বিডিআর বিদ্রোহঃ শহীদ কর্নেল এলাহীর জন্য মা-বাবার আজীবনের আর্তনাদ by হাবিবুর রহমান ও রোকেয়া রহমান
দুর্বিষহ সময়ের একটি বছর পেরিয়ে গেল। এক নির্মম-নিষ্ঠুর অন্তহীন যন্ত্রণা-বর্বরতা আর নিদারুণ পৈশাচিকতার ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে আরেক ২৫ ফেব্রুয়ারি। আমাদের জীবনের সামনে আর ক’টা ২৫ ফেবু্রয়ারি বাকি আছে, জানি না। যতবার এ দিনটি ঘুরে আসবে ততবার সন্তান হারানোর সীমাহীন শোক-দুঃখ-যন্ত্রণা আমাদের জর্জরিত করে তুলবে।
এ যন্ত্রণা যে কত নিদারুণ ও কষ্টময় তা শুধু ভুক্তভোগীই বুঝবেন। তবুও আমাদের সইতে হবে—সইতে হবে অবর্ণনীয় দুঃখময় এ দুঃসহ স্মৃতি। কারণ আমরা যে সন্তানহারা মা-বাবা। পিতা হিসেবে সন্তানের কফিন বহনে কত যে যন্ত্রণা সে কথা কখনোই বর্ণনা করা যায় না—এই কফিন যে কত ভারি, তাও বুঝানোর ক্ষমতা নেই কারও।
আমরা সেই হতভাগ্য পিতা-মাতা, যারা হারিয়েছি আমাদের প্রাণাধিক পুত্র কর্নেল কুদরত এলাহী রহমান শফিককে। এলাহীর জীবন প্রদীপ নিভেছে একদল বর্বর মানুুষরূপী হায়না-ঘাতকের বুলেটে-বেয়নেটে। ২৫ ফেব্রুয়ারির পিলখানা সৃষ্টি করেছে ইতিহাসের আরও একটি কলঙ্কময় দিন।
ঘাতকের বুলেটে শহীদ হলো আমাদের সন্তান কর্নেল এলাহী। এই একটি বছর আমরা সন্তানহারা শোক নিয়ে কীভাবে যে বেঁচে আছি, তা শুধু আল্লাহপাকই জানেন। এলাহীর শাহাদাত্ দিবসকে সামনে রেখে ওর উদ্দেশে বলতে চাই—‘বাবা ঘুমাও, যেভাবে ঘুমাতে সেই শিশুকালে আমাদের কোলে। সেভাবেই ঘুমাও কবরে। আল্লাহ তোমার আত্মাকে দেবেন অনন্ত শান্তি। দেশের অগণিত মানুষের ভালোবাসা আর দোয়া আছে তোমার জন্য। তোমাকে হারানোর ব্যথায় আকুল মা-বাবার আকুতিভরা প্রার্থনা পরম করুণাময় নিশ্চয় কবুল করবেন।’
আমাদের সন্তান কর্নেল এলাহীকে আমরা হারিয়েছি। এ ভব-সংসারে আর কোনো দিন তাকে ফিরে পাব না। কিন্তু তার হত্যার বিচার আমরা কোনো দিন পাব কী? দেখতে চাই সত্যিকার বিচার—বিচারের প্রহসন নয়, যে বিচার দেখে যেন ভবিষ্যতে কেউ কোনোদিন কোনো মানুষ খুন করতে উদ্যত না হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারির বর্বরতাই হয় যেন বাংলার ইতিহাসের শেষ কলঙ্ক। তাহলেই হয়তো এলাহীদের বিদেহী আত্মা শান্তি পাবে।
আমরা তো শুধু আমাদের সন্তান কর্নেল এলাহীকেই হারাইনি। দেশ হারিয়েছে এক মেধাবী সন্তানকে। এলাহী তার চেষ্টা ও মেধা দিয়ে শুধু নিজেকেই গড়ে তোলেনি, দেশকেও দিয়েছে অনেক কিছু। দিয়েছে সম্মান, দিয়েছে সেবা। তার উজ্জ্বল জীবনী এবং বর্ণাঢ্য কর্মজীবন দেশের যে কোনো মূল্যবান নাগরিকের জন্য একটি দৃষ্টান্ত।
এলাহীর জন্ম রংপুরে ১৯৬২ সালের পয়লা নভেম্বর তারিখে। আমাদের পারিবারিক নাম ‘রহমান’। জন্মের পর ওর নাম রেখেছিলাম রহমান শফিক। আমাদের প্রথম সন্তান হিসেবে ওকে পাওয়াটাকে আল্লাহর অসীম কুদরত হিসেবে মনে করেছি। সে কারণে আল্লাহর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ওর নামের প্রথমে ‘কুদরত এলাহী’ যুক্ত করেছিলাম। তাই ওর পুরো নাম হয়েছে কুদরত এলাহী রহমান শফিক। এলাহী তার শিশুকাল থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে নিজেকে দিবালোকের মতো সমুজ্জ্বল করে রেখেছে। তার সামনে ছিল ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের পদে উন্নীত হওয়ার সময় ওই ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯-এ মাত্র ৬ মাস পরেই এলাহী এ পদে অভিষিক্ত হতো। এমন একজন মেধাবী সেনা কর্মকর্তার কিছুই দেখে যেতে পারলাম না আমরা। দেশও তার কাছে পেতে পারত আরও অনেক কিছু। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস!
