খবরটি উদ্বেগের এবং আতঙ্কেরও by ড. তারেক শামসুর রেহমান
খবরটি ছাপা হয়েছে একটি জাতীয় দৈনিকে গত ২১ ফেব্রুয়ারি। খবরটি উদ্বেগের এবং আতঙ্কেরও। খবরে বলা হয়েছে, রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে বাঙালি-পাহাড়িদের সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে নয়াদিল্লিভিত্তিক একটি সংগঠন এশিয়ান সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস (এসিএইচআর) জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে।
সংগঠনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ আনা হয়েছে এবং জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশনারের হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়েছে। যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সোচ্চার, তাদের জন্য বিষয়টি উদ্বেগের। কারা ওই এসিএইচআর? তারা কী চায়? জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ(?) কামনা করে তারা কী চাইছে? এসিএইচআর কি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করছে? বাংলাদেশ সরকার যখন সম্প্রতি সেনাবাহিনীর একটি সম্পূর্ণ ব্রিগেড, ৩টি পদাতিক ব্যাটালিয়ন প্রত্যাহার ও ৩৫টি ক্যাম্প বন্ধ করে দিয়েছে, তখন বাঘাইছড়িতে সন্ত্রাসীরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি সেখানে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ডও ছাপা হয়েছে। একাধিক সংবাদপত্র পাঠ করে আমরা যা জেনেছি, তা হচ্ছে অনেকটা এরকম : ১. পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা গঙ্গারামমুখে ২২টি, বাঘাইহাট চৌধুরীপাড়ায় ৫টি ও নার্সারিপাড়ায় ৭টি বসতঘর জ্বালিয়ে দেয় (যায়যায়দিন); ২. পাহাড়িদের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে দুই থেকে আড়াইশ’ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়েছে (আমার দেশ); ৩. পাহাড়িদের একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মদতে বাঘাইহাটে সঙ্কট তৈরি করা হচ্ছে। সশস্ত্র এ গ্রুপটি দল ভারি করতে সাধারণ পাহাড়িদের উস্কানি দিয়ে অশান্তি তৈরির চেষ্টা করছে (কালের কণ্ঠ); ৪. পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে (যুগান্তর); ৫. গঙ্গারাম এলাকায় একটি কাঠের ব্রিজ ভেঙে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা একজন সিনিয়র সেনা কমান্ডারকে অবরুদ্ধ করে। সেই সঙ্গে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন বাঘাইছড়ি উপজেলার কর্মকর্তা ও বাঘাইছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা; ৬. গত এক মাসের অধিক সময় ধরে পাহাড়িদের সংগঠন ইউপিডিএফ বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের গঙ্গারাম এলাকায় বসবাসরত বাঙালিদের ৪২টি বসতবাড়ি সরিয়ে নিতে ও বাঘাইহাটে সেনাবাহিনীর একটি জোন প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন করে আসছিল (যায়যায়দিন); ৭. এই সংঘর্ষের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক কমিশনকে দায়ী করা হয়েছে (ডেসটিনি)। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে এটা স্পষ্ট যে, প্রধানত বাঙালিদের উচ্ছেদ ও একটি সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারের জন্যই পরিকল্পিতভাবে বাঙালিদের বাড়ি-ঘরে আগুন লাগানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পাহাড়িদের দু’একটি বাড়ি-ঘরে আগুন লাগানোর ঘটনাও ঘটে থাকতে পারে। এ ঘটনায় জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফ যে বিবৃতি দিয়েছে, তাতে মূল ঘটনাকে আড়াল করা হয়েছে। এখানে যে মূল সমস্যা অর্থাত্ পাহাড়ি-বাংলাদেশীদের সহাবস্থান, সে ব্যাপারে আলোকপাত করা হয়নি। একজন সিনিয়র সেনা কমান্ডারকে অবরুদ্ধ করা ও অপহরণের ঘটনা নিন্দনীয় হলেও তারা এর নিন্দা করেনি। ইউপিডিএফ বরং পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে পুরো সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে। দাবি জানিয়েছে বাঙালিদের সরিয়ে নেয়ার। এ দাবি জানিয়েছিলেন পাহাড়িদের স্বঘোষিত নেতা সন্তু লারমাও।
