এবার পার্বত্য চট্টগ্রামে by শাহ আহমদ রেজা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হত্যাকে কেন্দ্র করে চিরুনি অভিযান পুরোদমে চলমান থাকতেই পার্বত্য অঞ্চলে হঠাত্ সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। জনসংহতি সমিতি ও তার প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপ ইউপিডিএফের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতাদের একটি বিশেষ অংশ সহিংস হাঙ্গামার জন্য সরাসরি সেনাবাহিনীকে দায়ী করেছেন।
সমস্যার মূলে যাওয়ার পরিবর্তে এবং সহিংসতা জিইয়ে রাখার উদ্দেশ্য থেকে তারা যথারীতি সেনা প্রত্যাহারের দাবি তুলেছেন। বলেছেন, সেনাবাহিনীর ‘প্রশ্রয়’ ও ‘হস্তক্ষেপ’ই নাকি পরিস্থিতির জন্য দায়ী এবং সেনাবাহিনী গুলিবর্ষণ করেছিল বলেই নাকি উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে ও হত্যা-হাঙ্গামা ঘটেছে। পাহাড়িদের ওপর নির্যাতনসহ এ পর্যন্ত সংঘটিত সব হাঙ্গামাতেই সেনাবাহিনীর হাত রয়েছে বলেও তারা অভিযোগ করেছেন। অন্যদিকে দেশপ্রেমিক পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক তৈরি হওয়ার আগে সেনা প্রত্যাহার শুরু করায় পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারসাম্যহীন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা আরো বলেছেন, দেশের অখণ্ডতা রক্ষা ও পাহাড়ি-বাঙালিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থেই পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা মোতায়েন রাখা দরকার। কারণ শান্তিচুক্তির আড়াল নিয়ে কিছু বিদেশি শক্তি ওই অঞ্চলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়ে চলেছে। বিদেশি শক্তিগুলোর উদ্দেশ্যও ভয়ঙ্কর। বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে পার্বত্য চট্টগ্রামে তারা পূর্ব তিমুরের মতো স্বাধীন খ্রিস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
এমন অভিযোগ ও অনুমানকে হাল্কাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। দু-একটি তথ্যের উল্লেখ করলেও এ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। এরকম একটি তথ্য হলো, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংসদীয় প্রতিনিধিদল পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করে আসার পরই এবারের সহিংসতা শুরু হয়েছিল। প্রতিনিধিদলটি তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড়ি নেতারা, সুশীল সমাজ ও এনজিও প্রতিনিধিদের সঙ্গে বেশ কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। তাত্পর্যপূর্ণ বিষয় হলো, ২০ ফেব্রুয়ারির যে দিনটিতে প্রতিনিধিদলের প্রধান জেন ল্যামবার্ট ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করেছেন সেদিনই বাঘাইছড়িতে হঠাত্ হত্যা-হাঙ্গামা শুরু হয়েছিল। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, ইইউ প্রতিনিধিদলের জন্য ‘নগদ নগদ’ অজুহাত সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই হত্যা-হাঙ্গামা ঘটানো হয়েছে কি না।
প্রাসঙ্গিক দ্বিতীয় তথ্যটিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ : পার্বত্য চট্টগ্রামে হাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভারতভিত্তিক মানবাধিকার নামধারী সংগঠন এশিয়ান সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস (এসিএইচআর) জাতিসংঘের প্রতি হস্তক্ষেপ করার আবেদন জানিয়ে বার্তা পাঠিয়েছে। ভারত সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এ সংগঠনের নির্বাহী প্রধান সুহাস চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় নেতা উপেন্দ্রলাল চাকমার নিকটাত্মীয়। এসিএইচআরের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সেনাবাহিনী এবং বাঙালিরাই ১৯ ফেব্রুয়ারি রাতে উপজাতীয়দের বাড়িতে আগুন লাগিয়েছে! এ থেকেও পরিষ্কার হয়েছে, ইইউ প্রতিনিধিদলের সফর, বাঘাইছড়ির সহিংসতা এবং সুহাস চাকমাদের আবেদন পর্যন্ত সবকিছুই নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। সবার ‘লাটাই’ও রয়েছে একই কেন্দ্রে। বিশেষ করে জাতিসংঘের প্রতি হস্তক্ষেপের আবেদন জানানোর অর্থ ও উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না।