ক্যাডেট কলেজের পাঠ সমাপ্ত করে এলাহী বিএমএতে যোগদান করে। সে কমিশন লাভ করে ১৯৮৩ সালের ১০ জুন। ভাটিয়ারিতে সামরিক প্রশিক্ষণকালে এলাহী চট্টগ্রাম ভার্সিটিতে বিএসসি পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করে। অতঃপর সে থার্ড বেঙ্গল রেজিমেন্টে অফিসার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে। সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন হিসেবে তাকে সিলেট স্কুল অব এনফেন্টারি অ্যান্ড টেকটিসে (এসআইএনটি) প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। যেসব অফিসার এ কোর্সে প্রথম স্থান লাভ করে কেবল তাদেরই এ দায়িত্বে নিয়োগ করা হয়। দু’বার তাকে সেখানে প্রশিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছিল। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সেনা ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তিনজন সেনা অফিসারকে ইনস্টিটিউট অব বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশনে (আইবিএ) পড়তে পাঠানো হয়েছিল। দুই বছরের এই কোর্সে এলাহী এমবিএ (মার্কেটিং)-এ প্রথম স্থান লাভ করে এবং উজ্জ্বল করে সেনাবাহিনীর মুখ।
কর্নেল এলাহী এরপর জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে যোগদানের জন্য বসনিয়া যায়। সেখানে সে এক বছর দায়িত্ব পালন করে। বসনিয়া থেকে দেশে ফেরার পর এলাহী ব্রিগেড মেজর হিসেবে বান্দরবান ক্যান্টনমেন্টে যোগদান করে। কয়েক মাস সেখানে দায়িত্ব পালন করার পর এলাহী ডিফেন্স সার্ভিসে পিএসসি ডিগ্রি লাভ করে। এই পরীক্ষায় তার বিশেষ কৃতিত্বের জন্য তাকে মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় পিএসসি কোর্সের জন্য প্রেরণ করা হয়। সেখানেও সে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখে এবং দুটি পিএসসি লাভ করে। সেখান থেকে তাকে সিলেটে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টে নিয়োগ করা হয়। এ সময় সরকার বুয়েটের অনুরূপ সেনা নিয়ন্ত্রিত একটি সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এখানে সামরিক অফিসার এবং বেসামরিক শিক্ষার্থীদের জন্য বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং, এমবিএ, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি বিভাগ খোলার সিদ্ধান্ত হয়। সরকার এখানে এলাহীকে প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এরপর এলাহী লে. কর্নেল পদে উন্নীত হয়। সেনা নিয়ম অনুসারে লে. কর্নেল পদে পদোন্নতি লাভের সঙ্গে সঙ্গেই তাকে একটি ব্যাটালিয়নের কমান্ডে নিয়োগ দেয়ার কথা। কিন্তু কুদরত এলাহীকে গুরুত্বপূর্ণ মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে (এমআইএসটি) নিয়োগ করা হায়—প্রথম