অরণ্যে রোদন-জিব দিয়ে যেন নাক না ভাঙি by আনিসুল হক
কম কথার মানুষই শ্রেষ্ঠ মানুষ, বলেছেন শেক্সপিয়ার। কথা জিনিসটা যে খুবই মূল্যবান, আর নীরবতা ও কম কথা বলা যে তার চেয়েও মূল্যবান—এই নিয়ে গত এক বছরে একাধিক লেখাই এই প্রথম আলোয় এই ক্ষুদ্র লেখকই লিখেছে। অরণ্যে রোদন কলামের আর কিছু সার্থক না হোক, নামকরণটা সার্থক বটে।
মূল প্রসঙ্গে আসার আগে ইশপের নিজের জীবনের গল্পটা বলে নিতে হয়।
ইশপ ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের রাজপরিবারের এক ক্রীতদাস। তিনি ছিলেন খুবই জ্ঞানী আর চালাক মানুষ। একদিন রানি তাঁকে ডেকে বললেন, ‘ইশপ, তুমি যত খুশি স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে যাও, আর আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে দামি খাবারটা রেঁধে এনে দাও।’
ঈশপ বাজারে গেলেন। তারপর পৃথিবীর সবচেয়ে দামি খাবার, সুন্দর খাবার বলে যা তার মনে হয়েছে, তাই কিনে এনে রান্না করে রানির টেবিল সাজিয়ে দিলেন।
রানি এলেন। বললেন, ‘দেখি তোমার সুন্দর খাবার। এসব কী?’
‘জিহ্বা, রানিমা।’
‘পৃথিবীতে এত কিছু থাকতে তুমি আমার জন্যে জিহ্বা রেঁধে এনেছ!’
‘রানিমা, জিহ্বাই হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে দামি জিনিস। এটা দিয়ে সুন্দর সুন্দর কথা বলে পৃথিবীটাকে সুন্দর করা যায়। এর চেয়ে দামি, এর চেয়ে সুন্দর খাবার আর কী হতে পারে?’
‘আচ্ছা। এসব সরাও। পৃথিবীর সবচেয়ে কুিসত খাবার কী হতে পারে, সেটা পরিবেশন করো দেখি।’
এবারও জিহ্বা দিয়েই ঈশপ টেবিল সাজালেন।
রানি বললেন, ‘এসব কী?’
‘জিহ্বা, মহারাজ্ঞী।’
‘আবার জিহ্বা কেন?’
‘জিহ্বা দিয়েই পৃথিবীর সবচেয়ে কুিসত কথাগুলো উচ্চারিত হয়, পৃথিবীটাকে এই জিহ্বাই অসুন্দর করে তোলে। তাই আবারও জিহ্বাই রাঁধতে হলো, মহারানি।’
২.
সারা পৃথিবীতেই পরিবর্তনের পক্ষে আওয়াজ উঠেছে। বাংলাদেশেও আমরা পরিবর্তনের পক্ষে কথা বলছি। প্রথম আলো বলছে, ‘বদলে যাও, বদলে দাও।’ বলছে, নিজেকে বদলানো সবচেয়ে কঠিন, ওই কাজটা আগে করতে হবে। পরিবর্তনের কথা বলে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে। তারা ঘোষণা করেছে দিনবদলের সনদ! এইখানেও কিন্তু বলতে হয় ওই কথাটাই, ‘আসুন, আগে নিজে বদলাই। তারপর অন্যদের বদলাতে বলি।’
