বন্য প্রাণী সংরক্ষণ-বন্য প্রাণীর প্রতি বন্যতায় মনের সুন্দরই মরে যায় by খসরু চৌধুরী
আজকাল পত্রিকার পাতা খুললে প্রায়ই দেখা যায়, দেশের কোথাও না কোথাও গ্রামবাসী বন্য প্রাণী পিটিয়ে মেরেছে। নয়তো দু-চার দিন আটকে রেখে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে মেরে ফেলেছে। বন্য প্রাণীগুলোর অধিকাংশই মারা পড়ছে আমাদের গ্রামীণ জঙ্গল, বিল-হাওর অথবা সংরক্ষিত বনের আশপাশে।
বন্য প্রাণীর এ ধরনের ভাগ্যবরণ দেশবাসীকে ব্যথিত করে তোলে। কিছু ক্ষেত্রে আটক প্রাণীটি বন অধিদপ্তরের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। বন বিভাগের লোকজন সেটিকে কোনো সংরক্ষিত বনে ছেড়ে দিয়েছেন। খুব কম ক্ষেত্রেই বন্য প্রাণীর প্রতি মানুষের এ ধরনের ভালবাসার প্রকাশ ঘটে।
আমাদের দুর্ভাগ্য, এ পরিস্থিতির হঠাত্ উন্নয়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশে একটা সময় ছিল, প্রতিটি গ্রামেই পতিত এলাকা হিসেবে কবরস্থান, বাঁশঝাড়, ফলজগাছের মিশ্র বাগান, শ্মশানঘাট গ্রামবাসী রেখে দিত। গ্রামের দু-চারজন রাখাল, কবিরাজের চেলা ছাড়া সহসা কেউ এসব এলাকায় ঢুকত না। এ এলাকাগুলো হয়ে উঠেছিল গ্রামীণ বন্য প্রাণীর আদর্শ বাসস্থান। এ ধরনের পতিত এলাকা গত শতাব্দীর বিশের দশক পর্যন্ত বেশ বড়সড় আকারের ছিল। সেখানে ছোট বন্য প্রাণী ছাড়াও চিতাবাঘ ও শূকর আশ্রয় নিতে পারত। বিশের দশকে পাটচাষের বিস্তৃতি ঘটলে জঙ্গলের আয়তন ছোট হতে থাকে; চিতাবাঘ, শূকর বিলুপ্ত হয়ে যায়। গত শতাব্দীর সত্তরের দশক পর্যন্ত যেসব পতিত এলাকা টিকে ছিল, তাতে খেঁকশিয়াল, পাতিশিয়াল, ভাম, খাটাশ, বাগডাশ, ভোঁদড়, বনবিড়াল, খরগোশ, দুই ধরনের বেজি এমনকি দু-চারটি স্থানে বানর, হনুমানও বসবাস করতে পারত। আজকাল গাজীপুরের বর্মীবন্দর এলাকা, মাদারীপুরের চরমুগুরীয়া ছাড়া বানর এবং যশোরের আধাশহর কেশবপুর এলাকা ছাড়া হনুমান নেই বললেই চলে। গত শতাব্দীর সত্তর-আশির দশক পর্যন্ত ফরিদপুর ও যশোরের গ্রামগুলোতে ‘মাউস ডিয়ার’ বা খুরওয়ালা খরগোশ দেখা যেত। এখন আর সেগুলো দেখা যায় না।
গত ১৯৮৮ এবং ১৯৯৭ সালের ভয়াবহ বন্যায় দেশের বিশাল অংশ ডুবে যায়। উপদ্রুত মানুষ আশ্রয় নেয় অপেক্ষাকৃত উঁচু বাগানসহ পতিত এলাকাগুলোয়। ওইসব এলাকার বন্য প্রাণীগুলো মেরে ফেলা হয়। ফলে গ্রামীণ প্রাণীগুলোর অনেক প্রজাতিই গ্রাম থেকে লুপ্ত হয়ে যায়।
সাম্প্রতিক কালে সংরক্ষিত বনাঞ্চলগুলোতে মানুষের যাতায়াত বাড়ছে। গাছকাটা এখন নিত্যদিনের খবর। এর পরিণতিতে উদ্বাস্তু হচ্ছে বন্য প্রাণী। প্রায়ই বাগডাশ, মেছোবিড়াল, চিতাবিড়াল, বনবিড়াল, শেয়াল মারা পড়ার খবর আসছে। সীমান্ত এলাকায় চিতাবাঘও মারা পড়ছে দু-একটা। সুন্দরবনের বাঘও গ্রামে ঢুকে মারা পড়ছে। ঘটনাগুলো যখন প্রতিদিনের ব্যাপার হয়ে উঠছে, তখন এই মৃত্যুগুলো আমাদেরও গা-সহা হয়ে উঠছে। আমরা দুঃখিত হচ্ছি, আবার দিনান্তে ভুলেও যাচ্ছি।
