পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বছরপূর্তিতে by ড. মাহবুব উল্লাহ্
ঢাকার পিলখানায় বিডিআর জওয়ানদের বিদ্রোহের পর একটি বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। ২০০৯-এর ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রঘাতী এ বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। বিদ্রোহে নারকীয় পৈশাচিকতায় খুন হয়েছেন ৫৭ জন সামরিক অফিসার। এ ছাড়াও তাদের আত্মীয়-স্বজনরা কেউ কেউ নিহত হয়েছেন।
তাদের পরিবারের নারী সদস্যরা চরম লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। ঘটেছে লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা। পাষণ্ড বিদ্রোহীরা তাদের অফিসারদের হত্যা করেই নিবৃত্ত হয়নি, তাদের অনেকের লাশ পুড়িয়ে ফেলেছে, গণকবর দিয়ে পুঁতে ফেলেছিল এবং স্যুয়ারেজের ড্রেন দিয়ে গুম করার চেষ্টা করেছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে এ ধরনের বর্বরতা, অতীতে আর কখনো ঘটেনি। ১৯৭১-এর দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে ৫১ জন সামরিক কর্মকর্তা শত্রুর সঙ্গে প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। কিন্তু বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নিহত হয়েছেন ৫৭ জন চৌকস সামরিক কর্মকর্তা। যদি কোনো শত্রু রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্মুখ সমরে তাদের এভাবে প্রাণ দিতে হতো তাহলে হয়তো জাতির জন্য মনকে প্রবোধ দেয়ার একটা সুযোগ থাকত। আমরা নিজেদের বোঝাতে পারতাম, বিদেশি আগ্রাসন প্রতিহত করতে গিয়ে তারা বীরের মতো লড়াই করে আত্মাহুতি দিয়ে গেছেন। কিন্তু ২০০৯-এর ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি যে পরিস্থিতিতে চরম অবমাননাকর মৃত্যু তাদের বরণ করতে হলো সেই লজ্জা ঢেকে রাখার কোনো উপায় কি জাতির সামনে আছে? সান্ত্বনা খোঁজার কোনো ভাষা কি আমাদের জানা আছে? ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে কবিতার ভাষায় দৈনিক আজাদে শিরোনাম লিখেছিলেন প্রবীণ সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত। শিরোনামটি ছিল ‘মৃত্যুর জানাজা মোরা কিছুতেই করিব না পাঠ/কবরের ঘুম ভাঙে জীবনের দাবি আজ এতই বিরাট।’ বিদ্রোহে শাহাদাত্বরণকারী সামরিক অফিসারদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য, হৃদয়ের আকুতি প্রকাশের জন্য এরকম কোনো কবিতার ছত্রও হয়তো যথেষ্ট নয়।
শত্রুর সঙ্গে সম্মুখ সমরে তাদের মৃত্যু হয়নি। তারা ছিলেন নিরস্ত্র। যুদ্ধের জন্য কোনো মানসিক প্রস্তুতিও তাদের ছিল না। বিডিআর সপ্তাহ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাদের অনেকে এসেছিলেন পিলখানায়। উত্সবে যোগ দিতে এসে কেউ কি মৃত্যুর কথা ভাবে? কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে মৃত্যুই অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। শত্রু দৃশ্যমান না হলেও দেশের শত্রুরাই তাদের হত্যা করেছিল। কথাটি বলছি এ কারণে যে এটা যদি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শত্রুদের কাজ না হয় তাহলে অভূতপূর্ব ও অচিন্তনীয় এ ঘটনাটিকে আর কীভাবে মূল্যায়ন করা যাবে? দাবি-দাওয়ার ছদ্মাবরণে বিদ্রোহের ইন্ধন এবং বিদ্রোহের প্রক্রিয়ায় যে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ হলো তাতে এক ঢিলে দুই পাখি মারার লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। সীমান্তরক্ষী বাহিনী হিসেবে ঐতিহ্যবাহী বিডিআর এখন নিশ্চিহ্নপ্রায়। সীমান্তে ওরা আদৌ আছে কি না বুঝতে পারা যায় না। তাই প্রায়ই সীমান্তে ঘটছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের হাতে নিরীহ বাংলাদেশী হত্যার ঘটনা। গত সপ্তাহে সিলেটের জৈন্তাপুর সীমান্তে বিএসএফ সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী জনগণের মধ্যে চরম সন্ত্রস্ত অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। এমন ঘটনা ঘটেছে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে নিরাপত্তাসংক্রান্ত তিনটি চুক্তি স্বাক্ষরের পর। চুক্তিগুলো স্বাক্ষরিত হয়েছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক দিল্লি সফরকালে। চুক্তির বিষয়বস্তু বাংলাদেশের জনগণকে জানানো হয়নি। সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় সংসদেও পেশ করা হয়নি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর থেকে এদেশীয় কিছু শয়তানের কাছে আত্মা বিক্রয়কারী বুদ্ধিবৃত্তিক কামলা তারস্বরে বলতে শুরু করলো দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে আস্থা সৃষ্টিকারী এমন উদ্যোগ অতীতে আর কখনো নেয়া হয়নি। আস্থা কতটুকু সৃষ্টি হয়েছে তার নমুনাতো আমরা সীমান্তেই দেখতে পাচ্ছি। ১৯৭৪ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পিতা এবং তত্কালে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। চুক্তিটি ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চুক্তির দায় বাস্তবায়ন করা হলেও ভারত তার কিছুমাত্র বাস্তবায়ন করেনি। এই হলো ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের দৃষ্টান্ত!
