সাম্প্রদায়িকতা-শাহরুখের ওপর শিবসেনার রোষ by রাম পুনিয়ানি

পক্ষকাল আগে নন্দিত অভিনেতা শাহরুখ খান বলেছিলেন, পাকিস্তানি ক্রিকেট খেলোয়াড়দের আইপিএল ক্রিকেট লিগে খেলা থেকে নিবৃত করা উচিত হবে না। এ কথার জের ধরে স্থানীয় শিবসেনা সমর্থকেরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা শাহরুখের সমালোচনায় নামে, তাঁর ছবি মাই ন্যাম ইস খান-এর পোস্টার ছিঁড়ে ফেলে,


এমনকি তারা এমন কথাও বলে, শাহরুখের ‘খান’ পরিচয় যদি জেগে উঠতে থাকে, তবে পাকিস্তানে চলে গিয়ে সেখানেই তাঁর বসবাস করা উচিত। শিবসেনা পাশাপাশি এক সহিংস প্রচারণায় নেমেছে, যার মর্মকথা হলো, ‘মুম্বাই মহারাষ্ট্রবাসীদের জন্য।’ মহারাষ্ট্রবাসী ক্রিকেটতারকা শচীন টেন্ডুলকার অন্য অনেকের মতো এ প্রচারণার বিরুদ্ধে মতামত দিয়ে বলেছেন, সারা ভারতের মালিক ভারতের সব নাগরিক। আঞ্চলিকতাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে গোলযোগের জঘন্যতম প্রকাশ দেখা যাচ্ছে বর্তমানে মুম্বাইয়ে।
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক শুরু থেকেই সমস্যাসঙ্কুল। দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে তিনটি যুদ্ধ হয়েছে। সীমান্তের দুই পাশের জনগণ দেশ দুটির দ্বন্দ্বের কারণে তীব্র যন্ত্রণাকাতর। দুই দেশের বিবাদের কারণ হয়ে আছে নানা বিষয়। সাম্প্রতিক সময়ের প্রধান বিষয়টি সন্ত্রাসবাদ।
সন্ত্রাস নির্মূল করতে হলে এর গভীরতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। সন্ত্রাসের বীজ উপ্ত আছে তেলকেন্দ্রিক রাজনীতির মধ্যে; যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আল-কায়েদা সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষণদানের উদ্দেশ্যে পাকিস্তানের মাটিতে মাদ্রাসা তৈরির রাজনীতির গভীরে। ১৯৭০-এর দশকের শেষ ভাগে যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলদারির মোকাবিলা করতে। আল-কায়েদা তৈরি করা হয়েছে ইসলামের বিকৃত ব্যাখ্যায় মুসলমান তরুণদের দীক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে। যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমেই ওসামা বিন লাদেনকে আবার সেখানে টেনে আনা হয়েছে। সোভিয়েতবিরোধী শক্তিগুলোর সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য এই ওসামাকে এককালেলাখ লাখ ডলার ও বিপুল অস্ত্রশস্ত্র দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
সোভিয়েত বাহিনীর পরাজয়ের পর এই দীক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা এ অঞ্চলের অন্য শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে নামে। ইসলামের পরিচয়কে তারা সহিংসতার কাজে অপব্যবহার করেছে। বর্তমানে পাকিস্তান এর প্রধান শিকার।
সন্ত্রাসবাদের ঘাঁটি হয়তো পাকিস্তানে আছে, কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্র বা পাকিস্তানি জনগণ বা গণতান্ত্রিক উপাদানগুলো এই বিষাক্ত ক্যানসারকে সমর্থন জোগাচ্ছে না। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাসবাদের শিকার হয়ে মারা গেছেন এবং দেশটিতে সন্ত্রাসী ঘটনা নিয়মিত ঘটতে দেখা যায়। এই ক্যানসার দূর করতে পাকিস্তানের বেসামরিক সরকার চেষ্টা চালাচ্ছে নিজের মতো করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী-মোল্লাতন্ত্র এটির বাড়বাড়ন্তি ঘটিয়েছে। ভারতে বসে সন্ত্রাসবাদের নিন্দা জানানো ও বেসামরিক সরকারের প্রতি একে নিয়ন্ত্রণ করার আহ্বান জানানো যেমন ন্যায়সংগত, তেমনি সত্যি হলো পাকিস্তানের প্রতি বন্ধুত্বসুলভ অভিব্যক্তি শেষ পর্যন্ত বেসামরিক সরকারকে জোরদার এবং সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করবে। এ কারণে সংগীত, খেলাধুলা, বাণিজ্য ও শিক্ষার বিনিময়ের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের শান্তির সম্পর্ককে শক্তিশালী করতে হবে। দুই দেশের মধ্যে ঘৃণা ছড়ানো, দুই দেশের স্বার্থের জন্যই ক্ষতিকর।
