নিত্যজাতম্-হে ক্ষণিকের অতিথি by মহসীন হাবিব

স্বল্প সময়ে, অল্প কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বাংলাদেশ সফর করে গেলেন বিশ্বের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের শীর্ষ পর্যায়ের তিন নেতা। বাংলাদেশের জন্য এ এক বিরল ঘটনা। কোনো আন্তর্জাতিক সম্মেলন ছাড়া বাংলাদেশে কখনো কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে এমন উচ্চ পর্যায়ের নেতারা সফর করতে আসেননি।
নিন্দুকেরা যাই বলুক, জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী ওকাদা, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এবং ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের এ সফরকে ইতিবাচকভাবেই আমাদের দেখতে হবে। আমাদের মনে রাখা উচিত, উগ্র ব্যক্তিস্বার্থ, উগ্র জাতীয়তাবাদ আধুনিক সময়ে ব্যক্তি বা রাষ্ট্রকে বন্ধুহীন করে দেয়। পারস্পরিক সহযোগিতার এই যুগে কেউ এলেই যদি আমরা 'তেল-গ্যাস চুরি করতে এসেছে' ভেবে বসে থাকি, তাহলে না ধরে রাখতে পারব তেল-গ্যাস, আর না পারব বন্ধুত্ব।
এই তিন হাই প্রোফাইল নেতার সফরের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো, আমরা লক্ষ করছি বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের বাংলাদেশ সফর নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে উঠছে। এটি একটি ভালো ইঙ্গিত বহন করে। সে ইঙ্গিতটি হলো, বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। আর অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল থাকা কোনো দেশ কখনো গুরুত্ব পায় না। গুরুত্ব সে-ই পায়, যার সঙ্গে বাণিজ্য চলে, যার সঙ্গে নানা কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রয়োজন হয়। ৭০ বা ৮০-এর দশকে বাংলাদেশে মাসের পর মাস এ পর্যায়ের কোনো বিদেশি অতিথি দেখা যায়নি। এখন দেখা যাচ্ছে। কারণ বাংলাদেশ এখন আর শুধু দাতা দেশগুলোর ওপর পূর্ণ নির্ভরশীল রাষ্ট্র নয়। সরকার এখনো দরিদ্র হলেও এখানে বিশাল শক্তিশালী এক বাজার গড়ে উঠছে। এই বাজার ধরতে সব দেশকেই কমবেশি সফর করতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত. এশিয়ার রাজনীতিতে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের গুরুত্ব বেড়েছে আগের তুলনায় অনেক বেশি। সুতরাং বাংলাদেশে রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান, মন্ত্রী-সচিবদের সফর হয়ে উঠছে স্বাভাবিক।
শুধু ব্যবসা-বাণিজ্য নয়, আবেগের বা ঐতিহ্যের সম্পর্ক অস্বীকার করার কোনো উপায় আছে কি? ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সফরটি তেমনি এক আবেগ এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশ্রিত। তিনি এসেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বছরব্যাপী বাংলাদেশ আয়োজিত অনুষ্ঠানমালার সমাপনী পর্বে যোগ দিতে। ভারত-বাংলাদেশে দুটি দেশের চেতনা ও সত্তার সঙ্গে মিশে আছেন রবীন্দ্রনাথ। দুটি দেশেই রবীন্দ্রনাথ একটি পবিত্র নাম। সুতরাং এ সফরের মধ্যে বন্ধুত্বের বাইরে অন্য কিছু খুঁজতে যাওয়া শুধু সন্দেহবাতিক রোগ ছাড়া আর কিছুই হবে না। একটি সরল বাস্তবতা অনেকে খতিয়ে দেখেন না। তেল-গ্যাস কুক্ষিগত করতে চাইলে অথবা বাংলাদেশকে 'বাঁশ' দিতে চাইলে এখনকার দিনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এয়ারপোর্ট-টু-প্রধানমন্ত্রীর ভবন পর্যন্ত আসার প্রয়োজন হয়? মোটেই না। সুতরাং এ সফরকে ঘনিষ্ঠতার সফর, বন্ধুত্বের সফর বলে মনে করাটাই যথাযথ। আধুনিক সচেতন মানুষের কাছে অন্ধ-ভক্তি বা অন্ধ-ঘৃণার কোনো স্থান থাকা উচিত নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের ব্যর্থতার কথা যদি আমরা বলতে পারি, তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সফলতার কথা বলব না কেন?
