স্থানীয় সরকার-পথহারা দশা থেকে মুক্তি কবে? by আলী ইমাম মজুমদার
ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন আমাদের যত ধরনের শোষণই করে থাকুক না কেন, তারা তাদেরই প্রয়োজনে কিছুসংখ্যক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিল, যা এ দেশে আধুনিক শাসনব্যবস্থার ভিত রচনা করেছে। অনেকটা তাদেরই প্রেরণায় তাদের শাসনের শেষ দিকে গড়ে ওঠে উপমহাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো।
সীমিত ভোটাধিকারের মাধ্যমে নির্বাচিত স্থানীয় ও প্রাদেশিক সরকার কাঠামো, বিচার বিভাগ ও সিভিল সার্ভিসের রূপকার ছিল তারাই। এগুলোর উপযোগিতা আজও প্রশ্নাতীত। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর ভারত এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে অপ্রাসঙ্গিক বলে বিবেচনা না করে স্বাধীন দেশের চাহিদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে আরও শক্তিশালী করেছে। আমাদের দেশে ১৯৪৭-এর পরে ১৯৫৮-এর সামরিক শাসন জারি পর্যন্ত স্থানীয় ও প্রাদেশিক সরকার পর্যায়ে সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন হলেও জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার জন্য যথাযথ গণতন্ত্রায়ণ-প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। আর ১৯৫৮-এর সামরিক শাসনের পর সবগুলো প্রতিষ্ঠানই স্বকীয়তা হারিয়ে পরিণত হয় শাসকের তল্পিবাহক হিসেবে।
ঊনিশ শতকের শেষ দিকে ব্রিটিশ-শাসিত বঙ্গ প্রদেশে স্থানীয় শাসনব্যবস্থার সূচনা হয়। প্রথমে মনোনীত ব্যক্তি ও সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে এ কাঠামো যাত্রা শুরু করলেও অতি দ্রুতই ক্রমান্বয়ে সীমিত ভোটাধিকারের মাধ্যমে নির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। আমলাতান্ত্রিক খবরদারি থাকা সত্ত্বেও কার্যকর ও মর্যাদাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে রূপ নেয় ইউনিয়ন বোর্ড, পৌরসভা (স্থান ও সময় ভেদে ভিন্ন ভিন্ন নামে), কিছু সময়ের জন্য মহকুমা পর্যায়ে লোকাল বোর্ড এবং সর্বোপরি জেলা বোর্ড। কলকাতার মতো মহানগরে সিটি করপোরেশনও সে সময়কারই একটি প্রতিষ্ঠান। দায়িত্বের সুস্পষ্ট বিভাজন থাকায় প্রতিষ্ঠানগুলো একে অপরের কিংবা স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কোনো বৈরিতায় না গিয়ে বরং পরস্পরের সম্পূরক ও পরিপূরক হিসেবে জনকল্যাণমুখী অবদান রাখে। এসব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান জাতীয় পর্যায়ে নেতা তৈরিতেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। সে সময়ে এগুলোর উত্তরোত্তর গণতন্ত্রায়ণ হতে থাকে। আগেই উল্লেখ করেছি, ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর এ ভূখণ্ডে ১৯৫৮-এর সামরিক আইন জারির পূর্ব পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামোয় আরও কিছু গণতন্ত্রায়ণ হয়। সামরিক শাসন জারির পর ঔপনিবেশিক শাসনকাল থেকে প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর রূপ ব্যাপকভাবে পাল্টে যায়। ইউনিয়ন পরিষদ কাঠামোতে তেমন হস্তক্ষেপ করা না হলেও এগুলোর নির্বাচিত সদস্যদের প্রেসিডেন্ট, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের নির্বাচকমণ্ডলী হিসেবে ব্যবহার করে দুর্নীতির বিষবৃক্ষ রোপণ করা হয়। পৌরসভা, নবগঠিত থানা কাউন্সিল ও জেলা কাউন্সিলের নেতৃত্বে আসীন হন সরকারি কর্মকর্তারা। মৌলিক গণতন্ত্র নামক এ ব্যবস্থা তদানীন্তন শাসকের আসনকে জোরদার করতে বহুলভাবে ব্যবহূত হয়। পক্ষান্তরে এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ব্যাপক গণ-অসন্তোষও ছিল। তবে স্থানীয় সরকারের সকল স্তরেই সরকারের বরাদ্দ বহু গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এগুলো অবকাঠামোগত উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। বর্তমানে উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসনিক কার্যক্রমের যে ভৌত অবকাঠামো রয়েছে, তার সূচনা মূলত তখনই হয়। পাশাপাশি ঘটে দুর্নীতির প্রসার। তবে মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিরা এসব প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে অংশ নিতে ক্রমাগতভাবে অনীহা প্রকাশ করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে উপরিউক্ত অবস্থার যবনিকা ঘটবে বলে আশাবাদী হয় গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন জনগণ। আর জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতি মর্যাদা ও শাসনব্যবস্থার বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে সংবিধানে স্থানীয় শাসনব্যবস্থাকে জোরদার করার অঙ্গীকার করা হয়। কিন্তু ১৯৮২ সালের আগ পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা ব্যতীত আর কোনো স্তরে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার কাঠামো দাঁড় করানো হয়নি। ১৯৮২ সালে সামরিক আইন জারির পর একটি অধ্যাদেশবলে থানা পরিষদ (পরে নাম পরিবর্তন করে উপজেলা পরিষদ) গঠিত হয়। নির্বাচিত চেয়ারম্যানরা দায়িত্ব নেন ১৯৮৫ সালে। অস্বীকার করার জো নেই, এ স্তরে স্থানীয় সরকারের একটি শক্তিশালী কাঠামো জনস্বার্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল। তাই এর ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা লক্ষ করা যায়। তবে এটাও ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে এ কাঠামোটি তৈরির পেছনে কাজ করেছে তদানীন্তন সামরিক শাসকদের একটি বেসামরিক ক্ষমতাবলয় সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা। কিন্তু আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি এরশাদের পতনের পর নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব নিয়েই সেই নির্বাচিত উপজেলা পরিষদ কার্যত বিলুপ্ত করল। তারপর ২০০৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৯ বছর সেই উপজেলা পরিষদের সীমিত আকারের কার্যাবলি ও সম্পদাদি (উপজেলা পরিষদ, থানা পরিষদ, থানা উন্নয়ন কমিটি কোনো না কোনো নামে) মূলত আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হতে থাকে। এ সময়ে উপজেলা পরিষদসংক্রান্ত একটি আইন হলেও তা কার্যকর হয়নি।
২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার উপজেলা পরিষদ অধ্যাদেশ জারি করে নির্বাচনের ব্যবস্থাদিও সম্পন্ন করে। ২০০৯-এর সূচনায় নির্বাচিত সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই এর চেয়ারম্যান/ ভাইস চেয়ারম্যানরা নির্বাচিত হন। নির্বাচিত সংসদ সে অধ্যাদেশে কিছু সংশোধন/সংযোজনসহ এটাকে আইনে রূপ দেয়। কিন্তু উল্লেখ করার বিষয়; অধ্যাদেশ ও আইন এ উভয়টিতে মহিলা সদস্য নির্বাচনের বিধান থাকলেও তা অজ্ঞাত কারণে আজতক কার্যকর হয়নি। সুতরাং, পরিষদটি পূর্ণাঙ্গভাবে গঠিতই হয়নি এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। উপজেলা পরিষদ বিষয়ে সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইন, এর অধীনে প্রণীত বিধিমালা ও কিছু নির্বাহী আদেশ বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। চলমান এ বিতর্কের অন্যতম হচ্ছে উপজেলা পরিষদে স্থানীয় সংসদ সদস্যের উপদেষ্টা হিসেবে অন্তর্ভুক্তি ও তাঁর উপদেশ গ্রহণের বাধ্যবাধকতা এবং সরকারি কর্মকর্তা, বিশেষ করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার ক্ষমতার পরিসর।
উপজেলা পরিষদ উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়নকালে তাঁর প্রভাব ও মর্যাদা বিবেচনায় স্থানীয় সাংসদের কোনো যৌক্তিক পরামর্শ উপেক্ষিত হওয়ার কথা নয়। তাহলে তাঁকে উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা করা এবং সে উপদেশ গ্রহণের বাধ্যবাধকতার বিধান করতে হবে কেন? আর এ বিষয়টি নির্বাচিত স্থানীয় সরকার কাঠামোটিকেই কি অকার্যকর করে দিচ্ছে না? ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশনেও এ ধরনের বিধান রাখার উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত শুভবুদ্ধির উদয় হওয়ায় পরিত্যক্ত হয়েছে। তাই বলে সেসব প্রতিষ্ঠানেও কি স্থানীয় সাংসদের সুপারিশ যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হচ্ছে না?
