জিয়ার মরদেহঃ লাগামহীন নেতৃত্বের বোধোদয় by মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন
মহান আল্লাহপাক তাঁর সব সৃষ্টিতেই ভারসাম্য স্থাপন করেছেন। নতুবা এই মহাবিশ্ব এক মুহূর্তও স্থির থাকতে পারত না। তিনি যেমন ভারসাম্য স্থাপন করেছেন, আবার সব কাজের মধ্যে নির্দিষ্ট মাত্রাও স্থির করে দিয়েছেন। সব কাজেই এই নির্দিষ্ট মাত্রাটি বজায় রাখা সব দায়িত্বশীল মানুষের ও দায়িত্বশীল পদে আসীন ব্যক্তিদের জন্য কর্তব্য।
মাত্রা অতিক্রম হলেই যে আল্লাহপাকের তরফ থেকে বিপদ ও বির্পযয় আসন্ন হয়ে যায়, এই বোধটি আমাদের নেতৃত্বের থাকা উচিত।
কিন্তু জনগণ লক্ষ্য করছে, মধ্যে কিছুদিন বিরতি দিয়ে আমাদের জাতীয় নেতৃত্ব আবার সেই লাগামহীন ও রুচিহীন এবং নোংরা রাজনীতির অনুশীলন শুরু করেছেন। দেশের শীর্ষ পদে আসীন হয়ে কোটি কোটি মানুষের অন্তরে আঘাত দিয়ে আপত্তিজনক সব উক্তি করে যাচ্ছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাত্রাও অতিক্রম করছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন লাশ পড়ছে; এগুলো নিয়ে বিতর্ক না করে ত্রিশ বছর আগের পুরনো লাশ নিয়ে টানা-হেঁচড়া শুরু করেছেন। একজন বলছেন, জিয়ার সমাধিস্থলে নাকি তার লাশই নেই। আবার আরেকজন বলছেন, জিয়া নাকি মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন না; জিয়া নাকি সেক্টর কমান্ডারও নন। অন্যজন বলছেন, খালেদা জিয়া নাকি অ-মানুষ ও কুটনি বুড়ি। কী আশ্চর্যের কথা! সমগ্র দেশের মানুষকে স্তম্ভিত ও হতবাক করে দিয়ে এমন সব আপত্তিজনক, অসুন্দর ও রুচিহীন উক্তিই করে যাচ্ছেন দেশের শীর্ষপদে আসীন ব্যক্তিরা। অন্যদিক দিয়ে চলছে ঢালাও চরিত্র হনন, প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া, রগ-কাটা, মাথা ফাটাফাটি ও রক্তারক্তি এবং দেশব্যাপী নির্বিচারে গ্রেফতার অভিযান ইত্যাদি।
দেশের শীর্ষ মহল কর্তৃক এসব অনাকাঙ্ক্ষিত বাক-বিতণ্ডা ও বিতর্কের সূত্রপাত, মানুষের নিত্যদিনের সমস্যার সঙ্গে আরও একটি নতুন সমস্যার সংযোজন হলো। এমনিতেই দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, অসহনীয় যানজট, লোডশেডিংসহ আরও অসংখ্য সমস্যায় নাগরিক জীবন প্রায় বিপর্যস্ত। মানুষের কষ্টের যেন আর শেষ নেই। দেশের আপামর জনগণ বলছে, কোথায় গেল দিনবদলের রাজনীতি? কোথায় গেল ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন? কোথায় চাপা দেয়া হচ্ছে সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার? এসব দেখেশুনে দেশের মানুষ আরও বলাবলি করছে—গেল কিছুদিন আগে আমাদের জাতীয় নেতৃত্ব একটি প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খাওয়ার পরও তা থেকে কোনো অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা নিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে না।
সম্প্রতি দেশে যা ঘটছে, তা দেশের জন্য ও দেশের চলমান রাজনীতির জন্য কোনো ভালো লক্ষণ নয়। বড় ধরনের একটি রাজনৈতিক ক্ষেত্র তৈরি করার জন্যই যে এসব করা হচ্ছে, তা সহজেই অনুমেয়। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, ক্ষমতার মসনদকে দীঘায়িত করতে ভিশন-২১ এর ক্ষেত্র প্রস্তুত করতেই হয়তো এসব স্পর্শকাতর রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দেয়া হচ্ছে।
সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে স্পষ্ট ঘোষণা আছে যে, সরকার দিনবদলের রাজনীতি চালু করবে। আরও ঘোষণা আছে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ারও। আরও আছে নতুন প্রজন্মকে দেয়া সরকারের ঘরে-ঘরে চাকরির ওয়াদাও। এছাড়া দেশের জনগণকেও আরও অসংখ্য ওয়াদা দেয়া আছে সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে। কিন্তু সরকার জনগণকে দেয়া এসব ওয়াদা থেকে সরে গিয়ে দেশে নিত্য-নতুন রাজনৈতিক বিতর্কের সৃষ্টি করছে। সরকারের দেয়া এসব ওয়াদা থেকে নতুন প্রজন্মকে এবং দেশবাসীর দৃষ্টিকে ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিতেই মূলত এসব নিত্য-নতুন রাজনৈতিক বিতর্কের সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে জনগণের ধারণা। উদ্দেশ্য, সমগ্র দেশবাসীকে এসব রাজনৈতিক বিতর্কে জড়িয়ে ফেলা।
এরই মধ্যে আমাদের জাতীয় নেতৃত্বকে এই বিতর্কে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে। প্রতিনিয়ত উল্লিখিত বিতর্ক নিয়ে সবাই ব্যস্ত আছে। জনগণের মৌলিক সমস্যাগুলো এই বিতর্কের চোরাবালিতে চাপা পড়ে যাচ্ছে। নিত্যপণ্যের মূল্য লাগামহীন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে চালের দাম অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। গত এক মাসে মানভেদে প্রতি কেজি চাল ১০-২০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব মূল্যবৃদ্ধি দেশবাসীর দৃষ্টিতে ‘ফোকাস’ হচ্ছে না। ফোকাস হচ্ছে শুধু নিত্য-নতুন রাজনৈতিক বিতর্ক। রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যেই জড়িয়ে আছে বিরোধী দলের রাজনীতি। সরকার তার সঠিক কৌশল নিয়েই এগোচ্ছে। সরকার তার সৃষ্ট বিতর্কের চোরাবালিতে বিরোধী দলের রাজনীতিকে আটকিয়ে ফেলেছে। আর বিরোধী দলও সরকারের সৃষ্ট রাজনৈতিক বিতর্কেই নিজেদের জড়িয়ে রেখেছে আর ঘরে বসে বসে মার খাচ্ছে। বলা বাহুল্য, আওয়ামী লীগ যদি বিরোধী দল হতো, আর চালের দাম যদি প্রতি কেজি এক মাসের ব্যবধানে ১০-২০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেত, তাহলে কি বিএনপি সরকার চালাতে পারত?
কার্যত চালের দামের গতি-প্রকৃতির সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতি ও ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর গতি-প্রকৃতিও নির্ধারিত হয়ে থাকে। অতীতেও এর প্রতিফলন দেখা গেছে। দেশের বর্তমান চালের বাজার অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। আগামী দু’একমাস হয়তো চালের বাজার আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। এর লক্ষণও দেখা যাচ্ছে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়বে অন্যান্য পণ্যের মূল্যও। আগামী মাসগুলোতে বিদ্যুতের লোডশেডিংও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। পাশাপাশি গ্যাস, পানি ও অন্যান্য সমস্যা তো থাকবেই। সরকারের জন্য এসব আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ, সরকারও এটি আঁচ করছে। আর আঁচ করছে বলেই সরকারের গতি-প্রকৃতি ঘুরে যাচ্ছে ভিন্ন দিকে।
সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেই এই গতি নিত্যদিনের সমস্যা থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে বা রাজনৈতিক বিতর্কের দিকে ধাবিত করে দিয়েছে। উদ্দেশ্য, বিরোধী দলগুলোকে রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যে ব্যতিব্যস্ত রাখা। জনগণের নিত্যদিনের সমস্যাগুলো যাতে ‘ফোকাস’ না হয়।
