আমার ভাষা আমার একুশ-ভাষানীতি ও পরিকল্পনা কেন জরুরি by সৌরভ সিকদার
‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ সাম্প্রতিককালে আমাদের কাছে খুব পরিচিত বিষয়। কিন্তু ‘ভাষানীতি’ সম্পর্কে তেমন ধারণা হয়তো আমাদের অনেকেরই নেই। যেমন শিক্ষা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু নীতিমালা ও কার্য-পরিকল্পনা হচ্ছে শিক্ষানীতি, তেমনি আমাদের দেশের ভাষা-পরিকল্পনা ও ভাষাবিষয়ক কার্যক্রম যে নীতির আলোকে তৈরি করা হয়—তাই ভাষানীতি।
আমাদের সরকার এবং কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান, যেমন বাংলা একাডেমী বিভিন্ন সময়ে ভাষার উন্নয়ন ও মাতৃভাষার প্রচলন করার জন্য যে কর্ম-পরিকল্পনা বা সিদ্ধান্ত নিয়েছে (যেমন বানান সংস্কার, সরকারি দপ্তরে বাংলা প্রচলন) এগুলো ভাষা-পরিকল্পনার মধ্যে পড়ে। কিন্তু অবাক বিষয়, ভাষার বিষয়ে কোনো নীতিমালা অদ্যাবধি এ দেশে হয়নি, অথচ ভাষার অহঙ্কার নিয়ে আজ আমরা বিশ্বে নতুন পরিচয় পেয়েছি।
উন্নত বিশ্বের প্রায় সব দেশেই ভাষানীতি গ্রহণ করা হয়েছে, যা শুধু তাদের ভাষার শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যই নয় বরং তা শিক্ষাসহ জাতীয় উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এমনকি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে শ্রীলঙ্কা ও ইকুয়েডরে ভাষানীতি রয়েছে। ইকুয়েডর তাদের ভাষানীতির বিষয়ে ২০০২ সালে যে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছে, সেখানে এই নীতি তৈরির উদ্দেশ্য সম্পর্কে তারা বলছে, সে দেশের ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষাসহ শিক্ষার উন্নয়ন এবং স্থানীয় ভাষার উন্নয়নে ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা গঠনে এই নীতি সহায়ক হবে। শুধু উপযুক্ত ভাষানীতি তৈরির কল্যাণে নিউজিল্যান্ডের বিলীন হতে বসা মাউরি ভাষা আজ জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সে দেশে সুপ্রতিষ্ঠিত।
বাংলাদেশে ভাষা-পরিকল্পনা ও ভাষানীতির ওপর গুরুত্ব দিয়ে ভাষাবিজ্ঞানী আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ বলেন, ‘এ দেশের ৯০ ভাগ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা, কাজেই ভাষা-পরিকল্পনার জন্য খুবই ভালো পরিবেশ বিদ্যমান। তবে এখানে ভাষা-পরিকল্পনা সরকারি পর্যায়ে না হলে এটি বাস্তবায়ন করা কঠিন। কোনো কোনো পত্রিকা স্বাধীনভাবে ইচ্ছেমতো বানান লিখছে। প্রচলিত বানানের ব্যতিক্রমী বানান ব্যবহার করছে, কিছু কিছু গণমাধ্যমও (ই. মিডিয়া) বানান ও উচ্চারণের ক্ষেত্রে নৈরাজ্য তৈরি করছে—একই সঙ্গে আঞ্চলিক উচ্চারণরীতি ব্যবহার করছে। এর ফলে মান-ভাষার বিকৃতি ঘটছে।