এরপর আসে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) ক্ষমতা প্রসঙ্গে। উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও উপজেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এবং সরকারের প্রতিনিধি। আইন ও সরকারের বিধিবিধান তাঁকে মেনে চলতে হয়। ১৯৮২ সালের অধ্যাদেশেও প্রায় একই রূপ বিধান ছিল। বিতর্কের অবসান ঘটাতে পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে তাঁকে নিশ্চিত করতে হবে উপজেলা পরিষদে সরকারের হস্তান্তরিত সব বিষয়, যাতে পরিষদ ও চেয়ারম্যানের আইনানুগ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি তাঁর শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও মননশীলতা দিয়ে পরিষদকে একটি কার্যকর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালনায় মূল সহায়ক শক্তির ভূমিকা রাখতে পারেন। সরকারি কোনো আদেশও এর সাংঘর্ষিক হওয়া সমীচীন হবে না। সংসদ সদস্যকে পরিষদের উপদেষ্টা ও তাঁর উপদেশ গ্রহণের বাধ্যবাধকতার বিধানটিও পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ক্ষমতায়নের নামে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি অনাবশ্যক। কেননা, প্রকৃতপক্ষে ওই কর্মকর্তাদের সে ক্ষমতার প্রয়োগ করতে হতে পারে এবং করছেন অনেক ক্ষেত্রেই অন্যের ক্রীড়নক হয়ে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর জেলা পরিষদে (স্বল্পকালের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতীত) কোনো নির্বাচিত কাঠামো দাঁড়ায়নি। ১৯৮৮ সালের তখনকার সরকার নিজ দলের সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে জেলা পরিষদে চেয়ারম্যান নিয়োগ করে। ১৯৯০-এ সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরাও অব্যাহতি পান। কিন্তু কোনো নির্বাচিত কাঠামো আর দাঁড়ায়নি। কয়েক মাস আগে বর্তমান সরকার নিজ দলীয় ব্যক্তিদের মধ্য থেকে জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ দেয়। এগুলোর কোনোটাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। এই জেলা পরিষদগুলোর শিগগির নির্বাচন করার কোনো ইচ্ছে সরকারের আছে—এমনটা তো মনে হচ্ছে না। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান সময়কালে (১৯৫৮ পর্যন্ত) জেলা পরিষদ নির্বাচিত চেয়ারম্যান/প্রেসিডেন্ট পেলে স্বাধীন বাংলাদেশে পাবে না কেন?