বিএনপি তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে সরকারের ব্যর্থতাসহ আরও বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে সংসদের ভেতরে ও রাজপথে সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে। সরকারের ধারণা, ভারতের সঙ্গে অসম চুক্তি, সম্ভাব্য তেল-গ্যাস ইজারা চুক্তি, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিসহ নানা বিষয়ে আগামী দিনগুলোতে বিএনপি সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারে। জনগণের নিত্যদিনের সমস্যাগুলো ফোকাস হলে সরকারের জনপ্রিয়তায় চরম ধস নামার সম্ভাবনা আছে। এমনকি সরকার বেকায়দায়ও পড়ে যেতে পারে। ফলে আগামী দিনের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ একক বিএনপির হাতে চলে আসতে পারে। সরকার এটি আঁচ করতে পেরেই বিএনপি নেতৃত্বকে উল্লিখিত ইস্যুগুলো থেকে জিয়ার মরদেহ ও তার সমাধিস্থলের দিকে ডাইভার্ট করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। বিএনপি নেতৃত্ব যাতে জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোর পরিবর্তে তাদের দলীয় নিজস্ব ইস্যু নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকে। সুতরাং বিতর্ক যদি হতে হয় পুরনো কোনো ইস্যু নয়, বিতর্ক হতে হবে নিত্য-নতুন সমস্যা নিয়ে, বিতর্ক হবে জনগণের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে; বিতর্ক হবে দেশে যে নতুন নতুন লাশ পড়ছে, তা নিয়ে। ত্রিশ বছর আগের পুরনো বিষয় নিয়ে নিজেদের বিতর্কে জড়ানো মোটেও সমীচীন নয়। এটিই বিএনপি নেতৃত্বকে অনুধাবন করতে হবে।
ইতিহাসের একটি মীমাংসিত বিষয় নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করে জাতিকে বিভক্ত করার কোনো হেতু হতে পারে না। এই অহেতুক বিতর্কে কি জাতির কোনো প্রাপ্তি আছে? জিয়ার লাশ নিয়ে অহেতুক বিতর্ক তৈরি করে মানুষকে কেবল বোকা বানানো হচ্ছে।
৩০ মে ১৯৮০ সালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে কিছু বিপথগামী সেনাসদস্য কর্তৃক জিয়ার নির্মম মৃত্যু, অতঃপর চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার পাহাড় থেকে সেনাসদস্যদের (যারা বর্তমানেও জীবিত আছে) শহীদ জিয়ার মরদেহ উদ্ধার; পরে মানিক মিয়া এভিনিউয়ে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে তার জানাজা সম্পন্ন এবং সংসদ ভবন সংলগ্ন চন্দ্রিমা উদ্যানে (বর্তমানে জিয়া উদ্যান) তার দাফন সম্পন্ন করা—এসব কোনো লুকিয়ে রাখা বাঁকাচোরা ঘটনা নয়, এটি একটি দলিলকৃত সত্য ঘটনা; এটি একটি ধারণকৃত দৃশ্যমান ঘটনা। লাখ লাখ মানুষ সশরীরে উপস্থিত হয়ে নিজ চোখে ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেছে। ঘটনাটি যেমন ক্যামেরায় ধারণ করা আছে, তেমনি বাংলাদেশসহ বিশ্বের লক্ষ-কোটি মানুষের ধ্যানে-জ্ঞানে ও অন্তরেও ধারণ করা আছে। আর লক্ষ-কোটি মানুষের নিজে দেখা এবং নিজ নিজ ধ্যানে-জ্ঞানে ও অন্তরে ধারণ করা ঘটনা ইতিহাসও ধারণ করে এবং ইতিহাসের অংশ হয়। সুতরাং শহীদ জিয়ার মরদেহটি বর্তমানে কারও দেখা না দেখা এবং তার সমাধিস্থলটি কারও মানা না মানা বা কারও বিরূপ মন্তব্যের পর্যায়ে নেই। শহীদ জিয়ার সমাধিস্থলটি বর্তমান সময়ে ইতিহাসের একটি অংশ হয়ে গেছে। ইতিহাস এই সমাধিস্থলকে তার নিজ বুকে ধারণ করে নিয়েছে। এই সমাধিস্থল ইতিহাসখ্যাত হয়ে আছে।
শহীদ জিয়ার সমাধিস্থল নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করে, কোটি কোটি মানুষের অন্তরে আঘাত দেয়ার দায় কাউকে না কাউকে কাঁধে নিতে হবে। ইতিহাস এই দায় থেকে কাউকেই রেহাই দেবে না।
দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে, ১/১১ এর প্রেক্ষাপটে আমাদের জাতীয় নেতৃত্ব কী নিদারুণ দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছে। শুধু জাতীয় নেতারাই নয়, তাদের পরিবার-পরিজনও নিদারুণ দুঃখ-কষ্ট ও ভয়ভীতির মধ্যে দিনাতিপাত করেছে। এত সহজেই এই দুঃখ-কষ্টের দিনগুলো ভুলে যাওয়ার কথা নয়। এই বাস্তব সত্যটি মনে রাখলে, একে অপরকে খাটো করার রাজনীতি থেকে আমাদের জাতীয় নেতৃত্বকে বেরিয়ে আসতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। একে অপরকে অহেতুক খাটো করলে এর দায়ভার যে কাঁধে নিতে হয়—এই বোধোদয়টি আমাদের জাতীয় নেতৃত্বের ধ্যানে-জ্ঞানে ও অন্তরে আরও অতিমাত্রায় সঞ্চারিত হোক।
আমরা আশির দশকের তরুণ প্রজন্ম, সুস্পষ্ট একটি দর্শন চেতনায় ধারণ করে সামনে অগ্রসর হয়েছিলাম এবং একটি প্রচণ্ড প্রভাবশালী স্বৈর শাসককে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে পরাভূত করে বিনির্মাণ করে দিয়েছিলাম আমাদের জাতীয় নেতৃত্বের কাঠামো। বিনির্মাণ করে দিয়েছিলাম গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ। আমাদের পূর্বসূরিরাই আমাদের এর ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের আজকের প্রজন্ম লাগামহীন, রুচিহীন ও নোংরা রাজনীতির আবর্তে পড়ে তাদের চেতনায় এক ধরনের রাজনীতিহীনতা তৈরি হয়েছে। আজকের দিনের রাজনীতি থেকে নতুন প্রজন্ম স্বেচ্ছায় নিজেদের দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। নেতৃত্ব, গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ আজকের প্রজন্মের কাছ থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্র, গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ যদি বড় ধরনের কোনো সঙ্কটে পড়ে, তাহলে তা পুনরুদ্ধারে আজকের প্রজন্ম কোনো বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারবে বলে রাজনৈতিক সচেতন মহল মনে করে না।
লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক
ই-মেইল : belayet_1@yahoo.com
কিন্তু জনগণ লক্ষ্য করছে, মধ্যে কিছুদিন বিরতি দিয়ে আমাদের জাতীয় নেতৃত্ব আবার সেই লাগামহীন ও রুচিহীন এবং নোংরা রাজনীতির অনুশীলন শুরু করেছেন। দেশের শীর্ষ পদে আসীন হয়ে কোটি কোটি মানুষের অন্তরে আঘাত দিয়ে আপত্তিজনক সব উক্তি করে যাচ্ছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাত্রাও অতিক্রম করছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন লাশ পড়ছে; এগুলো নিয়ে বিতর্ক না করে ত্রিশ বছর আগের পুরনো লাশ নিয়ে টানা-হেঁচড়া শুরু করেছেন। একজন বলছেন, জিয়ার সমাধিস্থলে নাকি তার লাশই নেই। আবার আরেকজন বলছেন, জিয়া নাকি মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন না; জিয়া নাকি সেক্টর কমান্ডারও নন। অন্যজন বলছেন, খালেদা জিয়া নাকি অ-মানুষ ও কুটনি বুড়ি। কী আশ্চর্যের কথা! সমগ্র দেশের মানুষকে স্তম্ভিত ও হতবাক করে দিয়ে এমন সব আপত্তিজনক, অসুন্দর ও রুচিহীন উক্তিই করে যাচ্ছেন দেশের শীর্ষপদে আসীন ব্যক্তিরা। অন্যদিক দিয়ে চলছে ঢালাও চরিত্র হনন, প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া, রগ-কাটা, মাথা ফাটাফাটি ও রক্তারক্তি এবং দেশব্যাপী নির্বিচারে গ্রেফতার অভিযান ইত্যাদি।