এ ঘটনার রেশ ধরে গত মঙ্গলবার খাগড়াছড়িতেও যে ঘটনা ঘটল, তাতে করে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা এখানে দু’জন বাঙালিকে হত্যা করেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এখানে কারফিউ দিতে বাধ্য হয়েছিল স্থানীয় প্রশাসন। এখানে ইউপিডিএফ অবরোধের ডাক দিয়েছিল।
সম্প্রতি ইউপিডিএফ’র ভূমিকাও লক্ষ্য করার মতো। গেল বছর এক বিবৃতিতে তারা বলেছিল, শান্তি চুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে (আমাদের সময়, ২ ডিসেম্বর, ২০০৯)। ইউপিডিএফ মূলত পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন চায়। সেনা প্রত্যাহারের পরও ইউপিডিএফ এ দাবি অব্যাহত রেখেছে। বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিরা এক মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের একটা বড় অংশই এখনও তথাকথিত গুচ্ছগ্রামে বসবাস করেন। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর একটা ধারণার জন্ম হয়েছিল যে, উপজাতীয়রা বাঙালিদের মেনে নেবে। কিন্তু গত বেশ কয়েক বছরে শন্তু লারমার একাধিক উস্কানিমূলক বক্তব্য উপজাতি ও অউপজাতির মধ্যে ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান’-এর পরিবেশ সৃষ্টিতে অন্যতম অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। এখন আংশিক সেনা প্রত্যাহারের পরও সন্তু লারমা স্থানীয় বাঙালিদের গ্রহণ করে নেননি। উল্লেখ্য, বাঙালিরা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করছে তাদের অধিকার বলেই। সংবিধান তাদের এ অধিকার দিয়েছে। সংবিধানের ২৭, ৩৬, ৩৭, ৪২ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এজন বাঙালি বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এ অঞ্চলে বসবাস করা, সম্পত্তি অর্জন করা, চলাফেরা করা ও সমাবেশ করার অধিকার রাখেন। তার এ অধিকার লংঘন করে রাষ্ট্র যদি কোনো আইনও করে, সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সেই আইন বাতিল হতে বাধ্য। বৃহত্তর শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সন্তু লারমাদের আজ এসব বিষয় স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন। ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তি অনুযায়ী অনেক আগেই গঠিত হয়েছে একটি আঞ্চলিক পরিষদ। পরিষদের চেয়ারম্যান ‘নির্বাচিত’ হবেন বলা হলেও, সন্তু লারমা সরকার কর্তৃক চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৯৯৯ সালের ১২ মে থেকে তিনি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন এবং সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। এখন সময় এসেছে চেয়ারম্যান পরিবর্তনের। বৃহত্তর ঐক্যের লক্ষ্যে দল নিরপেক্ষ, বয়োজ্যেষ্ঠ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজনকে চেয়ারম্যান করা যেতে পারে। শান্তিচুক্তির উদ্দেশ্য ছিল অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠীর সুযোগ- সুবিধা বাড়ানো। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এর সুযোগ নিয়েছে চাকমা গোষ্ঠী। তাদের মাঝে শিক্ষিতের হার ৯০ ভাগের উপরে। অথচ অন্য গোষ্ঠীর (মারমা, ত্রিপুরা, মুরং, তনচৈঙ্গ্যা, লুসাই, বোম, পাংগো, খুমি, চাক এবং খিয়াং) কারও কারও শিক্ষার হার শূন্যের কোটায়। এ অঞ্চলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠারও বিরোধিতা করছে জনসংহতি সমিতি বা জেএসএস। কোন কোন জনগোষ্ঠী থেকে কেউ একজন বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছে এরকম দৃষ্টান্ত নেই। আর বাঙালি? বাঙালিদের সঙ্গে এখানে ‘দ্বিতীয় শ্রেণীর’ নাগরিকের মতো আচরণ করা হয়। বাঙালিরা ব্যাংক থেকে লোন নেন ১৬ ভাগ সুদে। অথচ পাহাড়িরা সুদ দেন মাত্র ৫ ভাগ হারে। এই যে বৈষম্য, তা তো সংবিধান লংঘনের সামিল। কেউ কি এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা নেবে? পাহাড়ি-বাঙালি বৈষম্যের কথা বাদই দিলাম। পাহাড়িদের মধ্যকার বৈষম্যও কমিয়ে আনা প্রয়োজন। সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে পারে। বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীর অর্ধেকেরও বেশি বাঙালি। তাদের মাঝে শিক্ষার হার মাত্র ২৫ ভাগ। এ জন্য তারা জাতীয় পর্যায়ে চাকরি পান না। আজ ‘পার্বত্য কোটা’র (উপজাতীয়দের জন্য) মতো ‘পার্বত্য বাঙালি কোটা’ প্রবর্তন করা প্রয়োজন, যাতে করে পার্বত্য এলাকার বাঙালিরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারবেন এবং পরবর্তীকালে সরকারি চাকরি পাবেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘পার্বত্য বাঙালি কোটা’ থাকলেও অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের কোটা নেই। বাঙালিরা সেখানে এক মানবেতর জীবনযাপন করছেন। উচ্চ শিক্ষা তো বটেই, চাকরির ক্ষেত্রেও তারা অবহেলিত। সংবিধানের ১৪নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতী মানুষ-কৃষক ও শ্রমিকের এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তিদান করা।’ পাহাড়ি অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে সরকার বিশেষ সুযোগ দিয়েছে। তাদের জন্য রয়েছে, ‘কোটা ব্যবস্থা’। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালিরাও তো ‘অনগ্রসর গোষ্ঠী’। একটা পরিসংখ্যান নিলেই তা বোঝা যাবে। রাষ্ট্র তো এদের জন্য কিছু করতে পারে। কেননা, সংবিধানের ১৯(১) ধারায় রাষ্ট্রের জন্য এরকম একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সক্ষমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন’। রাষ্ট্র তাই পারে পাহাড়ি বাঙালিদের জন্য সুযোগের সমতা সৃষ্টি করতে। সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্র অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন করতে পারে। এখানে ‘অনগ্রসর’ বলতে শুধু পাহাড়িদের চিহ্নিত না করে পাহাড়ি এলাকায় বসবাসরত বাঙালিদেরও বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। বাঙালি ও পাহাড়িদের মধ্যে ধর্মীয় পার্থক্য রয়েছে। বাঙালিরা মূলত মুসলমান, অন্যদিকে পাহাড়িদের মাঝে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর প্রাধান্য বেশি। যদিও ত্রিপুরাদের মাঝে সনাতন ধর্ম ও অন্যান্য পাহাড়ির মাঝে খ্রিস্টধর্মের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়।
শান্তিচুক্তির ১২ বছর পার হয়ে যাওয়ার পর এই লেখা যখন তৈরি করছি, তখন চোখে পড়ল পুরনো একটি সংখ্যায় প্রকাশিত একটি সংবাদে। উক্ত সংবাদে বলা হয়েছে, জেএসএস বিভিন্ন দূতাবাসে একটি চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নাকি তাদের বলেছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের গুচ্ছগ্রাম থেকে মুসলমান বসতি স্থাপনকারীদের তুলে এনে সমতল হাওর, বাঁওড় ও নদীতে জেগে ওঠা বিভিন্ন চরে তাদের পুনর্বাসন করবেন(?)। সংবাদটি ছাপা হয়েছে দৈনিক নয়া দিগন্তে গত ২ সেপ্টেম্বর। সংবাদটির পেছনে, অর্থাত্ উক্ত চিঠির ব্যাপারে সত্যতা কতটুকু রয়েছে তা আমি বলতে পারব না। কিন্তু ইন্টারনেট সার্চ করে দেখলাম, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কিংবা জেএসএসের পক্ষ থেকে এই চিঠির বিষয়বস্তু সম্পর্কে কোনো প্রতিবাদ জানান হয়নি। জিএসএস এ কাজটি সঠিক করেনি। প্রধানমন্ত্রীর নাম ব্যবহার করার কোনো অধিকার জাতি জেএসএসকে দেয়নি। জেএসএস এ ব্যাপারে অনধিকার চর্চা করেছে। চিঠিতে তারা তাদের ভাষায় ‘মুসলিম বসতি স্থাপনকারী’ হিসেবে বাঙালিদের আখ্যায়িত করে তাদের পুনর্বাসনে(?) বিদেশি দাতাগোষ্ঠী থেকে সাহায্য পাওয়া যাবে বলেও উল্লেখ করেছিল। এ বক্তব্য সাম্প্রদায়িক মানসিকতাসম্পন্ন। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই মিলেই পার্বত্য চট্টগ্রাম। এ ক্ষেত্রে শুধু মুসলমান ‘চিহ্নিত’ করে চিঠি দেয়া ভিন্ন মানসিকতার জন্ম দেয়। শান্তিচুক্তির ১২ বছর পার হওয়ায় তাই এ প্রশ্ন থাকবেই যে, জেএসএস আসলে কী চায়? তারা কি আদৌ বাংলাদেশের সংবিধানের প্রতি আস্থাশীল? আস্থাশীল হলে তারা এ ধরনের মন্তব্য করতে পারত না। মনে রাখতে হবে, শান্তিচুক্তিটি বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে স্বাক্ষরিত হয়েছিল কিনা, সে ব্যাপারেও একটি বড় প্রশ্ন রয়ে গেছে। আজ এত বছর পরও, এমনকি সেনাবাহিনীর