এই দেশের বহু কিছু বদলাতে হবে, উন্নত করতে হবে। আমরা চাই যে আমাদের বিদ্যুত্ সমস্যার সমাধান হোক। কিন্তু হাজার চাইলেও সেটা এক দিনে করা সম্ভব হবে না। কিছুদিন সময় দিতেই হবে। আমরা চাই আমাদের উপকূলের মানুষগুলো নিরাপদ থাকুক। উপকূল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ যদি করতে হয়, আমরা চাইলেই সেটা আগামীকালই নির্মিত হবে না। সময় দিতে হবে। চাইলেই আমরা আগামীকালই ঢাকা শহরে ভূগর্ভস্থ রেল বা শত মাইলের উড়াল সেতু বানিয়ে ফেলতে পারব না। কিন্তু চাইলেই এই মুহূর্তে, এখনই একটা কাজ করে ফেলতে পারি, তা হলো কথা কম বলা এবং সুন্দর করে কথা বলার প্রতিজ্ঞা করা। আর সেই কাজটাও শুরু করতে হবে নেতৃত্ব থেকে।
এবার শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট যে এত বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে, তার পেছনে এক শ একটা কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে। সবচেয়ে বড় কারণ, আগের মেয়াদে বেগম জিয়ার জোট সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতা ও ধরাকে সরা জ্ঞান করার মনোভাব; কিন্তু তার সঙ্গে নতুন আরেকটা জিনিস ভোটের আগে যোগ হয়েছিল, মহাজোট নেত্রী শেখ হাসিনা অভূতপূর্ব বাকসংযমের পরিচয় দিয়েছিলেন। সেই সংযম তিনি বহু দিন রক্ষা করে চলে আমাদের মনে এই আশার জন্ম দিয়েছিলেন যে শেখ হাসিনা নিজেই বদলের সূচনা করছেন, তিনি নিজে বদলেছেন এবং পুরো জাতিকে দিনবদলের আলোর পথে যোগ দিতে অনুপ্রাণিত করছেন।
কিন্তু সম্প্রতি জাতীয় সংসদের ভেতরে ও বাইরে আমাদের জাতীয় নেতারা যে ভাষায় আর যে প্রসঙ্গে বাক্যবিনিময় করছেন, তাতে আমাদের মাথা হেঁট হয়ে আসছে। আমাদের জাতির সামনে কি আলোচনা করার মতো কোনো বিষয় নেই? আমাদের জাতীয় সংসদে কি আলোচনার যোগ্য কোনো সমস্যা নেই? আমরা কি সব সমস্যার সমাধান করে ফেলেছি? খুব ভালো কথা। তাহলে সমস্যা নয়, সাফল্যের কথাই শুনি। সুন্দর সুন্দর কবিতা, চমত্কার গৌরবগাথা, সুরভিত সব সুভাষণেই ভরে উঠুক আমাদের জাতীয় সংসদের ফ্লোর, আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের মাইক্রোফোন।
তার বদলে এ কী! কোন নেতার লাশ কোথায় আছে, আছে কি না, সেটা ডিএনএ টেস্ট করে দেখা হোক—পরস্পরবিরোধী দল দুটো পরস্পরের প্রতি এই নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়িতে মত্ত হয়েছে। এটা কি একটা বলবার মতো কথা? তাও জাতীয় নেতা-নেত্রীদের মুখে?
