দেশহীন মানুষের কথা-আমি জীবনে জীবন মেলাবার কথা বলেছিলাম by সঞ্জীব দ্রং
মাঝে মাঝে মনে হয় জীবন কত সুন্দর। আমরা আমাদের আসকিপাড়া গ্রামে প্রতিবছর ওয়ান্না উত্সব পালন করি। গ্রামের কৃষক, খেটেখাওয়া নারী-পুরুষ সবাই এতে অংশ নেন। সারা দিন তাঁরা আনন্দে-উত্সবে-নাচগানে মেতে ওঠেন, ঢোল-দামা-বাদ্য বাজান, তাত্ক্ষণিক বানিয়ে বানিয়ে গান করেন। পানাহার করেন।
গারো পাহাড়ের কোলে বেলা গড়িয়ে এলে হতদরিদ্র শীর্ণকায় এই মানুষগুলো একটু আবেগপ্রবণ হয়ে যায়, যেন কত দিন কত কাল তারা আনন্দ করতে পারেনি। তারা ঘরে ফেরার কথা ভুলে যায়, অনেকের ঘরে হয়তো ঠিকঠাক চাল নেই। অনেকে গাইতে গাইতে আমাকে জড়িয়ে ধরেন, সুর টেনে কথা বলেন। তখন মনে হয়, জীবনের এই মুহূর্তগুলো কত সুন্দর! আদিবাসী জীবনের চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে চলা দুঃখ-কষ্ট, বৈষম্য ও বঞ্চনার মধ্যেও বেঁচে থাকা কত সুন্দর।
এই আদিবাসীরা অসহায় ও গরিব অথচ চেহারায় দুঃখীভাব নেই। আমি তাদের আশাভরা কথা শোনাতে চেষ্টা করি। অথচ আমাকেই আক্রান্ত হতে হলো, তাও আবার ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের দ্বারা। ভেবেছিলাম, এই বেদনা নিয়ে লিখব না আমি। আবার ভাবলাম, লেখা দরকার। আমি তো লেখার মধ্য দিয়েই শক্তি খুঁজি, পরিবর্তন খুঁজি। আশায় থাকি, আরেকটি পৃথিবী গড়া সম্ভব। অন্য রকম একটি পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব, যেখানে মানুষ সত্য, ন্যায় ও সুন্দরের পক্ষে দাঁড়াবে। যা কিছু অন্ধকার, যা অন্যায়, যা মিথ্যা, তাকে বর্জন করবে। যারা অন্যায় করে আর যারা অন্যায় সহ্য করে, মানুষ উভয়কে ঘৃণা করবে। এখন না হোক, কোনো একদিন।
আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি এবং লেখালেখি শুরু করি, তখন গ্রাম থেকে উদ্বিগ্ন হয়ে বাবা আমাকে চিঠি লিখতেন বিপদের আশঙ্কা করে, মন খারাপ হলেও আমি যেন আদিবাসী ও সংখ্যালঘু মানুষের বেদনা ও বঞ্চনাকে নিয়তি হিসেবে মেনে নিই। এখানে আদিবাসীদের অধিকারের কথা বলা সহজ ও নিরাপদ কাজ নয়। তবুও বাবার কথা আমি শুনিনি। তিনি আমাকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করতেন। আমি বাড়ি গেলে পাশের বাড়ির পুরুষ অলিত ত্রিশাকে রাতে জেগে পাহারা দিতে বলতেন। অলিত ত্রিশার ওপর বাবার ভরসা ছিল না, তাই নিজেই জেগে থাকতেন। এভাবে একদিন তাঁর অস্থির ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত শরীর স্ট্রোক করল। তিনি মারা গেলেন ২০০৫ সালে, যখন আমি আমেরিকার ওয়াশিংটনে রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে। আমি ভাবি, তিনি আমাকে এত ভালোবাসতেন যে মৃত্যুর সময় আমাকে রেখে গেলেন দূরদেশে। বাবা বেঁচে থাকতে কোনো দিন আমি আক্রমণের শিকার হইনি। গত বছর অক্টোবরে আমি নরওয়ের ট্রমসো বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করি। ওখানেই পিস সেন্টার আছে, ওখানে নোবেল বিজয়ীরা গিয়ে মহাত্মা গান্ধীর ভাস্কর্যে মালা পরান। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি আদিবাসীদের কথা বলেন, আপনার দেশ তো ঝক্কিঝামেলার (ট্রাবলড) দেশ। আপনি কতটা নিরাপদ?’ আমি বলেছিলাম, আমার দেশের অনেক সুন্দর সুন্দর গল্পের কথা আপনারা জানেন না। ওখানে মানুষ এখনো অল্পতে খুশি এবং এখনো মানুষ পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে।