বিবিএ/এমবিএ কোর্স পরিচালনা করার জন্য। এমআইএসটিকে এখন মিলিটারি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে উন্নীত করা হয়েছে। এরপর এলাহীকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৮তম বেঙ্গলে কমান্ডিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ করা হয়। সেখানে দুই বছর দায়িত্ব পালনের পর তাকে ডিএস হিসেবে সামরিক স্টাফ কলেজে নিয়োগ করা হয়। এর মাত্র কয়েক মাস পর কুদরত এলাহী ফুল কর্নেল হিসেবে নিয়োগ পায় এবং স্টাফ কলেজের সিনিয়র প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব লাভ করে। এর কয়েক মাস পর কর্নেল এলাহী আবার শান্তিরক্ষী বাহিনীতে সেক্টর কমান্ডার হিসেবে সুদানে চলে যায়। ২০০৭ সাল থেকে সেখানে সে এক বছর দায়িত্ব পালন করে। সুদানে দায়িত্ব পালনকালে কর্নেল এলাহী জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের কাছ থেকে জাতিসংঘ পদক গ্রহণ করে। বাংলাদেশের মাত্র কয়েকজন সেনা অফিসার এই বিরল সম্মানজনক পদকে ভূষিত হয়েছে। সুদান থেকে ফিরে আসার পর তাকে এক বছরের কোর্সে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে পাঠানো হয়। সাধারণত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এবং উচ্চ পদস্থদের এই কোর্সে অংশগ্রহণ করতে দেয়া হয়। এলাহীর ক্ষেত্রে এই ব্যতিক্রম শুধু তার অসাধারণ মেধার জন্য। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে এলাহী কৃতিত্বের সঙ্গে এনডিসি কোর্স সমাপ্ত করে। এনডিসি কোর্স সমাপ্ত করার সময়ই কর্নেল এলাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল ডিগ্রি লাভ করে। অল্প বয়সে সে যখন সেনাবাহিনীতে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন আমরা তাকে সেনাবাহিনীতে যোগদানের ব্যাপারে অনাগ্রহ দেখিয়েছিলাম। তার মেধার কারণে তাকে দেশে এবং দেশের বাইরে লেখাপড়া করে বিদেশ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে বিদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করুক—এটাই আমরা চেয়েছিলাম। তাই এলাহী আমাদের মনের আশা পূরণের জন্য পিএইচডি করতে চেয়েছিল। পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করে আমাদের ইচ্ছা পূরণের জন্যই এমফিল সমাপ্ত করেছিল। ২০০৯ সালের ১১ জানুয়ারি কর্নেল এলাহী দিনাজপুরে বিডিআরের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে যোগদান করে। সেখানে সে মাত্র এক মাস ১০ দিন দায়িত্ব পালন করেছিল। গত বছরের ২১ ফেবু্রয়ারি বিডিআর সপ্তাহে যোগদানের জন্য কর্নেল এলাহী ঢাকায় আসে। বিডিআর বিদ্রোহের সময় দুর্ভাগ্যজনকভাবে এলাহী পিলখানাতে অবস্থান করছিল। সেই বিদ্রোহে অন্যান্য সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিডিআরের দরবার হলে কর্নেল এলাহীও শাহাদাত্বরণ করে। যতদূর জানা যায়, ২৫ ফেব্রুয়ারিতেই সে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়। আহত অবস্থায় এলাহী তার কয়েকজন সহকর্মী এবং বন্ধুর কাছে মেসেজ দিয়েছিল যে, এখনও সে বেঁচে আছে এবং তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করার অনুরোধ করেছিল। কিন্তু, ভাগ্য ছিল বিরূপ!