কথা ওঠার কারণ রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, যখনই ইইউ বা আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থার কোনো প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে আসে তখনই পার্বত্য চট্টগ্রাম হঠাত্ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এখানে জেন ল্যামবার্টের আগে অন্য একটি উদাহরণ হিসেবে ব্রিটেনের হাউস অব লর্ডসের সদস্য এরিক এভবারির সফরের কথা উল্লেখ করা যায়। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন তদারকির জন্য প্রতিষ্ঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের চেয়ারম্যান তিনি (২০০৮ সালের জুন মাসে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে ১২ জনকে সদস্য করে কমিশন পুনর্গঠিত হয়। কমিটিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামালকে কো-চেয়ারপারসন করা হয়েছে। এই কমিশন পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের ওপর কথিত নির্যাতনের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশবিরোধী তত্পরতা চালিয়ে থাকে।)। গত বছরের আগস্ট মাসে লর্ড এভবারির নেতৃত্বে কমিশনের একটি প্রতিনিধিদল যখন বাংলাদেশ সফরে এসেছিল, তখনও পার্বত্য চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তোলার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যকার চিহ্নিত অংশের উদ্যোগে সে সময় সারা দেশে হঠাত্ ‘আদিবাসী দিবস’ পালনের ধুম পড়ে গিয়েছিল। এভবারিদের ভূমিকাও ছিল উস্কানিমূলক। লর্ড এভবারি বলেছিলেন, পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত বাঙালিদের মধ্যে যারা সমতলে ফিরে যেতে রাজি না হবে তাদের রেশনসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করতে হবে। চুক্তির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াও কমিশনই তত্ত্বাবধান করবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন লর্ড এভবারি। সে সময় বিশেষ ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত কয়েকটি সেমিনারে সন্তু লারমা বলেছিলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়রা নাকি বাংলাদেশের ৩৮ বছর ধরেই ‘সেনা শাসনের’ অধীনে রয়েছে এবং ‘সেনা সন্ত্রাসের’ শিকার হচ্ছে! সন্তু লারমার সমর্থনে লাফিয়ে এসেছিলেন বিশেষ তিনজন রাজনৈতিক নেতা। সন্তু লারমার অভিযোগ ও বক্তব্যকে অনেকাংশে ‘সত্যায়িত’ করার স্টাইলে তারাও বলেছিলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে এক ধরনের সেনা শাসন চলছে এবং সেটা অসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। নেতাদের একজন আবার কবিতার ভাষায় বলেছিলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘আদিবাসীরা’ নাকি ‘নিজ দেশে পরবাসী’ অবস্থায় রয়েছে! তিনজনই পার্বত্য চট্টগ্রামে কথিত সেনা শাসনের অবসান ঘটানোর দাবি জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে এমন কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি, যার জন্য সেখানে সেনা মোতায়েন করতে হবে।
লর্ড এভবারি ও সন্তু লারমার পাশাপাশি তিনজন নেতার বক্তব্যে সে সময় দেশপ্রেমিকদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছিল। কারণ তারা এমন এক সময়েই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন সরকারের আকস্মিক নির্দেশে যখন খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে সবে সেনাক্যাম্প গুটিয়ে নেয়া শুরু হয়েছিল। নেতাদের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার হয়েছিল, সবারই উদ্দেশ্য ছিল নতুন করে সেনাবাহিনীকে উস্কানি দেয়া এবং সহিংসতার বিস্তার ঘটানো। উল্লেখ্য, কোনো দাবি ওঠারও আগে জুলাই মাসে শেখ হাসিনার সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এক ব্রিগেড সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছিল। সরকার নিজে থেকে