অগ্রগতি ধরে রাখতে টেকসই গণতন্ত্র দরকার: হিলারি-তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচনের পক্ষে ড. ইউনূস ও আবেদ

সংঘাত এড়াতে আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের পক্ষে মত দিয়েছেন দেশের দুই বিশিষ্ট ব্যক্তি ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ফজলে হাসান আবেদ। আর আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশে যে অগ্রগতি হচ্ছে, তা অব্যাহত রাখতে হলে গণতন্ত্রকে টেকসই করার ওপর জোর দেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন।


ঢাকা সফরের দ্বিতীয় দিনে গতকাল রোববার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বেসরকারি সাহায্য সংস্থা বাংলাদেশ রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিটির (ব্র্যাক) চেয়ারপারসন ফজলে হাসান আবেদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সম্ভাবনা, নারীর ক্ষমতায়ন, সুশাসন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যা গুরুত্ব পায়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আগামী নির্বাচনের বিষয়ে আলোচনায় ড. ইউনূস ও ফজলে হাসান আবেদ সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একটি বিশ্বাসযোগ্য ও নিরপেক্ষ শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলে ভালো হয় বলে মত দেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক সহকর্মীর মাধ্যমে এবং ব্র্যাকের চেয়ারপারসন ফজলে হাসান আবেদ প্রথম আলোর কাছে এ মতামতের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনার গুলশানের বাসায় সকাল নয়টা ২৫ মিনিটে শুরু হওয়া এ বৈঠক প্রায় ৫০ মিনিট স্থায়ী হয়। বৈঠকে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ও ব্লেক এবং ড্যান ডব্লিউ মজীনা।
জানতে চাইলে ব্র্যাকের চেয়ারপারসন ফজলে হাসান আবেদ বলেন, ‘বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে গণতন্ত্র জরুরি বলে মত দেন হিলারি ক্লিনটন। তিনি সবার অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চান বলেও আমাদের জানিয়েছেন। এ লক্ষ্যে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মতপার্থক্য দূর করতে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে বসার পরামর্শ দিয়েছেন।’
আবেদ জানান, আগামী নির্বাচন সম্পর্কে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁদের মত জানতে চান। ফজলে হাসান আবেদ এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘এ ব্যাপারে তাঁকে জানিয়েছি, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে বিরোধী দল অংশ নিতে চায় না। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে প্রবল মতপার্থক্যের সৃষ্টি হয়। এ পরিস্থিতি এড়াতে আমরা নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান আয়োজনের কথা বলেছি।’
হিলারি ক্লিনটন গতকাল তরুণ সম্প্রদায়ের এক মতবিনিময় সভায়ও দুই নেত্রীকে মতপার্থক্য দূর করতে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন। রাজধানীর ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকার (আইএসডি) ওই অনুষ্ঠানে হিলারি বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলাদা বৈঠকে তাঁদের আলোচনার মাধ্যমে মতপার্থক্য দূর করার আহ্বান জানিয়েছি। আগামী নির্বাচনের জন্য একটি পথ খুঁজে বের করতে তাঁদের সংলাপে বসা উচিত। আমি বিশ্বাস করি, আলোচনায় বসলে তাঁরা সমাধানের পথ খুঁজে পাবেন। এতে করে আগামী দিনে বাংলাদেশের গণতন্ত্র টেকসই হবে।’
বৈঠক শেষে রাষ্ট্রদূতের বাসার বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের মুহাম্মদ ইউনূস জানান, তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার চেয়েছেন। এ অনুরোধের কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, এ সুবিধা পেলে নারীর ক্ষমতায়ন হবে, বাংলাদেশের উন্নতি হবে। ফজলে হাসান আবেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘বৈঠকে বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে কথা হয়েছে। কী করলে আমাদের উন্নয়ন হবে, নারীর ক্ষমতায়ন হবে, সে বিষয়ে আমাদের কথা হয়েছে।’
ড. ইউনূস বলেন, বাংলাদেশের সম্ভাবনা এবং এ পর্যন্ত অর্জনগুলো নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। ১৭ বছর আগে (১৯৯৫ সালে) প্রথম বাংলাদেশে এসেছিলেন হিলারি ক্লিনটন। আমরা সে সময় তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি, কথাবার্তা হয়েছে। এখন তাঁদের সন্তানেরা আছে, নতুন প্রজন্ম এসেছে। উনি যদি সময় নিয়ে এসে আমাদের গ্রামে যেতে পারতেন, নতুন প্রজন্মের সঙ্গে কথা বলতেন, আমরা আরও খুশি হতাম।’
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ-সংকটের বিষয়টিও বৈঠকে এসেছে জানিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ-নেপাল-মিয়ানমার মিলে একটি ‘এনার্জি নেটওয়ার্ক’ করা হলে তা একটি বড় ব্যাপার হবে।
হিলারির সঙ্গে বৈঠকে গ্রামীণ ব্যাংক প্রসঙ্গ এসেছে কি না, জানতে চাইলে ড. ইউনূস বলেন, ‘ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে, গ্রামীণ ব্যাংকের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আমাদের আলোচনা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা না বলাই ভালো।’
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও বৈঠকে কথা হয়েছে জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, হিলারি ক্লিনটন আশা প্রকাশ করেছেন, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে।
বৈঠকের পর ব্র্যাকের চেয়ারপারসন ফজলে হাসান আবেদ টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মার্কিন বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা নিশ্চিত করতে আমরা অনুরোধ জানিয়েছি। এ আলোচনায় সম্প্রতি পোশাকশ্রমিক-নেতা আমিনুলের হত্যার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন হিলারি। এ হত্যার বিচারসহ পোশাকশিল্পের পরিবেশ উন্নত করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন হিলারি ক্লিনটন।’
বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের কাজ করার পরিবেশ নিয়ে কথা বলেছেন হিলারি ক্লিনটন। ড. ইউনূস ও ফজলে হাসান আবেদ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাজ করার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা।
রাজনীতি নিয়ে কথা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে ফজলে হাসান আবেদ বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও উন্নয়ন নিয়ে হিলারি প্রশংসা করেছেন। তবে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশ আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পাচ্ছে। এ সাফল্য অব্যাহত রাখতে হলে গণতন্ত্রকে টেকসই করতে হবে। তাই আগামী নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়, সে ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দলকে কাজ করতে হবে।
বৈঠক শেষে হিলারি ক্লিনটন ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে সেখানকার কর্মীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। এরপর তিনি আইএসডি স্কুলে তরুণ সম্প্রদায়ের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। ওই অনুষ্ঠান শেষে তিনি দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে কলকাতার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন।

No comments

Powered by Blogger.