মানুষের শত্রুমিত্র- কন্যাদান একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি by মাহমুদ শামসুল হক
বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে মসনদ ও মুকুট রক্ষা একটি প্রাচীন রাজনৈতিক রেওয়াজ। প্রতিপক্ষের আক্রমণ থেকে রাজ্য রক্ষা এবং জীবন রক্ষার তাগিদে শর্তসাপেক্ষ সন্ধি স্থাপনের ইতিহাসও প্রাচীন। সন্ধির শর্ত হিসেবে বিজয়ী শাসক-সেনাপতিকে রাজ্যের কিয়দংশ দান, কর প্রদান কিংবা সম্পূর্ণ বশ্যতা স্বীকার করাসহ নারীদানের ঢের দৃষ্টান্ত রয়েছে ইতিহাসে।
এমনকি স্ত্রীকে বাজি রেখে রাজ্যের অধিকার নির্ণয় করতে সম্মত হয়েছিলেন মহাভারত-এ বর্ণিত কুরু-পাণ্ডবরা। প্রাচীন গ্রিস, মিসর ও অন্যান্য অঞ্চলের শাসকরা সন্ধির শর্ত কিংবা উপঢৌকন হিসেবে পেতেন ধনরত্ন-জীবজন্তুসহ সুন্দরী রমণী। জনৈক মিসরীয় রাজা শান্তি ও সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য নিজ কন্যাসহ তিনশ’ দাসী উপহার দিয়েছিলেন প্রতিপক্ষ রাজাকে। আধুনিক ধনতান্ত্রিক-পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায়ও রাজনৈতিক স্বার্থের প্রশ্নে নারীর অনৈতিক ব্যবহারের প্রচুর দৃষ্টান্ত রয়েছে। মধ্যযুগের ভারতে সন্ধি ও বশ্যতা স্বীকারের একটি অন্যতম শর্ত ছিল কন্যাদান। এখানে এরকম কয়েকটি ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ করছি। এ থেকে আঁচ করা সহজ হবে যে, রাজনীতিতে কামিনী ও কাঞ্চনের প্রভাব কতটা কার্যকর।
পৃথিবীর পূর্বাঞ্চলে সন্ধিসূত্রে কন্যাদানের ঘটনাটি সম্ভবত প্রথম ঘটে ভারতবর্ষে। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার সাম্রাজ্যের পূর্বাংশের শাসনকর্তা হন সেনাপতি সেলুকাস। ৩০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি পাঞ্জাব আক্রমণ করেন। ছয় লাখ সেনা নিয়ে তার মুখোমুখি হন মগধরাজ চন্দ্রগুপ্ত। পরাজয় নিশ্চিত জেনে সেলুকাস সন্ধির প্রস্তাব দেন এবং শর্তানুসারে চন্দ্রগুপ্তকে দান করেন নিজের মেয়েকে। ১৩৬৪ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপ থেকে মুসলমানদের বিতাড়িত করতে ইউরোপীয় রাজাদের আহ্বান জানান ধর্মগুরু পোপ পঞ্চম উর্বান। তার ডাকে সাড়া দিয়ে পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, সার্বিয়া, বুলগেরিয়া, বসনিয়া ও ওয়ালেশিয়ার খ্রিস্টান রাজারা সসৈন্যে গ্রিস সম্রাটকে সাহায্য করতে সমবেত হন গ্রিসের মরিত্সা নদীর তীরে। এই সম্মিলিত বাহিনী পরাজিত হয় তুর্কি সম্রাটের কাছে। এরপর গ্রিকরাজ বার্ষিক কর দেয়ার শর্তে এবং বলগার রাজা কন্যাদান করে সন্ধি করেন। পনের শতকের প্রথম দিকে ভারতের বিজয়নগরের রাজা ছিলেন দেবরায়। বাহমনী রাজ্যের সুলতান ফিরোজশাহর সঙ্গে যুদ্ধে হেরে তিনি আশ্রয় নেন বিজয়নগর দুর্গে। ফিরোজ-সেনারা দুর্গ অবরোধ করার এক পর্যায়ে রাজা দেবরায় বার্ষিক কর এবং নিজ কন্যাদানের শর্তে অব্যাহতি পান। এটি ১৪০৭ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা।