যখন সেনা প্রত্যাহার শুরু করেছিল ঠিক তখনই হঠাত্ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠার তত্পরতা অবশ্যই ছিল প্রশ্নসাপেক্ষ, রহস্যময় এবং তাত্পর্যপূর্ণ। লক্ষণীয় যে, সন্তু লারমার সুরে ওই নেতারাও শুধু ‘সেনাশাসন’ পর্যন্ত এসে থেমে যাননি, তারা ‘সেনা সন্ত্রাসের’ গুরুতর অভিযোগও তুলেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের পুরো সেনাবাহিনীকেই ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন তারা। অথচ যে কোনো মূল্যায়নে এটা ছিল চরম মিথ্যাচার। কারণ যাদের পক্ষাবলম্বন করতে গিয়ে নেতারা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ করেছিলেন সেই সন্তু লারমারা নিজেরাই বহু বছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে এসেছেন। সন্তু লারমার একার বিরুদ্ধেই ৩০ হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে সশস্ত্র কর্মকাণ্ড চালানোর অভিযোগও।
বর্তমান পর্যায়েও নেতাদের একই অংশ আবারও তাদের আগের ভূমিকাতেই অবতীর্ণ হয়েছেন। হাঙ্গামায় সেনাবাহিনীর ‘প্রশ্রয়’ ও ‘হস্তক্ষেপ’ থাকার কথা বললেও বাঙালিদের কারা হত্যা করেছে, কারা বাঙালিদের শত শত ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং কারা সেনা অফিসারদের ওপরও হামলা চালানোর দুঃসাহস দেখিয়েছে—এসব বিষয়ে নেতারা কিন্তু একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। তা ছাড়া গারো, হাজংসহ দেশের অন্য কোনো অঞ্চলের উপজাতীয়দের জন্য এসব নেতাকে কখনো দরদে উথলে উঠতে দেখা যায় না। এদিকে পাহাড়িদের সমর্থনে পাড়া মাতাতে চাইলেও সত্য কিন্তু মোটেও তেমন নয়, যেমনটি এভবারি, জেন ল্যামবার্ট ও সন্তু লারমার পাশাপাশি এই নেতারাও বোঝাতে চাচ্ছেন। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো ‘ধরনের’ সেনা শাসন চলছে বলে প্রশ্ন তোলারই অবকাশ নেই। দেশের অন্য সব অঞ্চলের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামও অসামরিক প্রশাসনের অধীনেই রয়েছে। সেখানে সেনাবাহিনীকে নিয়ে যেতে ও রাখতে হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। সীমা ছাড়ানো খুন-খারাবি, অপহরণ-ছিনতাই-ডাকাতি এবং ভূমি দখলের মতো ভয়ঙ্কর ধরনের অপরাধ সংঘটনের মধ্য দিয়ে সেনা মোতায়েনের প্রেক্ষাপটও সন্তু লারমারাই সৃষ্টি করেছিলেন। তারা যদি শান্তি ফিরিয়ে আনেন ও পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করেন তাহলেই শুধু সেনা প্রত্যাহার করা যেতে পারে। অন্যদিকে নানান নামের আড়াল নিয়ে এখনও তারা হরতাল এবং নৌ ও সড়ক অবরোধের মতো কর্মসূচি পালন করে চলেছে। তারা প্রতিমন্ত্রীকে ঘেরাও করছে, ইউএনওর গাড়িতে হামলা চালাচ্ছে এবং সশস্ত্র যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে।
চিহ্নিত নেতারাও শুধু সেনা শাসন চলছে পর্যন্ত বলে থেমে যাচ্ছেন না, সেনাবাহিনীই হাঙ্গামা ছড়িয়ে দিচ্ছে বলেও গুরুতর অভিযোগ তুলছেন। অথচ ঘটনাপ্রবাহে বিশেষ করে সেনা প্রত্যাহারের মুখে অসহায় হয়ে পড়া বাঙালিদের ওপর চালানো দমন-নির্যাতনই প্রমাণ করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনী ফিরিয়ে আনার পরিণতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। কারণ, সেনা প্রত্যাহার সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা বাঙালিদের হত্যা শুরু করেছে। তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে। ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে চলমান সহিংসতাকে তাই বিচ্ছিন্ন কার্যক্রম মনে করার সুযোগ নেই। কারণ পার্বত্য সন্ত্রাসীরা অতীতেও এ ধরনের এবং এর চাইতেও মারাত্মক অনেক ঘটনা ঘটিয়েছে। তারা হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা ও উত্খাত করেছে। এখানে উল্লেখ করা দরকার, গত বছরের আগস্টে লর্ড এভবারিরা যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন সরকার সে সময় সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের কার্যক্রম শুরু করতে না করতেই বাঙালিসহ অ-উপজাতীয়দের ওপর সর্বাত্মক দমন-নির্যাতন শুরু হয়েছিল। তাদের