একটা অংশ প্রত্যাহারের পরও সেখানে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যায়নি। পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা আজ এ ধরনের সাহস কোথায় পায় যে একজন সেনা সদস্যকে কুপিয়ে আহত করে! একজন সিনিয়র সেনা কর্মকর্তা (যিনি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদমর্যাদার) যখন হুমকির মুখে থাকেন, তখন বিষয়টিকে হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ কথাটাই আমরা বারবার বলে আসছিলাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে আংশিক সেনা প্রত্যাহার করা ঠিক হবে না। এতে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। আমাদের আশংকাই সত্য বলে প্রমাণিত হলো। পাহাড়িরা সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত করছে কোনো কোনো অঞ্চলকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক কমিশনের বিরুদ্ধে বড় ধরনের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। এদের কর্মকাণ্ড বারবার বিতর্কের সৃষ্টি করছে। তাদের কর্মকাণ্ড বাঙালি বিদ্বেষী। ইউএনডিপি যেসব কর্মকাণ্ড পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিচালনা করে তাও বাঙালিদের স্বার্থে নয়। বাঙালিরা থাকছে উপেক্ষিত। আরও একটা কথা। সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে খ্রিস্টীয় ধর্মে দীক্ষিতদের সংখ্যা বাড়ছে। পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাবে, সম্প্রতি সেখানে কীভাবে পরিকল্পিতভাবে খ্রিস্টীয় ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। পাংখোয়া, লুসাই ও বোমাং উপজাতিদের আর্থিক ও চাকরির সুবিধা দিয়ে ধর্মান্তরিত করে খ্রিস্টান বানানো হয়েছে। অথচ জেএসএস থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, পাহাড়িদের মুসলমান ধর্মে ধর্মান্তরিত(?) করা হচ্ছে। এ অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যা। তিনটি পার্বত্য জেলায় বর্তমানে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা মুসলমানদের চেয়ে বেশি। ৫ লাখ ৯৫ হাজার ৩৭৬ জন খ্রিস্টান এবং ৫ লাখ ৬২ হাজার ৯৪৭ জন মুসলমান। সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সংখ্যাও কম নয়, ১ লাখ ২৪ হাজার ৯১ জন (২০০১ সালের সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী)। বর্তমান পরিসংখ্যান যদি নেয়া যায় তাহলে দেখা যাবে, খ্রিস্টানদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। শত শত উপজাতি পরিবার যে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করছে, এ কথা স্বীকার করেছেন স্বয়ং খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের সদস্য রুইথি কারবারি (সমকাল, ১০ মার্চ ২০০৮)। তাহলে প্রশ্নটি উঠতেই পারে, এভাবে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করার উদ্দেশ্য কী? উদ্দেশ্য মূলত একটাই—এখানে পূর্ব তিমুরের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করা। পাঠক মাত্রেই জানেন, পূর্ব তিমুরকে ১৯৭৬ সালে ইন্দোনেশিয়ার ২৭তম প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। ইন্দোনেশিয়া মুসলমান প্রধান দেশ হলেও পূর্ব তিমুর ছিল খ্রিস্টানদের আধিক্য। এখানে মুসলমানরা ছিলেন সংখ্যালঘু। দীর্ঘ ২৩ বছর বিদেশি মিশনারিরা এখানে খ্রিস্টানদের ঐক্যবদ্ধ করেছে, চার্চকে শক্তিশালী করেছে এবং তারা ইন্দোনেশিয়ার বিরুদ্ধে একটা জনমত সৃষ্টি করেছিল। এ ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়া পালন করে আসছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কেননা, পূর্ব তিমুরের গ্যাস ও তেলের ব্যাপারে অস্ট্রেলিয়ার আগ্রহ ছিল এবং দেখা গেল পূর্ব তিমুর স্বাধীন হওয়ার পর (১৯৯৯) অস্ট্রেলিয়া পূর্ব তিমুরের সঙ্গে গ্যাস ও তেল উত্তোলনের যে চুক্তি করেছে, তাতে পূর্ব তিমুরের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। নিজের তেল ও গ্যাস সম্পদ থাকা সত্ত্বেও পূর্ব তিমুর আজ এই সম্পদ ভোগ-দখল থেকে বঞ্চিত। আমরা এ কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে আতঙ্কিত। ইউএনডিপি সেখানে কোন কোন প্রজেক্টে কী কী কাজ করছে, জন অ্যামবুরির নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক কমিশনের ভূমিকা নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা উচিত। প্রয়োজনে একটি গণকমিশনও গঠিত হতে পারে। নিশ্চয়ই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র আমরা বরদাশত করব না। এখানে আরও একটা কথা বলা প্রয়োজন। বাংলাদেশ বড় ধরনের জ্বালানি সঙ্কটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গ্যাসের রিজার্ভ ২০১১-১২ সালে ফুরিয়ে যাবে। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় (ব্লক-২২) গ্যাস ও তেল প্রাপ্তির একটা সম্ভাবনা থাকলেও কোন অদৃশ্য কারণে আজ অবধি সেখানে কোনো কূপ খনন করে পরীক্ষা চালানো হয়নি। অথচ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে সীতাকুণ্ডে ১৯১৯ সালে আইপিপিসি নামক একটি বিদেশি কোম্পানি অনুসন্ধানী কূপ খনন করেছিল। তিতাসে যদি বিপুল গ্যাস পাওয়া যায় (১৯৬৮ সালে আবিষ্কৃত, ২৬৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত ১০টি গ্যাসবাহী স্তর) তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামেও গ্যাস রয়েছে। এ ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন।
খাগড়াছড়ি ও বাঘাইছড়ির ঘটনাকে আমরা হাল্কাভাবে নিতে চাই না। এসিএইচআর বিদেশে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা করছে। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী এ সেনাবাহিনীকে নিয়ে মিথ্যাচার ভিন্ন প্রশ্নের জন্ম দিতে বাধ্য। যেখানে সংবাদপত্রগুলো আমাদের জানাচ্ছে উপরে পাহাড় থেকে সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে শত শত রাউন্ড গুলি ছোড়া হয় ও ব্রিজ জ্বালিয়ে দিয়ে ঊর্ধ্বতন সেনা কমান্ডারকে অবরুদ্ধ তথা অপহরণ করার উদ্যোগ নেয়া হয়, সেখানে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কথা বলা ও সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়ার দাবির অর্থ পরিষ্কার। এখানে সেন
এ ঘটনার রেশ ধরে গত মঙ্গলবার খাগড়াছড়িতেও যে ঘটনা ঘটল, তাতে করে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা এখানে দু’জন বাঙালিকে হত্যা করেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এখানে কারফিউ দিতে বাধ্য হয়েছিল স্থানীয় প্রশাসন। এখানে ইউপিডিএফ অবরোধের ডাক দিয়েছিল।
সম্প্রতি ইউপিডিএফ’র ভূমিকাও লক্ষ্য করার মতো। গেল বছর এক বিবৃতিতে তারা বলেছিল, শান্তি চুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে (আমাদের সময়, ২ ডিসেম্বর, ২০০৯)। ইউপিডিএফ মূলত পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন চায়। সেনা প্রত্যাহারের পরও ইউপিডিএফ এ দাবি অব্যাহত রেখেছে। বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিরা এক মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের একটা বড় অংশই এখনও তথাকথিত গুচ্ছগ্রামে বসবাস করেন। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর একটা ধারণার জন্ম হয়েছিল যে, উপজাতীয়রা বাঙালিদের মেনে নেবে। কিন্তু গত বেশ কয়েক বছরে শন্তু লারমার একাধিক উস্কানিমূলক বক্তব্য উপজাতি ও অউপজাতির মধ্যে ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান’-এর পরিবেশ সৃষ্টিতে অন্যতম অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। এখন আংশিক সেনা প্রত্যাহারের পরও সন্তু লারমা স্থানীয় বাঙালিদের গ্রহণ করে নেননি। উল্লেখ্য, বাঙালিরা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করছে তাদের অধিকার বলেই। সংবিধান তাদের এ অধিকার দিয়েছে। সংবিধানের ২৭, ৩৬, ৩৭, ৪২ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এজন বাঙালি বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এ অঞ্চলে বসবাস করা, সম্পত্তি অর্জন করা, চলাফেরা করা ও সমাবেশ করার অধিকার রাখেন। তার এ অধিকার লংঘন করে রাষ্ট্র যদি কোনো আইনও করে, সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সেই আইন বাতিল হতে বাধ্য। বৃহত্তর শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সন্তু লারমাদের আজ এসব বিষয় স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন। ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তি অনুযায়ী অনেক আগেই গঠিত হয়েছে একটি আঞ্চলিক পরিষদ। পরিষদের চেয়ারম্যান ‘নির্বাচিত’ হবেন বলা হলেও, সন্তু লারমা সরকার কর্তৃক চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৯৯৯ সালের ১২ মে থেকে তিনি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন এবং সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। এখন সময় এসেছে চেয়ারম্যান পরিবর্তনের। বৃহত্তর ঐক্যের লক্ষ্যে দল নিরপেক্ষ, বয়োজ্যেষ্ঠ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজনকে চেয়ারম্যান করা যেতে পারে। শান্তিচুক্তির উদ্দেশ্য ছিল অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠীর সুযোগ- সুবিধা বাড়ানো। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এর সুযোগ নিয়েছে চাকমা গোষ্ঠী। তাদের মাঝে শিক্ষিতের হার ৯০ ভাগের উপরে। অথচ অন্য গোষ্ঠীর (মারমা, ত্রিপুরা, মুরং, তনচৈঙ্গ্যা, লুসাই, বোম, পাংগো, খুমি, চাক এবং খিয়াং) কারও কারও শিক্ষার হার শূন্যের কোটায়। এ অঞ্চলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠারও বিরোধিতা করছে জনসংহতি সমিতি বা জেএসএস। কোন কোন জনগোষ্ঠী থেকে কেউ একজন বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছে এরকম দৃষ্টান্ত নেই। আর বাঙালি? বাঙালিদের সঙ্গে এখানে ‘দ্বিতীয় শ্রেণীর’ নাগরিকের মতো আচরণ করা হয়। বাঙালিরা ব্যাংক থেকে লোন নেন ১৬ ভাগ সুদে। অথচ পাহাড়িরা সুদ দেন মাত্র ৫ ভাগ হারে। এই যে বৈষম্য, তা তো সংবিধান লংঘনের সামিল। কেউ কি এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা নেবে? পাহাড়ি-বাঙালি বৈষম্যের কথা বাদই দিলাম। পাহাড়িদের মধ্যকার বৈষম্যও কমিয়ে আনা প্রয়োজন। সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে পারে। বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীর অর্ধেকেরও বেশি বাঙালি। তাদের মাঝে শিক্ষার হার মাত্র ২৫ ভাগ। এ জন্য তারা জাতীয় পর্যায়ে চাকরি পান না। আজ ‘পার্বত্য কোটা’র (উপজাতীয়দের জন্য) মতো ‘পার্বত্য বাঙালি কোটা’ প্রবর্তন করা প্রয়োজন, যাতে করে পার্বত্য এলাকার বাঙালিরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারবেন এবং পরবর্তীকালে সরকারি চাকরি পাবেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘পার্বত্য বাঙালি কোটা’ থাকলেও অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের কোটা নেই। বাঙালিরা সেখানে এক মানবেতর জীবনযাপন করছেন। উচ্চ শিক্ষা তো বটেই, চাকরির ক্ষেত্রেও তারা অবহেলিত। সংবিধানের ১৪নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতী মানুষ-কৃষক ও শ্রমিকের এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তিদান করা।’ পাহাড়ি অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে সরকার বিশেষ সুযোগ দিয়েছে। তাদের জন্য রয়েছে, ‘কোটা ব্যবস্থা’। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালিরাও তো ‘অনগ্রসর গোষ্ঠী’। একটা পরিসংখ্যান নিলেই তা বোঝা যাবে। রাষ্ট্র তো এদের জন্য কিছু করতে পারে। কেননা, সংবিধানের ১৯(১) ধারায় রাষ্ট্রের জন্য এরকম একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সক্ষমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন’। রাষ্ট্র তাই পারে পাহাড়ি বাঙালিদের জন্য সুযোগের সমতা সৃষ্টি করতে। সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্র অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন করতে পারে। এখানে ‘অনগ্রসর’ বলতে শুধু পাহাড়িদের চিহ্নিত না করে পাহাড়ি এলাকায় বসবাসরত বাঙালিদেরও বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। বাঙালি ও পাহাড়িদের মধ্যে ধর্মীয় পার্থক্য রয়েছে। বাঙালিরা মূলত মুসলমান, অন্যদিকে পাহাড়িদের মাঝে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর প্রাধান্য বেশি। যদিও ত্রিপুরাদের মাঝে সনাতন ধর্ম ও অন্যান্য পাহাড়ির মাঝে খ্রিস্টধর্মের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়।