বাংলা ছাড়াও আমাদের দেশে অন্য যেসব মাতৃভাষা অর্থাত্ ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভাষা রয়েছে, এগুলো কীভবে সংরক্ষণ করে তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা করা যায়, সেটিও ভাষা-পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত। আমরা সংবাদপত্রে দেখেছি, আন্দামানে বো ভাষার মাত্র একজন কথক জীবিত ছিলেন। সম্প্রতি তিনি মারা গেছেন, ফলে এ ভাষাটি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কাজেই ভাষানীতি নির্ধারণ করে যথাযথ পরিকল্পনা না নিলে এ দেশের আদিবাসীদের অবস্থাও একদিন সে রকম হতে পারে। কাজেই সরকারের দায়িত্ব এমন ভাষানীতি করা, যার ফলে বাংলা ভাষার মান রক্ষিত হয় এবং এ দেশের অন্য ভাষাভাষীদের ভাষাও বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পায়; একইসঙ্গে চাকরির ক্ষেত্রে যাতে তাদের অসুবিধা না হয়, সেভাবে বাংলা ও ইংরেজির ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। শিক্ষনীতি যেমন শিক্ষার উন্নয়নের সহায়ক, তেমনি ভাষানীতি ভাষা তথা জাতীয় উন্নয়নের সহায়ক।
ভাষাজ্ঞািনী চার্লস ফার্গুসন ও আনোয়ার এস দিল ১৯৭৯ সালে বাংলা ভাষার অবস্থা, অবস্থান এবং বাংলাদেশের উন্নয়নের সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক দেখিয়ে ১৪টি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব বা প্রকল্প উপস্থাপন করেছেন। আমাদের জাতীয় উন্নতিতে যে ভাষার ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ তাও তাঁরা দেখিয়েছেন। ভাষাসংশ্লিষ্ট তাদের উন্নয়ন এলাকার মধ্যে রয়েছে শিক্ষা, সরকারি কাজকর্ম, ব্যবস্থাপনা এবং প্রযুক্তির সম্প্রসারণ। আমরা জানি, উন্নয়নের ক্ষেত্রে এমনকি শিক্ষায় একাধিক ভাষার ব্যবহার শুধু বিঘ্নই ঘটায় না, বাধাগ্রস্তও করে তোলে। যেমন এ দেশে একইসঙ্গে বাংলা, ইংরেজি ও আরবি মাধ্যমে শিক্ষাদান হচ্ছে। ফলে শিক্ষা সমাপ্তির পর চাকরি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সব শিক্ষিতকে সব কাজে লাগানো যাচ্ছে না। কাজেই রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় ভাষা শুধু বাংলাকে যদি উন্নয়নের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা যায়, তবে উন্নয়নে গতি অর্জন করবে নিঃসন্দেহে। পৃথিবীর সব উন্নত জাতি ও দেশের দিকে তাকালে স্পষ্ট হবে যে মাতৃভাষার গুরুত্ব এবং ভাষানীতিতে তারা কত অনড়। যেমন—জাপান, জার্মান, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ। আবার ভাষানীতি দুর্বল ও পক্ষপাতদুষ্ট হলে কেমন হয়, তার দৃষ্টান্ত দেওয়া যায় ভারতের ক্ষেত্রে। সেখানে হিন্দির আধিপত্যে প্রাদেশিক ভাষাগুলো কোণঠাসা এবং ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ মাথা তুলেছে। ‘দেশে বহু ধর্ম বহুভাষা’ প্রবন্ধে অন্নদাশঙ্কর রায় লিখে ছিলেন, ‘বহুভাষী দেশ বহু রাষ্ট্র হবে, ভারত যদি ছত্রভঙ্গ হয় ভাষার ইস্যুতেই হবে।’ ভারতের সংবিধানে হিন্দি রাষ্ট্রভাষা নয়, কিন্তু দাপ্তরিক এবং অধিপত্যের ভাষা। তাই ভারতের ভাষানীতির সমালোচনা করে রত্নেশ্বর ভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘এক দুর্বল ভাষানীতি নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম, তারপর সে হীনবল নীতির প্রয়োগের সময় নিরপেক্ষতা ও ধৈর্যের বদলে পক্ষপাতদুষ্ট কুটিলতা দিয়ে তাকে উতরে দেবার বাসনায় আজ আমরা দেশজুড়ে দুরারোগ্য এক ভাষারোগের জন্ম কি দেইনি (ঘরে বাইরে আক্রমণ বাংলা ভাষা; ১৯৯০)।’ পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য।