বাড়িঘর দখল করেছে সন্ত্রাসীরা, নানা পন্থায় ভয়-ভীতিও দেখিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, অতীতের মতো পাহাড়ি বনাম বাঙালির প্রশ্ন তোলার পরিবর্তে তখন থেকে অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গে ধর্মীয় পরিচিতিকে প্রাধান্যে এনেছে সন্ত্রাসীরা। ফলে আক্রান্ত হয়েছেন মুসলমানরা। মুসলমানদের মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করতেও বাধা দেয়া হয়েছে। অথচ চার খণ্ডের শান্তিচুক্তির কোথাও বলা হয়নি যে, পার্বত্য অঞ্চল থেকে আদিবাসী বাঙালিদের উচ্ছেদ করতে হবে।
ঘটনাপ্রবাহে পর্যবেক্ষকরা আরো একবার বিশেষ করে লর্ড এভবারির দিকে আঙুল তুলেছেন। তারা সেই সঙ্গে পূর্ব তিমুরের পরিণতির কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কিছু দিন আগে পর্যন্ত পূর্ব তিমুর ছিল ইন্দোনেশিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ। দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে পাশ্চাত্যের এনজিওরা দ্বিপটিতে কয়েক বছর ধরে ব্যাপক তত্পরতা চালিয়েছে, দ্বিপবাসীদের খ্রিস্টান বানিয়েছে এবং সবশেষে স্বাধীন খ্রিস্টান রাষ্ট্রের স্লোগান তুলেছে। এর সমর্থনে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের মতো কয়েকটি ক্ষমতাধর দেশ এবং জাতিসংঘ। ফলে বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়া পূর্ব তিমুরের স্বাধীনতা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। সে ঘটনাপ্রবাহেও লর্ড এরিক এভবারি সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। ভীতি ও উদ্বেগের কারণ হলো, বাংলাদেশেও সে একই এভবারির এবং তার নেতৃত্বাধীন সংস্থার আবির্ভাব ঘটেছে। বলা হচ্ছে, মানবাধিকার আন্দোলনের আড়ালে এভবাবির মতো লর্ডরা আসলে ভারতের ‘র’, যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ এবং ব্রিটেনের এম-টুসহ কয়েকটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করছেন। এসব গোয়েন্দা সংস্থা মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রগুলোকে টুকরো টুকরো করার পরিকল্পনা নিয়ে একযোগে কাজ করে চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামকেও তারা পূর্ব তিমুরের মতো স্বাধীন খ্রিস্টান রাষ্ট্র বানাতে চায়। প্রকাশ্যে তাদের পক্ষে ভূমিকা পালন করছে এনজিওরা। টাকা ছড়ানো হচ্ছে শত কোটি টাকার অংকে। সে টাকার কাছেই বিক্রি হচ্ছেন দেশের রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের অনেকে। তাদের প্রশ্রয় পাচ্ছেন বলেই সন্তু লারমারা শুধু শান্তিচুক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চাচ্ছেন না। দাবি তুলছেন, পার্বত্য অঞ্চলে বাংলাদেশের একজন সেনাকেও রাখা চলবে না। এই দাবির সমর্থনে এগিয়ে এসেছে লর্ড এভবারিদের পার্বত্য কমিশনসহ পাশ্চাত্যের বিভিন্ন সংস্থা। সেনা প্রত্যাহারসহ সব বিষয়ে আওয়ামী লীগ সরকারও সন্তু লারমাদের কথা ও দাবিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে চলেছে। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রাম যেহেতু বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ সেহেতু সেখানে সেনা পাঠানোর বা সেনা মোতায়েন রাখার মধ্যে দোষের বা বিদেশিদের কাছে কৈফিয়ত দেয়ার কিছু থাকতে পারে না। বড়কথা, সেনাবাহিনী যাওয়ার পরই ওই অঞ্চলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল।
বর্তমান পর্যায়ে আশঙ্কার কারণ হলো, সন্তু লারমাদের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতাদের একটি অংশও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে চলেছেন, অন্যদিকে সুহাস চাকমারা জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের জন্য আবেদন জানাচ্ছেন। এসবের পাশাপাশি লর্ড এভবারির নেতৃত্বে পার্বত্য কমিশন যে খুবই তত্পর রয়েছে তার প্রমাণ তো ক’দিন আগে জেন ল্যামবার্টরাও দিয়ে গেছেন। অর্থাত্ সব মিলিয়েই পার্বত্য চট্টগ্রামকেন্দ্রিক পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে তোলার ষড়যন্ত্র চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বলা দরকার, ইইউ কিংবা এভবারিদের কমিশনকে কিন্তু ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো সমস্যা নিয়ে কোনো কথা বলতে দেখা যায় না। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে বিপুল ঘাটতির মতো অর্থনৈতিক বিষয়ে তো বটেই, ফারাক্কাসহ বিভিন্ন বাঁধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়ার কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধেও ইইউ কখনো প্রতিবাদ জানায়নি। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিবাদের সমর্থনেও ইইউ একটি কথা বলেনি। সে ইইউ-ই পূর্ব তিমুরকে স্বাধীন খ্রিস্টান রাষ্ট্র বানানোর কার্যক্রমে নেতৃত্বদানকারী লর্ড এভবারিদের সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের জন্য উঠে-পড়ে লেগে আছে বলেই উদ্বেগ বাড়ছে দেশপ্রেমিকদের।
লেখক : সাংবাদিক
ই-মেইল : shahahmadreza@yahoo.com
এমন অভিযোগ ও অনুমানকে হাল্কাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। দু-একটি তথ্যের উল্লেখ করলেও এ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। এরকম একটি তথ্য হলো, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংসদীয় প্রতিনিধিদল পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করে আসার পরই এবারের সহিংসতা শুরু হয়েছিল। প্রতিনিধিদলটি তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড়ি নেতারা, সুশীল সমাজ ও এনজিও প্রতিনিধিদের সঙ্গে বেশ কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। তাত্পর্যপূর্ণ বিষয় হলো, ২০ ফেব্রুয়ারির যে দিনটিতে প্রতিনিধিদলের প্রধান জেন ল্যামবার্ট ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করেছেন সেদিনই বাঘাইছড়িতে হঠাত্ হত্যা-হাঙ্গামা শুরু হয়েছিল। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, ইইউ প্রতিনিধিদলের জন্য ‘নগদ নগদ’ অজুহাত সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই হত্যা-হাঙ্গামা ঘটানো হয়েছে কি না।
প্রাসঙ্গিক দ্বিতীয় তথ্যটিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ : পার্বত্য চট্টগ্রামে হাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভারতভিত্তিক মানবাধিকার নামধারী সংগঠন এশিয়ান সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস (এসিএইচআর) জাতিসংঘের প্রতি হস্তক্ষেপ করার আবেদন জানিয়ে বার্তা পাঠিয়েছে। ভারত সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এ সংগঠনের নির্বাহী প্রধান সুহাস চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় নেতা উপেন্দ্রলাল চাকমার নিকটাত্মীয়। এসিএইচআরের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সেনাবাহিনী এবং বাঙালিরাই ১৯ ফেব্রুয়ারি রাতে উপজাতীয়দের বাড়িতে আগুন লাগিয়েছে! এ থেকেও পরিষ্কার হয়েছে, ইইউ প্রতিনিধিদলের সফর, বাঘাইছড়ির সহিংসতা এবং সুহাস চাকমাদের আবেদন পর্যন্ত সবকিছুই নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। সবার ‘লাটাই’ও রয়েছে একই কেন্দ্রে। বিশেষ করে জাতিসংঘের প্রতি হস্তক্ষেপের আবেদন জানানোর অর্থ ও উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না।
কথা ওঠার কারণ রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, যখনই ইইউ বা আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থার কোনো প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে আসে তখনই পার্বত্য চট্টগ্রাম হঠাত্ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এখানে জেন ল্যামবার্টের আগে অন্য একটি উদাহরণ হিসেবে ব্রিটেনের হাউস অব লর্ডসের সদস্য এরিক এভবারির সফরের কথা উল্লেখ করা যায়। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন তদারকির জন্য প্রতিষ্ঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের চেয়ারম্যান তিনি (২০০৮ সালের জুন মাসে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে ১২ জনকে সদস্য করে কমিশন পুনর্গঠিত হয়। কমিটিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামালকে কো-চেয়ারপারসন করা হয়েছে। এই কমিশন পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের ওপর কথিত নির্যাতনের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশবিরোধী তত্পরতা চালিয়ে থাকে।)। গত বছরের আগস্ট মাসে লর্ড এভবারির নেতৃত্বে কমিশনের একটি প্রতিনিধিদল যখন বাংলাদেশ সফরে এসেছিল, তখনও পার্বত্য চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তোলার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যকার চিহ্নিত অংশের উদ্যোগে সে সময় সারা দেশে হঠাত্ ‘আদিবাসী দিবস’ পালনের ধুম পড়ে গিয়েছিল। এভবারিদের ভূমিকাও ছিল উস্কানিমূলক। লর্ড এভবারি বলেছিলেন, পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত বাঙালিদের মধ্যে যারা সমতলে ফিরে যেতে রাজি না হবে তাদের রেশনসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করতে হবে। চুক্তির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াও কমিশনই তত্ত্বাবধান করবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন লর্ড এভবারি। সে সময় বিশেষ ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত কয়েকটি সেমিনারে সন্তু লারমা বলেছিলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়রা নাকি বাংলাদেশের ৩৮ বছর ধরেই ‘সেনা শাসনের’ অধীনে রয়েছে এবং ‘সেনা সন্ত্রাসের’ শিকার হচ্ছে! সন্তু লারমার সমর্থনে লাফিয়ে এসেছিলেন বিশেষ তিনজন রাজনৈতিক নেতা। সন্তু লারমার অভিযোগ ও বক্তব্যকে অনেকাংশে ‘সত্যায়িত’ করার স্টাইলে তারাও বলেছিলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে এক ধরনের সেনা শাসন চলছে এবং সেটা অসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। নেতাদের একজন আবার কবিতার ভাষায় বলেছিলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘আদিবাসীরা’ নাকি ‘নিজ দেশে পরবাসী’ অবস্থায় রয়েছে! তিনজনই পার্বত্য চট্টগ্রামে কথিত সেনা শাসনের অবসান ঘটানোর দাবি জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে এমন কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি, যার জন্য সেখানে সেনা মোতায়েন করতে হবে।
লর্ড এভবারি ও সন্তু লারমার পাশাপাশি তিনজন নেতার বক্তব্যে সে সময় দেশপ্রেমিকদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছিল। কারণ তারা এমন এক সময়েই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন সরকারের আকস্মিক নির্দেশে যখন খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে সবে সেনাক্যাম্প গুটিয়ে নেয়া শুরু হয়েছিল। নেতাদের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার হয়েছিল, সবারই উদ্দেশ্য ছিল নতুন করে সেনাবাহিনীকে উস্কানি দেয়া এবং সহিংসতার বিস্তার ঘটানো। উল্লেখ্য, কোনো দাবি ওঠারও আগে জুলাই মাসে শেখ হাসিনার সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এক ব্রিগেড সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছিল। সরকার নিজে থেকে যখন সেনা প্রত্যাহার শুরু করেছিল ঠিক তখনই হঠাত্ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠার তত্পরতা অবশ্যই ছিল প্রশ্নসাপেক্ষ, রহস্যময় এবং তাত্পর্যপূর্ণ। লক্ষণীয় যে, সন্তু লারমার সুরে ওই নেতারাও শুধু ‘সেনাশাসন’ পর্যন্ত এসে থেমে যাননি, তারা ‘সেনা সন্ত্রাসের’ গুরুতর অভিযোগও তুলেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের পুরো সেনাবাহিনীকেই ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন তারা। অথচ যে কোনো মূল্যায়নে এটা ছিল চরম মিথ্যাচার। কারণ যাদের পক্ষাবলম্বন করতে গিয়ে নেতারা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ করেছিলেন সেই সন্তু লারমারা নিজেরাই বহু বছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে এসেছেন। সন্তু লারমার একার বিরুদ্ধেই ৩০ হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে সশস্ত্র কর্মকাণ্ড চালানোর অভিযোগও।