আমরা পরিবারের সবাই মিলে ৩ দিন ধরে যখন টেলিভিশনে বিডিআরের ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ করছিলাম তখন ২৭ ফেব্রুয়ারি বিকালে দেখলাম কর্নেল এলাহীর নাম শহীদের তালিকায় এসে গেছে। তখন সব শেষ! তবে তার বন্ধুদের এবং সহকর্মীদের কাছে এলাহীর মেসেজ পেয়েছি—এলাহী বেঁচে আছে। আমরা বার বার চেষ্টা করেছি তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার। কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি। সে এতটাই দায়িত্ববান ছিল যে, কোথাও থাকলে তার খবর আমাদের কাছে, তার স্ত্রী এবং সন্তানের কাছে তা জানিয়ে দিত। কিন্তু এই ভয়াবহ ঘটনার সময় সে আমাদের কাছে একটি টেলিফোন কিংবা কোনো মেসেজ পাঠায়নি। আমরা মহাযন্ত্রণায় ছটফট ও ছোটাছুটি করব বলে। ২৭ ফেব্রুয়ারিতে বিডিআর সপ্তাহ সমাপ্ত হওয়ার পর আমাদের নিয়ে তার দিনাজপুরে যাওয়ার কথা ছিল। আমরা অনেক আশা করেছিলাম সবাই মিলে দিনাজপুরে যাব। সেখানে ওর সঙ্গে কয়েকদিন কাটিয়ে আসব। কিন্তু সে দিন আর ফিরে আসেনি।
৬ মাস পরে ২০০৯-এর জুলাই-আগষ্টে সেনাবাহিনীর প্রমোশন বোর্ড বসে। ওই বোর্ডেই এলাহী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে উন্নীত হওয়ার কথা ছিল। সে ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি উজ্জ্বল তারকা। তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৬ বছর তিন মাস। কুদরত এলাহী ছিল তার সহকর্মী, বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন এবং ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের অতিপ্রিয় একজন মানুষ। পিতা-মাতার প্রতি ছিল তার অসীম ভক্তি এবং স্ত্রী-পুত্র, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনের প্রতি অত্যন্ত দায়িত্বশীল। সে অধস্তনদের কাছে ছিল অত্যন্ত অমায়িক। মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য সে ছিল সব সময় নিবেদিত। কর্নেল এলাহী ছিল সবার কাছে মৃদুভাষী এক প্রিয় মানুষ। কর্নেল এলাহীকে যখন কবরে শুইয়ে দিয়েছিলাম তখন সেখানে দাঁড়িয়ে একজন সেনা কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘কর্নেল এলাহীর কাছে তার জুনিয়র-সিনিয়র সবারই অনেক কিছু শিক্ষণীয় ছিল।’ একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সেখানে বলেছিলেন, সেনাবাহিনীতে কর্নেল এলাহীর অভাব কখনোই পূরণ হবে না। অন্য একজন অফিসার কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, ‘বিডিআর বিদ্রোহে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যে ক্ষতি হলো তা ৫০ বছরেও পূরণ হওয়ার নয়।’ কর্নেল এলাহী দিনাজপুরে মাত্র এক মাস ১০ দিন দায়িত্ব পালন করেছিল। কয়েক হাজার বিডিআর জওয়ানের মধ্যে হাতেগোনা মাত্র কয়েকজন তাকে চিনত। তার কোনো শত্রু ছিল না। অথচ সেই মানুষটিকে বিপথগামী বিডিআর সদস্যরা নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করল। তার সঙ্গে আরও হারিয়ে গেল দেশের ৫৭ জন মেধাবী সেনা অফিসার। এই অভাব কী কোনো দিন পূরণ হবে? হয়তো না! যদিও সবকিছুই ঘটে আল্লাহর ইচ্ছায়, কিন্তু কী জওয়াব আছে এই মৃত্যুর। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি—তিনি যেন কর্নেল এলাহীকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করেন। সন্তানকে স্মরণ করে যখন ওর কথা লিখছিলাম আমার দু’চোখ অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে আসছিল। কলম থেমে যাচ্ছিল, বুকের স্পন্দন স্তব্ধ হয়ে আসছিল। আর লিখতে পারিনি। জান্নাতে আল্লাহ আমাদের সন্তানের সঙ্গে মিলন ঘটিয়ে দিন—এই একটিই প্রার্থনা আমাদের জীবনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের মহান দরবারে। আমিন।
আমরা সেই হতভাগ্য পিতা-মাতা, যারা হারিয়েছি আমাদের প্রাণাধিক পুত্র কর্নেল কুদরত এলাহী রহমান শফিককে। এলাহীর জীবন প্রদীপ নিভেছে একদল বর্বর মানুুষরূপী হায়না-ঘাতকের বুলেটে-বেয়নেটে। ২৫ ফেব্রুয়ারির পিলখানা সৃষ্টি করেছে ইতিহাসের আরও একটি কলঙ্কময় দিন।
ঘাতকের বুলেটে শহীদ হলো আমাদের সন্তান কর্নেল এলাহী। এই একটি বছর আমরা সন্তানহারা শোক নিয়ে কীভাবে যে বেঁচে আছি, তা শুধু আল্লাহপাকই জানেন। এলাহীর শাহাদাত্ দিবসকে সামনে রেখে ওর উদ্দেশে বলতে চাই—‘বাবা ঘুমাও, যেভাবে ঘুমাতে সেই শিশুকালে আমাদের কোলে। সেভাবেই ঘুমাও কবরে। আল্লাহ তোমার আত্মাকে দেবেন অনন্ত শান্তি। দেশের অগণিত মানুষের ভালোবাসা আর দোয়া আছে তোমার জন্য। তোমাকে হারানোর ব্যথায় আকুল মা-বাবার আকুতিভরা প্রার্থনা পরম করুণাময় নিশ্চয় কবুল করবেন।’
আমাদের সন্তান কর্নেল এলাহীকে আমরা হারিয়েছি। এ ভব-সংসারে আর কোনো দিন তাকে ফিরে পাব না। কিন্তু তার হত্যার বিচার আমরা কোনো দিন পাব কী? দেখতে চাই সত্যিকার বিচার—বিচারের প্রহসন নয়, যে বিচার দেখে যেন ভবিষ্যতে কেউ কোনোদিন কোনো মানুষ খুন করতে উদ্যত না হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারির বর্বরতাই হয় যেন বাংলার ইতিহাসের শেষ কলঙ্ক। তাহলেই হয়তো এলাহীদের বিদেহী আত্মা শান্তি পাবে।
আমরা তো শুধু আমাদের সন্তান কর্নেল এলাহীকেই হারাইনি। দেশ হারিয়েছে এক মেধাবী সন্তানকে। এলাহী তার চেষ্টা ও মেধা দিয়ে শুধু নিজেকেই গড়ে তোলেনি, দেশকেও দিয়েছে অনেক কিছু। দিয়েছে সম্মান, দিয়েছে সেবা। তার উজ্জ্বল জীবনী এবং বর্ণাঢ্য কর্মজীবন দেশের যে কোনো মূল্যবান নাগরিকের জন্য একটি দৃষ্টান্ত।
এলাহীর জন্ম রংপুরে ১৯৬২ সালের পয়লা নভেম্বর তারিখে। আমাদের পারিবারিক নাম ‘রহমান’। জন্মের পর ওর নাম রেখেছিলাম রহমান শফিক। আমাদের প্রথম সন্তান হিসেবে ওকে পাওয়াটাকে আল্লাহর অসীম কুদরত হিসেবে মনে করেছি। সে কারণে আল্লাহর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ওর নামের প্রথমে ‘কুদরত এলাহী’ যুক্ত করেছিলাম। তাই ওর পুরো নাম হয়েছে কুদরত এলাহী রহমান শফিক। এলাহী তার শিশুকাল থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে নিজেকে দিবালোকের মতো সমুজ্জ্বল করে রেখেছে। তার সামনে ছিল ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের পদে উন্নীত হওয়ার সময় ওই ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯-এ মাত্র ৬ মাস পরেই এলাহী এ পদে অভিষিক্ত হতো। এমন একজন মেধাবী সেনা কর্মকর্তার কিছুই দেখে যেতে পারলাম না আমরা। দেশও তার কাছে পেতে পারত আরও অনেক কিছু। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস!