আরেকজন বড় নেতা, তিনি বাকসংযমের জন্যে এত দিন প্রশংসিত ছিলেন। বলে বসলেন, দুই নেত্রীর একজন মানুষ, আরেকজন... থাক। কাদা যত কম ঘাঁটা যায়, ততই ভালো।
এই সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে মানুষ, বড় আশায় বুক বেঁধে। এই মন্ত্রিসভায় নতুন ও প্রতিশ্রুতিশীল মুখগুলো দেখে অন্য অনেকেরই মতো এই লেখকও মুগ্ধবিস্ময়ে ভেবেছিল, দিনবদল কি সত্যিই শুরু হয়ে গেল! কিন্তু ক্ষমতাসীন হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলে বসলেন, সব গণ্ডগোল করছে কেবল বিরোধী দলের লোকেরা, তখনই এই কলমটা ধরতে হয়েছিল, লিখতে হয়েছিল—স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এটা কী বললেন! তারপর একাধিক লেখায় বলেছি, টেলিভিশনের ক্যামেরা দেখলেই মুখ খোলাটা বিপজ্জনক। কারণ হঠাত্ করে বলে বসা কথায় ভুল হয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক, আর কথা একবার বেরিয়ে গেলে তা থেকে সংঘটিত হতে পারে অনেক বড় বিপদ। কথা আসলে এটম বোমার মতোই। আমাদের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আগের সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর মতোই কথার জন্যে কার্টুনের চমত্কার বিষয় হয়ে উঠছেন।
কবি রফিক আজাদের একটা দারুণ কবিতা আছে, ‘গদ্যের গহন অরণ্যে হারিয়ে যাওয়া আমি এক দিগ-ভ্রান্ত পথিক’ নামে। তাতে তিনি লিখেছেন:
‘সবিস্ময়ে একদিন শুনি
খুব সুশ্রী এক নারী কথা বলছেন
তার প্রেমিকের উদ্দেশে, যেন গলগল করে
বমন করছেন অবিরল ধারায় ইট-গুঁড়ো-করা খোয়া,
উত্তরে প্রেমিক ছেলেটিও উচ্চারণ করছে
শপাং শপাং গদ্যের চাবুক।’
এইখানে প্রেমিক আর সুশ্রী নারীর বদলে আমরা যদি আমাদের নেতা-নেত্রীদের কথা বসাই, তাঁদের ভাষণের কথা বসাই, একই অর্থ দাঁড়াবে। আমাদের এই নেতারা কথা বলছেন নাকি ইটের গুঁড়ো ওগড়াচ্ছেন, নাকি নোংরা ঘাঁটছেন!
রফিক আজাদ ওই কবিতাতেই দুঃখ করেছেন,
‘এমন একটি দিন তো ছিলো, যখন পল্টন ময়দানে
সমবেত জনতার উদ্বেলিত চিত্তে অনায়াসে
আমাদের নেতারা কবিতার বীজ বপন করে যেতেন,
স্বপ্ন বুনে যেতেন।...
...একদা এই দেশকে বলা হতো
সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা বাঙলা--
বড়বেশি গদ্যচর্চা হচ্ছে আজকাল
প্রবাদপ্রসিদ্ধ এই দেশে।
যার ফলে আমরা একজন বজ্রকণ্ঠ, স্বপ্নদ্রষ্টা
নেতার পরিবর্তে পাচ্ছি অসংখ্য ছোটখাট গদ্যনেতা,
একজন সিরাজদ্দৌলার পরিবর্তে
অসংখ্য মীরজাফর...’
সত্যি তো, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ তো জমাট জলের মেঘের মতোই মায়া আর বজ্র বর্ষণ করত, কিন্তু তাঁর সাতই মার্চের অমোঘ ভাষণ থেকে কেউ একটাও কটূক্তি খুঁজে বের করতে পারবেন? বড় নেতা হতে হলে মনটা বড় হতে হয়, রুচিবোধ আর সৌজন্যবোধও তাঁর বড় হয়।
আরবিতে একটা প্রবাদ আছে, ‘যখন তুমি একটা কথা বলো, সেটা তোমাকে পরাজিত করে। আর যদি তুমি সেটা না বলো, তাহলে তুমি তাকে পরাজিত করো।’
৩.