কন্যাদান করে মাথা ও মুকুট রক্ষার সবচেয়ে সাড়া জাগানো ঘটনা ঘটেছে মোঘল আমলে। মোঘল ও রাজপুত রাজনীতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল ‘কন্যাদান-কৌশল।’ বেশ ক’জন রাজপুত রাজন্যের মেয়ে মোঘল হেরেমের মহিষী ছিলেন। তাদের অনেকেই ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত। সবগুলো ঘটনার পেছনে ছিল রাজাদের রাজ্যরক্ষা এবং সম্ভাব্য যুদ্ধ এড়িয়ে চলার নীতি। সন্ধির শর্ত ছাড়াও একাধিক রাজপুতরাজা বশ্যতার উপহার হিসেবে সম্রাটকে কন্যাদান করেছেন। প্রথম ঘটনাটি ঘটে ১৫৬২ খ্রিস্টাব্দে। সম্রাট আকবর অম্বর বা জয়পুর অধিকার করলে সেখানকার রাজা বিহারীমল্ল সম্রাটকে কন্যাদান করে সন্ধিস্থাপন করেন। এই রাজপুত মহিষীই পরবর্তী সম্রাট জাহাঙ্গীরের জননী। এরপর আকবরকে মৈত্রীর স্মারক হিসেবে কন্যাদান করেন বিকানীরের রাজা এবং জয়শল্মীরের রাজা রাজরায়। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, সন্ধির শর্ত হিসেবে আকবর বিয়ে করেছিলেন খান্দেশ অধিপতি মিরন মুবারক শাহের মেয়েকে। মোঘল-রাজপুত মৈত্রীর স্মৃতিস্বরূপ জয়পুররাজ ভগবানদাসের মেয়ে মানবাইকে বিয়ে করেন জাহাঙ্গীর ১৩৮৫ খ্রিস্টাব্দে। একই উদ্দেশ্যে মোঘল হেরেম আক্ষরিক অর্থে আলোকিত করেন যোধপুরের রাজা রানা উদয়সিংহের কন্যা ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে। যিনি ইতিহাসে যোধাবাঈ নামে খ্যাত। তার অন্য নাম মানমতি ও বালমতি। এই যোধাবাঈয়ের গর্ভেই জন্মগ্রহণ করেন সম্রাট শাহজাহান। উপহার তথা স্ত্রী হিসেবে জাহাঙ্গীর পেয়েছিলেন খান্দেশ অধিপতি আলী খানের মেয়েকে। এরপর বিকানিরের রাজা রায়বার সিংহের মেয়ে তার অঙ্কশায়িনী হন। রাজা মানসিংহের দৌহিত্রী জগিসংহের মেয়েকেও বিয়ে করেছিলেন তিনি মোঘল-রাজপুত মৈত্রীর স্মারক হিসেবে। তবে রাজপুত বীর বান্দিলার কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন স্রেফ অনুরোধ রক্ষার তাগিদে। সন্ধির শর্ত হিসেবে সম্রাট আওরঙ্গজেব যাকে বিয়ে করেছিলেন তার নাম নবাববাঈ। তিনি ছিলেন কাশ্মীরের রাজৌরির শাসনকর্তা রাজুর মেয়ে। ১৬৬২ খ্রিস্টাব্দে আসামের গৌহাটি ও সিমলাগড় দখল করেন মোঘল সেনাপতি মীর জুমলা। এ সময় আসামের রাজা জয়ধ্বজ যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সন্ধি করেন। সন্ধির, সাতটি শর্তের প্রথম শর্ত ছিল জয়ধ্বজ নিজের মেয়েকে মোঘল দরবারে পাঠাবেন।
ভগ্নি দান করে রাজ্যরক্ষার একটি ঘটনা ঘটে ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে। ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড সুলতান সালাহউদ্দিনের ভাই সায়েফউদ্দিনের সঙ্গে নিজ বোনের বিয়ে দিয়ে সন্ধি স্থাপন করেন। ১৫১৪ খ্রিস্টাব্দে বাহমনী রাজ্য আক্রমণ করতে গিয়ে সুলতান মাহমুদ শাহ’র হাতে বন্দি হন বিজাপুরের সুলতান আদিল শাহ এবং তার ছেলে আহমদ। মাহমুদ শাহ তাদের মুক্তি দেন এই শর্তে যে, আহমদ তার বোন বিবি সতীকে বিয়ে করবেন। এ প্রস্তাবে পিতা-পুত্র রাজি হন এবং নববধূসহ ফিরে যান রাজধানী বিদরে। বশ্যতা স্বীকার, মৈত্রী ও সন্ধি স্থাপনে কন্যাদান, ভগ্নিদান, দাসীদান এমনকি স্ত্রীদানের আরও অনেক ঘটনার উল্লেখ রয়েছে ইতিহাসে, লোকগাথায়।