দেশে ঢাকাসহ বেশ কয়েকটি সিটি করপোরেশন গঠিত হয়েছে। ঢাকা ব্যতীত প্রতিটিতেই আছেন নির্বাচিত মেয়র ও পরিষদ। অথচ দেশের সবচেয়ে বৃহৎ ও প্রাচীন (১৮৬৪ সালে মিউনিসিপ্যাল কমিটি থেকে ১৯৭৮-এ মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনে রূপান্তরিত) ঢাকার নির্বাচন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অজুহাতে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। এই ৩৪ বছরে এর নির্বাচিত মেয়র ছিলেন মরহুম মোহাম্মদ হানিফ (১২.০৩.১৯৯৪ থেকে ০৪.০৪.২০০২), সাদেক হোসেন খোকা (০৫.০৪.২০০২ থেকে ৩০.১১.২০১১)। বাকি ১৮ বছরই প্রশাসক বা ভিন্ন কোনো পদবি নিয়ে অনির্বাচিত ব্যক্তিরাই এর দায়িত্ব পালন করেন। নির্বাচিত মেয়ররা জনগণের ম্যান্ডেট-প্রদত্ত সময়ের (পাঁচ বছর) অনেক অধিক সময়ই দায়িত্বে ছিলেন। সে সময় কালটা আইন দ্বারা সমর্থিত হলেও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী। এখন দুই ভাগে বিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন। দুজন প্রশাসক সরকারি কর্মকর্তা। নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হলেও আদালতের নির্দেশে তা স্থগিত হয়েছে। আদালতের সে নির্দেশনা পুরো বাস্তবায়ন করেও কয়েক মাসের মাঝেই এ নির্বাচন দুটি করা সম্ভব। কিন্তু তার কোনো লক্ষণ তো দেখছি না।
সংসদের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলো জোরদার হলে গণতন্ত্রের ভিত মজবুত হবে; যেমনটা হয়ে চলছে প্রতিবেশী ভারতে। লোকসভা, রাজ্যসভা, বিধানসভা এবং তিন স্তরবিশিষ্ট পঞ্চায়েতের কেউ কাউকে অসহিষ্ণুতা দেখাচ্ছে না এবং অপ্রয়োজনীয় মনে করছে না। বরং একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে, স্বীয় মর্যাদায় কার্যকরভাবে সক্রিয় রয়েছে প্রশাসন। ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার ধারাবাহিকতায় প্রাপ্ত এ প্রশাসনকে বিলুপ্ত বা ক্ষমতাহীন করার কোনো প্রয়াস বা প্রস্তাবনাও কারও মাঝে আছে বলে মনে হয় না। আমরাও এমন শত ফুল ফোটানোর প্রচেষ্টা চালাতে পারব না কেন? ব্রিটিশ শাসনামলে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা তো একই সময়ে হয়েছিল। পার্থক্য হলো, স্বাধীনতার পর ওরা থেমে থাকেনি বরং গতি বাড়িয়েছে। আমরা বিভিন্ন প্রতিকূলতায় সময়ে সময়ে থেমে থেকেছি কিংবা কখনো কখনো খেয়ালি শাসকের ইচ্ছায় পথভ্রষ্ট হয়েছি। দেখে
না-ই শিখলাম, ঠেকেও তো শিখতে হয়। অনেক তো ঠেকেছি—আর কত?
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
ঊনিশ শতকের শেষ দিকে ব্রিটিশ-শাসিত বঙ্গ প্রদেশে স্থানীয় শাসনব্যবস্থার সূচনা হয়। প্রথমে মনোনীত ব্যক্তি ও সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে এ কাঠামো যাত্রা শুরু করলেও অতি দ্রুতই ক্রমান্বয়ে সীমিত ভোটাধিকারের মাধ্যমে নির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। আমলাতান্ত্রিক খবরদারি থাকা সত্ত্বেও কার্যকর ও মর্যাদাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে রূপ নেয় ইউনিয়ন বোর্ড, পৌরসভা (স্থান ও সময় ভেদে ভিন্ন ভিন্ন নামে), কিছু সময়ের জন্য মহকুমা পর্যায়ে লোকাল বোর্ড এবং সর্বোপরি জেলা বোর্ড। কলকাতার মতো মহানগরে সিটি করপোরেশনও সে সময়কারই একটি প্রতিষ্ঠান। দায়িত্বের সুস্পষ্ট বিভাজন থাকায় প্রতিষ্ঠানগুলো একে অপরের কিংবা স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কোনো বৈরিতায় না গিয়ে বরং পরস্পরের সম্পূরক ও পরিপূরক হিসেবে জনকল্যাণমুখী অবদান রাখে। এসব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান জাতীয় পর্যায়ে নেতা তৈরিতেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। সে সময়ে এগুলোর উত্তরোত্তর গণতন্ত্রায়ণ হতে থাকে। আগেই উল্লেখ করেছি, ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর এ ভূখণ্ডে ১৯৫৮-এর সামরিক আইন জারির