মাননীয় নেতা-নেত্রীগণের প্রতি আমাদের আকুল আবেদন, এই নোংরা কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধ করুন। আমাদের তরুণ প্রজন্মের জন্যে উজ্জ্বল আদর্শ স্থাপন করুন। বিরোধী দল সংসদে যেতে চাইছে, আমরা চাই তারা সংসদে যাক। আমরা চাই সংসদে তাদের কথা বলতে দেওয়া হোক। আমরা জানি, তারা সংখ্যায় খুবই কম, কিন্তু মনে রাখতে হবে, তারাই বিরোধী মতের প্রতিনিধি। তাদের সমমর্যাদায় কথা বলতে দিতে হবে। সংসদ সদস্যের সংখ্যানুপাতে তারা কম, তবে প্রাপ্ত ভোটের হিসাবে তারা কমসংখ্যক মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে না। বা তারা যত কম ভোটই পাক না কেন, ওই কথাটা আমাদের গণতন্ত্রের মূল কথা বলে মেনে নিতে হবে যে ‘কেউ যদি বিরোধিতা করে, সে যদি একজনও হয়, আর আমি যদি তার মতের সঙ্গে একমত নাও হই, তার মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে আমি জীবন দিয়ে দেব।’
সংসদকে অর্থবহ করা দরকার বিরোধী দলের স্বার্থে নয়, সরকারেরও স্বার্থে কেবল নয়, গণতন্ত্রের স্বার্থে এবং বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার স্বার্থে। একটা সরকারের সাফল্য মানে তো কেবল সরকারেরই সাফল্য নয়, এর সঙ্গে জড়িত ১৫ কোটি মানুষের ভালোমন্দ।
এই সময়ে এই অহেতুক কবর-বিতর্ক, কটূক্তি, বেফাঁস মন্তব্য মোটেও কাম্য নয়।
কাজেই যে কথা আগে বলছিলাম, সেটা আরেকবার বলি, বহু পরিবর্তন সময়সাপেক্ষ, অর্থসাপেক্ষ, পদ্ধতিগত জটিলতায় ঘেরা। কিন্তু নিজেকে বদলাতে পয়সা লাগে না আর কথা বলতে একদমই পয়সা খরচ হয় না। কথা বলতে হলে ভালো কথাই বলা ভালো। সুন্দর করে যিনি কথা বলেন, তাঁকে সবাই পছন্দ করে, তিনি বহু কঠিন লড়াইও সহজে জিতে নেন। আর যিনি কটু কথা বলেন, অসৌজন্যমূলক কথা বলেন, তিনিও তাঁর কথার প্রতিফল হাতে হাতেই লাভ করেন। ১৬ শতকের ইংরেজ নাট্যকার যেমন সিমাস ম্যাকমানাস বলেছেন, ‘অনেকেই তাঁদের জিহ্বা দিয়ে নিজেদের নাক ভেঙেছেন।’
পরিবর্তনের পক্ষে যখন হাওয়া বইছে, তখন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেও পরিবর্তন আনতে হবে। বিরোধিতা থাকবেই, এর নামই রাজনীতি; কিন্তু সেই রাজনীতি হোক পরিশীলিত, সুভাষিত, সুরভিত।
আনিসুল হক: সহিত্যিক, সাংবাদিক।
ইশপ ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের রাজপরিবারের এক ক্রীতদাস। তিনি ছিলেন খুবই জ্ঞানী আর চালাক মানুষ। একদিন রানি তাঁকে ডেকে বললেন, ‘ইশপ, তুমি যত খুশি স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে যাও, আর আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে দামি খাবারটা রেঁধে এনে দাও।’
ঈশপ বাজারে গেলেন। তারপর পৃথিবীর সবচেয়ে দামি খাবার, সুন্দর খাবার বলে যা তার মনে হয়েছে, তাই কিনে এনে রান্না করে রানির টেবিল সাজিয়ে দিলেন।
রানি এলেন। বললেন, ‘দেখি তোমার সুন্দর খাবার। এসব কী?’
‘জিহ্বা, রানিমা।’
‘পৃথিবীতে এত কিছু থাকতে তুমি আমার জন্যে জিহ্বা রেঁধে এনেছ!’
‘রানিমা, জিহ্বাই হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে দামি জিনিস। এটা দিয়ে সুন্দর সুন্দর কথা বলে পৃথিবীটাকে সুন্দর করা যায়। এর চেয়ে দামি, এর চেয়ে সুন্দর খাবার আর কী হতে পারে?’
‘আচ্ছা। এসব সরাও। পৃথিবীর সবচেয়ে কুিসত খাবার কী হতে পারে, সেটা পরিবেশন করো দেখি।’
এবারও জিহ্বা দিয়েই ঈশপ টেবিল সাজালেন।
রানি বললেন, ‘এসব কী?’
