গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত by শামসুল আরেফিন খান
কথিত আছে, বলশেভিক বিপ্লবের আগে রুশ সম্রাটের সব ক্ষমতার চাবিকাঠি ছিল সম্রাজ্ঞীর মুঠোর মধ্যে। আর পরমা সুন্দরী সেই সম্রাজ্ঞী স্বয়ং যার মুঠোয় আবদ্ধ থাকতেন, তাঁর ইতিহাসখ্যাত নাম ছিল রাসপুতিন। তিনি ছিলেন অলক্ষ্যে বিধাতা পুরুষ। তাঁর কথায় বাঘ আর মহিষ নাকি একঘাটে জল খেত।
জার নিকোলাস ছিলেন কাগুজে বাঘ। তাঁর নামেই চলত সব অনিময় অপশাসন। কিন্তু তিনি ছিলেন নিমিত্ত মাত্র। কূটবুদ্ধির শিরোমণি এবং অঘটনঘটনপটু খলনায়ক হিসেবে রাসপুতিন ইতিহাসে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছেন। অনেকটা মিথ্যা কথার রাজা জার্মানির গোয়েবলসের মতো। তাঁরা দুজনই লেখালেখির উপমার ক্ষেত্রে প্রবাদতুল্য হয়ে উঠেছেন। তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিতেও তাঁদের কালো ছায়া পড়তে দেখা যাচ্ছে। আমাদের নিকট অতীতের স্মৃতিময় জগতে আরেকজন উচ্চাভিলাষী রাজনীতিক যুবা পুরুষ বিশ্বের নজর কাড়েন। তাঁর নাম লিন পিআও। তিনি বিপ্লবোত্তর মহাচীনের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী চেয়ারম্যান মাও জে দংয়ের আস্থাভাজন দক্ষিণহস্ত হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তিনি স্বল্পে তুষ্ট হওয়ার পাত্র ছিলেন না। তাঁর নজর ছিল আকাশে। এবং আকাশে এক বিমান বিস্ফোরণেই তাঁর স্বপ্নের সমাধি রচিত হয়েছিল আকস্মিকভাবে। অকালে, অপরিণত বয়সে। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত রাজীব গান্ধীর সহোদর অনুজ সঞ্জয় গান্ধীরও অকাল মৃত্যু হয় রহস্যজনক এক বিমান দুর্ঘটনায়। জনশ্রুতি ছিল, মায়ের অতিরিক্ত আদর ও প্রশ্রয় পেয়ে সঞ্জয় শুধু দুরন্তই নয়, উচ্চাভিলাষীর চূড়ান্ত হয়ে ওঠেন। আকাশ বিস্ফোরণে তাঁর আকস্মিক মৃত্যুটাও নাকি ঘটে রহস্যঘন কোনো রাজনৈতিক কারণে। এবং সেই রহস্য অনুদ্ঘাটিত থেকে বিস্মৃতির কালো চাদরে ঢাকা পড়ে। এ সম্পর্কে বিস্তর আলোচনায় যাওয়ার ইচ্ছা রাখি না।
অনুসন্ধিৎসু পাঠকের চিন্তার খোরাক জোগাতে কেবল এতটুকু স্মরণ করিয়ে দেওয়াই যথেষ্ট মনে করি, সঞ্জয় নিজের স্বতন্ত্র ইচ্ছায় একটি প্রভাবশালী শিখ-সামরিক পরিবারের রূপসী কন্যার পাণি গ্রহণ করেছিলেন। এ কথা সবাই জানেন, ভারতের জঙ্গিজাতি শিখদের বিচ্ছিন্নতাবাদী স্বপ্নের লীলা নিকেতন স্বর্ণমন্দিরে অভিযান চালানোর ফল সুখকর হয়নি জননন্দিত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রের জন্য। দুজনই মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
রাজনীতি, বিশেষ করে ক্ষমতার রাজনীতির পথটা এমনই কণ্টকাকীর্ণ, পিচ্ছিল ও কুহকে পূর্ণ। কুশীলবদের কে কখন উচ্চাশার ঊর্ধ্বাকাশে পাখা মেলবে এবং কখন কার পদস্খলন ঘটবে, সেই কথার কোনো পূর্বাভাস মেলে না। যেন, দেবতাও জানেন না, মানুষ তো তুচ্ছ, 'দেবঃ ন জনোন্তি কুত মনুষ্য'! তবে এ কথাকে অভ্রান্ত মানা যায় যে, গণতন্ত্রের কঠোর অনুশীলনই কেবল ঠেকাতে পারে সব অঘটন এবং দিতে পারে সব সংকটের সমাধান। কারণ, জনগণের সুস্পষ্ট রায় ব্যতীত বিশ্বাসযোগ্য, স্বচ্ছ, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়া ছাড়া অন্য কোনোভাবে ক্ষমতার শীর্ষে পরিবর্তন আনার কোনো পন্থা গণতান্ত্রিক বিধানে নির্দেশিত হয়নি। স্থান-কাল-পাত্র ও দেশ-জাতি নির্বিশেষে গণতন্ত্রের একই নিয়ম। বুশ-ব্লেয়ার-ওবামা এবং হাসিনা-খালেদা সবার জন্য একই বিধি-বিধান সমভাবে প্রযোজ্য। কেবল স্বৈরাচারকেই টেনেহিঁচড়ে ক্ষমতা থেকে নামানো যায়, যেভাবে আইয়ুব-ইয়াহিয়া-এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল। সাম্প্রতিককালে আরব বসন্ত এবং ন্যাটোর মদদপুষ্ট প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে মিসর, তিউনিসিয়া ও লিবিয়ায় ক্ষমতার পাকাপোক্ত আসন থেকে যুগ যুগ ধরে অধিষ্ঠিত স্বৈরাচার ও একনায়কদের চরম হেনস্তা করে ভূপাতিত করা হয়েছে। সিরিয়ার অবস্থা এখনো অনিশ্চিত। আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজতান্ত্রিক প্রভুরা সবাই আজও বহাল তবিয়তেই আছেন। ইরাক, মিসর, লিবিয়া- কোথাও গণতন্ত্র ফিরে আসেনি। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তবু যাহোক বাংলাদেশে সাংবিধানিক গণতন্ত্র টলমলভাবে সামনের দিকে এগোচ্ছে। এ সময় বাংলাদেশের জ্বালাও-পোড়াও এবং মার-মার, কাট-কাট, গুম বা ফাটাফাটি হরতাল-ধর্মঘট করে গণতন্ত্রকে সংহত করার চিন্তা বাতুলতা মাত্র।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর বিশাল শক্তি প্রয়োগ করেও দুর্নীতির বিষবৃক্ষের বিশাল মহীরুহসদৃশ স্ফীতকায় অস্তিত্বকে ধ্বংস করতে সক্ষম হননি। সেই দুঃখ নিয়েই তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তাঁর পরে যাঁরা ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁদের কথা কারো অজানা হয়। বিচারপতি সাত্তার পর্যন্ত কেউ ব্যক্তিগতভাবে অভিযুক্ত হননি দুর্নীতির দায়ে, এ কথাও মিথ্যা নয়। তবে যাঁরা বিচারপতি সাত্তারের পর ক্ষমতার শীর্ষে উঠেছেন, তাঁরা অর্থ কেলেঙ্কারি তথা দুর্নীতির নানা বর্ণিল উপাখ্যান রচনা করেছেন। দুর্নীতির সবচেয়ে বড় এবং সরস মহাকাব্য রচনা করেন ১৯৯১-'৯৬ আমলের জনৈক স্বনামধন্য 'এপিএস', প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যাঁর প্রতাপ ছিল প্রবল ও দোর্দণ্ড। তদন্ত কমিটিও হয়েছিল। কিন্তু কোনো রায় হয়ে থাকলেও তা জনগণের গোচরে আসতে পারেনি। জনগণ শুধু দেখেছে তাঁর বিত্ত-বৈভবের শনৈ শনৈ বিকাশ, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দ্রুত পদোন্নতি এবং অবিশ্বাস্য অগ্রগতি। দুষ্কর্মের জন্য তিরস্কারের পরিবর্তে লোভনীয় পুরস্কার এবং কালো টাকা সাদা করার উদার ও অবারিত সুযোগের কারণে জাতীয় জীবনে খুবই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। চলমান সময়ে তিন লাখ কোটি টাকার অধিক পরিমাণ কালো টাকা দেশের অর্থনীতির ওপর প্রবল প্রতাপে গদা ঘুরিয়ে দুর্নীতি দমনের সব প্রয়াসকে প্রহসনে পরিণত করেছে। বাতিহীন অন্ধকার রেলগাড়িতে কালো বিড়াল খুঁজতে গিয়ে রেলমন্ত্রী নিজেই রেলে কাটা পড়েছেন। তাঁর করিৎকর্মা এপিএস কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির আতশবাজির চলমান ধারায় হৃস্ব কলেবরের পটকাবাজি করে বড় মাপের ফটকাবাজের 'খ্যাতি' অর্জন করেছেন। তাঁকে নিয়ে রাজনীতির অঙ্গনে চলছে তুমুল গলাবাজি। ফাঁদ পাতা ফাটা বাঁশের চিপায় আটকা পড়েছেন ভূয়োদর্শী রাজনীতিক সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। বিলম্বে হলেও তিনি দৃষ্টান্তমূলক পদত্যাগ করে মান বাঁচানোর প্রয়াস পেয়েছেন। যাঁরা একসময় দুর্নীতির রাঘববোয়াল হিসেবে লাল দাগে চিহ্নিত হয়েছিলেন, কিন্তু রাজনৈতিক তেলেসমাতির গুণে পার পেয়েছেন, তাঁরাই বেশি করে গলা ফাটাচ্ছেন; মূর্খের মতো কাচের ঘরে বসে অন্যের ঘরে ঢিল ছুড়ছেন। এর ফলে অবশ্য একটা উপকার হয়েছে আমাদের দুর্ভাগা জাতির- সাধারণ মানুষ এখন নির্ভয়ে বলছে, কেউই ধোয়া তুলসীপাতা নয়, সবাই কলুষিত। জনগণ ঢালাওভাবে রাজনীতি ও রাজনীতিকদের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে শুরু করেছে।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক, কলামিস্ট, ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা
No comments