প্রবাসে একুশের ভাবনা by ফখরুজ্জামান চৌধুরী
প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস আসে। ফেব্রুয়ারি মাসসংলগ্ন হয়ে আসে বসন্তকাল—ঋতুরাজ নামে বাংলা কাব্যে যার পরিচিতি। ফেব্রুয়ারি মাস ধারণ করে আছে অগ্নিগর্ভ একদিন—একুশে। প্রায় ছয় দশক আগে এই দিনে ঘটে যাওয়া ইতিহাস সৃষ্টিকারী ঘটনার পটভূমি নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই এটা যেমন সত্য, তেমনি সত্য নতুন করে বলার প্রয়োজনও।
কারণ সখেদে লক্ষ্য করি, আজ অনেকের কাছে একুশে ফেব্রুয়ারি শুধুই আনুষ্ঠানিকতার উপলক্ষ্যমাত্র। একুশে ফেব্রুয়ারির সবচেয়ে অর্জন যদি বলি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে দিনটির স্বীকৃতি লাভ, তাহলে ভুল কিছু বলা হবে না। কানাডা প্রবাসী দুই তরুণ যাদের নাম নিয়তি নির্ধারিতভাবে ভাষা আন্দোলনের দুই শহীদের নামে রাখা—তাদের নিরলস প্রয়াসের স্বীকৃতিস্বরূপ ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০০ সালে পালিত হয় প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ২০০৮ সালকে ঘোষণা করা হয় আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে।
প্রতি বছর ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনে শুরু হওয়া বাংলা একাডেমীর অমর একুশে বইমেলা আজ বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে ক্যালেন্ডার অফ ইভেনটস-এ অন্তর্ভুক্ত একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানকে ঘিরে সারা বছর আবর্তিত হতে থাকে কবি-সাহিত্যিক-প্রকাশক-মুদ্রাকর-কাগজ ব্যবসায়ী, কালি সরবরাহকারী, বাইন্ডার—এক কথায় পুস্তক প্রকাশনার সঙ্গে জড়িত যাবতীয় স্টেক হোল্ডারদের কর্মপরিকল্পনা। আর প্রবাসীদের মধ্যে যারা লেখালেখির সঙ্গে জড়িত তারা দেশে ফেরার তাগিদ অনুভব করতে শুরু করেন ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে। ফেব্রুয়ারি মাসকে আমি বলি প্রবাসী লেখকদের ঘরে ফেরার কাল।
এবার ফেব্রুয়ারি মাসে দৈববলে আমি আছি দেশ থেকে দূরে নয়—অনেক দূরে।
এবারই প্রথম নয়। এর আগেও একবার একুশে ফেব্রুয়ারিতে দেশের বাইরে থাকতে হয়েছিল। তবে তা স্বল্পকালের জন্য। কিন্তু এবার দীর্ঘ সময়ের জন্য। ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে।
দূর থেকে অনেক সময় অনেক কিছু ঝাপসা দেখায়। তবে যদি তা দেখা হয় মনের চোখ দিয়ে তাহলে নিস্পৃহভাবে অনেক কিছু দেখা সম্ভব।
ভাষার জন্য আত্মত্যাগের কথা বলে বলে আমরা ইতিহাসের পাতার পর পাতা ভরে তুলেছি। যদি প্রশ্ন করি, ভাষার জন্য দৃশ্যমান কোন কাজটি করেছি, তাহলে অসহায়ভাবে অর্জনের অন্বেষণ করতে হবে।
একটা কাজ অত্যন্ত পটুভাবে আমরা করেছি। তা হলো ভাষার বিকৃতি সাধন! মন্ত্রণালয়ে সভা করে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলতে হচ্ছে, সাবধান, ভাষার বিকৃতি রোধ করুন। অন্যথায় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মিডিয়ার কর্তাব্যক্তিদের উপস্থিতিতে উচ্চারিত এই সতর্ক বাণীর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, তবে এর পটভূমি নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যায় কী? কি বাংলা শুনছি আমরা চারপাশে? ভাষা প্রকাশের স্বাধীনতা বলে এই অনাচারকে অনেক প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে। শুধু ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াকে দায়ী করে লাভ নেই, প্রিন্ট মিডিয়াও ধোয়া তুলসীপাতা নয়। বাংলা বাক্যে খুচরো ইংরেজি এবং কখনও কখনও ভয়াবহ রকম ভুল শব্দের প্রয়োগ ভাষা ব্যবহারে নৈরাজ্যের জ্বলন্ত প্রমাণ।
তবে কর্তৃপক্ষীয় নির্দেশে ভাষা মোলায়েম হয়ে যাবে, এমনটা ভাবি না। এর জন্য দরকার সচেতনতা সৃষ্টি। আধুনিকতা মানে যে স্বেচ্ছাচার নয়, তা বুঝতে পারার মতো ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।