কিন্তু এটা একটা সভ্য দেশের চালচিত্র হতে পারে না। আমাদের দৈনন্দিন জীবন অনেকটাই গ্রাস করছে যান্ত্রিকতা। মানবিক আবেগ অনেকটাই পরাস্ত। এটা সভ্যতার সংকট মেনেও আমরা আমাদের অন্তরের অন্তস্তলে বাঁচতে চাই—আনন্দ, বিস্ময় অবাক হওয়ার ক্ষমতা জীবন্ত রাখতে চাই। বন, বন্য প্রাণী এখনো আমাদের দিয়ে চলেছে বিস্মিত হওয়ার প্রাণদায়ী শক্তি। ফলে বন্য প্রাণী হারানো আমাদের ভেতরের সেই সুন্দর ও বিষ্ময়প্রেমী মানবিকতাকেই হারিয়ে ফেলারই অপর নাম। বন্য প্রাণীর প্রতি বন্যতায় মনের সুন্দরেরই মৃত্যু দেখি আজকাল। এটাও এক মানবিক বিপর্যয়।
পত্র-পত্রিকাগুলোর কল্যাণে দেশের শিক্ষিত জনগণ এখন বন্য প্রাণীর প্রতি অনেক সদয় ও সহনশীল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই জনগণ বনের পাশে বসবাস করে না, তারা বেশির ভাগই নগরবাসী। বন্য প্রাণীর অপমৃত্যুতে তাঁরা শুধু ব্যথিত হতে পারেন, এ মুহূর্তে আর কিছু করতে পারছেন না।
আমাদের বন অধিদপ্তরের বন্য প্রাণী সার্কেল খুবই দুর্বল। আহত বন্য প্রাণীর চিকিত্সা, পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তহবিল তাদের কাছে নেই। অথচ এ সমস্যা সমাধানের দায় তাদেরই।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগ অনিকেত বন্য প্রাণীদের জন্য উদ্ধারকেন্দ্র স্থাপন করে ধন্যবাদের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কিন্তু দেশের সামগ্রিক প্রয়োজনের তুলনায় এটা খুবই অপ্রতুল। তা ছাড়া দায়টাও পুরোপুরি তাদের নয়। এ ব্যাপারে বন অধিদপ্তরকেই বণ্যপ্রাণী রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। বছরচারেক আগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ার্স এলাকায় সরকারি পরিচালনায় এমনি একটি উদ্ধারকেন্দ্র দেখেছিলাম। এই এলাকাগুলোতে চিতাবাঘ প্রায়ই সংরক্ষিত জঙ্গল ছেড়ে আশপাশের চা-বাগানে ঢুকে শ্রমিকদের সঙ্গে হাতাহাতি করে। মানুষ-চিতাবাঘ উভয়ই মারা পড়ে। পশ্চিমবঙ্গের বন বিভাগ বনেরই কিছু অংশ লোহার শিক দিয়ে ঘিরে এসব চিতাবাঘের প্রাথমিক চিকিত্সা ও পুনর্বাসন করে। কিছু দিনের মধ্যে অন্য বিপদাপন্ন প্রাণীগুলোর সেখানে পুনর্বাসন করা হয়। দেখতে দেখতেই এলাকাটি পর্যটকদের জন্য একটি অবশ্য দর্শনীয় এলাকা হয়ে ওঠে। টিকিট কেটে দেখতে যেতে হয়।
এরই মধ্যে দেশের দুলাহাজরায় বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে বন্য প্রাণী প্রজনন ও সাফারির আয়োজন করা হয়েছে। আমাদের চিড়িয়াখানাগুলো অবিন্যস্ত, প্রাণীর জন্য জায়গাও নেই।