ক্যাডেট কলেজের পাঠ সমাপ্ত করে এলাহী বিএমএতে যোগদান করে। সে কমিশন লাভ করে ১৯৮৩ সালের ১০ জুন। ভাটিয়ারিতে সামরিক প্রশিক্ষণকালে এলাহী চট্টগ্রাম ভার্সিটিতে বিএসসি পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করে। অতঃপর সে থার্ড বেঙ্গল রেজিমেন্টে অফিসার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে। সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন হিসেবে তাকে সিলেট স্কুল অব এনফেন্টারি অ্যান্ড টেকটিসে (এসআইএনটি) প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। যেসব অফিসার এ কোর্সে প্রথম স্থান লাভ করে কেবল তাদেরই এ দায়িত্বে নিয়োগ করা হয়। দু’বার তাকে সেখানে প্রশিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছিল। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সেনা ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তিনজন সেনা অফিসারকে ইনস্টিটিউট অব বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশনে (আইবিএ) পড়তে পাঠানো হয়েছিল। দুই বছরের এই কোর্সে এলাহী এমবিএ (মার্কেটিং)-এ প্রথম স্থান লাভ করে এবং উজ্জ্বল করে সেনাবাহিনীর মুখ।
কর্নেল এলাহী এরপর জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে যোগদানের জন্য বসনিয়া যায়। সেখানে সে এক বছর দায়িত্ব পালন করে। বসনিয়া থেকে দেশে ফেরার পর এলাহী ব্রিগেড মেজর হিসেবে বান্দরবান ক্যান্টনমেন্টে যোগদান করে। কয়েক মাস সেখানে দায়িত্ব পালন করার পর এলাহী ডিফেন্স সার্ভিসে পিএসসি ডিগ্রি লাভ করে। এই পরীক্ষায় তার বিশেষ কৃতিত্বের জন্য তাকে মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় পিএসসি কোর্সের জন্য প্রেরণ করা হয়। সেখানেও সে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখে এবং দুটি পিএসসি লাভ করে। সেখান থেকে তাকে সিলেটে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টে নিয়োগ করা হয়। এ সময় সরকার বুয়েটের অনুরূপ সেনা নিয়ন্ত্রিত একটি সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এখানে সামরিক অফিসার এবং বেসামরিক শিক্ষার্থীদের জন্য বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং, এমবিএ, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি বিভাগ খোলার সিদ্ধান্ত হয়। সরকার এখানে এলাহীকে প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এরপর এলাহী লে. কর্নেল পদে উন্নীত হয়। সেনা নিয়ম অনুসারে লে. কর্নেল পদে পদোন্নতি লাভের সঙ্গে সঙ্গেই তাকে একটি ব্যাটালিয়নের কমান্ডে নিয়োগ দেয়ার কথা। কিন্তু কুদরত এলাহীকে গুরুত্বপূর্ণ মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে (এমআইএসটি) নিয়োগ করা হায়—প্রথম বিবিএ/এমবিএ কোর্স পরিচালনা করার জন্য। এমআইএসটিকে এখন মিলিটারি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে উন্নীত করা হয়েছে। এরপর এলাহীকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৮তম বেঙ্গলে কমান্ডিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ করা হয়। সেখানে দুই বছর দায়িত্ব পালনের পর তাকে ডিএস হিসেবে সামরিক স্টাফ কলেজে নিয়োগ করা হয়। এর মাত্র কয়েক মাস পর কুদরত এলাহী ফুল কর্নেল হিসেবে নিয়োগ পায় এবং স্টাফ কলেজের সিনিয়র প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব লাভ করে। এর কয়েক মাস পর কর্নেল এলাহী আবার শান্তিরক্ষী বাহিনীতে সেক্টর কমান্ডার হিসেবে সুদানে চলে যায়। ২০০৭ সাল থেকে সেখানে সে এক বছর দায়িত্ব পালন করে। সুদানে দায়িত্ব পালনকালে কর্নেল এলাহী জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের কাছ থেকে জাতিসংঘ পদক গ্রহণ করে। বাংলাদেশের মাত্র কয়েকজন সেনা অফিসার এই বিরল সম্মানজনক পদকে ভূষিত হয়েছে। সুদান থেকে ফিরে আসার পর তাকে এক বছরের কোর্সে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে পাঠানো হয়। সাধারণত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এবং উচ্চ পদস্থদের এই কোর্সে অংশগ্রহণ করতে দেয়া হয়। এলাহীর ক্ষেত্রে এই ব্যতিক্রম শুধু তার অসাধারণ মেধার জন্য। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে এলাহী কৃতিত্বের সঙ্গে এনডিসি কোর্স সমাপ্ত করে। এনডিসি কোর্স সমাপ্ত করার সময়ই কর্নেল এলাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল ডিগ্রি লাভ করে। অল্প বয়সে সে যখন সেনাবাহিনীতে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন আমরা তাকে সেনাবাহিনীতে যোগদানের ব্যাপারে অনাগ্রহ দেখিয়েছিলাম। তার মেধার কারণে তাকে দেশে এবং দেশের বাইরে লেখাপড়া করে বিদেশ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে বিদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করুক—এটাই আমরা চেয়েছিলাম। তাই এলাহী আমাদের মনের আশা পূরণের জন্য পিএইচডি করতে চেয়েছিল। পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করে আমাদের ইচ্ছা পূরণের জন্যই এমফিল সমাপ্ত করেছিল। ২০০৯ সালের ১১ জানুয়ারি কর্নেল এলাহী দিনাজপুরে বিডিআরের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে যোগদান করে। সেখানে সে মাত্র এক মাস ১০ দিন দায়িত্ব পালন করেছিল। গত বছরের ২১ ফেবু্রয়ারি বিডিআর সপ্তাহে যোগদানের জন্য কর্নেল এলাহী ঢাকায় আসে। বিডিআর বিদ্রোহের সময় দুর্ভাগ্যজনকভাবে এলাহী পিলখানাতে অবস্থান করছিল। সেই বিদ্রোহে অন্যান্য সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিডিআরের দরবার হলে কর্নেল এলাহীও শাহাদাত্বরণ করে। যতদূর জানা যায়, ২৫ ফেব্রুয়ারিতেই সে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়। আহত অবস্থায় এলাহী তার কয়েকজন সহকর্মী এবং বন্ধুর কাছে মেসেজ দিয়েছিল যে, এখনও সে বেঁচে আছে এবং তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করার অনুরোধ করেছিল। কিন্তু, ভাগ্য ছিল বিরূপ!