শান্তিচুক্তির ১২ বছর পার হয়ে যাওয়ার পর এই লেখা যখন তৈরি করছি, তখন চোখে পড়ল পুরনো একটি সংখ্যায় প্রকাশিত একটি সংবাদে। উক্ত সংবাদে বলা হয়েছে, জেএসএস বিভিন্ন দূতাবাসে একটি চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নাকি তাদের বলেছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের গুচ্ছগ্রাম থেকে মুসলমান বসতি স্থাপনকারীদের তুলে এনে সমতল হাওর, বাঁওড় ও নদীতে জেগে ওঠা বিভিন্ন চরে তাদের পুনর্বাসন করবেন(?)। সংবাদটি ছাপা হয়েছে দৈনিক নয়া দিগন্তে গত ২ সেপ্টেম্বর। সংবাদটির পেছনে, অর্থাত্ উক্ত চিঠির ব্যাপারে সত্যতা কতটুকু রয়েছে তা আমি বলতে পারব না। কিন্তু ইন্টারনেট সার্চ করে দেখলাম, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কিংবা জেএসএসের পক্ষ থেকে এই চিঠির বিষয়বস্তু সম্পর্কে কোনো প্রতিবাদ জানান হয়নি। জিএসএস এ কাজটি সঠিক করেনি। প্রধানমন্ত্রীর নাম ব্যবহার করার কোনো অধিকার জাতি জেএসএসকে দেয়নি। জেএসএস এ ব্যাপারে অনধিকার চর্চা করেছে। চিঠিতে তারা তাদের ভাষায় ‘মুসলিম বসতি স্থাপনকারী’ হিসেবে বাঙালিদের আখ্যায়িত করে তাদের পুনর্বাসনে(?) বিদেশি দাতাগোষ্ঠী থেকে সাহায্য পাওয়া যাবে বলেও উল্লেখ করেছিল। এ বক্তব্য সাম্প্রদায়িক মানসিকতাসম্পন্ন। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই মিলেই পার্বত্য চট্টগ্রাম। এ ক্ষেত্রে শুধু মুসলমান ‘চিহ্নিত’ করে চিঠি দেয়া ভিন্ন মানসিকতার জন্ম দেয়। শান্তিচুক্তির ১২ বছর পার হওয়ায় তাই এ প্রশ্ন থাকবেই যে, জেএসএস আসলে কী চায়? তারা কি আদৌ বাংলাদেশের সংবিধানের প্রতি আস্থাশীল? আস্থাশীল হলে তারা এ ধরনের মন্তব্য করতে পারত না। মনে রাখতে হবে, শান্তিচুক্তিটি বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে স্বাক্ষরিত হয়েছিল কিনা, সে ব্যাপারেও একটি বড় প্রশ্ন রয়ে গেছে। আজ এত বছর পরও, এমনকি সেনাবাহিনীর একটা অংশ প্রত্যাহারের পরও সেখানে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যায়নি। পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা আজ এ ধরনের সাহস কোথায় পায় যে একজন সেনা সদস্যকে কুপিয়ে আহত করে! একজন সিনিয়র সেনা কর্মকর্তা (যিনি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদমর্যাদার) যখন হুমকির মুখে থাকেন, তখন বিষয়টিকে হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ কথাটাই আমরা বারবার বলে আসছিলাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে আংশিক সেনা প্রত্যাহার করা ঠিক হবে না। এতে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। আমাদের আশংকাই সত্য বলে প্রমাণিত হলো। পাহাড়িরা সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত করছে কোনো কোনো অঞ্চলকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক কমিশনের বিরুদ্ধে বড় ধরনের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। এদের কর্মকাণ্ড বারবার বিতর্কের সৃষ্টি করছে। তাদের কর্মকাণ্ড বাঙালি বিদ্বেষী। ইউএনডিপি যেসব কর্মকাণ্ড পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিচালনা করে তাও বাঙালিদের স্বার্থে নয়। বাঙালিরা থাকছে উপেক্ষিত। আরও একটা কথা। সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে খ্রিস্টীয় ধর্মে দীক্ষিতদের সংখ্যা বাড়ছে। পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাবে, সম্প্রতি সেখানে কীভাবে পরিকল্পিতভাবে খ্রিস্টীয় ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। পাংখোয়া, লুসাই ও বোমাং উপজাতিদের আর্থিক ও চাকরির সুবিধা দিয়ে ধর্মান্তরিত করে খ্রিস্টান বানানো হয়েছে। অথচ জেএসএস থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, পাহাড়িদের মুসলমান ধর্মে ধর্মান্তরিত(?) করা হচ্ছে। এ অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যা। তিনটি পার্বত্য জেলায় বর্তমানে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা মুসলমানদের