পূর্ব পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামোয় আরও কিছু গণতন্ত্রায়ণ হয়। সামরিক শাসন জারির পর ঔপনিবেশিক শাসনকাল থেকে প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর রূপ ব্যাপকভাবে পাল্টে যায়। ইউনিয়ন পরিষদ কাঠামোতে তেমন হস্তক্ষেপ করা না হলেও এগুলোর নির্বাচিত সদস্যদের প্রেসিডেন্ট, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের নির্বাচকমণ্ডলী হিসেবে ব্যবহার করে দুর্নীতির বিষবৃক্ষ রোপণ করা হয়। পৌরসভা, নবগঠিত থানা কাউন্সিল ও জেলা কাউন্সিলের নেতৃত্বে আসীন হন সরকারি কর্মকর্তারা। মৌলিক গণতন্ত্র নামক এ ব্যবস্থা তদানীন্তন শাসকের আসনকে জোরদার করতে বহুলভাবে ব্যবহূত হয়। পক্ষান্তরে এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ব্যাপক গণ-অসন্তোষও ছিল। তবে স্থানীয় সরকারের সকল স্তরেই সরকারের বরাদ্দ বহু গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এগুলো অবকাঠামোগত উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। বর্তমানে উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসনিক কার্যক্রমের যে ভৌত অবকাঠামো রয়েছে, তার সূচনা মূলত তখনই হয়। পাশাপাশি ঘটে দুর্নীতির প্রসার। তবে মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিরা এসব প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে অংশ নিতে ক্রমাগতভাবে অনীহা প্রকাশ করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে উপরিউক্ত অবস্থার যবনিকা ঘটবে বলে আশাবাদী হয় গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন জনগণ। আর জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতি মর্যাদা ও শাসনব্যবস্থার বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে সংবিধানে স্থানীয় শাসনব্যবস্থাকে জোরদার করার অঙ্গীকার করা হয়। কিন্তু ১৯৮২ সালের আগ পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা ব্যতীত আর কোনো স্তরে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার কাঠামো দাঁড় করানো হয়নি। ১৯৮২ সালে সামরিক আইন জারির পর একটি অধ্যাদেশবলে থানা পরিষদ (পরে নাম পরিবর্তন করে উপজেলা পরিষদ) গঠিত হয়। নির্বাচিত চেয়ারম্যানরা দায়িত্ব নেন ১৯৮৫ সালে। অস্বীকার করার জো নেই, এ স্তরে স্থানীয় সরকারের একটি শক্তিশালী কাঠামো জনস্বার্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল। তাই এর ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা লক্ষ করা যায়। তবে এটাও ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে এ কাঠামোটি তৈরির পেছনে কাজ করেছে তদানীন্তন সামরিক শাসকদের একটি বেসামরিক ক্ষমতাবলয় সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা। কিন্তু আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি এরশাদের পতনের পর নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব নিয়েই সেই নির্বাচিত উপজেলা পরিষদ কার্যত বিলুপ্ত করল। তারপর ২০০৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৯ বছর সেই উপজেলা পরিষদের সীমিত আকারের কার্যাবলি ও সম্পদাদি (উপজেলা পরিষদ, থানা পরিষদ, থানা উন্নয়ন কমিটি কোনো না কোনো নামে) মূলত আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হতে থাকে। এ সময়ে উপজেলা পরিষদসংক্রান্ত একটি আইন হলেও তা কার্যকর হয়নি।