সামনের দিনে আরো হৃদয়স্পর্শী সফর রয়েছে। আগামী মাসে আসছেন মীরা কুমার। তিনি ভারতের লোকসভার স্পিকার। চোখ-মুখে প্রখর ব্যক্তিত্বের ছাপ এই নারী অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ভারতের লোকসভার পরিণত, ঝানু সব সদস্যের তুখোড় হট্টগোল সামলে থাকেন। তাঁর সফর আক্ষরিক অর্থেই একটি ব্যতিক্রম সফর। ভারতের লোকসভার এই স্পিকার বাংলাদেশে এসে বাংলায় বক্তৃতা করবেন। তাই তিনি দু-একটি শব্দ নয়, মনোযোগ সহকারে বাংলা ভাষা শিখছেন শিক্ষক রেখে। দিল্লির কমলা নেহরু গার্লস কলেজের অধ্যক্ষা মিনতি চট্টোপাধ্যায়ের কাছে তিনি বাড়িতে বসে বাংলা শিখছেন। শুধু 'তোমার নাম কী, বাড়ি কোথায়' ধরনের দুচার কথা বলার বাংলা শিখছেন না তিনি। একই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল সম্পর্কে গভীরভাবে পাঠ গ্রহণ করছেন মীরা কুমার। মীরা কুমারের সফরের উদ্দেশ্যটিও সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আসছেন ঢাকায়। এই সফরকে আমরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সফর বললে কী অন্যায় হবে না?
মাত্র কয়েক দিন আগে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি কলকাতায় গিয়েছিলেন মাদার তেরেসা আন্তর্জাতিক সম্মান আনতে। সেখান থেকে ব্যক্তিগত সফরে মেদিনিপুরে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্বামী তৌফিক নেওয়াজ, ছেলে তৌকীর এবং মেয়ে দীপাবলি। তৌফিক নেওয়াজের মামাবাড়ি মেদিনিপুর। তাঁর মামা খলিলুর রহমান এবং আহমেদ জানের বাড়িতে গিয়েছিলেন তাঁরা। সেই সঙ্গে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বাড়িও দেখতে গিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরিবারসহ। ওই অঞ্চলের মানুষ দীপু মনিকে কাছাকাছি পেয়ে প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, 'আমাদের বৌদি বাংলাদেশের মন্ত্রী, ভাবতেই গর্ব হয়। স্থানীয় এক নেতা বলেছেন, দেশ ভাগ হয়েছে, ভাগ হয়নি ভাষা-সংস্কৃতি। ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী আরো সুদৃঢ় ও গভীর হবে সেটাই আমাদের সবার আশা।'
এমন সফরগুলোর প্রয়োজনয়ীতা অস্বীকার করার উপায় কী? সম্পর্ক এমন ব্যাপার, যা সঠিকভাবে গড়ে তুলতে পারলে বিপদের সময় একটি দেশ আরেকটি দেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। ঠিক ব্যক্তিমানুষের মতোই। সেটা আমরা প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ নানা ক্ষেত্রে দেখেছি। অবশ্যই ভারত-বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ নিয়ে বেশ কিছু সমস্যা আছে। কিন্তু সে সমস্যা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে যতটা মেটানো সম্ভব, বৈরিতার মধ্যে তা সম্ভব নয়। আজ এ উপলব্ধি ভারত ও পাকিস্তানের সচেতন মহলের মধ্যেও জেগে উঠেছে। পাকিস্তানের মতো একটি গোঁড়া মানসিকতার দেশে এখন এত সংখ্যক মানুষ ভারতের সঙ্গে বনু্লত্বের পথ খুঁজে বের করার এবং হাত বাড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন যে বিষয়টি ছোট আকারে হলেও এখন একটি রাজনৈতিক চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈরিতা মানেই যে বীরত্ব এ ধারণা মধ্যযুগীয়।
এই অতিথিদের সফর নিয়ে টেলিভিশনে দেওয়া ড. দেবব্রত ভট্টাচার্যের একটি উক্তি খুব মনে ধরেছে। তিনি স্মিত হেসে বলেছেন, সব কিছুর মধ্যে ষড়যন্ত্র খোঁজার একটি রোগ আছে আমাদের।' তাঁর এ উক্তি বহুদিন ধরেই উপলব্ধি করছি। গুরুত্বপূর্ণ কেউ সফরে এলেই একটি শ্রেণী সোচ্চার হয়ে উঠছে, 'তেল-গ্যাস নিয়ে যাওয়ার মতলব।' নিশ্চয়ই আমরা আমাদের প্রাকৃতিক সব সম্পদ সম্পর্কে সজাগ থাকব। কেউ এ দেশের কোনো সম্পদ কোনো বিদেশি শক্তির হাতে তুলে দিলে জাতি তাঁকে বা তাদের ক্ষমা করবে না। কিন্তু ভাইরাসের মতো যে নতুন 'তেল-গ্যাস রোগ' দেখা দিয়েছে, তার প্রকোপ কিন্তু অনেক ইতিবাচক কর্মেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.