চেয়ে বেশি। ৫ লাখ ৯৫ হাজার ৩৭৬ জন খ্রিস্টান এবং ৫ লাখ ৬২ হাজার ৯৪৭ জন মুসলমান। সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সংখ্যাও কম নয়, ১ লাখ ২৪ হাজার ৯১ জন (২০০১ সালের সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী)। বর্তমান পরিসংখ্যান যদি নেয়া যায় তাহলে দেখা যাবে, খ্রিস্টানদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। শত শত উপজাতি পরিবার যে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করছে, এ কথা স্বীকার করেছেন স্বয়ং খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের সদস্য রুইথি কারবারি (সমকাল, ১০ মার্চ ২০০৮)। তাহলে প্রশ্নটি উঠতেই পারে, এভাবে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করার উদ্দেশ্য কী? উদ্দেশ্য মূলত একটাই—এখানে পূর্ব তিমুরের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করা। পাঠক মাত্রেই জানেন, পূর্ব তিমুরকে ১৯৭৬ সালে ইন্দোনেশিয়ার ২৭তম প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। ইন্দোনেশিয়া মুসলমান প্রধান দেশ হলেও পূর্ব তিমুর ছিল খ্রিস্টানদের আধিক্য। এখানে মুসলমানরা ছিলেন সংখ্যালঘু। দীর্ঘ ২৩ বছর বিদেশি মিশনারিরা এখানে খ্রিস্টানদের ঐক্যবদ্ধ করেছে, চার্চকে শক্তিশালী করেছে এবং তারা ইন্দোনেশিয়ার বিরুদ্ধে একটা জনমত সৃষ্টি করেছিল। এ ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়া পালন করে আসছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কেননা, পূর্ব তিমুরের গ্যাস ও তেলের ব্যাপারে অস্ট্রেলিয়ার আগ্রহ ছিল এবং দেখা গেল পূর্ব তিমুর স্বাধীন হওয়ার পর (১৯৯৯) অস্ট্রেলিয়া পূর্ব তিমুরের সঙ্গে গ্যাস ও তেল উত্তোলনের যে চুক্তি করেছে, তাতে পূর্ব তিমুরের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। নিজের তেল ও গ্যাস সম্পদ থাকা সত্ত্বেও পূর্ব তিমুর আজ এই সম্পদ ভোগ-দখল থেকে বঞ্চিত। আমরা এ কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে আতঙ্কিত। ইউএনডিপি সেখানে কোন কোন প্রজেক্টে কী কী কাজ করছে, জন অ্যামবুরির নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক কমিশনের ভূমিকা নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা উচিত। প্রয়োজনে একটি গণকমিশনও গঠিত হতে পারে। নিশ্চয়ই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র আমরা বরদাশত করব না। এখানে আরও একটা কথা বলা প্রয়োজন। বাংলাদেশ বড় ধরনের জ্বালানি সঙ্কটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গ্যাসের রিজার্ভ ২০১১-১২ সালে ফুরিয়ে যাবে। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় (ব্লক-২২) গ্যাস ও তেল প্রাপ্তির একটা সম্ভাবনা থাকলেও কোন অদৃশ্য কারণে আজ অবধি সেখানে কোনো কূপ খনন করে পরীক্ষা চালানো হয়নি। অথচ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে সীতাকুণ্ডে ১৯১৯ সালে আইপিপিসি নামক একটি বিদেশি কোম্পানি অনুসন্ধানী কূপ খনন করেছিল। তিতাসে যদি বিপুল গ্যাস পাওয়া যায় (১৯৬৮ সালে আবিষ্কৃত, ২৬৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত ১০টি গ্যাসবাহী স্তর) তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামেও গ্যাস রয়েছে। এ ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন।
খাগড়াছড়ি ও বাঘাইছড়ির ঘটনাকে আমরা হাল্কাভাবে নিতে চাই না। এসিএইচআর বিদেশে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা করছে। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী এ সেনাবাহিনীকে নিয়ে মিথ্যাচার ভিন্ন প্রশ্নের জন্ম দিতে বাধ্য। যেখানে সংবাদপত্রগুলো আমাদের জানাচ্ছে উপরে পাহাড় থেকে সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে শত শত রাউন্ড গুলি ছোড়া হয় ও ব্রিজ জ্বালিয়ে দিয়ে ঊর্ধ্বতন সেনা কমান্ডারকে অবরুদ্ধ তথা অপহরণ করার উদ্যোগ নেয়া হয়, সেখানে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কথা বলা ও সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়ার দাবির অর্থ পরিষ্কার। এখানে সেন
No comments