ভাষাবিজ্ঞানের ঘরে ভাষা-পরিকল্পনা নামক শাস্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল ঔপনিবেশ উত্তরকালে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের জাতীয় ভাষার সমস্যা আর উন্নত দেশের দ্বিতীয় ভাষা তথা ঔপনিবেশিক ভাষা সংরক্ষণের আগ্রহ থেকে। উন্নত বিশ্ব তাদের ভাষা-পরিকল্পনাকে কাজে লাগিয়ে শুধু উন্নয়নই ঘটায়নি বরং তাদের ভাষাকে পণ্য করে বিদেশে রপ্তানিও করছে। তাই আমাদের এ কালে রাজ্য বিদেশি প্রভুরা পরিচালনা করে না বটে, কিন্তু তাদের ভাষা এখনো ঘরে-বাইরে কর্তৃত্ব চালিয়ে যাচ্ছে। আর এ শৃঙ্খল থেকে মু্ক্ত হতে ভাষানীতি এবং তার আলোকে ভাষা-পরিকল্পনা আজ অনিবার্য। ভাষাবিজ্ঞানী মনসুর মুসা তাই লিখেছেন, ‘ভাষা-পরিকল্পনা অন্য অনেক ভাষার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়েছে। কখনো পুরো মাত্রায়, কখনো আংশিকভাবে। বাংলা ভাষা-পরিকল্পনা যে সম্ভব, ইতিহাস তার সাক্ষ্য। এখন তত্ত্বও তার পক্ষে। প্রযুক্তিও দুষ্প্রাপ্য নয় (১৯৯৫)।’
প্রায় সব দেশেই কখনো ব্যক্তি, কখনো প্রতিষ্ঠান ভাষা-পরিকল্পনার কাজ করেন। যেমন বিদ্যাসাগর, প্রমথ চৌধুরী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, বাংলা একাডেমী প্রভৃতি। কিন্তু ভাষানীতি সরকারকেই করতে হয়। এটি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাজ নয়। এরা সহায়তা দিতে পারে শুধু। ভাষানীতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাষ্ট্র পরিচালনা, প্রশাসন, শিক্ষা, প্রযুক্তির সম্প্রসারণ, ভাষার উন্নয়ন সর্বোপরি সংখ্যালঘু ভাষিকগোষ্ঠীর ভাষার অধিকার ও মর্যাদার প্রশ্ন। তাই বাংলা ভাষা তথা বাংলাদেশের ভাষাগুলোর ভবিষ্যত্ এবং সম্ভাবনার কথা স্মরণ রেখে ভাষানীতি তৈরির উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে দেশের জন্ম, সে দেশে স্বাধীনতার চার দশকেও কি আমরা একটি যুগোপযোগী ভাষানীতি প্রত্যাশা করতে পারি না?
সৌরভ সিকদার: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
উন্নত বিশ্বের প্রায় সব দেশেই ভাষানীতি গ্রহণ করা হয়েছে, যা শুধু তাদের ভাষার শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যই নয় বরং তা শিক্ষাসহ জাতীয় উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এমনকি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে শ্রীলঙ্কা ও ইকুয়েডরে ভাষানীতি রয়েছে। ইকুয়েডর তাদের ভাষানীতির বিষয়ে ২০০২ সালে যে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছে, সেখানে এই নীতি তৈরির উদ্দেশ্য সম্পর্কে তারা বলছে, সে দেশের ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষাসহ শিক্ষার উন্নয়ন এবং স্থানীয় ভাষার উন্নয়নে ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা গঠনে এই নীতি সহায়ক হবে। শুধু উপযুক্ত ভাষানীতি তৈরির কল্যাণে নিউজিল্যান্ডের বিলীন হতে বসা মাউরি ভাষা আজ জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সে দেশে সুপ্রতিষ্ঠিত।
