এই নগরীর দিনরাত্রীঃ এখন ভরা বসন্ত by রেজোয়ান সিদ্দিকী

শীত চলিয়া গিয়াছে। এখন আর খুব বেশি মানুষের গায়ে গরম বস্ত্র নাই। চাদর, মাফলার, সোয়েটার, জ্যাকেট উধাও হইয়া গিয়াছে। ভোরে কিংবা সন্ধ্যায় কোনো কোনো নাগরিকের গায়ে স্যুট দেখা যায়। আর একশ্রেণীর মানুষ আছেন তাহারা বত্সর জুড়িয়া স্যুট-টাই পরিয়া থাকেন।

তাহাদের কথা আলাদা, বাকি সবকিছু স্বাভাবিক হইয়া আসিয়াছে। শীত চলিয়া যাইয়া সরাসরি গ্রীষ্ম আসিয়া হাজির হয় নাই। এখন শীতের সঙ্গে গ্রীষ্মের সেতু বন্ধনের কাল চলিতেছে। কিন্তু কী আশ্চর্য, নগরীতেও তাহার প্রতিফলন ঘটিতেছে! আশপাশে বিচিত্র ফুলের সমারোহ। ঘন বৃক্ষরাজির নিচে বসন্তের ঘ্রাণ বহিয়া যাইতেছে। আমের মুকুল গাছগুলোকে ঢাকিয়া দিয়াছে। সবুজে মিশানো হলুদ ফুলে ছাইয়া গিয়াছে। গ্রীষ্মের অন্যান্য ফল গাছও মুকুলিত হইয়া উঠিয়াছে। সাজিনা সাদা ফুলে চারিদিক একাকার। মৌমাছির গুঞ্জন বাড়িয়াছে। ঘাসের ভিতরে ছোট্ট সাদা ফুল কোথা হইতে যেন মাথা বাহির করিয়া হাসিয়া দিতেছে। পলাশ ফুল ফুটিয়া প্রকৃতি লালে লাল হইয়া গিয়াছে। শিমুলের বড় বড় লাল ফুল মনে রং ধরাইয়া দিতেছে। সিঙ্গারার মতো ফুল ভেদ করিয়া কাঁঠালের মোচা আত্মপ্রকাশ করিতেছে। হঠাত্ হঠাত্ উদাস দুপুরে কোকিল কুউ বলিয়া ডাকিয়া উঠিতেছে। অন্য পাখিরা মুখে মুখে বাসা বাঁধিবার উপকরণ লইয়া গাছের ডালে জানালার কার্নিশে কিংবা ভেন্টিলেটারর ফোকরে ফোকরে ছুটিতেছে। গ্রীষ্ম আসিবার পূর্বেই ডিম পাড়িয়া ছানা ফুটাইয়া তাহাদিগকে উড়িতে শিখাইয়া বিদায় জানাইতে হইবে। তাই প্রকৃতিতে এতসব আয়োজন চলিতেছে।
সাজিনার সাদা ফুলের ভিতরে সুচের মাথার মতো ছোট্ট একটু সাজিনা ফল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করিতেছে। তারপর প্রতিদিন বাড়িয়া বাড়িয়া একটি করিয়া ক্ষুদ্র সাজিনায় রূপান্তরিত হইতেছে। সামান্য হাওয়ায় ছোট ছোট পাতাওয়ালা গাছগুলো হইতে অসংখ্য মৃত পাতা বৃষ্টির ফোঁটার মতো ঝরিয়া পড়িতেছে। আম গাছের নিচে মৃত মুকুলের আস্তরণ জমিতেছে। সাজিনা গাছের নিচে শিউলির মতো সাদা ফুল যেন দুগ্ধ ফেননিভ সজ্জা পাতিয়া দিয়াছে। দুপুরের দিকে প্রকৃতি কেমন যেন ঝিম মারিয়া যাইতেছে। তাহার মধ্যে দুই একটি ভারী পাতা গাছের ডাল হইতে ঝরিয়া ঘুরিতে ঘুরিতে ভূমিতে পতিত হইতেছে।