সীমান্তে ২০০৯-এর ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর বিডিআর যেভাবে অসহায় হয়ে পড়েছে অতীতে কখনো বিডিআরের এমন অসহায়ত্ব ছিল না। বড়াইবাড়ী পাদুয়ার ঘটনায় বিডিআর ভারতীয় বিএসএফকে চরম শিক্ষা দিয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল অনেকের মতে, বিডিআরকে বিদ্রোহের ঘটনায় প্রলুব্ধ করে তারই প্রতিশোধ গ্রহণ করা হয়েছে পুরো বাহিনীটির কাঠামো ধ্বংস করে। এ ঘটনার পর পুরো এক বছর কেটে গেছে। কেবল পোশাক ও নাম পরিবর্তনের উদ্যোগ ছাড়া সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে পুনর্গঠিত করে হৃতগৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠায় কোনো উদ্যোগই দেখা যাচ্ছে না। ঢাকার একটি সাপ্তাহিকের খবর অনুযায়ী জানা গেছে, এপ্রিল থেকে বাংলাদেশ রাইফেলসকে নতুন আঙিকে সাজানো হচ্ছে। সম্প্রতি এ সিদ্ধান্ত তৈরি করে এরই মধ্যে তা বিডিআর সদর দফতর থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য এই রূপরেখাকে এই সপ্তাহে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপন করা হচ্ছে। মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর বিডিআর সদর দফতর বিডিআর বাহিনী ঢেলে সাজানোর কাজ শুরু করবে। রূপরেখার পাশাপাশি এ বাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে দেয়া হয়েছে। এখন সরকার এ প্রস্তাব মার্চের মধ্যে অনুমোদন করলে এপ্রিল থেকেই বিডিআর পুনর্গঠনের কাজ শুরু করা হবে। বিডিআরের রূপরেখায় বাহিনীটির নাম পরিবর্তন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ বাহিনীর কর্মকর্তা পদে শুধু সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদেরই নয়, সেনাবাহিনী বিমানবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর কর্মকর্তাদেরও অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে নতুন রূপরেখায়। একাধিক স্তরের গোয়েন্দাবাহিনী গঠন, অপ্রয়োজনীয় ট্রেডগুলো পরিবর্তন করে যোগ্যতাসম্পন্ন বেসামরিক কারিগরি ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তি, অভ্যন্তরীণ পদোন্নতিতে ধীরগতি নিরসন করে প্রতিযোগিতামূলক পদোন্নতি বাস্তবায়নের জন্য পিরামিড আকারে সুষম কাঠামো প্রণয়ন ও অধস্তন কর্মচারীদের যোগ্যতাসাপেক্ষে বিভাগীয় কর্মকর্তা পদে পদোন্নতির সুযোগ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই রূপরেখা বাস্তবায়ন করা হলে পুনর্গঠিত বিডিআর অতীতের গৌরব ফিরে পাবে কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সামরিক অফিসারদের কমান্ডে থাকার ফলে বিডিআর রণকৌশলের ক্ষেত্রে যে সাফল্য প্রদর্শন করত নতুন রূপরেখা বাস্তবায়িত হলে তা অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ বিমানবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর স্থলযুদ্ধের অভিজ্ঞতা নেই। বিডিআরকে সেনাবাহিনীর অফিসারদের কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণে রেখে বাংলাদেশের ফার্স্ট লাইন অব ডিফেন্স হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল। এই কৌশল যে সঠিক ও যথার্থ ছিল তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি বিডিআর কর্তৃক বিএসএফকে সার্থকভাবে মোকাবিলা করার মধ্যে। এ ছাড়া যোগ্যতা সাপেক্ষে নিম্নপদস্থ কর্মকর্তাদের উচ্চপদে যাওয়ার সুযোগ বাহিনীর দক্ষতার জন্য কতটা সহায়ক হবে সে ব্যাপারেও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। তা ছাড়া বাহিনীর ভেতরকার ট্রেডগুলো পরিবর্তন করে বেসামরিক কারিগরি ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তি বাহিনীর শৃঙ্খলার জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াতে পারে। বেসামরিক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সার্ভিস রুল মূলবাহিনীর সার্ভিসরুলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিডিআরকে ধ্বংস করার জন্য যে বিদ্রোহের সৃষ্টি করা হয়েছিল তার লক্ষ্য ছিল বিডিআরকে একটি সম্পূর্ণ নিরামিষ বাহিনীতে পরিণত করা, যাতে শত্রুদের সুবিধা হয়। নানা আলোচনা ও সমালোচনার ফলে পুরোপুরি তা করা না গেলেও প্রস্তাবিত রূপরেখাটি বিডিআরকে একটি অকার্যকর বাহিনীতে পরিণত করার আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। এ ছাড়া দলীয়করণে সিদ্ধহস্ত এই সরকারের হাতে যখন এর জনবল বৃদ্ধি করা হবে তখন এই বাহিনীটি পরিণত হবে একটি দলীয় বাহিনীতে। এর রাষ্ট্রীয় চরিত্র বিলুপ্ত হওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হবে। তাই দেখা যাচ্ছে, দেশের শত্রুরা যা চেয়েছিল তার অনেকটাই কার্যকর হতে যাচ্ছে।
সেনাবাহিনীর ৫৭ জন অফিসারকে হত্যা করার পর খোদ সেনাবাহিনীও দুর্বল হয়ে পড়েছে। সেনাবাহিনীর একজন অফিসার তৈরি করতে অনেক সম্পদ ও সময়ের প্রয়োজন হয়। ৫৭ জন অফিসারকে হারিয়ে সেনাবাহিনীর যে ক্ষতি হলো তা কাটিয়ে উঠতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হবে। পেশাগতভাবে সেনাবাহিনীর অফিসার হওয়া এদেশের তরুণদের জন্য খুব আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বিডিআর বিদ্রোহের পর যেভাবে নিহত অফিসারদের পরিবারের সদস্যদের সম্ভ্রমহানি করা হয়েছে তার ফলে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ পাওয়ার আকর্ষণ অনেকটাই নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। এ ভাবে সেনাবাহিনীর মনোবলকেও অনেকটাই চুরমার করে দেয়া হয়েছে। এই আলোচনার পর এ সিদ্ধান্তে আসা যে বিডিআরের বিদ্রোহটি ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বৈরি শক্তির একটি কারসাজি, সে ব্যাপারে কি সন্দেহের অবকাশ থাকে?