‘জিহ্বা, মহারাজ্ঞী।’
‘আবার জিহ্বা কেন?’
‘জিহ্বা দিয়েই পৃথিবীর সবচেয়ে কুিসত কথাগুলো উচ্চারিত হয়, পৃথিবীটাকে এই জিহ্বাই অসুন্দর করে তোলে। তাই আবারও জিহ্বাই রাঁধতে হলো, মহারানি।’
২.
সারা পৃথিবীতেই পরিবর্তনের পক্ষে আওয়াজ উঠেছে। বাংলাদেশেও আমরা পরিবর্তনের পক্ষে কথা বলছি। প্রথম আলো বলছে, ‘বদলে যাও, বদলে দাও।’ বলছে, নিজেকে বদলানো সবচেয়ে কঠিন, ওই কাজটা আগে করতে হবে। পরিবর্তনের কথা বলে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে। তারা ঘোষণা করেছে দিনবদলের সনদ! এইখানেও কিন্তু বলতে হয় ওই কথাটাই, ‘আসুন, আগে নিজে বদলাই। তারপর অন্যদের বদলাতে বলি।’
এই দেশের বহু কিছু বদলাতে হবে, উন্নত করতে হবে। আমরা চাই যে আমাদের বিদ্যুত্ সমস্যার সমাধান হোক। কিন্তু হাজার চাইলেও সেটা এক দিনে করা সম্ভব হবে না। কিছুদিন সময় দিতেই হবে। আমরা চাই আমাদের উপকূলের মানুষগুলো নিরাপদ থাকুক। উপকূল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ যদি করতে হয়, আমরা চাইলেই সেটা আগামীকালই নির্মিত হবে না। সময় দিতে হবে। চাইলেই আমরা আগামীকালই ঢাকা শহরে ভূগর্ভস্থ রেল বা শত মাইলের উড়াল সেতু বানিয়ে ফেলতে পারব না। কিন্তু চাইলেই এই মুহূর্তে, এখনই একটা কাজ করে ফেলতে পারি, তা হলো কথা কম বলা এবং সুন্দর করে কথা বলার প্রতিজ্ঞা করা। আর সেই কাজটাও শুরু করতে হবে নেতৃত্ব থেকে।
এবার শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট যে এত বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে, তার পেছনে এক শ একটা কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে। সবচেয়ে বড় কারণ, আগের মেয়াদে বেগম জিয়ার জোট সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতা ও ধরাকে সরা জ্ঞান করার মনোভাব; কিন্তু তার সঙ্গে নতুন আরেকটা জিনিস ভোটের আগে যোগ হয়েছিল, মহাজোট নেত্রী শেখ হাসিনা অভূতপূর্ব বাকসংযমের পরিচয় দিয়েছিলেন। সেই সংযম তিনি বহু দিন রক্ষা করে চলে আমাদের মনে এই আশার জন্ম দিয়েছিলেন যে শেখ হাসিনা নিজেই বদলের সূচনা করছেন, তিনি নিজে বদলেছেন এবং পুরো জাতিকে দিনবদলের আলোর পথে যোগ দিতে অনুপ্রাণিত করছেন।
কিন্তু সম্প্রতি জাতীয় সংসদের ভেতরে ও বাইরে আমাদের জাতীয় নেতারা যে ভাষায় আর যে প্রসঙ্গে বাক্যবিনিময় করছেন, তাতে আমাদের মাথা হেঁট হয়ে আসছে। আমাদের জাতির সামনে কি আলোচনা করার মতো কোনো বিষয় নেই? আমাদের জাতীয় সংসদে কি আলোচনার যোগ্য কোনো সমস্যা নেই? আমরা কি সব সমস্যার সমাধান করে ফেলেছি? খুব ভালো কথা। তাহলে সমস্যা নয়, সাফল্যের কথাই শুনি। সুন্দর সুন্দর কবিতা, চমত্কার গৌরবগাথা, সুরভিত সব সুভাষণেই ভরে উঠুক আমাদের জাতীয় সংসদের ফ্লোর, আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের মাইক্রোফোন।
তার বদলে এ কী! কোন নেতার লাশ কোথায় আছে, আছে কি না, সেটা ডিএনএ টেস্ট করে দেখা হোক—পরস্পরবিরোধী দল দুটো পরস্পরের প্রতি এই নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়িতে মত্ত হয়েছে। এটা কি একটা বলবার মতো কথা? তাও জাতীয় নেতা-নেত্রীদের মুখে?
