সপ্তাহের হালচাল-রাজউকের হলফনামা তাহলে কার জন্য by আব্দুল কাইয়ুম
উত্তরায় প্লট পাওয়ার জন্য একজন সাংসদ যদি মিথ্যা হলফনামা দেন, তাহলে তাঁর নীতিবোধ বলে কিছু থাকে কি? তাঁরা সাংসদ। আইন প্রণেতা। তাঁরা দেশের জন্য আইন করবেন, কিন্তু নিজেরা আইন অনুযায়ী কাজ করবেন না। এই আমাদের দেশ।
রাজউকের নিয়ম হলো, ঢাকায় যাঁর বাড়ি বা জমি আছে, তিনি প্লট পাবেন না। আইনটা তো সর্বাগ্রে দেশের আইনপ্রণেতাদের জন্য প্রযোজ্য হওয়া উচিত। অথচ সম্প্রতি অভিযোগ উঠেছে যে ১৮ জন সাংসদ উত্তরায় প্লট পেয়ে গেছেন, যাঁদের নিজের অথবা স্ত্রীর নামে ঢাকায় বাড়ি, ফ্ল্যাট বা জমি আছে। এখন তাঁরা যুক্তি দিচ্ছেন, ওটা তো আমার নয়, পৈতৃক বাড়ি। কেউ বলছেন, আলাদা বাড়ি তো নয়, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পত্তির অংশীদার মাত্র। সবচেয়ে হাস্যকর যুক্তি হলো, আমি তো জানতাম না যে হলফ করে বলতে হবে। অভিযুক্ত এই ১৮ জনের মধ্যে ১৪ জন আওয়ামী লীগের, দুজন জাতীয় পার্টির, একজন বিএনপির ও একজন জাসদের। এখন সরকার বলতে পারে, একা তো নিইনি, আনুপাতিক হারে সবাইকে দিয়ে-থুয়ে নিয়েছি!
বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ের চিত্রটি আরও ভয়াবহ। তাদের সময় ৪০ জনেরও বেশি সাংসদ, নেতা ও বিএনপির ঘনিষ্ঠজনেরা বনানীতে বিশেষ বিবেচনায় প্লট পেয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এভাবে মন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রীর অনুগ্রহভাজনেরা অনায়াসে বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে গেছেন। তাঁদের একমাত্র যোগ্যতা হলো ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতাধর লোক।
তা ছাড়া ধানমন্ডি, গুলশানে প্রাসাদোপম বাড়ি আছে, তার পরও পূর্বাচলে প্লট নিয়েছেন বা পেয়েছেন—এমন মন্ত্রী, সাংসদ বা প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার অভাব নেই। তাঁদের অনেকে অনৈতিক পথে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। তাতেও সন্তুষ্ট না। আরও চাই। এবং সেটা রাজউকের সুবিধা ব্যবহার করে।
রাজউক বলেছে, যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে তাঁদের বরাদ্দ বাতিল করা হবে। সেটা তো করতেই হবে। কিন্তু একজন সাংসদের এই নৈতিক স্খলনের দায়মুক্তির জন্য কি শুধু সেই বরাদ্দ বাতিলই যথেষ্ট? বিষয়টা ভেবে দেখার মতো। রাজউকের প্লট নিয়ে এর আগে অনেক কাহিনি হয়েছে। একবার বিগত আওয়ামী লীগের সরকারের সময় ‘আওয়ামী পল্লি’ ও তারপর বিএনপি সরকারের আমলে ‘বিএনপি পল্লি’র কত খবরই তো পত্রিকায় বেরিয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে কোনো শাস্তি হতে দেখা যায়নি। খুব বেশি হলে হয়তো এক সরকারের বদলে আরেক সরকার এসে বিরোধী পক্ষের কারও বরাদ্দ বাতিল করেছে। এর বেশি কিছু না।
শুধু রাজউকের প্লট না, শুল্কমুক্ত গাড়ি নিয়ে সাংসদদের কেলেংকারির কথাও তো সবাই জানি। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় এই সুযোগ নিয়ে রীতিমতো অনৈতিক ব্যবসা শুরু হয়ে যায়। কোনো কোনো গাড়ি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছে সাংসদদের কেউ কেউ শুল্কমুক্ত কোটা অঘোষিতভাবে বিক্রি করে দেন। তাঁদের নামে হামার, পোরশে, লেক্সাসসহ বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি করা হয়। শোরুম থেকে সেসব গাড়ি দেশের তথাকথিত বড়লোকেরা কিনে নেন। এঁরা তথাকথিত, কারণ এঁদের অধিকাংশেরই টাকা আসলে ‘কালো টাকা’। আর বিনিময়ে সাংসদেরা একটা টয়োটা গাড়ি ও ২০-৩০ লাখ নগদ টাকাও পান। এভাবে শুল্কমুক্ত গাড়ির কাছে কিছু সাংসদের বিক্রি হয়ে যাওয়ার অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত আজও হয়নি। তাই এগুলো এখনো অভিযোগ হিসেবেই রয়ে গেছে।