প্রবাসে বসে দেশকে নিয়ে অনেক ভাবনা হয়। এই মুহূর্তে আমাকে আচ্ছন্ন করে আছে একুশে ফেব্রুয়ারি এবং তাকে ঘিরে নানা আয়োজন। পত্রপত্রিকা বের হবে একুশকে নিয়ে নানা রচনায় সমৃদ্ধ হয়ে। যেমন বের হয়েছে এর সূচনা থেকে। কিন্তু আমরা সংরক্ষণের ব্যাপারে সচেতন নই বলে অনেক লেখা হারিয়ে গেছে। আবার অনেকের লেখা আমরা হারিয়ে যেতে দিয়েছি, কারণ ওইসব লেখা যারা লিখেছেন তারা আমাদের মতবাদের বা দলের নন। আবার অনেকে হারিয়ে গেছেন নিজেদের স্বল্পকালীন উপস্থিতির জন্য। যেমন হারিয়ে গেছেন আমার জানা মতে একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে লেখা প্রথম বিদেশি কবি ক্রেসিদা লিল্ডসে। গত শতকের ছয়ের দশকে প্রকাশিত স্বল্পস্থায়ী ইংরেজি ত্রৈমাসিক ‘রিপাবলিক’-এ প্রকাশিত নাতিদীর্ঘ এই কবিতাটি কোনো সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বলে মনে পড়ে না, কবি-সাংবাদিক আবদুল গণি হাজারি ও গল্পকার-ঔপন্যাসিক সরদার জয়েনউদ্দীন সম্পাদিত ত্রৈমাসিকটির কোনো কপি আজ কারও সংগ্রহে অবশিষ্ট আছে কিনা, এমন সন্দেহও আছে।
একুশে ফেব্রুয়ারির আরেক বিস্মৃত কবি চৌধুরী লুত্ফর রহমান। স্বল্পবিত্ত পরিবারের জাতক চৌধুরী লুত্ফর রহমান বড় ছেলে হিসেবে পরিবারের আয় অর্জনে সহায়তা না করে কবিতা, গল্প রচনা আর গান গাওয়াতেই প্রশান্তি খুঁজে পেয়েছিলেন। পাঁচ-ছয়ের দশকে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘কবি শেলী’ নামে। অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক সৈনিকে তিনি নিয়মিত লিখতেন।
ভাষা আন্দোলনে সৈনিকের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। যারা এক সময়ে সৈনিকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, পরবর্তীকালে মত বদলেছেন, তারা সৈনিকের কথা বলতে সংকোচ বোধ করেন বোধগম্য কারণে!
সৈনিকের ভূমিকা অনুক্ত। চৌধুরী লুত্ফর রহমান বিস্মৃত। একুশে ফেব্রুয়ারি ইতিহাসের অনেক উপাদানই ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
দুঃখ, চৌধুরী লুত্ফর রহমানের কোনো লেখা তার পরিবারের সংগ্রহেও নেই। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে ‘সাহিত্যিক’ ধারণ করার মানসিকতা তৈরি হওয়ার আগেই যে জন্মেছিলেন চৌধুরী লুত্ফর রহমান! তাই তো তার পরিবারে তিনি ছিলেন অপচয়িত -এক যুবক।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক
প্রতি বছর ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনে শুরু হওয়া বাংলা একাডেমীর অমর একুশে বইমেলা আজ বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে ক্যালেন্ডার অফ ইভেনটস-এ অন্তর্ভুক্ত একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানকে ঘিরে সারা বছর আবর্তিত হতে থাকে কবি-সাহিত্যিক-প্রকাশক-মুদ্রাকর-কাগজ ব্যবসায়ী, কালি সরবরাহকারী, বাইন্ডার—এক কথায় পুস্তক প্রকাশনার সঙ্গে জড়িত যাবতীয় স্টেক হোল্ডারদের কর্মপরিকল্পনা। আর প্রবাসীদের মধ্যে যারা লেখালেখির সঙ্গে জড়িত তারা দেশে ফেরার তাগিদ অনুভব করতে শুরু করেন ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে। ফেব্রুয়ারি মাসকে আমি বলি প্রবাসী লেখকদের ঘরে ফেরার কাল।
এবার ফেব্রুয়ারি মাসে দৈববলে আমি আছি দেশ থেকে দূরে নয়—অনেক দূরে।
এবারই প্রথম নয়। এর আগেও একবার একুশে ফেব্রুয়ারিতে দেশের বাইরে থাকতে হয়েছিল। তবে তা স্বল্পকালের জন্য। কিন্তু এবার দীর্ঘ সময়ের জন্য। ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে।
দূর থেকে অনেক সময় অনেক কিছু ঝাপসা দেখায়। তবে যদি তা দেখা হয় মনের চোখ দিয়ে তাহলে নিস্পৃহভাবে অনেক কিছু দেখা সম্ভব।