আরেকজন বড় নেতা, তিনি বাকসংযমের জন্যে এত দিন প্রশংসিত ছিলেন। বলে বসলেন, দুই নেত্রীর একজন মানুষ, আরেকজন... থাক। কাদা যত কম ঘাঁটা যায়, ততই ভালো।
এই সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে মানুষ, বড় আশায় বুক বেঁধে। এই মন্ত্রিসভায় নতুন ও প্রতিশ্রুতিশীল মুখগুলো দেখে অন্য অনেকেরই মতো এই লেখকও মুগ্ধবিস্ময়ে ভেবেছিল, দিনবদল কি সত্যিই শুরু হয়ে গেল! কিন্তু ক্ষমতাসীন হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলে বসলেন, সব গণ্ডগোল করছে কেবল বিরোধী দলের লোকেরা, তখনই এই কলমটা ধরতে হয়েছিল, লিখতে হয়েছিল—স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এটা কী বললেন! তারপর একাধিক লেখায় বলেছি, টেলিভিশনের ক্যামেরা দেখলেই মুখ খোলাটা বিপজ্জনক। কারণ হঠাত্ করে বলে বসা কথায় ভুল হয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক, আর কথা একবার বেরিয়ে গেলে তা থেকে সংঘটিত হতে পারে অনেক বড় বিপদ। কথা আসলে এটম বোমার মতোই। আমাদের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আগের সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর মতোই কথার জন্যে কার্টুনের চমত্কার বিষয় হয়ে উঠছেন।
কবি রফিক আজাদের একটা দারুণ কবিতা আছে, ‘গদ্যের গহন অরণ্যে হারিয়ে যাওয়া আমি এক দিগ-ভ্রান্ত পথিক’ নামে। তাতে তিনি লিখেছেন:
‘সবিস্ময়ে একদিন শুনি
খুব সুশ্রী এক নারী কথা বলছেন
তার প্রেমিকের উদ্দেশে, যেন গলগল করে
বমন করছেন অবিরল ধারায় ইট-গুঁড়ো-করা খোয়া,
উত্তরে প্রেমিক ছেলেটিও উচ্চারণ করছে
শপাং শপাং গদ্যের চাবুক।’
এইখানে প্রেমিক আর সুশ্রী নারীর বদলে আমরা যদি আমাদের নেতা-নেত্রীদের কথা বসাই, তাঁদের ভাষণের কথা বসাই, একই অর্থ দাঁড়াবে। আমাদের এই নেতারা কথা বলছেন নাকি ইটের গুঁড়ো ওগড়াচ্ছেন, নাকি নোংরা ঘাঁটছেন!
রফিক আজাদ ওই কবিতাতেই দুঃখ করেছেন,
‘এমন একটি দিন তো ছিলো, যখন পল্টন ময়দানে
সমবেত জনতার উদ্বেলিত চিত্তে অনায়াসে
আমাদের নেতারা কবিতার বীজ বপন করে যেতেন,
স্বপ্ন বুনে যেতেন।...
...একদা এই দেশকে বলা হতো
সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা বাঙলা--
বড়বেশি গদ্যচর্চা হচ্ছে আজকাল
প্রবাদপ্রসিদ্ধ এই দেশে।
যার ফলে আমরা একজন বজ্রকণ্ঠ, স্বপ্নদ্রষ্টা
নেতার পরিবর্তে পাচ্ছি অসংখ্য ছোটখাট গদ্যনেতা,
একজন সিরাজদ্দৌলার পরিবর্তে
অসংখ্য মীরজাফর...’