এসব ঘটনা প্রমাণ করে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অধস্তনতা কতটা মর্মদাহী। ক্ষমতার কাছে অনেক কিছুর মতো রক্ত সম্পর্কের বন্ধনও গুরুত্বপূর্ণ নয়! একালের ইংরেজ রাজনীতিক ভিজরেইলির ভাষায়, ঞযবত্ব রং হড় মধসনষরহম ষরশব ঢ়ড়ষরঃরপং. কথাটি মিথ্যায় পর্যবসিত হওয়া জরুরি।
পৃথিবীর পূর্বাঞ্চলে সন্ধিসূত্রে কন্যাদানের ঘটনাটি সম্ভবত প্রথম ঘটে ভারতবর্ষে। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার সাম্রাজ্যের পূর্বাংশের শাসনকর্তা হন সেনাপতি সেলুকাস। ৩০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি পাঞ্জাব আক্রমণ করেন। ছয় লাখ সেনা নিয়ে তার মুখোমুখি হন মগধরাজ চন্দ্রগুপ্ত। পরাজয় নিশ্চিত জেনে সেলুকাস সন্ধির প্রস্তাব দেন এবং শর্তানুসারে চন্দ্রগুপ্তকে দান করেন নিজের মেয়েকে। ১৩৬৪ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপ থেকে মুসলমানদের বিতাড়িত করতে ইউরোপীয় রাজাদের আহ্বান জানান ধর্মগুরু পোপ পঞ্চম উর্বান। তার ডাকে সাড়া দিয়ে পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, সার্বিয়া, বুলগেরিয়া, বসনিয়া ও ওয়ালেশিয়ার খ্রিস্টান রাজারা সসৈন্যে গ্রিস সম্রাটকে সাহায্য করতে সমবেত হন গ্রিসের মরিত্সা নদীর তীরে। এই সম্মিলিত বাহিনী পরাজিত হয় তুর্কি সম্রাটের কাছে। এরপর গ্রিকরাজ বার্ষিক কর দেয়ার শর্তে এবং বলগার রাজা কন্যাদান করে সন্ধি করেন। পনের শতকের প্রথম দিকে ভারতের বিজয়নগরের রাজা ছিলেন দেবরায়। বাহমনী রাজ্যের সুলতান ফিরোজশাহর সঙ্গে যুদ্ধে হেরে তিনি আশ্রয় নেন বিজয়নগর দুর্গে। ফিরোজ-সেনারা দুর্গ অবরোধ করার এক পর্যায়ে রাজা দেবরায় বার্ষিক কর এবং নিজ কন্যাদানের শর্তে অব্যাহতি পান। এটি ১৪০৭ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা।
কন্যাদান করে মাথা ও মুকুট রক্ষার সবচেয়ে সাড়া জাগানো ঘটনা ঘটেছে মোঘল আমলে। মোঘল ও রাজপুত রাজনীতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল ‘কন্যাদান-কৌশল।’ বেশ ক’জন রাজপুত রাজন্যের মেয়ে মোঘল হেরেমের মহিষী ছিলেন। তাদের অনেকেই ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত। সবগুলো ঘটনার পেছনে ছিল রাজাদের রাজ্যরক্ষা এবং সম্ভাব্য যুদ্ধ এড়িয়ে চলার নীতি। সন্ধির শর্ত ছাড়াও একাধিক রাজপুতরাজা বশ্যতার উপহার হিসেবে সম্রাটকে কন্যাদান করেছেন। প্রথম ঘটনাটি ঘটে ১৫৬২ খ্রিস্টাব্দে। সম্রাট আকবর অম্বর বা জয়পুর অধিকার করলে সেখানকার রাজা বিহারীমল্ল সম্রাটকে কন্যাদান করে সন্ধিস্থাপন করেন। এই রাজপুত মহিষীই পরবর্তী সম্রাট জাহাঙ্গীরের জননী। এরপর আকবরকে মৈত্রীর স্মারক হিসেবে কন্যাদান করেন বিকানীরের রাজা এবং জয়শল্মীরের রাজা রাজরায়। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, সন্ধির শর্ত হিসেবে আকবর বিয়ে করেছিলেন খান্দেশ অধিপতি মিরন মুবারক শাহের মেয়েকে। মোঘল-রাজপুত মৈত্রীর স্মৃতিস্বরূপ জয়পুররাজ ভগবানদাসের মেয়ে মানবাইকে বিয়ে করেন জাহাঙ্গীর ১৩৮৫ খ্রিস্টাব্দে। একই উদ্দেশ্যে মোঘল হেরেম আক্ষরিক অর্থে আলোকিত করেন যোধপুরের রাজা রানা উদয়সিংহের কন্যা ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে। যিনি ইতিহাসে যোধাবাঈ নামে খ্যাত। তার অন্য নাম মানমতি ও বালমতি। এই যোধাবাঈয়ের গর্ভেই জন্মগ্রহণ করেন সম্রাট শাহজাহান। উপহার তথা স্ত্রী হিসেবে জাহাঙ্গীর পেয়েছিলেন খান্দেশ অধিপতি আলী খানের মেয়েকে। এরপর বিকানিরের রাজা রায়বার সিংহের মেয়ে তার অঙ্কশায়িনী হন। রাজা মানসিংহের দৌহিত্রী জগিসংহের মেয়েকেও বিয়ে করেছিলেন তিনি মোঘল-রাজপুত মৈত্রীর স্মারক হিসেবে। তবে রাজপুত বীর বান্দিলার কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন স্রেফ অনুরোধ রক্ষার তাগিদে। সন্ধির শর্ত হিসেবে সম্রাট আওরঙ্গজেব যাকে বিয়ে করেছিলেন তার নাম নবাববাঈ। তিনি ছিলেন কাশ্মীরের রাজৌরির শাসনকর্তা রাজুর মেয়ে। ১৬৬২ খ্রিস্টাব্দে আসামের গৌহাটি ও সিমলাগড় দখল করেন মোঘল সেনাপতি মীর জুমলা। এ সময় আসামের রাজা জয়ধ্বজ যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সন্ধি করেন। সন্ধির, সাতটি শর্তের প্রথম শর্ত ছিল জয়ধ্বজ নিজের মেয়েকে মোঘল দরবারে পাঠাবেন।
ভগ্নি দান করে রাজ্যরক্ষার একটি ঘটনা ঘটে ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে। ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড সুলতান সালাহউদ্দিনের ভাই সায়েফউদ্দিনের সঙ্গে নিজ বোনের বিয়ে দিয়ে সন্ধি স্থাপন করেন। ১৫১৪ খ্রিস্টাব্দে বাহমনী রাজ্য আক্রমণ করতে গিয়ে সুলতান মাহমুদ শাহ’র হাতে বন্দি হন বিজাপুরের সুলতান আদিল শাহ এবং তার ছেলে আহমদ। মাহমুদ শাহ তাদের মুক্তি দেন এই শর্তে যে, আহমদ তার বোন বিবি সতীকে বিয়ে করবেন। এ প্রস্তাবে পিতা-পুত্র রাজি হন এবং নববধূসহ ফিরে যান রাজধানী বিদরে। বশ্যতা স্বীকার, মৈত্রী ও সন্ধি স্থাপনে কন্যাদান, ভগ্নিদান, দাসীদান এমনকি স্ত্রীদানের আরও অনেক ঘটনার উল্লেখ রয়েছে ইতিহাসে, লোকগাথায়।
এসব ঘটনা প্রমাণ করে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অধস্তনতা কতটা মর্মদাহী। ক্ষমতার কাছে অনেক কিছুর মতো রক্ত সম্পর্কের বন্ধনও গুরুত্বপূর্ণ নয়! একালের ইংরেজ রাজনীতিক ভিজরেইলির ভাষায়, ঞযবত্ব রং হড় মধসনষরহম ষরশব ঢ়ড়ষরঃরপং. কথাটি মিথ্যায় পর্যবসিত হওয়া জরুরি।
No comments