আলোয় ভূবন ভরা- লাইবেরিয়াঃ আমেরিকা কেবল নিতেই জানে, দিতে জানে না by কাজী জহিরুল ইসলাম
মনরোভিয়া বিমানবন্দরে আমাদের ডেশ-সেভেন অবতরণ করার আগে নিচে তাকিয়ে রীতিমত ভড়কে যাই। কী আশ্চর্য, আমরা কি পানিতে নামছি? একপাল মেঘ মাঠে চড়ানো মেষপালের মতো আমাদের ঘিরে ধরেছিল ঠিকই। মেঘের পালকে পাশ কাটিয়ে কানাডিয়ান ক্যাপ্টেন নেমে এসেছেন লাইবেরিয়ার মাটিতে।
নামার আগে আকাশ থেকে দেখি মনরোভিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে জলারণ্য। যেন এক হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে আছে হাজার হাজার বৃক্ষের সারি। এখানে কি বন্যা হয়েছে? না, এই অরণ্য লাইবেরিয়ার বিখ্যাত ম্যানগ্রোভ অরণ্য। আমরা ম্যানগ্রোভ অরণ্য পেরিয়ে এখন লাইবেরিয়ার রাজধানী মনরোভিয়াতে।
হতদরিদ্র এক বিমানবন্দর। পুরো বন্দরে চোখে পড়ার মতো যদি কিছু থাকে, তা হলো এখানকার ইউএন মিশনের মুভকন অফিস। আমরা লাইবেরিয়া থেকে আরও কিছু সহকর্মীকে নিয়ে উড়াল দেব সিয়েরা লিয়নের লুঙ্গি বিমানবন্দরের উদ্দেশে। খুব ভোরে রওনা হওয়ার কারণে সকালে নাস্তা খেয়ে আসতে পারিনি। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। সবাই যখন মুভকনের অফিসে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে, আমি তখন ঢুকে পড়ি বন্দর ভবনের ভেতরে। প্রকৃতপক্ষে ভবন-টবন বলে কিছু নেই। ভাঙাচুরা কিছু বেখাপ্পা ধরনের দালান, ভেতরটা এত অন্ধকার আর নোংরা যে দুর্গন্ধে বমি আসার জোগাড়। খাবারের দোকান বলতে কারওয়ান বাজারের মাছের পসরা যেখানে বসে সেরকম একটি উঁচু ফ্লোরের ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এক লোক কিছু শক্ত পাউরুটি আর কালসিটে পড়া ফ্লাস্ক থেকে ঢেলে লাল চা বিক্রি করছে। নিজের রুচির সঙ্গে যুদ্ধ করে আমি হেরে গেলাম। ফিরে এলাম মুভকনের অফিসে।
গৃহযুদ্ধের আগুনে পুড়ছে আফ্রিকার অনেক দেশ। হুতু-তুতসি কনফ্লিক্ট ধ্বংস করে দিয়েছে রুয়ান্ডাকে। কঙ্গোতে এখনও চলছে গৃহযুদ্ধ; চলছে সুদান, আইভরিকোস্ট, গিনিসহ আরও অনেক দেশে। কিন্তু লাইবেরিয়ার মতো এত খারাপ অবস্থা আর কোনো দেশের হয়নি। এর কারণ কী? কেন এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও একটি দেশের নিজস্ব কোনো বিদ্যুত্ উত্পাদন ব্যবস্থা নেই? ভাবতে কেমন অবাক লাগে, লাইবেরিয়াতে বিদ্যুত্ নেই। ধনী লোকদের বাড়িতে আলো জ্বলে নিজস্ব জেনারেটর দিয়ে। বোধ করি পৃথিবীতে একমাত্র দেশ লাইবেরিয়া যে দেশে বিদ্যুত্ নেই। আধুনিক সভ্যতার চাকা ঘোরাতে সর্বপ্রথম যা প্রয়োজন তা হলো বিদ্যুত্।