বিডিআর বিদ্রোহের পর তাত্ক্ষণিক বিদ্রোহ দমনের জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বিদ্রোহীদের যেভাবে মারাত্মক ক্ষতিসাধন করার জন্য প্রশ্রয় দেয়া হয়েছিল তার কোনো সদুত্তর আজও পাওয়া যায়নি। বিদ্রোহ বিদ্রোহই। বিদ্রোহ দমনের পর কখনোই রাজনৈতিক সালিশি হতে পারে না। বিদ্রোহীদের প্রতি নমনীয় আচরণ ভবিষ্যতের বিদ্রোহীদেরই আস্কারা দেবে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক হিসাব থেকে দেখা গেল ৭১ জন বিডিআর সদস্য তদন্ত চলাকালে মৃত্যুবরণ করেছে। এদের কেউ আত্মহত্যা করেছে, কেউ হার্ট এ্যাটাকে মারা গেছে আবার কেউ জণ্ডিসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে বলে দাবি করা হয়েছে। জনমনে এদের মৃত্যু সম্পর্কে নানা প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। সরকার অস্বীকার করলেও অনেক নাগরিকেরই ধারণা—এসব ব্যক্তি এমন কোনো তথ্য হয়তো ফাঁস করে দিতেন যার ফলে সরকারকে বিব্রত হতে হতো। এ ক্ষেত্রেও যে স্বচ্ছতার দারুণ ঘাটতি রয়েছে তা বলাই বাহুল্য। বিডিআর মসজিদের ইমাম সাহেবের মৃত্যুটিও বড় ধরনের প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আপাতত কিছু না হলেও এসব প্রশ্ন ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের ভবিষ্যতে তাড়া করার সম্ভাবনা আছে। প্রধানমন্ত্রী ডিএডি তৌহিদসহ ১৪ জন বিদ্রোহী নেতার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ বৈঠক করেছিলেন। বৈঠকের ফলাফল হিসেবে সাধারণ ক্ষমাও ঘোষণা করা হয়েছিল। ডিএডি তৌহিদকে বিডিআরের কমান্ড্যান্ট পদেও নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। এই নিয়োগ এবং সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা বিদ্রোহের বিচারের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করবে কি-না সেই প্রশ্নটিও থেকে যাচ্ছে। এখন বলা হচ্ছে, পুঞ্জীভূত ক্ষোভের ফলেই বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছে। প্রশ্ন হলো, পুঞ্জীভূত ক্ষোভের কারণ দেখিয়ে পুঞ্জীভূত ষড়যন্ত্রকে আড়াল করা হচ্ছে কি-না।
বিডিআর বিদ্রোহের এক বছর পূর্তিতে সেনাবাহিনীর নিহত অফিসারদের আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে আমরা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আল-আমিনের কাছে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে প্রার্থনা করব, হায়েনাদের থাবা থেকে তিনি বাংলাদেশকে হেফাজত করুন।
লেখক : অধ্যাপক, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শত্রুর সঙ্গে সম্মুখ সমরে তাদের মৃত্যু হয়নি। তারা ছিলেন নিরস্ত্র। যুদ্ধের জন্য কোনো মানসিক প্রস্তুতিও তাদের ছিল না। বিডিআর সপ্তাহ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাদের অনেকে এসেছিলেন পিলখানায়। উত্সবে যোগ দিতে এসে কেউ কি মৃত্যুর কথা ভাবে? কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে মৃত্যুই অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। শত্রু দৃশ্যমান না হলেও দেশের শত্রুরাই তাদের হত্যা করেছিল। কথাটি বলছি এ কারণে যে এটা যদি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শত্রুদের কাজ না হয় তাহলে অভূতপূর্ব ও অচিন্তনীয় এ ঘটনাটিকে আর কীভাবে মূল্যায়ন করা যাবে? দাবি-দাওয়ার ছদ্মাবরণে বিদ্রোহের ইন্ধন এবং বিদ্রোহের প্রক্রিয়ায় যে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ হলো তাতে এক ঢিলে দুই পাখি মারার লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। সীমান্তরক্ষী বাহিনী হিসেবে ঐতিহ্যবাহী বিডিআর এখন নিশ্চিহ্নপ্রায়। সীমান্তে ওরা আদৌ আছে কি না বুঝতে পারা যায় না। তাই প্রায়ই সীমান্তে ঘটছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের হাতে নিরীহ বাংলাদেশী হত্যার ঘটনা। গত সপ্তাহে সিলেটের জৈন্তাপুর সীমান্তে বিএসএফ সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী জনগণের মধ্যে চরম সন্ত্রস্ত অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। এমন ঘটনা ঘটেছে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে নিরাপত্তাসংক্রান্ত তিনটি চুক্তি স্বাক্ষরের পর। চুক্তিগুলো স্বাক্ষরিত হয়েছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক দিল্লি সফরকালে। চুক্তির বিষয়বস্তু বাংলাদেশের জনগণকে জানানো হয়নি। সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় সংসদেও পেশ করা হয়নি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর থেকে এদেশীয় কিছু শয়তানের কাছে আত্মা বিক্রয়কারী বুদ্ধিবৃত্তিক কামলা তারস্বরে বলতে শুরু করলো দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে আস্থা সৃষ্টিকারী এমন উদ্যোগ অতীতে আর কখনো নেয়া হয়নি। আস্থা কতটুকু সৃষ্টি হয়েছে তার নমুনাতো আমরা সীমান্তেই দেখতে পাচ্ছি। ১৯৭৪ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পিতা এবং তত্কালে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। চুক্তিটি ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চুক্তির দায় বাস্তবায়ন করা হলেও ভারত তার কিছুমাত্র বাস্তবায়ন করেনি। এই হলো ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের দৃষ্টান্ত!
