বাঘা তেঁতুল-সংবর্ধনা ও কুলখানি by সৈয়দ আবুল মকসুদ

একটি-দুটি ঘটনাই একটি দেশের একটি সময়ের সামগ্রিক পরিস্থিতির পরিচয় বহন করে। দেশটির রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও শাসনপদ্ধতির অবস্থা তা থেকে জানা যায়। কোনো মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যের তাঁর এলাকায় আগমন উপলক্ষে সংবর্ধনা অথবা কোনো সরকারি কর্মকর্তার মায়ের কুলখানির অনুষ্ঠান বিশ্লেষণ করলেই


জানা যায়, দেশটির রাজনীতি কেমন, তার সামাজিক অবস্থা কেমন, তার অর্থনীতির অবস্থা কী, তার জনগণের ধর্মীয় সংস্কৃতি কেমন এবং দেশটির শাসনব্যবস্থাটির চরিত্র কী।
সংবর্ধনা হরদম হচ্ছে দেশের বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায়। জনগণ দায়ে পড়ে ভোট দিয়েছে, নির্বাচিত করেছে, এখন তারা সংবর্ধনা দিতে পারবে না—তা হবে না, তা হবে না। আর সে সংবর্ধনায় ধান-দূর্বা দিয়ে বরণ করে নিলেও হবে না, তৈরি করতে হবে প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড তোরণ এবং উপঢৌকন দিতে হবে সোনা-রুপার নৌকা, বৈঠা ইত্যাদি।
দক্ষিণ এশিয়ার—বলতে গেলে এশিয়া মহাদেশের সর্বকালের স্মরণীয় সংবর্ধনাটি হয়ে গেল কয়েকদিন আগে। যোগাযোগমন্ত্রীর সংবর্ধনা। বঙ্গবন্ধু বা শেখ হাসিনার ভাগ্যেও এমন সংবর্ধনা জোটেনি। কোটি টাকার মামলা। সংবর্ধনার আয়োজনে কার্পণ্য ঘটেনি কিছুমাত্র। মোগল বাদশাদের বা ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহরও সৌভাগ্য হয়নি এত বেশি তোরণের তলা দিয়ে যাওয়ার।
তোরণ বানাতে টাকা লাগে। আলিশান মঞ্চ বা বেদি বানাতেও টাকা লাগে। কৌতূহলী সাংবাদিকদের প্রশ্ন: কোথা থেকে আসবে সেই টাকা? বিশ্বস্ত সূত্র থেকে তাঁরা যা জানতে পারেন তা হলো: এলাকার জনগণ চাঁদা তুলে সে টাকা সংগ্রহ করতে পারে অথবা যিনি ওই তোরণের তলা দিয়ে যাবেন তিনি নিজেও দিতে পারেন। অথবা ফিফটি-ফিফটি শেয়ারের মাধ্যমে ব্যয় নির্বাহ হতে পারে।
সংবর্ধনা একটি আনন্দযজ্ঞ। কিন্তু এই দুনিয়াটা শুধু আনন্দের জায়গা নয়। জন্মমৃত্যুর বা হাসি-আনন্দের দুদিনের এই খেলাঘরে শোকের যজ্ঞও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কুলখানি বা আদ্যশ্রাদ্ধ হলো শোকযজ্ঞ। জীবনের আনন্দযজ্ঞে যেমন কবিসহ সবার আমন্ত্রণ, তেমনি মৃত্যুর শোকযজ্ঞেও অগণিত মানুষকে আমন্ত্রণ না জানালে অনেকের মন ভরে না। ভূমি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার মায়ের কুলখানি হয়ে গেল গত শনিবার। ঢাকার নবাবের আম্মাজানের কুলখানিতে কিংবা কাশিমবাজারের মহারাজা বা মুক্তাগাছার মহারাজার মাতৃদেবীর আদ্যশ্রাদ্ধেও এত লোক খাওয়া-দাওয়া করেনি।
খবরে বলা হয়েছে: হূষ্টপুষ্ট ২৫টি গরু জবাই করা হয়। রান্না করা হয় ১৭৫ মণ চালের ভাত। আরও কয়েক পদের উপাদেয় খাবারে ভূরিভোজ হয় প্রায় ৩০ হাজার মানুষের। সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এই ভোজের আয়োজন চলে। তিন জেলার পাঁচ উপজেলা থেকে অতিথিরা এসে যোগ দেন। প্রধান বাবুর্চির নেতৃত্বে ৭০ জন কর্মী, ৩০০ জন পরিবেশন ও পরিচ্ছন্নতা কর্মী এবং ইউনিয়ন পরিষদের চৌকিদারের নেতৃত্বে ২০০ জন স্বেচ্ছাসেবক কর্মী নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন। স্বেচ্ছাসেবকের সংখ্যা খুব কমই মনে হচ্ছে। এ ধরনের অনুষ্ঠানে তো হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক স্বেচ্ছায় যোগ দেওয়ার কথা।