আমরা পরিবারের সবাই মিলে ৩ দিন ধরে যখন টেলিভিশনে বিডিআরের ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ করছিলাম তখন ২৭ ফেব্রুয়ারি বিকালে দেখলাম কর্নেল এলাহীর নাম শহীদের তালিকায় এসে গেছে। তখন সব শেষ! তবে তার বন্ধুদের এবং সহকর্মীদের কাছে এলাহীর মেসেজ পেয়েছি—এলাহী বেঁচে আছে। আমরা বার বার চেষ্টা করেছি তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার। কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি। সে এতটাই দায়িত্ববান ছিল যে, কোথাও থাকলে তার খবর আমাদের কাছে, তার স্ত্রী এবং সন্তানের কাছে তা জানিয়ে দিত। কিন্তু এই ভয়াবহ ঘটনার সময় সে আমাদের কাছে একটি টেলিফোন কিংবা কোনো মেসেজ পাঠায়নি। আমরা মহাযন্ত্রণায় ছটফট ও ছোটাছুটি করব বলে। ২৭ ফেব্রুয়ারিতে বিডিআর সপ্তাহ সমাপ্ত হওয়ার পর আমাদের নিয়ে তার দিনাজপুরে যাওয়ার কথা ছিল। আমরা অনেক আশা করেছিলাম সবাই মিলে দিনাজপুরে যাব। সেখানে ওর সঙ্গে কয়েকদিন কাটিয়ে আসব। কিন্তু সে দিন আর ফিরে আসেনি।
৬ মাস পরে ২০০৯-এর জুলাই-আগষ্টে সেনাবাহিনীর প্রমোশন বোর্ড বসে। ওই বোর্ডেই এলাহী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে উন্নীত হওয়ার কথা ছিল। সে ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি উজ্জ্বল তারকা। তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৬ বছর তিন মাস। কুদরত এলাহী ছিল তার সহকর্মী, বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন এবং ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের অতিপ্রিয় একজন মানুষ। পিতা-মাতার প্রতি ছিল তার অসীম ভক্তি এবং স্ত্রী-পুত্র, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনের প্রতি অত্যন্ত দায়িত্বশীল। সে অধস্তনদের কাছে ছিল অত্যন্ত অমায়িক। মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য সে ছিল সব সময় নিবেদিত। কর্নেল এলাহী ছিল সবার কাছে মৃদুভাষী এক প্রিয় মানুষ। কর্নেল এলাহীকে যখন কবরে শুইয়ে দিয়েছিলাম তখন সেখানে দাঁড়িয়ে একজন সেনা কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘কর্নেল এলাহীর কাছে তার জুনিয়র-সিনিয়র সবারই অনেক কিছু শিক্ষণীয় ছিল।’ একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সেখানে বলেছিলেন, সেনাবাহিনীতে কর্নেল এলাহীর অভাব কখনোই পূরণ হবে না। অন্য একজন অফিসার কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, ‘বিডিআর বিদ্রোহে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যে ক্ষতি হলো তা ৫০ বছরেও পূরণ হওয়ার নয়।’ কর্নেল এলাহী দিনাজপুরে মাত্র এক মাস ১০ দিন দায়িত্ব পালন করেছিল। কয়েক হাজার বিডিআর জওয়ানের মধ্যে হাতেগোনা মাত্র কয়েকজন তাকে চিনত। তার কোনো শত্রু ছিল না। অথচ সেই মানুষটিকে বিপথগামী বিডিআর সদস্যরা নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করল। তার সঙ্গে আরও হারিয়ে গেল দেশের ৫৭ জন মেধাবী সেনা অফিসার। এই অভাব কী কোনো দিন পূরণ হবে? হয়তো না! যদিও সবকিছুই ঘটে আল্লাহর ইচ্ছায়, কিন্তু কী জওয়াব আছে এই মৃত্যুর। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি—তিনি যেন কর্নেল এলাহীকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করেন। সন্তানকে স্মরণ করে যখন ওর কথা লিখছিলাম আমার দু’চোখ অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে আসছিল। কলম থেমে যাচ্ছিল, বুকের স্পন্দন স্তব্ধ হয়ে আসছিল। আর লিখতে পারিনি। জান্নাতে আল্লাহ আমাদের সন্তানের সঙ্গে মিলন ঘটিয়ে দিন—এই একটিই প্রার্থনা আমাদের জীবনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের মহান দরবারে। আমিন।
No comments