কী চেয়েছিলাম আমি? আদিবাসীরা মানুষের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকুক। ভূমি ও সম্পদের ওপর তাদের অধিকার থাকুক। তাদের পরিচয় শ্রদ্ধেয় ও সম্মানিত হোক। যে উন্নয়ন হবে, তা হোক মর্যাদাপূর্ণ, দয়া বা করুণার বিষয় নয়। একদিন পাহাড়ে, অরণ্যে গল্পের মতো জীবন ছিল তাদের। তখন পাহাড়ের ভূমিতে শুধু আদিবাসীরা ছিল। পাহাড়ের ঢালে জুমচাষ হতো; ধান, ভুট্টা, আদা, মারফা, কলা আরও কত কী। উত্সবে মাদল-দামা বাজত আর নাচ হতো কোমর জড়াজড়ি করে। কেউ তেমন সঞ্চয় করত না। কেউ বেশি ধান পেলে তা দিয়ে গ্রামবাসীকে খাওয়াত। এ রকমই জীবন ছিল। আদিবাসীদের মতো এত নির্মল আনন্দ করতে জানা সমাজ আমি দেখিনি। তারপর কোথা থেকে কত মানুষ এল। আদিবাসীদের ভূমির অধিকার চলে গেল। সব হারিয়ে আদিবাসী মানুষ বিপন্ন ও অসহায়। আদিবাসীদের মূল্যবোধ আক্রান্ত হলো, বাইরের নষ্ট মূল্যবোধ ঢুকে গেল তাদের সমাজে।
কী চেয়েছিলাম আমি? প্রশ্ন করেছিলাম, কেন ওরা দলে দলে দেশান্তরিত হলো? আদিবাসী ভাষায় ‘শোষণ’ বা ‘ধর্ষণ’ এসব শব্দের তো প্রতিশব্দই নেই। অথচ জনমভর ওরা শোষণের শিকার, তাদের মেয়েরা লাঞ্ছনা ও অপমানের শিকার হয়। ব্রিটিশ আমলে বিহারের এক ছোটলাট সাহেবের আত্মীয়কে এক মুন্ডা আদিবাসী বলেছিল, ‘তুই যদি ভালো গোরমেন, তবে আমাদের এত কষ্ট কেন?’ আমি আজও সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরছি।
অনেকের নিশ্চয় মনে আছে, লেখালেখির বাইরেও আমি দীর্ঘদিন ধরে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, একটি অসাম্প্র্রদায়িক, মুক্ত, মানবিক, উন্নত, গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য কাজ করে আসছিলাম। আমি সব সময় চেষ্টা করেছি মানুষের মঙ্গল হয়, কল্যাণ হয়—এ রকম কিছু করার। যা কিছু অসুন্দর, যা কিছু অন্ধকার, যা কিছু অশুভ ও অন্যায় তার বিরুদ্ধে সত্য সুন্দর ন্যায়ের পক্ষে থাকার চেষ্টা করেছি সব সময়।
অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আমাকেই বর্বরোচিত হামলার শিকার হতে হলো, যা আমি কখনো ভাবিনি। আমি সৌভাগ্যক্রমে ফিরে এসেছি, হয়তো বা কিছু পুণ্যকাজের জোরে। কারণ, যারা আমাকে আক্রমণ করেছে, তারা পয়সা দিয়ে আনা ভাড়াটে সন্ত্রাসী। তাদের সঙ্গে কোনোভাবেই আমার শত্রুতা থাকার কোনো কারণ নেই। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তাঁর ফেরা উপন্যাসে খুনিদের সম্পর্কে বলেছেন, যারা খুন করে তারা জানে না, একটা মানুষের মানে একটা জগত্।
হয়তো কেউ কেউ জানেন, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য শুধু জাতীয় পর্যায়ে নয়, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। কানাডা, ইউরোপ ও আমেরিকার সরকারসমূহের রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে আমি সফর করেছি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ বক্তৃতা করলাম সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের জন্য গত ডিসেম্বরে। আমার ওপরে যখন এ রকম প্রকাশ্য হামলা সম্ভব হয়, তখন সবাইকে বুঝতে হবে, অন্যদের অবস্থা কতটা নাজুক ও অসহায়। গরিব ও আদিবাসীরা আরও কতটা অসহায়। তবু যত দিন বেঁচে থাকব মানুষের জন্য কাজ করে যাব।