এক লাখ এগারো হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দেশটিতে লোক বাস করে মাত্র ৩৫ লাখ। তিন দিকে আইভরিকোস্ট, গিনি এবং সিয়েরা লিয়ন আর একদিকে অবারিত আটলান্টিক। লাইবেরিয়াতে রয়েছে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ। হীরা আর স্বর্ণ ছাড়াও আছে অফুরন্ত বনজ সম্পদ, আছে বিস্তীর্ণ সমতলভূমি। কিন্তু অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে আজ লাইবেরিয়া পরিণত হয়েছে সম্পূর্ণ এক ব্যর্থ রাষ্ট্রে। বহির্বিশ্বের কাছে দেশটির দেনার পরিমাণ সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার। অর্থাত্ মাথাপিছু এক হাজার ডলারেরও বেশি। দেশটির রফতানি আয় মাত্র ৯১০ মিলিয়ন ডলার হলেও আমদানি ব্যয় এর পাঁচগুণ বেশি, প্রায় ৫ মিলিয়ন ডলার।
ইংরেজ, ফরাসি এবং স্পেনিশরা সারা পৃথিবী দাপিয়ে বেড়িয়েছে। তৈরি করেছে অসংখ্য উপনিবেশ। এসব উপনিবেশ স্বাধীনতালাভের পর থেকে ক্রমশ উন্নয়নের সোপানে পা রেখে হাঁটতে শুরু করেছে। লাইবেরিয়া কিন্তু সেই অর্থে কখনোই উপনিবেশ ছিল না। ১৮২১ সালে আমেরিকা একদল কৃষ্ণাঙ্গ দাসকে মুক্ত করে নিয়ে আসে লাইবেরিয়ায়, ওরাই আমেরিকার আদলে গড়ে তোলে স্বাধীন লাইবেরিয়া রাষ্ট্র। এত প্রাচীন একটি দেশের এই হতদরিদ্র চেহারা কেন? কারণ একটাই, লাইবেরিয়া প্রকৃতপক্ষে কখনোই স্বাধীন দেশ ছিল না। সেই ১৮২১ সাল থেকেই এই দেশটির গলায় দাসত্বের শৃঙ্খল ঝুলছে। পেছন থেকে লাইবেরিয়া শসন করছে মূলত আমেরিকা। আসলে আরও পরিষ্কার করে বলা উচিত, শাসন নয়—শোষণ করছে আমেরিকা। অন্য ঔপনিবেশিক প্রভুরা নিয়েছে প্রচুর, তবে কিছু দিয়েছেও। কিন্তু মার্কিনিরা কেবল নিতেই জানে, দিতে জানে না। লাইবেরিয়ার সোনা আর হীরা প্রায় সব চলে গেছে আমেরিকার পেটে। জাহাজ ভরে নিয়ে যাচ্ছে মূল্যবান টিম্বার। মার্কিনিরা ‘গণতন্ত্র’ নামক এক মধুর শব্দ মানুষের কানে মন্ত্রের মতো ঢুকিয়ে বেহুঁশ করে দেয়। এরপর শুরু হয় ওদের লুটতরাজের খেলা। আফগানিস্তানেও তো এই ঘটনাই ঘটল। গণতন্ত্রের নামে বসিয়ে দিয়েছে মার্কিন তেল কোম্পানির ম্যানেজার হামিদ কারজাইকে। গত প্রায় এক দশকে কতটুকু এগিয়েছে আফগানিস্তান? এক সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশ ছিল ইরাক। আজ কী অবস্থা সেই ইরাকের? প্রতিদিনই বোমা বিস্ফোরণ, নিজেরা নিজেদের হত্যা করছে ইরাকের মানুষ। এই অবস্থার জন্য কে দায়ী? ‘গণতন্ত্র’ নামক মধু এখন ইরাকিদের কাছে, আফগানদের কাছে এক বিষের পিপা ছাড়া আর কিছুই নয়।
১৯৮৯ থেকে ১৯৯৯, এই দশ বছর ধরে গৃহযুদ্ধের আগুনে পুড়েছে লাইবেরিয়া। এরপর জাতিসংঘ আসে। সমঝোতা
হয়। এক সময় নির্বাচন হয়। এখন
একটি গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায়,
যার নেতৃত্বে রয়েছেন হার্ভার্ড গ্রাজুয়েট এলেন জনসন সার্লিফ। মিসেস সার্লিফ
এক সময় আমেরিকান সিটি ব্যাংকের ডাইরেক্টর হিসেবে নাইরোবিতে ও
পরে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওয়াশিংটন ডিসিতে কাজ করেন। পরে তিনি ইউএনডিপির রিজিওনাল ডাইরেক্টর হিসেবেও কাজ করেন। অবশ্য এরও