বাংলাদেশে ভাষা-পরিকল্পনা ও ভাষানীতির ওপর গুরুত্ব দিয়ে ভাষাবিজ্ঞানী আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ বলেন, ‘এ দেশের ৯০ ভাগ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা, কাজেই ভাষা-পরিকল্পনার জন্য খুবই ভালো পরিবেশ বিদ্যমান। তবে এখানে ভাষা-পরিকল্পনা সরকারি পর্যায়ে না হলে এটি বাস্তবায়ন করা কঠিন। কোনো কোনো পত্রিকা স্বাধীনভাবে ইচ্ছেমতো বানান লিখছে। প্রচলিত বানানের ব্যতিক্রমী বানান ব্যবহার করছে, কিছু কিছু গণমাধ্যমও (ই. মিডিয়া) বানান ও উচ্চারণের ক্ষেত্রে নৈরাজ্য তৈরি করছে—একই সঙ্গে আঞ্চলিক উচ্চারণরীতি ব্যবহার করছে। এর ফলে মান-ভাষার বিকৃতি ঘটছে।
বাংলা ছাড়াও আমাদের দেশে অন্য যেসব মাতৃভাষা অর্থাত্ ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভাষা রয়েছে, এগুলো কীভবে সংরক্ষণ করে তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা করা যায়, সেটিও ভাষা-পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত। আমরা সংবাদপত্রে দেখেছি, আন্দামানে বো ভাষার মাত্র একজন কথক জীবিত ছিলেন। সম্প্রতি তিনি মারা গেছেন, ফলে এ ভাষাটি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কাজেই ভাষানীতি নির্ধারণ করে যথাযথ পরিকল্পনা না নিলে এ দেশের আদিবাসীদের অবস্থাও একদিন সে রকম হতে পারে। কাজেই সরকারের দায়িত্ব এমন ভাষানীতি করা, যার ফলে বাংলা ভাষার মান রক্ষিত হয় এবং এ দেশের অন্য ভাষাভাষীদের ভাষাও বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পায়; একইসঙ্গে চাকরির ক্ষেত্রে যাতে তাদের অসুবিধা না হয়, সেভাবে বাংলা ও ইংরেজির ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। শিক্ষনীতি যেমন শিক্ষার উন্নয়নের সহায়ক, তেমনি ভাষানীতি ভাষা তথা জাতীয় উন্নয়নের সহায়ক।
ভাষাজ্ঞািনী চার্লস ফার্গুসন ও আনোয়ার এস দিল ১৯৭৯ সালে বাংলা ভাষার অবস্থা, অবস্থান এবং বাংলাদেশের উন্নয়নের সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক দেখিয়ে ১৪টি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব বা প্রকল্প উপস্থাপন করেছেন। আমাদের জাতীয় উন্নতিতে যে ভাষার ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ তাও তাঁরা দেখিয়েছেন। ভাষাসংশ্লিষ্ট তাদের উন্নয়ন এলাকার মধ্যে রয়েছে শিক্ষা, সরকারি কাজকর্ম, ব্যবস্থাপনা এবং প্রযুক্তির সম্প্রসারণ। আমরা জানি, উন্নয়নের ক্ষেত্রে এমনকি শিক্ষায় একাধিক ভাষার ব্যবহার শুধু বিঘ্নই ঘটায় না, বাধাগ্রস্তও করে তোলে। যেমন এ দেশে একইসঙ্গে বাংলা, ইংরেজি ও আরবি মাধ্যমে শিক্ষাদান হচ্ছে। ফলে শিক্ষা সমাপ্তির পর চাকরি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সব শিক্ষিতকে সব কাজে লাগানো যাচ্ছে না। কাজেই রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় ভাষা শুধু বাংলাকে যদি উন্নয়নের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা যায়, তবে উন্নয়নে গতি অর্জন করবে নিঃসন্দেহে। পৃথিবীর সব উন্নত জাতি ও দেশের দিকে তাকালে স্পষ্ট হবে যে মাতৃভাষার গুরুত্ব এবং ভাষানীতিতে তারা কত অনড়। যেমন—জাপান, জার্মান, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ। আবার