ভাষার জন্য আত্মত্যাগের কথা বলে বলে আমরা ইতিহাসের পাতার পর পাতা ভরে তুলেছি। যদি প্রশ্ন করি, ভাষার জন্য দৃশ্যমান কোন কাজটি করেছি, তাহলে অসহায়ভাবে অর্জনের অন্বেষণ করতে হবে।
একটা কাজ অত্যন্ত পটুভাবে আমরা করেছি। তা হলো ভাষার বিকৃতি সাধন! মন্ত্রণালয়ে সভা করে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলতে হচ্ছে, সাবধান, ভাষার বিকৃতি রোধ করুন। অন্যথায় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মিডিয়ার কর্তাব্যক্তিদের উপস্থিতিতে উচ্চারিত এই সতর্ক বাণীর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, তবে এর পটভূমি নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যায় কী? কি বাংলা শুনছি আমরা চারপাশে? ভাষা প্রকাশের স্বাধীনতা বলে এই অনাচারকে অনেক প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে। শুধু ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াকে দায়ী করে লাভ নেই, প্রিন্ট মিডিয়াও ধোয়া তুলসীপাতা নয়। বাংলা বাক্যে খুচরো ইংরেজি এবং কখনও কখনও ভয়াবহ রকম ভুল শব্দের প্রয়োগ ভাষা ব্যবহারে নৈরাজ্যের জ্বলন্ত প্রমাণ।
তবে কর্তৃপক্ষীয় নির্দেশে ভাষা মোলায়েম হয়ে যাবে, এমনটা ভাবি না। এর জন্য দরকার সচেতনতা সৃষ্টি। আধুনিকতা মানে যে স্বেচ্ছাচার নয়, তা বুঝতে পারার মতো ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।
প্রবাসে বসে দেশকে নিয়ে অনেক ভাবনা হয়। এই মুহূর্তে আমাকে আচ্ছন্ন করে আছে একুশে ফেব্রুয়ারি এবং তাকে ঘিরে নানা আয়োজন। পত্রপত্রিকা বের হবে একুশকে নিয়ে নানা রচনায় সমৃদ্ধ হয়ে। যেমন বের হয়েছে এর সূচনা থেকে। কিন্তু আমরা সংরক্ষণের ব্যাপারে সচেতন নই বলে অনেক লেখা হারিয়ে গেছে। আবার অনেকের লেখা আমরা হারিয়ে যেতে দিয়েছি, কারণ ওইসব লেখা যারা লিখেছেন তারা আমাদের মতবাদের বা দলের নন। আবার অনেকে হারিয়ে গেছেন নিজেদের স্বল্পকালীন উপস্থিতির জন্য। যেমন হারিয়ে গেছেন আমার জানা মতে একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে লেখা প্রথম বিদেশি কবি ক্রেসিদা লিল্ডসে। গত শতকের ছয়ের দশকে প্রকাশিত স্বল্পস্থায়ী ইংরেজি ত্রৈমাসিক ‘রিপাবলিক’-এ প্রকাশিত নাতিদীর্ঘ এই কবিতাটি কোনো সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বলে মনে পড়ে না, কবি-সাংবাদিক আবদুল গণি হাজারি ও গল্পকার-ঔপন্যাসিক সরদার জয়েনউদ্দীন সম্পাদিত ত্রৈমাসিকটির কোনো কপি আজ কারও সংগ্রহে অবশিষ্ট আছে কিনা, এমন সন্দেহও আছে।
একুশে ফেব্রুয়ারির আরেক বিস্মৃত কবি চৌধুরী লুত্ফর রহমান। স্বল্পবিত্ত পরিবারের জাতক চৌধুরী লুত্ফর রহমান বড় ছেলে হিসেবে পরিবারের আয় অর্জনে সহায়তা না করে কবিতা, গল্প রচনা আর গান গাওয়াতেই প্রশান্তি খুঁজে পেয়েছিলেন। পাঁচ-ছয়ের দশকে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘কবি শেলী’ নামে। অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক সৈনিকে তিনি নিয়মিত লিখতেন।
ভাষা আন্দোলনে সৈনিকের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। যারা এক সময়ে সৈনিকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, পরবর্তীকালে মত বদলেছেন, তারা সৈনিকের কথা বলতে সংকোচ বোধ করেন বোধগম্য কারণে!
সৈনিকের ভূমিকা অনুক্ত। চৌধুরী লুত্ফর রহমান বিস্মৃত। একুশে ফেব্রুয়ারি ইতিহাসের অনেক উপাদানই ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
দুঃখ, চৌধুরী লুত্ফর রহমানের কোনো লেখা তার পরিবারের সংগ্রহেও নেই। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে ‘সাহিত্যিক’ ধারণ করার মানসিকতা তৈরি হওয়ার আগেই যে জন্মেছিলেন চৌধুরী লুত্ফর রহমান! তাই তো তার পরিবারে তিনি ছিলেন অপচয়িত -এক যুবক।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক
No comments