আগে তিনি লাইবেরিয়ার সহকারী
অর্থমন্ত্রী ছিলেন। চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে বলা যায়, লাইবেরিয়া এখনও মার্কিন অনুশাসনের মধ্যেই রয়েছে। আর তাই এ দেশের উন্নতি এখনও সুদূরপরাহত। কারণ আমেরিকা কেবল নিতেই জানে, দিতে জানে না।
লেখক : কবি, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা
হতদরিদ্র এক বিমানবন্দর। পুরো বন্দরে চোখে পড়ার মতো যদি কিছু থাকে, তা হলো এখানকার ইউএন মিশনের মুভকন অফিস। আমরা লাইবেরিয়া থেকে আরও কিছু সহকর্মীকে নিয়ে উড়াল দেব সিয়েরা লিয়নের লুঙ্গি বিমানবন্দরের উদ্দেশে। খুব ভোরে রওনা হওয়ার কারণে সকালে নাস্তা খেয়ে আসতে পারিনি। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। সবাই যখন মুভকনের অফিসে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে, আমি তখন ঢুকে পড়ি বন্দর ভবনের ভেতরে। প্রকৃতপক্ষে ভবন-টবন বলে কিছু নেই। ভাঙাচুরা কিছু বেখাপ্পা ধরনের দালান, ভেতরটা এত অন্ধকার আর নোংরা যে দুর্গন্ধে বমি আসার জোগাড়। খাবারের দোকান বলতে কারওয়ান বাজারের মাছের পসরা যেখানে বসে সেরকম একটি উঁচু ফ্লোরের ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এক লোক কিছু শক্ত পাউরুটি আর কালসিটে পড়া ফ্লাস্ক থেকে ঢেলে লাল চা বিক্রি করছে। নিজের রুচির সঙ্গে যুদ্ধ করে আমি হেরে গেলাম। ফিরে এলাম মুভকনের অফিসে।
গৃহযুদ্ধের আগুনে পুড়ছে আফ্রিকার অনেক দেশ। হুতু-তুতসি কনফ্লিক্ট ধ্বংস করে দিয়েছে রুয়ান্ডাকে। কঙ্গোতে এখনও চলছে গৃহযুদ্ধ; চলছে সুদান, আইভরিকোস্ট, গিনিসহ আরও অনেক দেশে। কিন্তু লাইবেরিয়ার মতো এত খারাপ অবস্থা আর কোনো দেশের হয়নি। এর কারণ কী? কেন এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও একটি দেশের নিজস্ব কোনো বিদ্যুত্ উত্পাদন ব্যবস্থা নেই? ভাবতে কেমন অবাক লাগে, লাইবেরিয়াতে বিদ্যুত্ নেই। ধনী লোকদের বাড়িতে আলো জ্বলে নিজস্ব জেনারেটর দিয়ে। বোধ করি পৃথিবীতে একমাত্র দেশ লাইবেরিয়া যে দেশে বিদ্যুত্ নেই। আধুনিক সভ্যতার চাকা ঘোরাতে সর্বপ্রথম যা প্রয়োজন তা হলো বিদ্যুত্।
এক লাখ এগারো হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দেশটিতে লোক বাস করে মাত্র ৩৫ লাখ। তিন দিকে আইভরিকোস্ট, গিনি এবং সিয়েরা লিয়ন আর একদিকে অবারিত আটলান্টিক। লাইবেরিয়াতে রয়েছে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ। হীরা আর স্বর্ণ ছাড়াও আছে অফুরন্ত বনজ সম্পদ, আছে বিস্তীর্ণ সমতলভূমি। কিন্তু অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে আজ লাইবেরিয়া পরিণত হয়েছে সম্পূর্ণ এক ব্যর্থ রাষ্ট্রে। বহির্বিশ্বের কাছে দেশটির দেনার পরিমাণ সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার। অর্থাত্ মাথাপিছু এক হাজার ডলারেরও বেশি। দেশটির রফতানি আয় মাত্র ৯১০ মিলিয়ন ডলার হলেও আমদানি ব্যয় এর পাঁচগুণ বেশি, প্রায় ৫ মিলিয়ন ডলার।