২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার উপজেলা পরিষদ অধ্যাদেশ জারি করে নির্বাচনের ব্যবস্থাদিও সম্পন্ন করে। ২০০৯-এর সূচনায় নির্বাচিত সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই এর চেয়ারম্যান/ ভাইস চেয়ারম্যানরা নির্বাচিত হন। নির্বাচিত সংসদ সে অধ্যাদেশে কিছু সংশোধন/সংযোজনসহ এটাকে আইনে রূপ দেয়। কিন্তু উল্লেখ করার বিষয়; অধ্যাদেশ ও আইন এ উভয়টিতে মহিলা সদস্য নির্বাচনের বিধান থাকলেও তা অজ্ঞাত কারণে আজতক কার্যকর হয়নি। সুতরাং, পরিষদটি পূর্ণাঙ্গভাবে গঠিতই হয়নি এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। উপজেলা পরিষদ বিষয়ে সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইন, এর অধীনে প্রণীত বিধিমালা ও কিছু নির্বাহী আদেশ বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। চলমান এ বিতর্কের অন্যতম হচ্ছে উপজেলা পরিষদে স্থানীয় সংসদ সদস্যের উপদেষ্টা হিসেবে অন্তর্ভুক্তি ও তাঁর উপদেশ গ্রহণের বাধ্যবাধকতা এবং সরকারি কর্মকর্তা, বিশেষ করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার ক্ষমতার পরিসর।
উপজেলা পরিষদ উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়নকালে তাঁর প্রভাব ও মর্যাদা বিবেচনায় স্থানীয় সাংসদের কোনো যৌক্তিক পরামর্শ উপেক্ষিত হওয়ার কথা নয়। তাহলে তাঁকে উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা করা এবং সে উপদেশ গ্রহণের বাধ্যবাধকতার বিধান করতে হবে কেন? আর এ বিষয়টি নির্বাচিত স্থানীয় সরকার কাঠামোটিকেই কি অকার্যকর করে দিচ্ছে না? ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশনেও এ ধরনের বিধান রাখার উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত শুভবুদ্ধির উদয় হওয়ায় পরিত্যক্ত হয়েছে। তাই বলে সেসব প্রতিষ্ঠানেও কি স্থানীয় সাংসদের সুপারিশ যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হচ্ছে না?
এরপর আসে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) ক্ষমতা প্রসঙ্গে। উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও উপজেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এবং সরকারের প্রতিনিধি। আইন ও সরকারের বিধিবিধান তাঁকে মেনে চলতে হয়। ১৯৮২ সালের অধ্যাদেশেও প্রায় একই রূপ বিধান ছিল। বিতর্কের অবসান ঘটাতে পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে তাঁকে নিশ্চিত করতে হবে উপজেলা পরিষদে সরকারের হস্তান্তরিত সব বিষয়, যাতে পরিষদ ও চেয়ারম্যানের আইনানুগ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি তাঁর শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও মননশীলতা দিয়ে পরিষদকে একটি কার্যকর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালনায় মূল সহায়ক শক্তির ভূমিকা রাখতে পারেন। সরকারি কোনো আদেশও এর সাংঘর্ষিক হওয়া সমীচীন হবে না। সংসদ সদস্যকে পরিষদের উপদেষ্টা ও তাঁর উপদেশ গ্রহণের বাধ্যবাধকতার বিধানটিও পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ক্ষমতায়নের নামে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি অনাবশ্যক। কেননা, প্রকৃতপক্ষে ওই কর্মকর্তাদের সে ক্ষমতার প্রয়োগ করতে হতে পারে এবং করছেন অনেক ক্ষেত্রেই অন্যের ক্রীড়নক হয়ে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর জেলা পরিষদে (স্বল্পকালের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতীত) কোনো নির্বাচিত কাঠামো দাঁড়ায়নি। ১৯৮৮ সালের তখনকার সরকার নিজ দলের সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে জেলা পরিষদে চেয়ারম্যান নিয়োগ করে। ১৯৯০-এ সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরাও অব্যাহতি পান। কিন্তু কোনো নির্বাচিত কাঠামো আর দাঁড়ায়নি। কয়েক মাস আগে বর্তমান সরকার নিজ দলীয় ব্যক্তিদের মধ্য থেকে জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ দেয়। এগুলোর কোনোটাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। এই জেলা পরিষদগুলোর শিগগির নির্বাচন করার কোনো ইচ্ছে সরকারের আছে—এমনটা তো মনে হচ্ছে না। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান সময়কালে (১৯৫৮ পর্যন্ত) জেলা পরিষদ নির্বাচিত চেয়ারম্যান/প্রেসিডেন্ট পেলে স্বাধীন বাংলাদেশে পাবে না কেন?