বর্তমান পর্যায়েও নেতাদের একই অংশ আবারও তাদের আগের ভূমিকাতেই অবতীর্ণ হয়েছেন। হাঙ্গামায় সেনাবাহিনীর ‘প্রশ্রয়’ ও ‘হস্তক্ষেপ’ থাকার কথা বললেও বাঙালিদের কারা হত্যা করেছে, কারা বাঙালিদের শত শত ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং কারা সেনা অফিসারদের ওপরও হামলা চালানোর দুঃসাহস দেখিয়েছে—এসব বিষয়ে নেতারা কিন্তু একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। তা ছাড়া গারো, হাজংসহ দেশের অন্য কোনো অঞ্চলের উপজাতীয়দের জন্য এসব নেতাকে কখনো দরদে উথলে উঠতে দেখা যায় না। এদিকে পাহাড়িদের সমর্থনে পাড়া মাতাতে চাইলেও সত্য কিন্তু মোটেও তেমন নয়, যেমনটি এভবারি, জেন ল্যামবার্ট ও সন্তু লারমার পাশাপাশি এই নেতারাও বোঝাতে চাচ্ছেন। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো ‘ধরনের’ সেনা শাসন চলছে বলে প্রশ্ন তোলারই অবকাশ নেই। দেশের অন্য সব অঞ্চলের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামও অসামরিক প্রশাসনের অধীনেই রয়েছে। সেখানে সেনাবাহিনীকে নিয়ে যেতে ও রাখতে হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। সীমা ছাড়ানো খুন-খারাবি, অপহরণ-ছিনতাই-ডাকাতি এবং ভূমি দখলের মতো ভয়ঙ্কর ধরনের অপরাধ সংঘটনের মধ্য দিয়ে সেনা মোতায়েনের প্রেক্ষাপটও সন্তু লারমারাই সৃষ্টি করেছিলেন। তারা যদি শান্তি ফিরিয়ে আনেন ও পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করেন তাহলেই শুধু সেনা প্রত্যাহার করা যেতে পারে। অন্যদিকে নানান নামের আড়াল নিয়ে এখনও তারা হরতাল এবং নৌ ও সড়ক অবরোধের মতো কর্মসূচি পালন করে চলেছে। তারা প্রতিমন্ত্রীকে ঘেরাও করছে, ইউএনওর গাড়িতে হামলা চালাচ্ছে এবং সশস্ত্র যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে।
চিহ্নিত নেতারাও শুধু সেনা শাসন চলছে পর্যন্ত বলে থেমে যাচ্ছেন না, সেনাবাহিনীই হাঙ্গামা ছড়িয়ে দিচ্ছে বলেও গুরুতর অভিযোগ তুলছেন। অথচ ঘটনাপ্রবাহে বিশেষ করে সেনা প্রত্যাহারের মুখে অসহায় হয়ে পড়া বাঙালিদের ওপর চালানো দমন-নির্যাতনই প্রমাণ করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনী ফিরিয়ে আনার পরিণতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। কারণ, সেনা প্রত্যাহার সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা বাঙালিদের হত্যা শুরু করেছে। তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে। ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে চলমান সহিংসতাকে তাই বিচ্ছিন্ন কার্যক্রম মনে করার সুযোগ নেই। কারণ পার্বত্য সন্ত্রাসীরা অতীতেও এ ধরনের এবং এর চাইতেও মারাত্মক অনেক ঘটনা ঘটিয়েছে। তারা হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা ও উত্খাত করেছে। এখানে উল্লেখ করা দরকার, গত বছরের আগস্টে লর্ড এভবারিরা যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন সরকার সে সময় সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের কার্যক্রম শুরু করতে না করতেই বাঙালিসহ অ-উপজাতীয়দের ওপর সর্বাত্মক দমন-নির্যাতন শুরু হয়েছিল। তাদের বাড়িঘর দখল করেছে সন্ত্রাসীরা, নানা পন্থায় ভয়-ভীতিও দেখিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, অতীতের মতো পাহাড়ি বনাম বাঙালির প্রশ্ন তোলার পরিবর্তে তখন থেকে অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গে ধর্মীয় পরিচিতিকে প্রাধান্যে এনেছে সন্ত্রাসীরা। ফলে আক্রান্ত হয়েছেন মুসলমানরা। মুসলমানদের মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করতেও বাধা দেয়া হয়েছে। অথচ চার খণ্ডের শান্তিচুক্তির কোথাও বলা হয়নি যে, পার্বত্য অঞ্চল থেকে আদিবাসী বাঙালিদের উচ্ছেদ করতে হবে।