সত্যি তো, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ তো জমাট জলের মেঘের মতোই মায়া আর বজ্র বর্ষণ করত, কিন্তু তাঁর সাতই মার্চের অমোঘ ভাষণ থেকে কেউ একটাও কটূক্তি খুঁজে বের করতে পারবেন? বড় নেতা হতে হলে মনটা বড় হতে হয়, রুচিবোধ আর সৌজন্যবোধও তাঁর বড় হয়।
আরবিতে একটা প্রবাদ আছে, ‘যখন তুমি একটা কথা বলো, সেটা তোমাকে পরাজিত করে। আর যদি তুমি সেটা না বলো, তাহলে তুমি তাকে পরাজিত করো।’
৩.
মাননীয় নেতা-নেত্রীগণের প্রতি আমাদের আকুল আবেদন, এই নোংরা কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধ করুন। আমাদের তরুণ প্রজন্মের জন্যে উজ্জ্বল আদর্শ স্থাপন করুন। বিরোধী দল সংসদে যেতে চাইছে, আমরা চাই তারা সংসদে যাক। আমরা চাই সংসদে তাদের কথা বলতে দেওয়া হোক। আমরা জানি, তারা সংখ্যায় খুবই কম, কিন্তু মনে রাখতে হবে, তারাই বিরোধী মতের প্রতিনিধি। তাদের সমমর্যাদায় কথা বলতে দিতে হবে। সংসদ সদস্যের সংখ্যানুপাতে তারা কম, তবে প্রাপ্ত ভোটের হিসাবে তারা কমসংখ্যক মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে না। বা তারা যত কম ভোটই পাক না কেন, ওই কথাটা আমাদের গণতন্ত্রের মূল কথা বলে মেনে নিতে হবে যে ‘কেউ যদি বিরোধিতা করে, সে যদি একজনও হয়, আর আমি যদি তার মতের সঙ্গে একমত নাও হই, তার মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে আমি জীবন দিয়ে দেব।’
সংসদকে অর্থবহ করা দরকার বিরোধী দলের স্বার্থে নয়, সরকারেরও স্বার্থে কেবল নয়, গণতন্ত্রের স্বার্থে এবং বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার স্বার্থে। একটা সরকারের সাফল্য মানে তো কেবল সরকারেরই সাফল্য নয়, এর সঙ্গে জড়িত ১৫ কোটি মানুষের ভালোমন্দ।
এই সময়ে এই অহেতুক কবর-বিতর্ক, কটূক্তি, বেফাঁস মন্তব্য মোটেও কাম্য নয়।
কাজেই যে কথা আগে বলছিলাম, সেটা আরেকবার বলি, বহু পরিবর্তন সময়সাপেক্ষ, অর্থসাপেক্ষ, পদ্ধতিগত জটিলতায় ঘেরা। কিন্তু নিজেকে বদলাতে পয়সা লাগে না আর কথা বলতে একদমই পয়সা খরচ হয় না। কথা বলতে হলে ভালো কথাই বলা ভালো। সুন্দর করে যিনি কথা বলেন, তাঁকে সবাই পছন্দ করে, তিনি বহু কঠিন লড়াইও সহজে জিতে নেন। আর যিনি কটু কথা বলেন, অসৌজন্যমূলক কথা বলেন, তিনিও তাঁর কথার প্রতিফল হাতে হাতেই লাভ করেন। ১৬ শতকের ইংরেজ নাট্যকার যেমন সিমাস ম্যাকমানাস বলেছেন, ‘অনেকেই তাঁদের জিহ্বা দিয়ে নিজেদের নাক ভেঙেছেন।’
পরিবর্তনের পক্ষে যখন হাওয়া বইছে, তখন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেও পরিবর্তন আনতে হবে। বিরোধিতা থাকবেই, এর নামই রাজনীতি; কিন্তু সেই রাজনীতি হোক পরিশীলিত, সুভাষিত, সুরভিত।
আনিসুল হক: সহিত্যিক, সাংবাদিক।
No comments