কিন্তু তাই বলে অভিযোগগুলো একেবারে ভিত্তিহীন বলা যাবে না। কারণ তা-ই যদি হতো তাহলে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রাস্তায় রাস্তায় সেসব দামি ও বিলাসবহুল পোরশে, হামার গাড়ি মালিকবিহীন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যেত না। এটা পরিষ্কার যে এসব অনৈতিক কাজের সঙ্গে তত্কালীন সরকারের বড় বড় মন্ত্রী-নেতা জড়িত ছিলেন। তাঁদের কারও কারও গাড়ির ব্যবসা ছিল। তাই শুল্কমুক্ত সুবিধার মাখনটা তাঁরা সহজেই উঠিয়ে নিতে পেরেছিলেন। তাঁদের আইনের আওতায় আনতে গেলে এখনই হয়তো রাজপথে মাতম শুরু হয়ে যাবে।
সাংসদদের নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে, প্রলোভনে ফেলে দল ভারী করার অপকৌশলটি শুরু হয় সেই পাকিস্তান আমলে। ১৯৫৪ সালে পূর্ববাংলায় মুসলিম লীগের ভরাডুবির পর ৯২(ক) ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেওয়া হলো। এরপর নতুন সরকারকে হাতে রাখার জন্য শুরু হলো সাংসদদের বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া। সে সময় অনেক সাংসদ প্রথম নগদ টাকার সন্ধান পান। বেছে বেছে সাংসদদের নিজ এলাকার উন্নয়নের নামে টাকা বরাদ্দ দেওয়া হতে থাকে। শর্ত একটাই, পাকিস্তানি শাসক-শোষকদের সঙ্গে থাকতে হবে। এভাবেই আইয়ুব-মোনায়েম চক্রের আশীর্বাদপুষ্ট একটি কায়েমি স্বার্থবাদী শক্তি সরকারি আনুকূল্যে বাড়ি-গাড়ি-জমিজমাসহ বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়ে যান।
কিন্তু মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ সেসব অনৈতিক পথ পরিত্যাগ করেছিল। আজ বিশ্বাস করা কঠিন যে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের অন্তত প্রথম এক দশক এ ধরনের নৈতিকতাবিরোধী কাজ সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে এসেছেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে খাদ্যসচিব একবার একটা দরখাস্ত নিয়ে গেলেন। তাঁর বাড়ি মেরামতের জন্য তিনি কিছু আর্থিক সহায়তা চান। ওই বাড়িটি তিনি পাকিস্তান আমলে নির্বাচন কমিশনকে ভাড়া দিয়েছিলেন। সে জন্য মুক্তিযোদ্ধারা সেই অফিসটি ভেঙে দেয়। তিনি দরখাস্তে লেখেন—মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বাড়িটি ভেঙে গেছে, সেটা ঠিকঠাক করার সংগতি তাঁর নেই। বঙ্গবন্ধু প্রথমে ফাইলে লিখলেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর কিছু আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া যায়। ফাইলটা অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবের কাছে গেলে তিনি লেখেন—‘বঙ্গবন্ধু, উদার মনোভাবের বশবর্তী হয়ে আপনি হয়তো এমন লিখেছেন...এ রকম কত বাড়িঘর পাকিস্তানি হানাদাররা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। আমরা কি তাদের কমপেনসেশন (ক্ষতিপূরণ) দিতে পারব?...এ অবস্থার প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর পূর্ব প্রদত্ত আদেশ পুনর্বিবেচনা ও নির্দেশের জন্য আমি ফাইলটা ফেরত পাঠালাম।’ এরপর সেই ফাইলে বঙ্গবন্ধু লিখলেন, ‘অর্থমন্ত্রীর মন্তব্য সঠিক। আমি তাঁর সাথে একমত।’