ঘটনাপ্রবাহে পর্যবেক্ষকরা আরো একবার বিশেষ করে লর্ড এভবারির দিকে আঙুল তুলেছেন। তারা সেই সঙ্গে পূর্ব তিমুরের পরিণতির কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কিছু দিন আগে পর্যন্ত পূর্ব তিমুর ছিল ইন্দোনেশিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ। দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে পাশ্চাত্যের এনজিওরা দ্বিপটিতে কয়েক বছর ধরে ব্যাপক তত্পরতা চালিয়েছে, দ্বিপবাসীদের খ্রিস্টান বানিয়েছে এবং সবশেষে স্বাধীন খ্রিস্টান রাষ্ট্রের স্লোগান তুলেছে। এর সমর্থনে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের মতো কয়েকটি ক্ষমতাধর দেশ এবং জাতিসংঘ। ফলে বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়া পূর্ব তিমুরের স্বাধীনতা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। সে ঘটনাপ্রবাহেও লর্ড এরিক এভবারি সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। ভীতি ও উদ্বেগের কারণ হলো, বাংলাদেশেও সে একই এভবারির এবং তার নেতৃত্বাধীন সংস্থার আবির্ভাব ঘটেছে। বলা হচ্ছে, মানবাধিকার আন্দোলনের আড়ালে এভবাবির মতো লর্ডরা আসলে ভারতের ‘র’, যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ এবং ব্রিটেনের এম-টুসহ কয়েকটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করছেন। এসব গোয়েন্দা সংস্থা মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রগুলোকে টুকরো টুকরো করার পরিকল্পনা নিয়ে একযোগে কাজ করে চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামকেও তারা পূর্ব তিমুরের মতো স্বাধীন খ্রিস্টান রাষ্ট্র বানাতে চায়। প্রকাশ্যে তাদের পক্ষে ভূমিকা পালন করছে এনজিওরা। টাকা ছড়ানো হচ্ছে শত কোটি টাকার অংকে। সে টাকার কাছেই বিক্রি হচ্ছেন দেশের রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের অনেকে। তাদের প্রশ্রয় পাচ্ছেন বলেই সন্তু লারমারা শুধু শান্তিচুক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চাচ্ছেন না। দাবি তুলছেন, পার্বত্য অঞ্চলে বাংলাদেশের একজন সেনাকেও রাখা চলবে না। এই দাবির সমর্থনে এগিয়ে এসেছে লর্ড এভবারিদের পার্বত্য কমিশনসহ পাশ্চাত্যের বিভিন্ন সংস্থা। সেনা প্রত্যাহারসহ সব বিষয়ে আওয়ামী লীগ সরকারও সন্তু লারমাদের কথা ও দাবিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে চলেছে। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রাম যেহেতু বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ সেহেতু সেখানে সেনা পাঠানোর বা সেনা মোতায়েন রাখার মধ্যে দোষের বা বিদেশিদের কাছে কৈফিয়ত দেয়ার কিছু থাকতে পারে না। বড়কথা, সেনাবাহিনী যাওয়ার পরই ওই অঞ্চলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল।
বর্তমান পর্যায়ে আশঙ্কার কারণ হলো, সন্তু লারমাদের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতাদের একটি অংশও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে চলেছেন, অন্যদিকে সুহাস চাকমারা জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের জন্য আবেদন জানাচ্ছেন। এসবের পাশাপাশি লর্ড এভবারির নেতৃত্বে পার্বত্য কমিশন যে খুবই তত্পর রয়েছে তার প্রমাণ তো ক’দিন আগে জেন ল্যামবার্টরাও দিয়ে গেছেন। অর্থাত্ সব মিলিয়েই পার্বত্য চট্টগ্রামকেন্দ্রিক পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে তোলার ষড়যন্ত্র চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বলা দরকার, ইইউ কিংবা এভবারিদের কমিশনকে কিন্তু ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো সমস্যা নিয়ে কোনো কথা বলতে দেখা যায় না। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে বিপুল ঘাটতির মতো অর্থনৈতিক বিষয়ে তো বটেই, ফারাক্কাসহ বিভিন্ন বাঁধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়ার কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধেও ইইউ কখনো প্রতিবাদ জানায়নি। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিবাদের সমর্থনেও ইইউ একটি কথা বলেনি। সে ইইউ-ই পূর্ব তিমুরকে স্বাধীন খ্রিস্টান রাষ্ট্র বানানোর কার্যক্রমে নেতৃত্বদানকারী লর্ড এভবারিদের সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের জন্য উঠে-পড়ে লেগে আছে বলেই উদ্বেগ বাড়ছে দেশপ্রেমিকদের।
লেখক : সাংবাদিক
ই-মেইল : shahahmadreza@yahoo.com
No comments