সন্ত্রাসবাদের প্রতি রোষ যেমন স্বাভাবিক, তেমনি আমরা এ অঞ্চলের গভীরতর গতি-প্রকৃতিকে অবজ্ঞা করতে পারি না; শান্তির পথ পরিহার করতে পারি না। এ অঞ্চলে প্রগতির পূর্বশর্ত শান্তি। শাহরুখের মুসলমান নামের কারণে তাঁকে শিবসেনার কটাক্ষ, তাঁকে পাকিস্তানে চলে যেতে বলা, ভারতের সংবিধানের মূল্যবোধ ও ভারতের জাতীয় আন্দোলনের চেতনার পরিপন্থী। সব ধর্মের নাগরিকই ভারতের নাগরিক। কোনো ব্যক্তির ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে তার দেশপ্রেম সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করার অর্থ ভারতের সংবিধানকে অমর্যাদা করা।
একইভাবে, মুম্বাইয়ের মতো মহানগর একটি নির্দিষ্ট মাত্রার পর নতুন লোকদের জায়গা দিতে পারবে না—এ কথা মেনে নিয়েও বলা যায়, কেন এত মানুষ মুম্বাইয়ে যায় সেদিকটিও দেখা দরকার। ভারতের ভারসাম্যহীন উন্নয়ন লোকজনকে এমন মহানগরের দিকে ধাবিত করছে। সুতরাং শিবসেনার মাস্তানি ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী কথাবার্তার লাগাম টেনে ধরার দাবি উত্থাপনের পাশাপাশি উন্নয়নের এমন ধরনের দিকেও দৃষ্টি নিবদ্ধ করা প্রয়োজন।
শিবসেনার ইতিহাস বেশ জটিল। কয়েক দশক আগে দলটির প্রতি শিল্পপতিদের সমর্থন ছিল এবং কংগ্রেস নেতৃত্বের এক অংশ একে প্রতিপালন করেছে। তখনকার বিবেচ্য ছিল বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলো ধ্বংস করা। ট্রেড ইউনিয়নগুলো তখন সততার সঙ্গে শ্রমিকদের স্বার্থে লড়াই করছিল। পরে শিবসেনার আক্রমণের লক্ষ্যে চলে আসে দক্ষিণ ভারতীয়, গুজরাটি ও উত্তর ভারতীয়রা। শেষমেশ দলটি বিজেপির লালকৃষ্ণ আদভানির পৌরহিত্যে হিন্দুত্বের রথে চড়ে বসে। বিজেপি ও এর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সবচেয়ে দৃঢ় মিত্র শিবসেনা। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর ও ১৯৯৩ সালের জানুয়ারি মাসের দাঙ্গার ওপর শ্রীকৃষ্ণা কমিশনের প্রতিবেদনে শিবসেনাপ্রধান বাল ঠাকরেকেও অভিযুক্ত করা হয়। এই প্রতিবেদনটি কংগ্রেসসরকার হিমাগারে পাঠিয়ে দিয়েছে।
শিবসেনা ও রাজ ঠাকরের মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা (এমএনএস) রাজপথে সহিংসতার মাধ্যমে ত্রাস সৃষ্টির পদ্ধতি ব্যবহার করে, এর তুলনা চলে হিটলারের পদাতিক বাহিনীর সঙ্গে। এ পথে শিবসেনা নিয়মিতভাবে শিল্পীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। গজল গায়ক গুলাম আলি, চিত্রশিল্পী এম এফ হুসেইন আর এখন শাহরুখ খান তাঁদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন। প্রশিক্ষিত কর্মীদের দ্বারা আকস্মিক আক্রমণ চালানোর কৌশলে আরএসএস ধারার ও বজরং দলের মতো সমান্তরাল কিছু দলের সঙ্গে শিবসেনা কাজ করে। এ কৌশলের মূলে আছে ভাঙচুর করা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর হামলা চালান। শিবসেনা, এমএনএস ও বজরং দল ফ্যাসিবাদী। তারা গণতান্ত্রিক পরিসর ব্যবহার করে আর মধ্যপন্থী সুবিধাবাদী রাজনীতির ভুলত্রুটির ফায়দা লুটে সামাজিক পরিসরে জায়গা করে নেয়। হিটলারের অবির্ভাবও ঘটেছিল গণতান্ত্রিক পরিসরকে কাজে লাগিয়ে। সেই পরিসর ধ্বংসের কাজেও তিনি এটিকে ব্যবহার করেন। হিটলারের সঙ্গে ফ্যাসিবাদীদের এমন সাদৃশ্য অবজ্ঞা করার মতো নয়। এই ফ্যাসিবাদীরা কায়েমি স্বার্থের রাজনীতির ফল। এরা কংগ্রেস ও অন্য মধ্যপন্থীদের রাজনৈতিক চরিত্রের সুযোগ নিয়ে বাড়বাড়ন্তি ঘটিয়ে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দৈত্যে পরিণত হচ্ছে।
বাল ঠাকরের ফ্যাসিবাদী রাজনীতির উত্তরাধিকার নিয়ে তাঁর ছেলে উদ্ভব ও ভ্রাতুষ্পুত্র রাজের মধ্যে বিরোধের জেরে রাজ তাঁর নিজের দল এমএনএস তৈরি করেছেন। এমএনএসের সৃষ্টিকালীনও কংগ্রেস দলটির বিকাশের পক্ষে অনুকূল অবস্থানে ছিল।
শিবসেনা-এমএনএস প্রধানত বিভেদ সৃষ্টিকারী, সাম্প্রদায়িকতা ও আঞ্চলিকতার ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের অনুসারী। ভারতের জাতীয় অখণ্ডতার চেতনা এসব আঞ্চলিক শক্তির কর্মকাণ্ডে আক্রান্ত। ধর্ম বা অঞ্চলের নামে নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করা উচিত নয়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঘৃণা উসকে দেওয়া অদূরদর্শী কাজ। সন্ত্রাসবাদের গভীরতর কারণগুলো অগ্রাহ্য করে এটি স্থূল আবেগ নিয়ে খেলে। সন্ত্রাসবাদের কারণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির দিকে অভিযোগের আঙুল ওঠা উচিত।
কাউন্টারকারেন্টস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
রাম পুনিয়ানি: ভারতীয় মানবাধিকার কর্মী।

No comments

Powered by Blogger.