয়ার কারণে এরা চুরি ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এদের নিয়ে আইনগত কিছু সমস্যাও রয়েছে। তারপরও এদের নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর প্রত্যেক থানাকে কঠোর নির্দেশ দেওয়া রয়েছে বলে জানান তিনি।
No comments