আমি জীবনের সঙ্গে জীবন মেলাবার চেষ্টা করেছিলাম। প্রাণে প্রাণ মেলাবার গান গেয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। ‘আমরা সুন্দরের অতন্দ্র প্রহরী’ গানটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক দলের দলীয় সংগীত ছিল। সব অনুষ্ঠানে সমবেত কণ্ঠে এ গান সবার আগে গাইতে হতো। সব মানুষকে আমি ভালোবাসতে চেয়েছি। কিন্তু পৃথিবী তো সব মানুষের জন্য সমান নিরাপদ, সুন্দর ও আনন্দময় নয়। আফগানিস্তানে যে মেয়েটি আজ জন্ম নিল, তার অধিকার কি সমান হবে আমস্টারডাম বা ওয়াশিংটনের নবজাত কন্যার মতো। অথবা ঢাকায় দামি হাসপাতালে জন্ম নেওয়া শিশুর সঙ্গে চিম্বুক বা গারো-খাসি পাহাড়ের কোনো দূরগ্রামে ভূমিষ্ঠ শিশু কি সমান মর্যাদা পাবে? পাবে না। তিস্তা বা ব্রহ্মপুত্রের পারের শিশুর মর্যাদা কি সমান? পৃথিবীতে ও রাষ্ট্রে বৈষম্য আছে এবং তা প্রবলতর হচ্ছে। আমি এই বৈষম্যপীড়িত সমাজকে প্রত্যাখ্যান করে সব মানুষের জন্য, তার সঙ্গে আদিবাসী মানুষের জন্য কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম। আমি স্বপ্ন দেখি এখনো, আরেকটি অন্য রকম সমাজ ও পৃথিবী গড়া সম্ভব।
আক্রান্ত হওয়ার পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত স্টেফান ফ্রয়াইনসহ অনেকে ফোন করেছেন, সমবেদনা জানিয়েছেন। নরওয়ের পিস সেন্টার থেকে ফোন করেছেন প্রফেসর টুনা ব্লেই। জার্মানি, ওয়াশিংটন, কোপেনহেগেন থেকে কতজন কত চিঠি লিখেছেন সরকারের কাছে। কয়েকজন লেখকবন্ধু কলাম লিখেছেন। ঢাকার নাগরিক সমাজ প্রতিবাদ-সমাবেশ করেছে। আজকাল রবীন্দ্রনাথের ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু বিরহ দহন লাগে’ গানের ভেতরের লাইনগুলোকে আমি একটু নিজের মতো করে গুনগুন করে উচ্চারণ করি, অন্যকে শোনাই। ‘আপনি হয়তো নদীতে ঢেউ দেখতে ভালোবাসেন, কিন্তু ঢেউ বেশিক্ষণ থাকে না, মিলায়ে যায়, মন খারাপ করবেন না, আবার জোরে বাতাস বইবে, ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভরে উঠবে নদী।’
এই আশায় আজও চেয়ে আছি। রাষ্ট্র যদি আদিবাসীদের পাশে না দাঁড়ায়, তাহলে ওদের যাওয়ার জায়গা কোথায়?
সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী
sanjeebdrong@gmail.com
এই আদিবাসীরা অসহায় ও গরিব অথচ চেহারায় দুঃখীভাব নেই। আমি তাদের আশাভরা কথা শোনাতে চেষ্টা করি। অথচ আমাকেই আক্রান্ত হতে হলো, তাও আবার ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের দ্বারা। ভেবেছিলাম, এই বেদনা নিয়ে লিখব না আমি। আবার ভাবলাম, লেখা দরকার। আমি তো লেখার মধ্য দিয়েই শক্তি খুঁজি, পরিবর্তন খুঁজি। আশায় থাকি, আরেকটি পৃথিবী গড়া সম্ভব। অন্য রকম একটি পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব, যেখানে মানুষ সত্য, ন্যায় ও সুন্দরের পক্ষে দাঁড়াবে। যা কিছু অন্ধকার, যা অন্যায়, যা মিথ্যা, তাকে বর্জন করবে। যারা অন্যায় করে আর যারা অন্যায় সহ্য করে, মানুষ উভয়কে ঘৃণা করবে। এখন না হোক, কোনো একদিন।
আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি এবং লেখালেখি শুরু করি, তখন গ্রাম থেকে উদ্বিগ্ন হয়ে বাবা আমাকে চিঠি লিখতেন বিপদের আশঙ্কা করে, মন খারাপ হলেও আমি যেন আদিবাসী ও সংখ্যালঘু মানুষের বেদনা ও বঞ্চনাকে নিয়তি হিসেবে মেনে নিই। এখানে আদিবাসীদের অধিকারের কথা বলা সহজ ও নিরাপদ কাজ নয়। তবুও বাবার কথা আমি শুনিনি। তিনি আমাকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করতেন। আমি বাড়ি গেলে পাশের বাড়ির পুরুষ অলিত ত্রিশাকে রাতে জেগে পাহারা দিতে বলতেন। অলিত ত্রিশার ওপর বাবার ভরসা ছিল না, তাই নিজেই জেগে থাকতেন। এভাবে একদিন তাঁর অস্থির ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত শরীর স্ট্রোক করল। তিনি মারা গেলেন ২০০৫ সালে, যখন আমি আমেরিকার ওয়াশিংটনে রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে। আমি ভাবি, তিনি আমাকে এত ভালোবাসতেন যে মৃত্যুর সময় আমাকে রেখে গেলেন দূরদেশে। বাবা বেঁচে থাকতে কোনো দিন আমি আক্রমণের শিকার হইনি। গত বছর অক্টোবরে আমি নরওয়ের ট্রমসো বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করি। ওখানেই পিস সেন্টার আছে, ওখানে নোবেল বিজয়ীরা গিয়ে মহাত্মা গান্ধীর ভাস্কর্যে মালা পরান। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি আদিবাসীদের কথা বলেন, আপনার দেশ তো ঝক্কিঝামেলার (ট্রাবলড) দেশ। আপনি কতটা নিরাপদ?’ আমি বলেছিলাম, আমার দেশের অনেক সুন্দর সুন্দর গল্পের কথা আপনারা জানেন না। ওখানে মানুষ এখনো অল্পতে খুশি এবং এখনো মানুষ পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে।
কী চেয়েছিলাম আমি? আদিবাসীরা মানুষের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকুক। ভূমি ও সম্পদের ওপর তাদের অধিকার থাকুক। তাদের পরিচয় শ্রদ্ধেয় ও সম্মানিত হোক। যে উন্নয়ন হবে, তা হোক মর্যাদাপূর্ণ, দয়া বা করুণার বিষয় নয়। একদিন পাহাড়ে, অরণ্যে গল্পের মতো জীবন ছিল তাদের। তখন পাহাড়ের ভূমিতে শুধু আদিবাসীরা ছিল। পাহাড়ের ঢালে জুমচাষ হতো; ধান, ভুট্টা, আদা, মারফা, কলা আরও কত কী। উত্সবে মাদল-দামা বাজত আর নাচ হতো কোমর জড়াজড়ি করে। কেউ তেমন সঞ্চয় করত না। কেউ বেশি ধান পেলে তা দিয়ে গ্রামবাসীকে খাওয়াত। এ রকমই জীবন ছিল। আদিবাসীদের মতো এত নির্মল আনন্দ করতে জানা সমাজ আমি দেখিনি। তারপর কোথা থেকে কত মানুষ এল। আদিবাসীদের ভূমির অধিকার চলে গেল। সব হারিয়ে আদিবাসী মানুষ বিপন্ন ও অসহায়। আদিবাসীদের মূল্যবোধ আক্রান্ত হলো, বাইরের নষ্ট মূল্যবোধ ঢুকে গেল তাদের সমাজে।
কী চেয়েছিলাম আমি? প্রশ্ন করেছিলাম, কেন ওরা দলে দলে দেশান্তরিত হলো? আদিবাসী ভাষায় ‘শোষণ’ বা ‘ধর্ষণ’ এসব শব্দের তো প্রতিশব্দই নেই। অথচ জনমভর ওরা শোষণের শিকার, তাদের মেয়েরা লাঞ্ছনা ও অপমানের শিকার হয়। ব্রিটিশ আমলে বিহারের এক ছোটলাট সাহেবের আত্মীয়কে এক মুন্ডা আদিবাসী বলেছিল, ‘তুই যদি ভালো গোরমেন, তবে আমাদের এত কষ্ট কেন?’ আমি আজও সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরছি।
অনেকের নিশ্চয় মনে আছে, লেখালেখির বাইরেও আমি দীর্ঘদিন ধরে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, একটি অসাম্প্র্রদায়িক, মুক্ত, মানবিক, উন্নত, গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য কাজ করে আসছিলাম। আমি সব সময় চেষ্টা করেছি মানুষের মঙ্গল হয়, কল্যাণ হয়—এ রকম কিছু করার। যা কিছু অসুন্দর, যা কিছু অন্ধকার, যা কিছু অশুভ ও অন্যায় তার বিরুদ্ধে সত্য সুন্দর ন্যায়ের পক্ষে থাকার চেষ্টা করেছি সব সময়।
অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আমাকেই বর্বরোচিত হামলার শিকার হতে হলো, যা আমি কখনো ভাবিনি। আমি সৌভাগ্যক্রমে ফিরে এসেছি, হয়তো বা কিছু পুণ্যকাজের জোরে। কারণ, যারা আমাকে আক্রমণ করেছে, তারা পয়সা দিয়ে আনা ভাড়াটে সন্ত্রাসী। তাদের সঙ্গে কোনোভাবেই আমার শত্রুতা থাকার কোনো কারণ নেই। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তাঁর ফেরা উপন্যাসে খুনিদের সম্পর্কে বলেছেন, যারা খুন করে তারা জানে না, একটা মানুষের মানে একটা জগত্।
হয়তো কেউ কেউ জানেন, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য শুধু জাতীয় পর্যায়ে নয়, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। কানাডা, ইউরোপ ও আমেরিকার সরকারসমূহের রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে আমি সফর করেছি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ বক্তৃতা করলাম সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের জন্য গত ডিসেম্বরে। আমার ওপরে যখন এ রকম প্রকাশ্য হামলা সম্ভব হয়, তখন সবাইকে বুঝতে হবে, অন্যদের অবস্থা কতটা নাজুক ও অসহায়। গরিব ও আদিবাসীরা আরও কতটা অসহায়। তবু যত দিন বেঁচে থাকব মানুষের জন্য কাজ করে যাব।
আমি জীবনের সঙ্গে জীবন মেলাবার চেষ্টা করেছিলাম। প্রাণে প্রাণ মেলাবার গান গেয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। ‘আমরা সুন্দরের অতন্দ্র প্রহরী’ গানটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক দলের দলীয় সংগীত ছিল। সব অনুষ্ঠানে সমবেত কণ্ঠে এ গান সবার আগে গাইতে হতো। সব মানুষকে আমি ভালোবাসতে চেয়েছি। কিন্তু পৃথিবী তো সব মানুষের জন্য সমান নিরাপদ, সুন্দর ও আনন্দময় নয়। আফগানিস্তানে যে মেয়েটি আজ জন্ম নিল, তার অধিকার কি সমান হবে আমস্টারডাম বা ওয়াশিংটনের নবজাত কন্যার মতো। অথবা ঢাকায় দামি হাসপাতালে জন্ম নেওয়া শিশুর সঙ্গে চিম্বুক বা গারো-খাসি পাহাড়ের কোনো দূরগ্রামে ভূমিষ্ঠ শিশু কি সমান মর্যাদা পাবে? পাবে না। তিস্তা বা ব্রহ্মপুত্রের পারের শিশুর মর্যাদা কি সমান? পৃথিবীতে ও রাষ্ট্রে বৈষম্য আছে এবং তা প্রবলতর হচ্ছে। আমি এই বৈষম্যপীড়িত সমাজকে প্রত্যাখ্যান করে সব মানুষের জন্য, তার সঙ্গে আদিবাসী মানুষের জন্য কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম। আমি স্বপ্ন দেখি এখনো, আরেকটি অন্য রকম সমাজ ও পৃথিবী গড়া সম্ভব।
আক্রান্ত হওয়ার পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত স্টেফান ফ্রয়াইনসহ অনেকে ফোন করেছেন, সমবেদনা জানিয়েছেন। নরওয়ের পিস সেন্টার থেকে ফোন করেছেন প্রফেসর টুনা ব্লেই। জার্মানি, ওয়াশিংটন, কোপেনহেগেন থেকে কতজন কত চিঠি লিখেছেন সরকারের কাছে। কয়েকজন লেখকবন্ধু কলাম লিখেছেন। ঢাকার নাগরিক সমাজ প্রতিবাদ-সমাবেশ করেছে। আজকাল রবীন্দ্রনাথের ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু বিরহ দহন লাগে’ গানের ভেতরের লাইনগুলোকে আমি একটু নিজের মতো করে গুনগুন করে উচ্চারণ করি, অন্যকে শোনাই। ‘আপনি হয়তো নদীতে ঢেউ দেখতে ভালোবাসেন, কিন্তু ঢেউ বেশিক্ষণ থাকে না, মিলায়ে যায়, মন খারাপ করবেন না, আবার জোরে বাতাস বইবে, ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভরে উঠবে নদী।’
এই আশায় আজও চেয়ে আছি। রাষ্ট্র যদি আদিবাসীদের পাশে না দাঁড়ায়, তাহলে ওদের যাওয়ার জায়গা কোথায়?
সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী
sanjeebdrong@gmail.com
No comments