ভাষানীতি দুর্বল ও পক্ষপাতদুষ্ট হলে কেমন হয়, তার দৃষ্টান্ত দেওয়া যায় ভারতের ক্ষেত্রে। সেখানে হিন্দির আধিপত্যে প্রাদেশিক ভাষাগুলো কোণঠাসা এবং ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ মাথা তুলেছে। ‘দেশে বহু ধর্ম বহুভাষা’ প্রবন্ধে অন্নদাশঙ্কর রায় লিখে ছিলেন, ‘বহুভাষী দেশ বহু রাষ্ট্র হবে, ভারত যদি ছত্রভঙ্গ হয় ভাষার ইস্যুতেই হবে।’ ভারতের সংবিধানে হিন্দি রাষ্ট্রভাষা নয়, কিন্তু দাপ্তরিক এবং অধিপত্যের ভাষা। তাই ভারতের ভাষানীতির সমালোচনা করে রত্নেশ্বর ভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘এক দুর্বল ভাষানীতি নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম, তারপর সে হীনবল নীতির প্রয়োগের সময় নিরপেক্ষতা ও ধৈর্যের বদলে পক্ষপাতদুষ্ট কুটিলতা দিয়ে তাকে উতরে দেবার বাসনায় আজ আমরা দেশজুড়ে দুরারোগ্য এক ভাষারোগের জন্ম কি দেইনি (ঘরে বাইরে আক্রমণ বাংলা ভাষা; ১৯৯০)।’ পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য।
ভাষাবিজ্ঞানের ঘরে ভাষা-পরিকল্পনা নামক শাস্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল ঔপনিবেশ উত্তরকালে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের জাতীয় ভাষার সমস্যা আর উন্নত দেশের দ্বিতীয় ভাষা তথা ঔপনিবেশিক ভাষা সংরক্ষণের আগ্রহ থেকে। উন্নত বিশ্ব তাদের ভাষা-পরিকল্পনাকে কাজে লাগিয়ে শুধু উন্নয়নই ঘটায়নি বরং তাদের ভাষাকে পণ্য করে বিদেশে রপ্তানিও করছে। তাই আমাদের এ কালে রাজ্য বিদেশি প্রভুরা পরিচালনা করে না বটে, কিন্তু তাদের ভাষা এখনো ঘরে-বাইরে কর্তৃত্ব চালিয়ে যাচ্ছে। আর এ শৃঙ্খল থেকে মু্ক্ত হতে ভাষানীতি এবং তার আলোকে ভাষা-পরিকল্পনা আজ অনিবার্য। ভাষাবিজ্ঞানী মনসুর মুসা তাই লিখেছেন, ‘ভাষা-পরিকল্পনা অন্য অনেক ভাষার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়েছে। কখনো পুরো মাত্রায়, কখনো আংশিকভাবে। বাংলা ভাষা-পরিকল্পনা যে সম্ভব, ইতিহাস তার সাক্ষ্য। এখন তত্ত্বও তার পক্ষে। প্রযুক্তিও দুষ্প্রাপ্য নয় (১৯৯৫)।’
প্রায় সব দেশেই কখনো ব্যক্তি, কখনো প্রতিষ্ঠান ভাষা-পরিকল্পনার কাজ করেন। যেমন বিদ্যাসাগর, প্রমথ চৌধুরী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, বাংলা একাডেমী প্রভৃতি। কিন্তু ভাষানীতি সরকারকেই করতে হয়। এটি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাজ নয়। এরা সহায়তা দিতে পারে শুধু। ভাষানীতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাষ্ট্র পরিচালনা, প্রশাসন, শিক্ষা, প্রযুক্তির সম্প্রসারণ, ভাষার উন্নয়ন সর্বোপরি সংখ্যালঘু ভাষিকগোষ্ঠীর ভাষার অধিকার ও মর্যাদার প্রশ্ন। তাই বাংলা ভাষা তথা বাংলাদেশের ভাষাগুলোর ভবিষ্যত্ এবং সম্ভাবনার কথা স্মরণ রেখে ভাষানীতি তৈরির উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে দেশের জন্ম, সে দেশে স্বাধীনতার চার দশকেও কি আমরা একটি যুগোপযোগী ভাষানীতি প্রত্যাশা করতে পারি না?
সৌরভ সিকদার: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments