এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা by প্রকৌশলী এসএম ফজলে আলী
বাংলাদেশের স্বাধীনতা শুধু ১৯৭১ সালের সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে—তা কিন্তু নয়। মীরজাফরদের চক্রান্তে ১৭৫৭ সালে এ দেশের স্বাধীনতা হারাবার পরপরই একদল মুজাহিদ বিচ্ছিন্নভাবে হলেও স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে আসতে থাকেন।
রায় বেরলভীর মুক্তি সংগ্রাম, শহীদ তিতুমীরের বৃটিশবিরোধী সংগ্রাম, যা বাঁশের কেল্লা নামে পরিচিত ছিল। এর পরে মাকুশাঁ, ফকির আন্দোলন এসব কিছুই উপমহাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পথে যথেষ্ট শক্তি যুগিয়েছে। এই উপমহাদেশের ঘুমন্ত মানুষকে জাগ্রত করতে ওইসব আন্দোলনের প্রয়োজন ছিল। এরপর সিপাহী বিদ্রোহে সারা ভারতে স্বাধীনতার জন্য মানুষ জেগে ওঠে। তখন থেকে রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগ্রাম যুগপত্ চলতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন যখন কাবু হয়ে পড়ে তখন এদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের কাছে ব্রিটিশ সরকার মাথানত করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৪৭ সালে ব্রিটেনের চিরাচরিত উরারফব ধহফ জঁষব পদ্ধতিতে এ উপমহাদেশকে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র করে যায়। তারা এ উপমহাদেশকে সত্উদ্দেশ্যে বিভক্ত করে যায়নি। বরং হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে যায়। চাণক্যনীতি প্রয়োগ করে কাশ্মীরকে স্বাধীনতা না দিয়ে ভারতকে এটা জবরদখল করে নেয়ার সুযোগ করে দেয়। পূর্বাঞ্চলে বর্তমান বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম নিয়ে আরেকটি রাষ্ট্র হওয়ার সব উপাদান থাকা সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকার তা না করে পূর্ববঙ্গকে পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে দেয়। আর ওদিকে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামকে হিন্দুস্থানের সঙ্গে যুক্ত করে দেয়। ফল হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ববঙ্গকে শোষণ-শাসন করতে থাকে। একইভাবে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামকে দিল্লি সরকার শোষণ করতে থাকে। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের বৈষম্য ও শোষণের শিকার হয়। আর ওদিকে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের লোকও স্বাধীনতার সুখ পেল না। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ শোষণ-বঞ্চনায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠে এবং ১৯৭০ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা সত্ত্বেও তাদের সরকার গঠন করতে না দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকা শহরে এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায় পশ্চিম পাকিস্তানের হায়েনারা। এর আগে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন, ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন ইত্যাদি বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতামুখী করে তোলে। তাই ২৫ মার্চ রাতের নারকীয় হত্যাকাণ্ডে সারা বাংলাদেশ গর্জে ওঠে। আর নয় পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকদের সঙ্গে এক সঙ্গে বাস করা। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণা অনুযায়ী এবং ২৫ মার্চের পাশবিক নির্যাতনের কারণে বাঙালি সৈন্যরা মেজর জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধের আহ্বানে সারা জাতি স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের হাতে তেমন অস্ত্র ছিল না, কিন্তু ছিল স্বাধীনতালাভের জন্য দুর্দান্ত মনোবল। স্বাধীনতাপাগল মানুষ প্রায় খালি হাতেও ট্যাকটিক্যাল যুদ্ধে সম্মুখসমরে এগিয়ে যায়। হানাদার বাহিনীর পোড়ামাটি নীতির কারণে গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস করে ও লাখ লাখ নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। আর মুক্তিবাহিনীর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র না থাকায় তাদের স্বাধীনতার জন্য মূল্য দিতে হয়। অসংখ্য মানুষ এ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। ৯ মাসের এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে ৩০ লাখ বাংলাদেশী শহীদ হন। সে জন্যই বলা হয়, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা। মাত্র ৯ মাসে পাকিস্তানের মতো বিশ্বখ্যাত সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা শুধু বাঙালি মানুষদের দ্বারাই সম্ভব।
স্বাধীনতার শেষ প্রান্তে ভারতীয় সৈন্য পিছন ফ্রন্টে থেকে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছে এবং আমাদের স্বাধীনতা দ্রুত অর্জনে সহায়তা করেছে ঠিকই, কিন্তু তারা আমাদের স্বাধীনতার জন্যই যুদ্ধ করেনি। এর আগে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতীয় সৈন্য ২ বার যুদ্ধ করে কিছুই অর্জন করতে পারেনি। ভারতের নীতি ছিল পুরো উপমহাদেশসহ আশপাশের রাষ্ট্রগুলো গ্রাস করে মহাভারতের সেই মহারাষ্ট্র সৃষ্টি করা। ‘ভারত সন্ধানে নেহেরু উরংপড়াবত্ু ওহফরধ’ বস্তুত সেরকম ইঙ্গিতই দেয়। তারা দেখল পাকিস্তানকে দু’টুকরা করার এটাই মোক্ষম সময়। পাকিস্তানকে দু’টুকরা করতে পারলে পাকিস্তান একটি দুর্বল রাষ্ট্র হবে। তখন সে ভারতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারবে না। এ হিসাব-নিকাশে ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে যুদ্ধে নামে। আসলে হয়েছেও তাই। পাকিস্তান আজ অনেক দুর্বল। ভারতের সঙ্গে টেক্কা দেয়ার মতো তার শক্তি নেই। বর্তমানে ভারতের চালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনায় পাকিস্তান অভ্যন্তরে আজ তালেবান ও আল কায়দাদের ধ্বংস করার ঘেরাটোপে আটকা পড়েছে। পশ্চিমাদের তথাকথিত সন্ত্রাসীদের ধ্বংস করতে গিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে পাকিস্তানের টানাটানি। এখন ভারতের ‘র’ ইসরাইলের মোসাদ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ একাট্টা হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। তাই পাকিস্তানের ভবিষ্যত্ আরেকটি আফগানিস্তান বা ইরাকে পরিণত হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা আছে।
যা বলা হচ্ছিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পরমুহূর্ত থেকে ভারত আমাদের সঙ্গে যে আচরণ করে আসছে তা কোনোভাবেই বন্ধুসুলভ নয়। স্বাধীনতার পরপরই আমাদের অফিস-আদালত, শিল্প-কারখানা থেকে তারা যে জিনিসপত্র লুট করেছে তা কল্পনাতীত। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে প্রায় সব যখন ধ্বংস তখন বাকি জিনিস ভারতীয় সেনাবাহিনী ও সরকারের প্রশ্রয়ে ভারতীয়রা লুট করেছে। ক্যান্টনমেন্ট থেকে সব সমরাস্ত্র ভারতে নিয়ে গেল। তখনকার বাংলাদেশ সরকার কিছুই বলল না। মেজর জলিল যশোর ও খুলনার সমরাস্ত্র লুট করার কাজে বাধা দেয়ায় তাকে সেনাবাহিনী থেকে পদচ্যুত করা হলো। তিনি ছিলেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সেক্টর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা। ভারতীয় সেনাবাহিনীর লুণ্ঠনের প্রত্যক্ষদর্শী আমি নিজে। তখন আমি জিকে প্রকল্পে (এক চত্ড়লবপঃ) ঝিনাইদহ ও ওয়াপদা বিভাগের সাব-ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার ছিলাম। স্বাধীনতার পরপরই অফিসে গিয়ে দেখি অফিসের চেয়ার, টেবিল, আলমিরা, টাইপরাইটার মেশিনসহ সবকিছুই উধাও। সেখানে দুটো ডিভিশনও ছিল। সব অফিসের একই হাল। একদিন ভারতের এক মেজর এসে জিজ্ঞেস করল, সব ঠিক আছে তো। নির্বাহী প্রকৌশলী কিছু না বললেও আমি জবাব দিলাম— হ্যাঁ সব ঠিক আছে বটে, আমাদের অফিস করার মতো টেবিল, চেয়ার সব উধাও। দেখনা আমরা কেমন দাঁড়িয়ে আছি। তিনি আমার কথার ঝাঁঝ বুঝতে পেরে বললেন—চিন্তা করো না—আমরা তোমাদের একশত কোটি টাকা ঋণ দেব। কী সুন্দর জবাব! একেই বলে ‘গরু মেরে জুতা দান’। তখন বর্ডার ছিল উন্মুক্ত। বাজারে যত বিদেশি মালামাল ছিল ভারতীয় সৈন্যরা তা লুফে নিয়ে যায়। ভারতে বিদেশি মালামালের আমদানিতে কড়াকড়ি থাকায় তারা বুভুক্ষুর মতো দোকান থেকে নিয়ে যায়।
ভারত শুরুতেই বাংলাদেশের সঙ্গে এ আচরণ করে আসছে। স্বাধীনতার আগে থেকেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের কংগ্রেস পার্টির সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল। সাধারণ মানুষ আশা করেছিল আওয়ামী লীগ তাদের এ সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তুলবে। কিন্তু ফল দেখা গেল উল্টো। তারা বাংলাদেশের বাজার দখল করে নিল। পাকিস্তান আমলে যে শিল্প ছিল তা বাজার না পাওয়ায় বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। ভারতের প্ররোচনায় সব কলকারখানা জাতীয়করণ করে দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে লেজেগোবরে পরিণত করা হল। শিল্প-কারখানা গুণ্ডাপাণ্ডাদের লুটপাটের চারণভূমিতে পরিণত হলো। পাকিস্তান আমলে যা কিছু শিল্প গড়ে উঠেছিল তাও ধ্বংস হলো। দক্ষ ব্যবস্থাপনা না থাকায় একদল শ্রমিক নেতা ভুঁইফোড়ের মতো গড়ে উঠল, যারা লুটপাট ছাড়া আর কিছুই বুঝত না। এতে করে ভারতের ইচ্ছাই পূর্ণ হলো। তারা চেয়েছিল বাংলাদেশকে তাদের পশ্চাত্ভূমি হিসেবে। সরকারও সেই মোতাবেক চলছিল।
এদিকে ইন্দিরা গান্ধী শেখ মুজিবের কাছ থেকে প্রায় ১৫০ বর্গকিলোমিটারের বেরুবাড়ী নিয়ে নিলেন। আমাদের আঙ্গরপোতা দহগ্রাম ছিটমহলের সঙ্গে মূলভূমির সংযোগের জন্য যে মাত্র ১৮৫ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১৬৪ মিটার প্রস্থের করিডোর দেয়ার কথা ছিল এত বছর পার হয়ে গেলেও আজও তা বুঝিয়ে দেয়নি। ফলে প্রায় দশ হাজার বাংলাদেশি সেখানে মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাদের না আছে শিক্ষা, না আছে স্বাস্থ্যসেবা, না হচ্ছে কোনো সামাজিক উন্নয়ন। তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের কাছ থেকে ইন্দিরা গান্ধী ফারাক্কা বাঁধ মাত্র দশ দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার অনুরোধ করায় তাতে শেখ মুজিব রাজি হন। এটা ১৯৭৩ সালে চালু হওয়ার পর আর কোনো দিন বন্ধ হয়নি। আন্তর্জাতিক নীতি অনুযায়ী অভিন্ন নদীর পানি সমতার ভিত্তিতে ব্যবহার করার কথা। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ কোনো দিনই তার প্রাপ্য পানি পায়নি। ফলে আজ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চল মরুভূমি হতে যাচ্ছে। নদী নাব্যতা হারিয়েছে। নদীর বুকে বিরাট বিরাট চর পড়ছে। জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। আজ আমাদের প্রধান নদী পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার এ হাল। ওদিকে আমাদের প্রকৌশলীদের দ্বারা তৈরি তিস্তা ব্যারাজ বন্ধ হওয়ার উপক্রম পানির অভাবে। তিস্তা নদীর ৭০ মাইল উজানে ভারত গজল ডোবায় বাঁধ দিয়ে একতরফাভাবে পানি নিয়ে যাচ্ছে। এতে আমাদের তিস্তা প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৩০ লাখ হেক্টর জমির চাষবাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ফারাক্কার মতো দেশের উত্তরাঞ্চলের এক-তৃতীয়াংশ মরুকরণের পথে। জেআরসির মাধ্যমে বাংলাদেশ বিগত ২০ বছর যাবত্ তিস্তার পানি ভাগাভাগি করে ব্যবহারের বিষয় বলে আসলেও ভারত তাতে কোনো সাড়া দিচ্ছে না। ওদিকে নতুনভাবে টিপাইমুখ বাঁধ দিয়ে আমাদের পূর্বাঞ্চলের বিরাট এলাকা পানিশূন্য করতে যাচ্ছে। এরূপ ৫৩টি অভিন্ন নদীর পানি ভারত তার নিজের সুবিধার জন্য প্রত্যাহার করছে। এদিকে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ পানির অভাবে মরুভূমিতে পরিণত হবে এবং ১৫ কোটি লোক সুপেয় পানিসহ খাদ্যাভাবে পড়বে, সেটা ভারত বিবেচনায় আনতেই চায় না।
ভারত আমাদের দ্বীপ তালপট্টি দেড়যুগ আগে অবৈধভাবে দখল করে আছে। র্যাডক্লিফের অনুযায়ী হারিয়াভাঙ্গা নদীর জলস্রোতের মধ্যভাগ ধরলে তালপট্টি দ্বীপটি নদীর পূর্ব পাশে পড়ে। সে মোতাবেক এটা বাংলাদেশের দ্বীপ। অথচ আন্তর্জাতিক বিধিবিধান উপেক্ষা করে ভারত তা দখল করে আছে। বর্তমান সরকার এ ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্য করছে না।
ভারত বাংলাদেশের ওপর দিয়ে করিডোর চেয়ে আসছে ১৯৭৪ সাল থেকে। কিন্তু আগের কোনো সরকারই তা দেয়নি জাতীয় নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে। ভারত যেভাবে করিডোর চায়, তাতে বাংলাদেশ পাঁচটি টুকরা হয়ে যাবে। বাংলাবান্ধা থেকে যমুনা ব্রিজ-গাজীপুর-ঢাকা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আখাউড়া জংশন-তামাবিল হয়ে পূর্ব ভারতে এবং আরেকটি হবে বেনাপোল সীমান্ত থেকে যমুনা ব্রিজ-গাজীপুর-ভৈরব-আখাউড়া-তামাবিল-ভারতীয় বর্ডার পর্যন্ত। আগে করিডোর চাইলেও এখন ভোল পাল্টিয়ে এশিয়ান হাইওয়ের মোড়কে এটা বাংলাদেশকে গিলাতে চাচ্ছে। ওদিকে চিটাগাং পোর্ট ব্যবহার করার নতুন আবদার তুলেছে ভারত; তার মালামাল চিটাগাং সমুদ্রবন্দরে খালাস করে সড়ক ও রেল যোগাযোগের মাধ্যমে পূর্ব ভারতে পাঠাতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশ-নেপাল দীর্ঘ তিন যুগ ধরে ভারতকে অনুরোধ করে আসছে যে, তাদের মাত্র ২৩ মাইল করিডোর পেলে স্থলবেষ্টিত নেপাল মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে পারে। তাতে তার পণ্য আমদানির পরিবহন খরচ অনেক কমে যাবে এবং নেপাল-বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বহুগুণ বেড়ে যাবে। কিন্তু ভারত বিরাট দেশ, সামরিক শক্তিতে মহাবলীয়ান হয়ে নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে তা দিচ্ছে না। তারা দাবি করছে, ১৫০০ কিলোমিটারেরও বেশি করিডোর। এই বিরাট করিডোরের নিরাপত্তা কীভাবে আমাদের মতো একটি দুর্বল রাষ্ট্র রক্ষা করবে? ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে বেশ কয়েকটি স্বাধীনতাকামী দল সক্রিয়। তারা এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতীয় সামরিক সরঞ্জাম ও সৈন্যবাহিনী যাতায়াত করলে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তাদের লোকদের হেনস্তা করলে বাংলাদেশও তাদের টার্গেটে পরিণত হবে। ভারত তখন নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে বাংলাদেশে সৈন্য সমাবেশ করলে তা ঠেকাবে কে? এছাড়া আমাদের সমুদ্রসীমা অগ্রাহ্য করে ভারত প্রায় ২৮০০ বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসীমা দখল করে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান চালাচ্ছে। সঙ্গে নিয়েছে মিয়ানমারকে। তারাও আমাদের প্রায় ৩১,০০০ বর্গকিলোমিটার তাদের বলে দাবি করছে। তার কারিগরি সার্ভে ভারতীয় বিশেষজ্ঞ করে দিয়েছে এবং উভয়ই যৌথভাবে বাংলাদেশের ওপর চাপ দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া ভারত একতরফাভাবে বাংলাদেশের বাজারে তাদের পণ্য বৈধ-অবৈধভাবে চালান দিয়ে বাণিজ্যে বিরাট ব্যবধান সৃষ্টি করে যাচ্ছে। আর আমাদের পণ্য ভারতে পাঠাতে গেলে বিবিধ ট্রেড ব্যারিয়ার দিয়ে তা ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না।
অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় আনতে ভারতের ‘র’ (জঅড) এবং ইসরাইলের মোসাদের সূক্ষ্ম ভূমিকা ছিল। তাই সে ঋণ শোধ করার জন্য শেখ হাসিনার সরকার উঠেপড়ে লেগেছে। তার সরকারের মন্ত্রীরা ভারত বন্দনা শুরু করেছেন। যোগাযোগমন্ত্রী বলছেন, ভারতকে করিডোর দিলে বাংলাদেশ আর্থিকভাবে লাভবান হবে। পানিসম্পদমন্ত্রী বলছেন, টিপাইমুখ বাঁধে আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না, বরং আমরা বিদ্যুত্ পাব। বাণিজ্যমন্ত্রী বলছেন, ভারত আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তারা আমাদের ক্ষতি করতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ভারত সফর করে আসলেন, তাতে বাংলাদেশের কি উপকার হলো? তিনি পানি সমস্যার কোনো কথাই বলেননি। বাণিজ্যে ভারসাম্য আনার ব্যাপারে তেমন উচ্চবাচ্য নেই। সমুদ্রসীমা নির্ধারণের দিকনির্দেশনা নেই। করিডোর দেয়ার সম্মতি থাকলেও নেপাল-ভুটানের করিডোর পাওয়ার কোনো ওয়াদা নেই, আছে শুধু আশ্বাস। যে ভারত চুক্তি করে সে মোতাবেক নদীর পানির হিস্যা দিচ্ছে না, তাদের সে আশ্বাসবাণী বাংলাদেশের কোনো কাজে আসবে কি? ভারতের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে দশ বছর আগে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, টিপাইমুখ বাঁধে বাংলাদেশের ক্ষতি হয় তেমন কাজ ভারত করবে না। তারা কি বাংলাদেশের কী কী ক্ষতি হতে পারে, তা জরিপ করে দেখেছে? বা টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ কি বন্ধ রেখেছে? বেরুবাড়ী এককথায় নিয়ে গেলেও ভারত কি তিনবিঘা করিডোর আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে? এসব কারণে বাংলাদেশের মানুষ ভারতকে আস্থায় নিতে পারছে না। শুধু বাংলাদেশ নয়, এ অঞ্চলের সার্কভুক্ত কোনো দেশের সঙ্গেই ভারতের সুসম্পর্ক নেই। বিশাল শক্তিধর ভারতের কাছে তার ক্ষুদ্র প্রতিবেশীরা চায় সহযোগিতা ও নিরাপত্তা। কিন্তু ভারত সেরকম কোনো পরিবেশ আজ পর্যন্ত তৈরি করতে পারেনি। তার প্রতিটি কার্যক্রম প্রতিবেশীদের জন্য সন্দেহের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত যদি বড় ভাইসুলভ আচরণ করত এবং ছোট ভাইদের সুবিধা-অসুবিধা অনুধাবন করে উদারতার হাত বাড়িয়ে দিত, তাহলে এ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর অনেক উন্নতি হতো। সার্ককে অকার্যকর করে রেখেছে ভারত।
আর সেই ভারতের সঙ্গে বর্তমান সরকার যেভাবে হরিহর আত্মার ভাব দেখাচ্ছে, তাতেই দেশের জনগণ শঙ্কিত। আমরা চাই সমতার ভিত্তিতে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক। ভারত বিরাট দেশ। তার সামরিক শক্তি অনেক। তাই বলে তার প্রতিবেশীদের উপেক্ষা করতে পারে না। চীন তার প্রতিবেশীদের সর্বতোভাবে সহায়তা করছে। অন্যান্য দেশও তাই করছে। আমরাও তাই চাই। কিন্তু বর্তমান সরকার কী সে নীতি অনুসরণ করছে? তারা যেভাবে ভারত বন্দনা শুরু করেছে, তাতে দেশের স্বাধীন-সার্বভৌম মর্যাদা কি থাকবে? তাদের অতিরিক্ত ভারতপ্রীতির জন্�
স্বাধীনতার শেষ প্রান্তে ভারতীয় সৈন্য পিছন ফ্রন্টে থেকে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছে এবং আমাদের স্বাধীনতা দ্রুত অর্জনে সহায়তা করেছে ঠিকই, কিন্তু তারা আমাদের স্বাধীনতার জন্যই যুদ্ধ করেনি। এর আগে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতীয় সৈন্য ২ বার যুদ্ধ করে কিছুই অর্জন করতে পারেনি। ভারতের নীতি ছিল পুরো উপমহাদেশসহ আশপাশের রাষ্ট্রগুলো গ্রাস করে মহাভারতের সেই মহারাষ্ট্র সৃষ্টি করা। ‘ভারত সন্ধানে নেহেরু উরংপড়াবত্ু ওহফরধ’ বস্তুত সেরকম ইঙ্গিতই দেয়। তারা দেখল পাকিস্তানকে দু’টুকরা করার এটাই মোক্ষম সময়। পাকিস্তানকে দু’টুকরা করতে পারলে পাকিস্তান একটি দুর্বল রাষ্ট্র হবে। তখন সে ভারতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারবে না। এ হিসাব-নিকাশে ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে যুদ্ধে নামে। আসলে হয়েছেও তাই। পাকিস্তান আজ অনেক দুর্বল। ভারতের সঙ্গে টেক্কা দেয়ার মতো তার শক্তি নেই। বর্তমানে ভারতের চালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনায় পাকিস্তান অভ্যন্তরে আজ তালেবান ও আল কায়দাদের ধ্বংস করার ঘেরাটোপে আটকা পড়েছে। পশ্চিমাদের তথাকথিত সন্ত্রাসীদের ধ্বংস করতে গিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে পাকিস্তানের টানাটানি। এখন ভারতের ‘র’ ইসরাইলের মোসাদ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ একাট্টা হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। তাই পাকিস্তানের ভবিষ্যত্ আরেকটি আফগানিস্তান বা ইরাকে পরিণত হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা আছে।
যা বলা হচ্ছিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পরমুহূর্ত থেকে ভারত আমাদের সঙ্গে যে আচরণ করে আসছে তা কোনোভাবেই বন্ধুসুলভ নয়। স্বাধীনতার পরপরই আমাদের অফিস-আদালত, শিল্প-কারখানা থেকে তারা যে জিনিসপত্র লুট করেছে তা কল্পনাতীত। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে প্রায় সব যখন ধ্বংস তখন বাকি জিনিস ভারতীয় সেনাবাহিনী ও সরকারের প্রশ্রয়ে ভারতীয়রা লুট করেছে। ক্যান্টনমেন্ট থেকে সব সমরাস্ত্র ভারতে নিয়ে গেল। তখনকার বাংলাদেশ সরকার কিছুই বলল না। মেজর জলিল যশোর ও খুলনার সমরাস্ত্র লুট করার কাজে বাধা দেয়ায় তাকে সেনাবাহিনী থেকে পদচ্যুত করা হলো। তিনি ছিলেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সেক্টর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা। ভারতীয় সেনাবাহিনীর লুণ্ঠনের প্রত্যক্ষদর্শী আমি নিজে। তখন আমি জিকে প্রকল্পে (এক চত্ড়লবপঃ) ঝিনাইদহ ও ওয়াপদা বিভাগের সাব-ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার ছিলাম। স্বাধীনতার পরপরই অফিসে গিয়ে দেখি অফিসের চেয়ার, টেবিল, আলমিরা, টাইপরাইটার মেশিনসহ সবকিছুই উধাও। সেখানে দুটো ডিভিশনও ছিল। সব অফিসের একই হাল। একদিন ভারতের এক মেজর এসে জিজ্ঞেস করল, সব ঠিক আছে তো। নির্বাহী প্রকৌশলী কিছু না বললেও আমি জবাব দিলাম— হ্যাঁ সব ঠিক আছে বটে, আমাদের অফিস করার মতো টেবিল, চেয়ার সব উধাও। দেখনা আমরা কেমন দাঁড়িয়ে আছি। তিনি আমার কথার ঝাঁঝ বুঝতে পেরে বললেন—চিন্তা করো না—আমরা তোমাদের একশত কোটি টাকা ঋণ দেব। কী সুন্দর জবাব! একেই বলে ‘গরু মেরে জুতা দান’। তখন বর্ডার ছিল উন্মুক্ত। বাজারে যত বিদেশি মালামাল ছিল ভারতীয় সৈন্যরা তা লুফে নিয়ে যায়। ভারতে বিদেশি মালামালের আমদানিতে কড়াকড়ি থাকায় তারা বুভুক্ষুর মতো দোকান থেকে নিয়ে যায়।
ভারত শুরুতেই বাংলাদেশের সঙ্গে এ আচরণ করে আসছে। স্বাধীনতার আগে থেকেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের কংগ্রেস পার্টির সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল। সাধারণ মানুষ আশা করেছিল আওয়ামী লীগ তাদের এ সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তুলবে। কিন্তু ফল দেখা গেল উল্টো। তারা বাংলাদেশের বাজার দখল করে নিল। পাকিস্তান আমলে যে শিল্প ছিল তা বাজার না পাওয়ায় বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। ভারতের প্ররোচনায় সব কলকারখানা জাতীয়করণ করে দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে লেজেগোবরে পরিণত করা হল। শিল্প-কারখানা গুণ্ডাপাণ্ডাদের লুটপাটের চারণভূমিতে পরিণত হলো। পাকিস্তান আমলে যা কিছু শিল্প গড়ে উঠেছিল তাও ধ্বংস হলো। দক্ষ ব্যবস্থাপনা না থাকায় একদল শ্রমিক নেতা ভুঁইফোড়ের মতো গড়ে উঠল, যারা লুটপাট ছাড়া আর কিছুই বুঝত না। এতে করে ভারতের ইচ্ছাই পূর্ণ হলো। তারা চেয়েছিল বাংলাদেশকে তাদের পশ্চাত্ভূমি হিসেবে। সরকারও সেই মোতাবেক চলছিল।
এদিকে ইন্দিরা গান্ধী শেখ মুজিবের কাছ থেকে প্রায় ১৫০ বর্গকিলোমিটারের বেরুবাড়ী নিয়ে নিলেন। আমাদের আঙ্গরপোতা দহগ্রাম ছিটমহলের সঙ্গে মূলভূমির সংযোগের জন্য যে মাত্র ১৮৫ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১৬৪ মিটার প্রস্থের করিডোর দেয়ার কথা ছিল এত বছর পার হয়ে গেলেও আজও তা বুঝিয়ে দেয়নি। ফলে প্রায় দশ হাজার বাংলাদেশি সেখানে মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাদের না আছে শিক্ষা, না আছে স্বাস্থ্যসেবা, না হচ্ছে কোনো সামাজিক উন্নয়ন। তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের কাছ থেকে ইন্দিরা গান্ধী ফারাক্কা বাঁধ মাত্র দশ দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার অনুরোধ করায় তাতে শেখ মুজিব রাজি হন। এটা ১৯৭৩ সালে চালু হওয়ার পর আর কোনো দিন বন্ধ হয়নি। আন্তর্জাতিক নীতি অনুযায়ী অভিন্ন নদীর পানি সমতার ভিত্তিতে ব্যবহার করার কথা। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ কোনো দিনই তার প্রাপ্য পানি পায়নি। ফলে আজ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চল মরুভূমি হতে যাচ্ছে। নদী নাব্যতা হারিয়েছে। নদীর বুকে বিরাট বিরাট চর পড়ছে। জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। আজ আমাদের প্রধান নদী পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার এ হাল। ওদিকে আমাদের প্রকৌশলীদের দ্বারা তৈরি তিস্তা ব্যারাজ বন্ধ হওয়ার উপক্রম পানির অভাবে। তিস্তা নদীর ৭০ মাইল উজানে ভারত গজল ডোবায় বাঁধ দিয়ে একতরফাভাবে পানি নিয়ে যাচ্ছে। এতে আমাদের তিস্তা প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৩০ লাখ হেক্টর জমির চাষবাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ফারাক্কার মতো দেশের উত্তরাঞ্চলের এক-তৃতীয়াংশ মরুকরণের পথে। জেআরসির মাধ্যমে বাংলাদেশ বিগত ২০ বছর যাবত্ তিস্তার পানি ভাগাভাগি করে ব্যবহারের বিষয় বলে আসলেও ভারত তাতে কোনো সাড়া দিচ্ছে না। ওদিকে নতুনভাবে টিপাইমুখ বাঁধ দিয়ে আমাদের পূর্বাঞ্চলের বিরাট এলাকা পানিশূন্য করতে যাচ্ছে। এরূপ ৫৩টি অভিন্ন নদীর পানি ভারত তার নিজের সুবিধার জন্য প্রত্যাহার করছে। এদিকে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ পানির অভাবে মরুভূমিতে পরিণত হবে এবং ১৫ কোটি লোক সুপেয় পানিসহ খাদ্যাভাবে পড়বে, সেটা ভারত বিবেচনায় আনতেই চায় না।
ভারত আমাদের দ্বীপ তালপট্টি দেড়যুগ আগে অবৈধভাবে দখল করে আছে। র্যাডক্লিফের অনুযায়ী হারিয়াভাঙ্গা নদীর জলস্রোতের মধ্যভাগ ধরলে তালপট্টি দ্বীপটি নদীর পূর্ব পাশে পড়ে। সে মোতাবেক এটা বাংলাদেশের দ্বীপ। অথচ আন্তর্জাতিক বিধিবিধান উপেক্ষা করে ভারত তা দখল করে আছে। বর্তমান সরকার এ ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্য করছে না।
ভারত বাংলাদেশের ওপর দিয়ে করিডোর চেয়ে আসছে ১৯৭৪ সাল থেকে। কিন্তু আগের কোনো সরকারই তা দেয়নি জাতীয় নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে। ভারত যেভাবে করিডোর চায়, তাতে বাংলাদেশ পাঁচটি টুকরা হয়ে যাবে। বাংলাবান্ধা থেকে যমুনা ব্রিজ-গাজীপুর-ঢাকা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আখাউড়া জংশন-তামাবিল হয়ে পূর্ব ভারতে এবং আরেকটি হবে বেনাপোল সীমান্ত থেকে যমুনা ব্রিজ-গাজীপুর-ভৈরব-আখাউড়া-তামাবিল-ভারতীয় বর্ডার পর্যন্ত। আগে করিডোর চাইলেও এখন ভোল পাল্টিয়ে এশিয়ান হাইওয়ের মোড়কে এটা বাংলাদেশকে গিলাতে চাচ্ছে। ওদিকে চিটাগাং পোর্ট ব্যবহার করার নতুন আবদার তুলেছে ভারত; তার মালামাল চিটাগাং সমুদ্রবন্দরে খালাস করে সড়ক ও রেল যোগাযোগের মাধ্যমে পূর্ব ভারতে পাঠাতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশ-নেপাল দীর্ঘ তিন যুগ ধরে ভারতকে অনুরোধ করে আসছে যে, তাদের মাত্র ২৩ মাইল করিডোর পেলে স্থলবেষ্টিত নেপাল মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে পারে। তাতে তার পণ্য আমদানির পরিবহন খরচ অনেক কমে যাবে এবং নেপাল-বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বহুগুণ বেড়ে যাবে। কিন্তু ভারত বিরাট দেশ, সামরিক শক্তিতে মহাবলীয়ান হয়ে নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে তা দিচ্ছে না। তারা দাবি করছে, ১৫০০ কিলোমিটারেরও বেশি করিডোর। এই বিরাট করিডোরের নিরাপত্তা কীভাবে আমাদের মতো একটি দুর্বল রাষ্ট্র রক্ষা করবে? ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে বেশ কয়েকটি স্বাধীনতাকামী দল সক্রিয়। তারা এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতীয় সামরিক সরঞ্জাম ও সৈন্যবাহিনী যাতায়াত করলে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তাদের লোকদের হেনস্তা করলে বাংলাদেশও তাদের টার্গেটে পরিণত হবে। ভারত তখন নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে বাংলাদেশে সৈন্য সমাবেশ করলে তা ঠেকাবে কে? এছাড়া আমাদের সমুদ্রসীমা অগ্রাহ্য করে ভারত প্রায় ২৮০০ বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসীমা দখল করে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান চালাচ্ছে। সঙ্গে নিয়েছে মিয়ানমারকে। তারাও আমাদের প্রায় ৩১,০০০ বর্গকিলোমিটার তাদের বলে দাবি করছে। তার কারিগরি সার্ভে ভারতীয় বিশেষজ্ঞ করে দিয়েছে এবং উভয়ই যৌথভাবে বাংলাদেশের ওপর চাপ দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া ভারত একতরফাভাবে বাংলাদেশের বাজারে তাদের পণ্য বৈধ-অবৈধভাবে চালান দিয়ে বাণিজ্যে বিরাট ব্যবধান সৃষ্টি করে যাচ্ছে। আর আমাদের পণ্য ভারতে পাঠাতে গেলে বিবিধ ট্রেড ব্যারিয়ার দিয়ে তা ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না।
অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় আনতে ভারতের ‘র’ (জঅড) এবং ইসরাইলের মোসাদের সূক্ষ্ম ভূমিকা ছিল। তাই সে ঋণ শোধ করার জন্য শেখ হাসিনার সরকার উঠেপড়ে লেগেছে। তার সরকারের মন্ত্রীরা ভারত বন্দনা শুরু করেছেন। যোগাযোগমন্ত্রী বলছেন, ভারতকে করিডোর দিলে বাংলাদেশ আর্থিকভাবে লাভবান হবে। পানিসম্পদমন্ত্রী বলছেন, টিপাইমুখ বাঁধে আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না, বরং আমরা বিদ্যুত্ পাব। বাণিজ্যমন্ত্রী বলছেন, ভারত আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তারা আমাদের ক্ষতি করতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ভারত সফর করে আসলেন, তাতে বাংলাদেশের কি উপকার হলো? তিনি পানি সমস্যার কোনো কথাই বলেননি। বাণিজ্যে ভারসাম্য আনার ব্যাপারে তেমন উচ্চবাচ্য নেই। সমুদ্রসীমা নির্ধারণের দিকনির্দেশনা নেই। করিডোর দেয়ার সম্মতি থাকলেও নেপাল-ভুটানের করিডোর পাওয়ার কোনো ওয়াদা নেই, আছে শুধু আশ্বাস। যে ভারত চুক্তি করে সে মোতাবেক নদীর পানির হিস্যা দিচ্ছে না, তাদের সে আশ্বাসবাণী বাংলাদেশের কোনো কাজে আসবে কি? ভারতের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে দশ বছর আগে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, টিপাইমুখ বাঁধে বাংলাদেশের ক্ষতি হয় তেমন কাজ ভারত করবে না। তারা কি বাংলাদেশের কী কী ক্ষতি হতে পারে, তা জরিপ করে দেখেছে? বা টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ কি বন্ধ রেখেছে? বেরুবাড়ী এককথায় নিয়ে গেলেও ভারত কি তিনবিঘা করিডোর আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে? এসব কারণে বাংলাদেশের মানুষ ভারতকে আস্থায় নিতে পারছে না। শুধু বাংলাদেশ নয়, এ অঞ্চলের সার্কভুক্ত কোনো দেশের সঙ্গেই ভারতের সুসম্পর্ক নেই। বিশাল শক্তিধর ভারতের কাছে তার ক্ষুদ্র প্রতিবেশীরা চায় সহযোগিতা ও নিরাপত্তা। কিন্তু ভারত সেরকম কোনো পরিবেশ আজ পর্যন্ত তৈরি করতে পারেনি। তার প্রতিটি কার্যক্রম প্রতিবেশীদের জন্য সন্দেহের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত যদি বড় ভাইসুলভ আচরণ করত এবং ছোট ভাইদের সুবিধা-অসুবিধা অনুধাবন করে উদারতার হাত বাড়িয়ে দিত, তাহলে এ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর অনেক উন্নতি হতো। সার্ককে অকার্যকর করে রেখেছে ভারত।
আর সেই ভারতের সঙ্গে বর্তমান সরকার যেভাবে হরিহর আত্মার ভাব দেখাচ্ছে, তাতেই দেশের জনগণ শঙ্কিত। আমরা চাই সমতার ভিত্তিতে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক। ভারত বিরাট দেশ। তার সামরিক শক্তি অনেক। তাই বলে তার প্রতিবেশীদের উপেক্ষা করতে পারে না। চীন তার প্রতিবেশীদের সর্বতোভাবে সহায়তা করছে। অন্যান্য দেশও তাই করছে। আমরাও তাই চাই। কিন্তু বর্তমান সরকার কী সে নীতি অনুসরণ করছে? তারা যেভাবে ভারত বন্দনা শুরু করেছে, তাতে দেশের স্বাধীন-সার্বভৌম মর্যাদা কি থাকবে? তাদের অতিরিক্ত ভারতপ্রীতির জন্�
No comments