দেশে ঢাকাসহ বেশ কয়েকটি সিটি করপোরেশন গঠিত হয়েছে। ঢাকা ব্যতীত প্রতিটিতেই আছেন নির্বাচিত মেয়র ও পরিষদ। অথচ দেশের সবচেয়ে বৃহৎ ও প্রাচীন (১৮৬৪ সালে মিউনিসিপ্যাল কমিটি থেকে ১৯৭৮-এ মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনে রূপান্তরিত) ঢাকার নির্বাচন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অজুহাতে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। এই ৩৪ বছরে এর নির্বাচিত মেয়র ছিলেন মরহুম মোহাম্মদ হানিফ (১২.০৩.১৯৯৪ থেকে ০৪.০৪.২০০২), সাদেক হোসেন খোকা (০৫.০৪.২০০২ থেকে ৩০.১১.২০১১)। বাকি ১৮ বছরই প্রশাসক বা ভিন্ন কোনো পদবি নিয়ে অনির্বাচিত ব্যক্তিরাই এর দায়িত্ব পালন করেন। নির্বাচিত মেয়ররা জনগণের ম্যান্ডেট-প্রদত্ত সময়ের (পাঁচ বছর) অনেক অধিক সময়ই দায়িত্বে ছিলেন। সে সময় কালটা আইন দ্বারা সমর্থিত হলেও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী। এখন দুই ভাগে বিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন। দুজন প্রশাসক সরকারি কর্মকর্তা। নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হলেও আদালতের নির্দেশে তা স্থগিত হয়েছে। আদালতের সে নির্দেশনা পুরো বাস্তবায়ন করেও কয়েক মাসের মাঝেই এ নির্বাচন দুটি করা সম্ভব। কিন্তু তার কোনো লক্ষণ তো দেখছি না।
সংসদের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলো জোরদার হলে গণতন্ত্রের ভিত মজবুত হবে; যেমনটা হয়ে চলছে প্রতিবেশী ভারতে। লোকসভা, রাজ্যসভা, বিধানসভা এবং তিন স্তরবিশিষ্ট পঞ্চায়েতের কেউ কাউকে অসহিষ্ণুতা দেখাচ্ছে না এবং অপ্রয়োজনীয় মনে করছে না। বরং একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে, স্বীয় মর্যাদায় কার্যকরভাবে সক্রিয় রয়েছে প্রশাসন। ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার ধারাবাহিকতায় প্রাপ্ত এ প্রশাসনকে বিলুপ্ত বা ক্ষমতাহীন করার কোনো প্রয়াস বা প্রস্তাবনাও কারও মাঝে আছে বলে মনে হয় না। আমরাও এমন শত ফুল ফোটানোর প্রচেষ্টা চালাতে পারব না কেন? ব্রিটিশ শাসনামলে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা তো একই সময়ে হয়েছিল। পার্থক্য হলো, স্বাধীনতার পর ওরা থেমে থাকেনি বরং গতি বাড়িয়েছে। আমরা বিভিন্ন প্রতিকূলতায় সময়ে সময়ে থেমে থেকেছি কিংবা কখনো কখনো খেয়ালি শাসকের ইচ্ছায় পথভ্রষ্ট হয়েছি। দেখে
না-ই শিখলাম, ঠেকেও তো শিখতে হয়। অনেক তো ঠেকেছি—আর কত?
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
No comments