ইহার ভিতর আবার কোথায় যেন সৃষ্টির গতি সঞ্চারিত হইতেছে। কিছু কিছু গাছে লাল-সবুজে মেশানো কচু পাতা ফুঁড়িয়া বাহির হইতেছে। পত্রপল্লবহীন যে নিম গাছগুলো এতদিন জীবন্মৃত ঠায় দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাদের ডগায় ডগায় কচি ছোট পাতা গুচ্ছে গুচ্ছে মুখ বাহির করিতেছে। কাঁঠাল গাছের ডালের শীর্ষে শীর্ষে দুইটি করিয়া ধবধবে গাঢ় সবুজ পাতা ফুটিয়া বাহির হইয়াছে। তাহার চারিপাশের বড় পাতাগুলি ধূলিতে ধূসরিত হইয়া রহিয়াছে। বৃষ্টি নাই, এতদিন কেবলই ধূলি জমাট বাঁধিয়াছে। পরিষ্কার থাকিবার উপায় ছিল না। কিন্তু নতুন পাতাগুলি এখনও পরিচ্ছন্ন। তাহারা ধূলিময় হইবার আগেই বৃষ্টি আসিয়া সকল পাতা ধুইয়া-মুছিয়া পরিচ্ছন্ন করিয়া দিয়া যাইবে।
এই যে বৃক্ষের পত্রালিসব এমন করিয়া ধূলি আটকাইয়া রাখিয়াছে তাহারই বা কারণ কী? ইহাও অকারণে ঘটে নাই। পুরা শীতকাল জুড়িয়া বৃষ্টি থাকে না। বসন্তেও বৃষ্টি হইবার সম্ভাবনা নাই। বৃক্ষের পাতারা যদি ধূলি আটকাইয়া না রাখিত তাহা হইলে মানুষ বা অন্য প্রাণীর চলাচলই বাধাগ্রস্ত থাকিত। বাতাসও ধূলিতে ধূলিময় হইয়া যাইত। প্রকৃতির তাই আশ্চর্য নিয়ম। সে বৃষ্টিহীন ঋতুতে পত্রপল্লবেই কোটি কোটি টন ধূলির প্রবাহ আটকাইয়া রাখে। একটি আম পাতাই আটকায় পাঁচ মিলিগ্রাম ধূলি।
এইভাবেই পরস্পরের ওপর নির্ভর করিয়া ঋতুতে বৈচিত্র্য আনিয়া ভারসাম্য রক্ষা করিয়া প্রাণিজগত্ টিকিয়া রহিয়াছে। কোথায়ও এই ধারার ব্যত্যয় ঘটিলে সেই ভারসাম্য নষ্ট হইয়া যায়। তাহাতে কাহারও লাভ নাই। বরং সকল প্রজাতিরই সমূহ ক্ষতি আসন্ন।
গ্যাস-বিদ্যুত্ নাই
২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে দুই বছরের স্বৈরশাসনে দিশাহারা মানুষ আশার কথা শুনিতে চাহিয়াছিল। নগর জনপদ ভেদে সেই আশায় ফারাক কিছু আছিল বৈকি। পল্লী অঞ্চলের কৃষকদের চাওয়া ছিল সারের অব্যাহত সরবরাহ, ডিজেল বিদ্যুতের নিশ্চয়তা, সময়মত বীজ আর প্রয়োজনীয় কৃষিঋণ। নাগরিকদের চাহিদা ভিন্ন। তাহারা চাহিয়া ছিলেন গ্যাস-বিদ্যুতেরই, নিরাপত্তা, জানমালের নিরাপত্তা, অকারণ হয়রানির অবসান আর কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি।
পুরাতন স্বৈরশাসকদের লইয়া গঠিত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সেইসব মিটাইয়া দিবার কী চমত্কার অঙ্গীকারই না করিয়াছিল। বিদ্যুতের সঙ্কট থাকিবে না। গ্যাসের সঙ্কট থাকিবে না। পানির সঙ্কট থাকিবে না। চাউলের মূল্য কেজিপ্রতি ১০ টাকা হইবে। কাঁচা মরিচ পাঁচ টাকা। কৃষক সার পাইবে বিনামূল্যে। সেচ সুবিধার জন্য কৃষকের শ্যালো-ডিপ টিউবওয়েলে সারাক্ষণ বিদ্যুত্ থাকিবে। নগরীর যানজট সমস্যার সমাধান হইয়া যাইবে। ফ্লাইওভার, আকাশ রেল, পাতাল রেল চালু হইবে। মহাজোটকে ভোট দিলে নাগরিকরা যাহা যাহা চাহিবে তাহার সবকিছু পূরণ করিয়া দেওয়া হইবে। স্বৈরাচারপীড়িত নাগরিকরা এসব আশার বাণীতে বুক বাঁধিয়াছিলেন। তাহার ওপর পতিত স্বৈরাচার ও তাহাদের মনোনীত নির্বাচন কমিশন মিলিয়া-মিশিয়া মহাজোটকে ক্ষমতাসীন করিয়া দিয়াছে।
ইহাতে বোধ করি নাগরিকদের খুব বেশি আসিত-যাইত না। তাহারা যদি অঙ্গীকার অনুযায়ী সকল কিছু পাইতেন তাহা হইলে ক্ষোভেরও কারণ ঘটিত না। মহাজোট যেইসব অঙ্গীকার করিয়াছিল তাহা বাস্তবায়ন হইলে যাহারা তাহাদের এবার ভোট দেয় নাই সম্ভবত আগামীবার তাহাদিগকে ভোট প্রদান করিত। কিন্তু নাগরিকরা ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনের প্রাক্কালে ভাবিয়া দেখিবার সুযোগ পায় নাই যে, যে অঙ্গীকার শুনিয়া তাহাদের মন উতালা হইয়াছে সেই সব অঙ্গীকার আদৌ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হইবে কিনা।
এখন নাগরিকদের আশা ভঙ্গের কাল শুরু হইয়া গিয়াছে। মহাজোট ক্ষমতায় বসিবার পর নাগরিকরা দাবি করিল এবার ওয়াদা পূরণের ব্যবস্থা করুন, এই কথা শুনিয়া হিংস্র হইয়া উঠিল সরকার। তাহারা উচ্চস্বরে বলিতে থাকিল যে, আলাদিনের চেরাগ হাতে লইয়া আসি নাই যে ঘষা দিলেই সকল সমস্যার সমাধান হইয়া যাইবে। অপেক্ষা করিয়া থাকুন, ধীরে ধীরে সমাধান আসিবে।
এই রকম ধমক খাইয়া নাগরিকরা হয়তো কিছুটা অপেক্ষাই করিতে ছিলেন; কিন্তু তাহার মধ্যে নানান কাণ্ড ঘটিয়া যাইতে শুরু করিয়াছে। বিদ্যুতের সঙ্কট তার মধ্যে প্রবল। এক বছর চলিয়া গিয়াছে সরকার বিদ্যুতের উত্পাদন বাড়াইতে পারে নাই। গ্রীষ্ম এখনও আসেই নাই। তাহারই মধ্যে ব্যাপক লোডশেডিং শুরু হইয়া গিয়াছে। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসিবার পর নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো পণ্যেরই দাম কমে নাই বরং প্রতিদিন হু হু করিয়া নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বাড়িতেছে। চাল-ডাল, পিঁয়াজ, রসুন, আদা, তেলের মূল্য আকাশ ছুঁইয়া আছে। সরকারের বিভিন্নজন এই জন্য বিভিন্ন জনকে দোষারোপ করিতেছে। তাহাতে নাগরিকদের সুবিধা হইবার কোনো সম্ভাবনা নাই। তাহারা এইরকম বোঝেন যে, টাকা লইয়া ব্যাগ হাতে বাজারে যাইবেন, সঙ্গত মূল্যে পণ্য ক্রয় করিবেন। তাহার পর হাসিমুখে ঘরে ফিরে আসিবেন। সেই রকম কোনো ব্যবস্থার কথা সরকার