যিনি জবাই দিয়েছেন তাঁর ভাষ্য: ‘২৫টি গরু জবাই করা হয়েছে। একেকটি গরুর দাম ৯০ থেকে ৯৫ হাজার টাকা। প্রতিটি গরু জবাই করে মাংস তৈরি করতে তিন হাজার টাকা মজুরি দেওয়া হয়। আমরা ১০ জন কর্মী কাজ করেছি।’ বাবুর্চি বলেছেন, ৩০ হাজার মানুষের রান্নার জন্য তাকে এক লাখ টাকা দেওয়া হবে। অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপকের মতে, ‘অনুষ্ঠানে ৫০ লাখ টাকা ব্যয় হবে।’
প্রতিবেদনের শেষ পর্যায়ে গিয়ে যিনি সদ্য মাতৃহীন হয়েছেন তাঁর বক্তব্য আমরা জানতে পারি। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আপনারা জানেন, আমি একটি বড় ধরনের বিপদ থেকে মুক্ত হয়েছি। আল্লাহ আমাকে সামর্থ্য দিয়েছেন, তাই খরচ করছি।’ একেবারে শেষ অনুচ্ছেদে গিয়ে আরও একটু তথ্য জানা যায়। তা হলো: বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলায় ভূমি মন্ত্রণালয়ের এই কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ‘১৬ মাস কারাগারে থাকার পর ২০০৮ সালে হাইকোর্ট মামলার কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ জারি করেন। ২০০৯ সালে তিনি জামিনে মুক্তি পান। পরে চাকরিতেও বহাল হন।’ [প্রথম অলো, ৭.২.১০]
কুলখানির এই আয়োজনে একমাত্র নিরামিষভোজী ছাড়া আর কারও অসন্তোষ প্রকাশের সুযোগ নেই। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বঞ্চিত করা হয়েছে, তাও হয়তো নয়। যেখানে গরুর মতো বড় প্রাণী গেল ২৫টি, সেখানে খাসি, পাঁঠা, মুরগি যে কত জবাই হয়েছে তা অনুমান করা যায়।
যা হোক, কুলখানির ঘটনাটি থেকে আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, রাজস্ব বিভাগ ও সমাজ সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। যে রাজনীতির মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশ পেয়েছি সেই রাজনীতির এটাই যৌক্তিক পরিণতি। ভূমি মন্ত্রণালয়ের তহশিলদার থেকে শীর্ষ আমলা পর্যন্ত কি তা যার একটুকরো জমি আছে সে জানে। দুদক কাউকে কোনো অভিযোগে গ্রেপ্তার করার পর ন্যায়বিচারের মাধ্যমে মীমাংসা না করে উচ্চতর আদালত যদি ছেড়ে দেন, তাহলে যারা সততা ও ন্যায়ের কথা বলে তারা অসহায় বোধ করবেই। আমাদের এই রাষ্ট্রে কার কি আয়ের উত্স তা দেখার সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউ নেই। যিনি এক কুলখানিতে ৫০ লাখ টাকা ব্যয় করতে পারেন, তিনি কত লাখ টাকা গত বছর আয়কর দিয়েছেন তা রাজস্ব বিভাগই জানে।
সবশেষে আসে সাধারণ জনগণ। কোনো সমাজ সার্বিকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হতে পারে না, যদি না অধিকাংশ মানুষ দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষকতা করে। আমরা না জানতে পারি, কিন্তু যে ৩০ হাজার মানুষ খুব তৃপ্তি করে খেয়েছে, আমন্ত্রণকারীর আয়ের উত্স সম্পর্কে তারা নিশ্চয়ই অবগত। অবৈধ উপায়ে যে টাকা রোজগার করে সে যেমন অপরাধী ও নিন্দনীয়, তেমনি জেনেশুনে ওই অর্থের তিল পরিমাণ যে গ্রহণ করে সেও নিন্দার পাত্র।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.