ঢাকা শহর থেকে দেড় ঘণ্টা গাড়িচলা দূরত্বে রয়েছে সিমলীপাড়ার শালের জঙ্গল। চারদিকের চাপে এখানে বন্য প্রাণী নেই বললেই চলে। এ এলাকাটি ঘিরে সাফারি ও বন্য প্রাণী উদ্ধারকেন্দ্র গড়ে তুলতে পারে বন বিভাগ। এই এলাকাটিতে উদ্ধারকেন্দ্র করা হলে এর পর্যটন-মূল্য অনেক বাড়বে। জঙ্গলের পাশে পর্যটকদের থাকার জন্য বেসরকারি উদ্যোক্তাদের আবাসনের এলাকা বরাদ্দ করা যেতে পারে। এর ফলে জঙ্গলটি যেমন বেঁচে যাবে, তেমনি বন্য প্রাণীও বাঁচার সুযোগ পাবে।
খসরু চৌধুরী: বন বিশেষজ্ঞ।
আমাদের দুর্ভাগ্য, এ পরিস্থিতির হঠাত্ উন্নয়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশে একটা সময় ছিল, প্রতিটি গ্রামেই পতিত এলাকা হিসেবে কবরস্থান, বাঁশঝাড়, ফলজগাছের মিশ্র বাগান, শ্মশানঘাট গ্রামবাসী রেখে দিত। গ্রামের দু-চারজন রাখাল, কবিরাজের চেলা ছাড়া সহসা কেউ এসব এলাকায় ঢুকত না। এ এলাকাগুলো হয়ে উঠেছিল গ্রামীণ বন্য প্রাণীর আদর্শ বাসস্থান। এ ধরনের পতিত এলাকা গত শতাব্দীর বিশের দশক পর্যন্ত বেশ বড়সড় আকারের ছিল। সেখানে ছোট বন্য প্রাণী ছাড়াও চিতাবাঘ ও শূকর আশ্রয় নিতে পারত। বিশের দশকে পাটচাষের বিস্তৃতি ঘটলে জঙ্গলের আয়তন ছোট হতে থাকে; চিতাবাঘ, শূকর বিলুপ্ত হয়ে যায়। গত শতাব্দীর সত্তরের দশক পর্যন্ত যেসব পতিত এলাকা টিকে ছিল, তাতে খেঁকশিয়াল, পাতিশিয়াল, ভাম, খাটাশ, বাগডাশ, ভোঁদড়, বনবিড়াল, খরগোশ, দুই ধরনের বেজি এমনকি দু-চারটি স্থানে বানর, হনুমানও বসবাস করতে পারত। আজকাল গাজীপুরের বর্মীবন্দর এলাকা, মাদারীপুরের চরমুগুরীয়া ছাড়া বানর এবং যশোরের আধাশহর কেশবপুর এলাকা ছাড়া হনুমান নেই বললেই চলে। গত শতাব্দীর সত্তর-আশির দশক পর্যন্ত ফরিদপুর ও যশোরের গ্রামগুলোতে ‘মাউস ডিয়ার’ বা খুরওয়ালা খরগোশ দেখা যেত। এখন আর সেগুলো দেখা যায় না।
গত ১৯৮৮ এবং ১৯৯৭ সালের ভয়াবহ বন্যায় দেশের বিশাল অংশ ডুবে যায়। উপদ্রুত মানুষ আশ্রয় নেয় অপেক্ষাকৃত উঁচু বাগানসহ পতিত এলাকাগুলোয়। ওইসব এলাকার বন্য প্রাণীগুলো মেরে ফেলা হয়। ফলে গ্রামীণ প্রাণীগুলোর অনেক প্রজাতিই গ্রাম থেকে লুপ্ত হয়ে যায়।
সাম্প্রতিক কালে সংরক্ষিত বনাঞ্চলগুলোতে মানুষের যাতায়াত বাড়ছে। গাছকাটা এখন নিত্যদিনের খবর। এর পরিণতিতে উদ্বাস্তু হচ্ছে বন্য প্রাণী। প্রায়ই বাগডাশ, মেছোবিড়াল, চিতাবিড়াল, বনবিড়াল, শেয়াল মারা পড়ার খবর আসছে। সীমান্ত এলাকায় চিতাবাঘও মারা পড়ছে দু-একটা। সুন্দরবনের বাঘও গ্রামে ঢুকে মারা পড়ছে। ঘটনাগুলো যখন প্রতিদিনের ব্যাপার হয়ে উঠছে, তখন এই মৃত্যুগুলো আমাদেরও গা-সহা হয়ে উঠছে। আমরা দুঃখিত হচ্ছি, আবার দিনান্তে ভুলেও যাচ্ছি।
কিন্তু এটা একটা সভ্য দেশের চালচিত্র হতে পারে না। আমাদের দৈনন্দিন জীবন অনেকটাই গ্রাস করছে যান্ত্রিকতা। মানবিক আবেগ অনেকটাই পরাস্ত। এটা সভ্যতার সংকট মেনেও আমরা আমাদের অন্তরের অন্তস্তলে বাঁচতে চাই—আনন্দ, বিস্ময় অবাক হওয়ার ক্ষমতা জীবন্ত রাখতে চাই। বন, বন্য প্রাণী এখনো আমাদের দিয়ে চলেছে বিস্মিত হওয়ার প্রাণদায়ী শক্তি। ফলে বন্য প্রাণী হারানো আমাদের ভেতরের সেই সুন্দর ও বিষ্ময়প্রেমী মানবিকতাকেই হারিয়ে ফেলারই অপর নাম। বন্য প্রাণীর প্রতি বন্যতায় মনের সুন্দরেরই মৃত্যু দেখি আজকাল। এটাও এক মানবিক বিপর্যয়।
পত্র-পত্রিকাগুলোর কল্যাণে দেশের শিক্ষিত জনগণ এখন বন্য প্রাণীর প্রতি অনেক সদয় ও সহনশীল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই জনগণ বনের পাশে বসবাস করে না, তারা বেশির ভাগই নগরবাসী। বন্য প্রাণীর অপমৃত্যুতে তাঁরা শুধু ব্যথিত হতে পারেন, এ মুহূর্তে আর কিছু করতে পারছেন না।
আমাদের বন অধিদপ্তরের বন্য প্রাণী সার্কেল খুবই দুর্বল। আহত বন্য প্রাণীর চিকিত্সা, পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তহবিল তাদের কাছে নেই। অথচ এ সমস্যা সমাধানের দায় তাদেরই।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগ অনিকেত বন্য প্রাণীদের জন্য উদ্ধারকেন্দ্র স্থাপন করে ধন্যবাদের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কিন্তু দেশের সামগ্রিক প্রয়োজনের তুলনায় এটা খুবই অপ্রতুল। তা ছাড়া দায়টাও পুরোপুরি তাদের নয়। এ ব্যাপারে বন অধিদপ্তরকেই বণ্যপ্রাণী রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। বছরচারেক আগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ার্স এলাকায় সরকারি পরিচালনায় এমনি একটি উদ্ধারকেন্দ্র দেখেছিলাম। এই এলাকাগুলোতে চিতাবাঘ প্রায়ই সংরক্ষিত জঙ্গল ছেড়ে আশপাশের চা-বাগানে ঢুকে শ্রমিকদের সঙ্গে হাতাহাতি করে। মানুষ-চিতাবাঘ উভয়ই মারা পড়ে। পশ্চিমবঙ্গের বন বিভাগ বনেরই কিছু অংশ লোহার শিক দিয়ে ঘিরে এসব চিতাবাঘের প্রাথমিক চিকিত্সা ও পুনর্বাসন করে। কিছু দিনের মধ্যে অন্য বিপদাপন্ন প্রাণীগুলোর সেখানে পুনর্বাসন করা হয়। দেখতে দেখতেই এলাকাটি পর্যটকদের জন্য একটি অবশ্য দর্শনীয় এলাকা হয়ে ওঠে। টিকিট কেটে দেখতে যেতে হয়।
এরই মধ্যে দেশের দুলাহাজরায় বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে বন্য প্রাণী প্রজনন ও সাফারির আয়োজন করা হয়েছে। আমাদের চিড়িয়াখানাগুলো অবিন্যস্ত, প্রাণীর জন্য জায়গাও নেই।
ঢাকা শহর থেকে দেড় ঘণ্টা গাড়িচলা দূরত্বে রয়েছে সিমলীপাড়ার শালের জঙ্গল। চারদিকের চাপে এখানে বন্য প্রাণী নেই বললেই চলে। এ এলাকাটি ঘিরে সাফারি ও বন্য প্রাণী উদ্ধারকেন্দ্র গড়ে তুলতে পারে বন বিভাগ। এই এলাকাটিতে উদ্ধারকেন্দ্র করা হলে এর পর্যটন-মূল্য অনেক বাড়বে। জঙ্গলের পাশে পর্যটকদের থাকার জন্য বেসরকারি উদ্যোক্তাদের আবাসনের এলাকা বরাদ্দ করা যেতে পারে। এর ফলে জঙ্গলটি যেমন বেঁচে যাবে, তেমনি বন্য প্রাণীও বাঁচার সুযোগ পাবে।
খসরু চৌধুরী: বন বিশেষজ্ঞ।
No comments