ইংরেজ, ফরাসি এবং স্পেনিশরা সারা পৃথিবী দাপিয়ে বেড়িয়েছে। তৈরি করেছে অসংখ্য উপনিবেশ। এসব উপনিবেশ স্বাধীনতালাভের পর থেকে ক্রমশ উন্নয়নের সোপানে পা রেখে হাঁটতে শুরু করেছে। লাইবেরিয়া কিন্তু সেই অর্থে কখনোই উপনিবেশ ছিল না। ১৮২১ সালে আমেরিকা একদল কৃষ্ণাঙ্গ দাসকে মুক্ত করে নিয়ে আসে লাইবেরিয়ায়, ওরাই আমেরিকার আদলে গড়ে তোলে স্বাধীন লাইবেরিয়া রাষ্ট্র। এত প্রাচীন একটি দেশের এই হতদরিদ্র চেহারা কেন? কারণ একটাই, লাইবেরিয়া প্রকৃতপক্ষে কখনোই স্বাধীন দেশ ছিল না। সেই ১৮২১ সাল থেকেই এই দেশটির গলায় দাসত্বের শৃঙ্খল ঝুলছে। পেছন থেকে লাইবেরিয়া শসন করছে মূলত আমেরিকা। আসলে আরও পরিষ্কার করে বলা উচিত, শাসন নয়—শোষণ করছে আমেরিকা। অন্য ঔপনিবেশিক প্রভুরা নিয়েছে প্রচুর, তবে কিছু দিয়েছেও। কিন্তু মার্কিনিরা কেবল নিতেই জানে, দিতে জানে না। লাইবেরিয়ার সোনা আর হীরা প্রায় সব চলে গেছে আমেরিকার পেটে। জাহাজ ভরে নিয়ে যাচ্ছে মূল্যবান টিম্বার। মার্কিনিরা ‘গণতন্ত্র’ নামক এক মধুর শব্দ মানুষের কানে মন্ত্রের মতো ঢুকিয়ে বেহুঁশ করে দেয়। এরপর শুরু হয় ওদের লুটতরাজের খেলা। আফগানিস্তানেও তো এই ঘটনাই ঘটল। গণতন্ত্রের নামে বসিয়ে দিয়েছে মার্কিন তেল কোম্পানির ম্যানেজার হামিদ কারজাইকে। গত প্রায় এক দশকে কতটুকু এগিয়েছে আফগানিস্তান? এক সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশ ছিল ইরাক। আজ কী অবস্থা সেই ইরাকের? প্রতিদিনই বোমা বিস্ফোরণ, নিজেরা নিজেদের হত্যা করছে ইরাকের মানুষ। এই অবস্থার জন্য কে দায়ী? ‘গণতন্ত্র’ নামক মধু এখন ইরাকিদের কাছে, আফগানদের কাছে এক বিষের পিপা ছাড়া আর কিছুই নয়।
১৯৮৯ থেকে ১৯৯৯, এই দশ বছর ধরে গৃহযুদ্ধের আগুনে পুড়েছে লাইবেরিয়া। এরপর জাতিসংঘ আসে। সমঝোতা
হয়। এক সময় নির্বাচন হয়। এখন
একটি গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায়,
যার নেতৃত্বে রয়েছেন হার্ভার্ড গ্রাজুয়েট এলেন জনসন সার্লিফ। মিসেস সার্লিফ
এক সময় আমেরিকান সিটি ব্যাংকের ডাইরেক্টর হিসেবে নাইরোবিতে ও
পরে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওয়াশিংটন ডিসিতে কাজ করেন। পরে তিনি ইউএনডিপির রিজিওনাল ডাইরেক্টর হিসেবেও কাজ করেন। অবশ্য এরও
আগে তিনি লাইবেরিয়ার সহকারী
অর্থমন্ত্রী ছিলেন। চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে বলা যায়, লাইবেরিয়া এখনও মার্কিন অনুশাসনের মধ্যেই রয়েছে। আর তাই এ দেশের উন্নতি এখনও সুদূরপরাহত। কারণ আমেরিকা কেবল নিতেই জানে, দিতে জানে না।
লেখক : কবি, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা
No comments