এ ঘটনাটি বিএনপির নেতা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী, প্রয়াত এম সাইফুর রহমান তাঁর কিছু কথা কিছু স্মৃতি গ্রন্থে লিখেছেন। সেখানে তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সম্পর্কেও একই ধরনের একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। তাঁর সরকারের প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান সংসদ সদস্যদের জন্য শুল্কমুক্ত গাড়ির প্রস্তাব করেন এবং রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকেও রাজি করিয়ে ফেলেন। কিন্তু সে সময়ের অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান ‘না’ করে দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে শাহ আজিজুর রহমান অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগেন। জিয়াউর রহমানের কাছে গিয়ে শাহ আজিজ বলেন, ‘তিনি কি প্রেসিডেন্ট, না আপনি প্রেসিডেন্ট?’ এ কথায় তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, হ্যাঁ, এ ব্যাপারে অর্থমন্ত্রীই প্রেসিডেন্ট। তারপর তিনি বলেন, না, আমি শুল্কমুক্ত গাড়ি দিব না। আমি অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে একমত।
এ ঘটনাগুলো প্রমাণ করে আমাদের দেশে মাত্র কয়েক দশক আগেও রাজনীতিতে আদর্শ প্রাধান্য পেত। কিন্তু এরশাদের সময় সব ভেসে যায়। ১৯৮৮ সালে একতরফা নির্বাচনে তথাকথিত সংসদকে ঘুষ দিয়ে হাত করার অসত্ উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতি এরশাদ শুল্কমুক্ত গাড়ির সুবিধা চালু করেন। দুঃখজনক যে প্রথাটি আজও টিকে আছে। অবশ্য এবার লাগাম টেনে ধরা হয়েছে। অন্তত শুল্কমুক্ত গাড়ি নিয়ে সাংসদদের অসত্ বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হবে।
ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবে রাজনীতি যে কত কলুষিত হয়ে পড়েছে সে সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে সাইফুর রহমান তাঁর বইয়ে লিখেছেন, আজ (২০০৬) জিয়ার পরিবার কোথা থেকে কোথায় আসছে। এটা স্ববিরোধী ব্যাপার যে জিয়ার পরিবারে এখন টাকার জন্য হুলুস্থূল পড়ে গেছে।... বেগম জিয়া এটা জানেন না তা নয়। কোথায় জিয়াউর রহমান আর কোথায় তাঁর পরিবার। (দেখুন, সাইফুর রহমান, হাক্কানী পাবলিশার্স, ফেব্রুয়ারি ২০০৯, পৃষ্ঠা ২৩২)
সংসদ সদস্যদের ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে সম্প্রতি সংসদে একটি বেসরকারি বিল উত্থাপন করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরী তাঁর বিলে সদস্যদের সততা-স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য সাতটি মূলনীতির কথা বলেছেন। বিলটির ভবিষ্যত্ কী, আমরা জানি না। তবে সাংসদদের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার জন্য এ রকম একটি আচরণবিধি প্রণয়ন খুব জরুরি। সরকারি দল যদি এটা বুঝতে না চায়, তাহলে তাদের ভবিষ্যত্ অন্ধকার।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
No comments