ভাবিতেছে বলিয়া ভুলেও মনে হইতেছে না। সরকার তাহার সমস্ত শক্তি যেন নিয়োগ করিয়াছে বিরোধী দল দমন ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করিবার জন্য। যাহা ইস্যু নহে নির্বাচনের আগে যেসব কথা সরকার মুখেও আনে নাই সেইসব কাজই যেন তাহাদের মুখ্য কর্মে পরিণত হইয়াছে। নাগরিকের কী প্রয়োজন সেই দিকে সরকারের বিন্দুমাত্রও খেয়াল নাই।
এখন সারাদেশে গ্যাসের সঙ্কট তীব্র হইয়া উঠিয়াছে। বহু এলাকায় চুলা জ্বলিতেছে না। সিএনজি স্টেশনে প্রেসার থাকিতেছে না। কারখানা চলিতেছে না। গ্যাসের অভাবে বিদ্যুত্ও উত্পাদন করা যাইতেছে না। কিন্তু গ্যাসের উত্পাদন বৃদ্ধি ও বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য কার্যকর কোনো পদক্ষেপ সরকার গ্রহণ করিতেছে না। বরং মানুষের এই দুর্ভোগের সময় প্রধানমন্ত্রী সহাস্য বদনে অবলীলায় বলিয়া বসিয়াছেন যে, আল্লাহতায়ালা জন বুঝিয়া ধন দেন। তাই এর আগে ১৯৯৬-২০০১ সালে তাহারা যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন দেশ গ্যাসের ওপরে ভাসিতেছিল, এরপর চারদলীয় জোট ক্ষমতা গ্রহণ করিলে দেশ গ্যাসশূন্য হইয়া পড়ে। তাহারা আবারও ক্ষমতায় আসিয়াছেন সুতরাং ভবিষ্যতে দেশ আবারও গ্যাসের ওপরে ভাসিতে শুরু করিবে। উহা যে কবে করিবে তাহার নিশ্চয়তা কেহ দিতে পারিতেছে না।
সুতরাং গ্যাসের রেশন করিবার পরিকল্পনা নেওয়া হইতেছে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী সপ্তাহে পাঁচদিন ৯টা হইতে ৪টা পর্যন্ত সিএনজি স্টেশনে গ্যাস বন্ধ করিয়া দিবার প্রস্তাব করিয়াছে সরকার, নাগরিকরা প্রমাদ গুনিতেছে। গ্যাস বন্ধ করিয়া দিলে যান চলাচলের কী হইবে? অত মূল্যে পেট্রোল-অকটেন কিনিয়া তাহারা চলাচল করিবে কী করিয়া? সরকার হয়তো ভাবিতেছে, যে পারিবে সে যানবাহন চালাক, যে পারিবে না সে বন্ধ করিয়া দিক। ইহার নাম কি রাষ্ট্র পরিচালনা? ইহার নাম কি জনগণের সরকার?
নগর পদ্য
একজন লোক আছে রাজধানী ঢাকাতে
বলে, শিক্ষা দিয়ে দেব লোক কিবা জনেতে,
সবে মেরে ডাণ্ডা করে দেব ঠাণ্ডা
রবে শুধু মোর দল একটাই ঝাণ্ডা
বাকি সব গুঁড়িয়ে সুখে রবো ঢাকাতে।

ফুটনোট
জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলিয়াছেন, ‘বিএনপিকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য জিয়ার নাম বদলিয়েছি।’ একথা শুনিয়া মন্তব্য করিলেন জনৈক নাগরিক, ‘ভবিষ্যতে কেউ আবার তাকে শিক্ষা দিয়ে দেবে না তো?’

No comments

Powered by Blogger.