দেশের শীর্ষ মহল কর্তৃক এসব অনাকাঙ্ক্ষিত বাক-বিতণ্ডা ও বিতর্কের সূত্রপাত, মানুষের নিত্যদিনের সমস্যার সঙ্গে আরও একটি নতুন সমস্যার সংযোজন হলো। এমনিতেই দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, অসহনীয় যানজট, লোডশেডিংসহ আরও অসংখ্য সমস্যায় নাগরিক জীবন প্রায় বিপর্যস্ত। মানুষের কষ্টের যেন আর শেষ নেই। দেশের আপামর জনগণ বলছে, কোথায় গেল দিনবদলের রাজনীতি? কোথায় গেল ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন? কোথায় চাপা দেয়া হচ্ছে সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার? এসব দেখেশুনে দেশের মানুষ আরও বলাবলি করছে—গেল কিছুদিন আগে আমাদের জাতীয় নেতৃত্ব একটি প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খাওয়ার পরও তা থেকে কোনো অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা নিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে না।
সম্প্রতি দেশে যা ঘটছে, তা দেশের জন্য ও দেশের চলমান রাজনীতির জন্য কোনো ভালো লক্ষণ নয়। বড় ধরনের একটি রাজনৈতিক ক্ষেত্র তৈরি করার জন্যই যে এসব করা হচ্ছে, তা সহজেই অনুমেয়। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, ক্ষমতার মসনদকে দীঘায়িত করতে ভিশন-২১ এর ক্ষেত্র প্রস্তুত করতেই হয়তো এসব স্পর্শকাতর রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দেয়া হচ্ছে।
সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে স্পষ্ট ঘোষণা আছে যে, সরকার দিনবদলের রাজনীতি চালু করবে। আরও ঘোষণা আছে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ারও। আরও আছে নতুন প্রজন্মকে দেয়া সরকারের ঘরে-ঘরে চাকরির ওয়াদাও। এছাড়া দেশের জনগণকেও আরও অসংখ্য ওয়াদা দেয়া আছে সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে। কিন্তু সরকার জনগণকে দেয়া এসব ওয়াদা থেকে সরে গিয়ে দেশে নিত্য-নতুন রাজনৈতিক বিতর্কের সৃষ্টি করছে। সরকারের দেয়া এসব ওয়াদা থেকে নতুন প্রজন্মকে এবং দেশবাসীর দৃষ্টিকে ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিতেই মূলত এসব নিত্য-নতুন রাজনৈতিক বিতর্কের সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে জনগণের ধারণা। উদ্দেশ্য, সমগ্র দেশবাসীকে এসব রাজনৈতিক বিতর্কে জড়িয়ে ফেলা।
এরই মধ্যে আমাদের জাতীয় নেতৃত্বকে এই বিতর্কে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে। প্রতিনিয়ত উল্লিখিত বিতর্ক নিয়ে সবাই ব্যস্ত আছে। জনগণের মৌলিক সমস্যাগুলো এই বিতর্কের চোরাবালিতে চাপা পড়ে যাচ্ছে। নিত্যপণ্যের মূল্য লাগামহীন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে চালের দাম অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। গত এক মাসে মানভেদে প্রতি কেজি চাল ১০-২০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব মূল্যবৃদ্ধি দেশবাসীর দৃষ্টিতে ‘ফোকাস’ হচ্ছে না। ফোকাস হচ্ছে শুধু নিত্য-নতুন রাজনৈতিক বিতর্ক। রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যেই জড়িয়ে আছে বিরোধী দলের রাজনীতি। সরকার তার সঠিক কৌশল নিয়েই এগোচ্ছে। সরকার তার সৃষ্ট বিতর্কের চোরাবালিতে বিরোধী দলের রাজনীতিকে আটকিয়ে ফেলেছে। আর বিরোধী দলও সরকারের সৃষ্ট রাজনৈতিক বিতর্কেই নিজেদের জড়িয়ে রেখেছে আর ঘরে বসে বসে মার খাচ্ছে। বলা বাহুল্য, আওয়ামী লীগ যদি বিরোধী দল হতো, আর চালের দাম যদি প্রতি কেজি এক মাসের ব্যবধানে ১০-২০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেত, তাহলে কি বিএনপি সরকার চালাতে পারত?
কার্যত চালের দামের গতি-প্রকৃতির সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতি ও ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর গতি-প্রকৃতিও নির্ধারিত হয়ে থাকে। অতীতেও এর প্রতিফলন দেখা গেছে। দেশের বর্তমান চালের বাজার অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। আগামী দু’একমাস হয়তো চালের বাজার আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। এর লক্ষণও দেখা যাচ্ছে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়বে অন্যান্য পণ্যের মূল্যও। আগামী মাসগুলোতে বিদ্যুতের লোডশেডিংও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। পাশাপাশি গ্যাস, পানি ও অন্যান্য সমস্যা তো থাকবেই। সরকারের জন্য এসব আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ, সরকারও এটি আঁচ করছে। আর আঁচ করছে বলেই সরকারের গতি-প্রকৃতি ঘুরে যাচ্ছে ভিন্ন দিকে।
সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেই এই গতি নিত্যদিনের সমস্যা থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে বা রাজনৈতিক বিতর্কের দিকে ধাবিত করে দিয়েছে। উদ্দেশ্য, বিরোধী দলগুলোকে রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যে ব্যতিব্যস্ত রাখা। জনগণের নিত্যদিনের সমস্যাগুলো যাতে ‘ফোকাস’ না হয়।
বিএনপি তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে সরকারের ব্যর্থতাসহ আরও বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে সংসদের ভেতরে ও রাজপথে সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে। সরকারের ধারণা, ভারতের সঙ্গে অসম চুক্তি, সম্ভাব্য তেল-গ্যাস ইজারা চুক্তি, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিসহ নানা বিষয়ে আগামী দিনগুলোতে বিএনপি সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারে। জনগণের নিত্যদিনের সমস্যাগুলো ফোকাস হলে সরকারের জনপ্রিয়তায় চরম ধস নামার সম্ভাবনা আছে। এমনকি সরকার বেকায়দায়ও পড়ে যেতে পারে। ফলে আগামী দিনের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ একক বিএনপির হাতে চলে আসতে পারে। সরকার এটি আঁচ করতে পেরেই বিএনপি নেতৃত্বকে উল্লিখিত ইস্যুগুলো থেকে জিয়ার মরদেহ ও তার সমাধিস্থলের দিকে ডাইভার্ট করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। বিএনপি নেতৃত্ব যাতে জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোর পরিবর্তে তাদের দলীয় নিজস্ব ইস্যু নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকে। সুতরাং বিতর্ক যদি হতে হয় পুরনো কোনো ইস্যু নয়, বিতর্ক হতে হবে নিত্য-নতুন সমস্যা নিয়ে, বিতর্ক হবে জনগণের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে; বিতর্ক হবে দেশে যে নতুন নতুন লাশ পড়ছে, তা নিয়ে। ত্রিশ বছর আগের পুরনো বিষয় নিয়ে নিজেদের বিতর্কে জড়ানো মোটেও সমীচীন নয়। এটিই বিএনপি নেতৃত্বকে অনুধাবন করতে হবে।
ইতিহাসের একটি মীমাংসিত বিষয় নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করে জাতিকে বিভক্ত করার কোনো হেতু হতে পারে না। এই অহেতুক বিতর্কে কি জাতির কোনো প্রাপ্তি আছে? জিয়ার লাশ নিয়ে অহেতুক বিতর্ক তৈরি করে মানুষকে কেবল বোকা বানানো হচ্ছে।
৩০ মে ১৯৮০ সালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে কিছু বিপথগামী সেনাসদস্য কর্তৃক জিয়ার নির্মম মৃত্যু, অতঃপর চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার পাহাড় থেকে সেনাসদস্যদের (যারা বর্তমানেও জীবিত আছে) শহীদ জিয়ার মরদেহ উদ্ধার; পরে মানিক মিয়া এভিনিউয়ে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে তার জানাজা সম্পন্ন এবং সংসদ ভবন সংলগ্ন চন্দ্রিমা উদ্যানে (বর্তমানে জিয়া উদ্যান) তার দাফন সম্পন্ন করা—এসব কোনো লুকিয়ে রাখা বাঁকাচোরা ঘটনা নয়, এটি একটি দলিলকৃত সত্য ঘটনা; এটি একটি ধারণকৃত দৃশ্যমান ঘটনা। লাখ লাখ মানুষ সশরীরে উপস্থিত হয়ে নিজ চোখে ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেছে। ঘটনাটি যেমন ক্যামেরায় ধারণ করা আছে, তেমনি বাংলাদেশসহ বিশ্বের লক্ষ-কোটি মানুষের ধ্যানে-জ্ঞানে ও অন্তরেও ধারণ করা আছে। আর লক্ষ-কোটি মানুষের নিজে দেখা এবং নিজ নিজ ধ্যানে-জ্ঞানে ও অন্তরে ধারণ করা ঘটনা ইতিহাসও ধারণ করে এবং ইতিহাসের অংশ হয়। সুতরাং শহীদ জিয়ার মরদেহটি বর্তমানে কারও দেখা না দেখা এবং তার সমাধিস্থলটি কারও মানা না মানা বা কারও বিরূপ মন্তব্যের পর্যায়ে নেই। শহীদ জিয়ার সমাধিস্থলটি বর্তমান সময়ে ইতিহাসের একটি অংশ হয়ে গেছে। ইতিহাস এই সমাধিস্থলকে তার নিজ বুকে ধারণ করে নিয়েছে। এই সমাধিস্থল ইতিহাসখ্যাত হয়ে আছে।
শহীদ জিয়ার সমাধিস্থল নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করে, কোটি কোটি মানুষের অন্তরে আঘাত দেয়ার দায় কাউকে না কাউকে কাঁধে নিতে হবে। ইতিহাস এই দায় থেকে কাউকেই রেহাই দেবে না।
দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে, ১/১১ এর প্রেক্ষাপটে আমাদের জাতীয় নেতৃত্ব কী নিদারুণ দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছে। শুধু জাতীয় নেতারাই নয়, তাদের পরিবার-পরিজনও নিদারুণ দুঃখ-কষ্ট ও ভয়ভীতির মধ্যে দিনাতিপাত করেছে। এত সহজেই এই দুঃখ-কষ্টের দিনগুলো ভুলে যাওয়ার কথা নয়। এই বাস্তব সত্যটি মনে রাখলে, একে অপরকে খাটো করার রাজনীতি থেকে আমাদের জাতীয় নেতৃত্বকে বেরিয়ে আসতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। একে অপরকে অহেতুক খাটো করলে এর দায়ভার যে কাঁধে নিতে হয়—এই বোধোদয়টি আমাদের জাতীয় নেতৃত্বের ধ্যানে-জ্ঞানে ও অন্তরে আরও অতিমাত্রায় সঞ্চারিত হোক।
আমরা আশির দশকের তরুণ প্রজন্ম, সুস্পষ্ট একটি দর্শন চেতনায় ধারণ করে সামনে অগ্রসর হয়েছিলাম এবং একটি প্রচণ্ড প্রভাবশালী স্বৈর শাসককে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে পরাভূত করে বিনির্মাণ করে দিয়েছিলাম আমাদের জাতীয় নেতৃত্বের কাঠামো। বিনির্মাণ করে দিয়েছিলাম গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ। আমাদের পূর্বসূরিরাই আমাদের এর ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের আজকের প্রজন্ম লাগামহীন, রুচিহীন ও নোংরা রাজনীতির আবর্তে পড়ে তাদের চেতনায় এক ধরনের রাজনীতিহীনতা তৈরি হয়েছে। আজকের দিনের রাজনীতি থেকে নতুন প্রজন্ম স্বেচ্ছায় নিজেদের দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। নেতৃত্ব, গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ আজকের প্রজন্মের কাছ থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্র, গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ যদি বড় ধরনের কোনো সঙ্কটে পড়ে, তাহলে তা পুনরুদ্ধারে আজকের প্রজন্ম কোনো বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারবে বলে রাজনৈতিক সচেতন মহল মনে করে না।
লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক
ই-মেইল : belayet_1@yahoo.com
No comments