সীমান্তে ২০০৯-এর ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর বিডিআর যেভাবে অসহায় হয়ে পড়েছে অতীতে কখনো বিডিআরের এমন অসহায়ত্ব ছিল না। বড়াইবাড়ী পাদুয়ার ঘটনায় বিডিআর ভারতীয় বিএসএফকে চরম শিক্ষা দিয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল অনেকের মতে, বিডিআরকে বিদ্রোহের ঘটনায় প্রলুব্ধ করে তারই প্রতিশোধ গ্রহণ করা হয়েছে পুরো বাহিনীটির কাঠামো ধ্বংস করে। এ ঘটনার পর পুরো এক বছর কেটে গেছে। কেবল পোশাক ও নাম পরিবর্তনের উদ্যোগ ছাড়া সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে পুনর্গঠিত করে হৃতগৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠায় কোনো উদ্যোগই দেখা যাচ্ছে না। ঢাকার একটি সাপ্তাহিকের খবর অনুযায়ী জানা গেছে, এপ্রিল থেকে বাংলাদেশ রাইফেলসকে নতুন আঙিকে সাজানো হচ্ছে। সম্প্রতি এ সিদ্ধান্ত তৈরি করে এরই মধ্যে তা বিডিআর সদর দফতর থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য এই রূপরেখাকে এই সপ্তাহে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপন করা হচ্ছে। মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর বিডিআর সদর দফতর বিডিআর বাহিনী ঢেলে সাজানোর কাজ শুরু করবে। রূপরেখার পাশাপাশি এ বাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে দেয়া হয়েছে। এখন সরকার এ প্রস্তাব মার্চের মধ্যে অনুমোদন করলে এপ্রিল থেকেই বিডিআর পুনর্গঠনের কাজ শুরু করা হবে। বিডিআরের রূপরেখায় বাহিনীটির নাম পরিবর্তন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ বাহিনীর কর্মকর্তা পদে শুধু সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদেরই নয়, সেনাবাহিনী বিমানবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর কর্মকর্তাদেরও অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে নতুন রূপরেখায়। একাধিক স্তরের গোয়েন্দাবাহিনী গঠন, অপ্রয়োজনীয় ট্রেডগুলো পরিবর্তন করে যোগ্যতাসম্পন্ন বেসামরিক কারিগরি ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তি, অভ্যন্তরীণ পদোন্নতিতে ধীরগতি নিরসন করে প্রতিযোগিতামূলক পদোন্নতি বাস্তবায়নের জন্য পিরামিড আকারে সুষম কাঠামো প্রণয়ন ও অধস্তন কর্মচারীদের যোগ্যতাসাপেক্ষে বিভাগীয় কর্মকর্তা পদে পদোন্নতির সুযোগ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই রূপরেখা বাস্তবায়ন করা হলে পুনর্গঠিত বিডিআর অতীতের গৌরব ফিরে পাবে কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সামরিক অফিসারদের কমান্ডে থাকার ফলে বিডিআর রণকৌশলের ক্ষেত্রে যে সাফল্য প্রদর্শন করত নতুন রূপরেখা বাস্তবায়িত হলে তা অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ বিমানবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর স্থলযুদ্ধের অভিজ্ঞতা নেই। বিডিআরকে সেনাবাহিনীর অফিসারদের কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণে রেখে বাংলাদেশের ফার্স্ট লাইন অব ডিফেন্স হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল। এই কৌশল যে সঠিক ও যথার্থ ছিল তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি বিডিআর কর্তৃক বিএসএফকে সার্থকভাবে মোকাবিলা করার মধ্যে। এ ছাড়া যোগ্যতা সাপেক্ষে নিম্নপদস্থ কর্মকর্তাদের উচ্চপদে যাওয়ার সুযোগ বাহিনীর দক্ষতার জন্য কতটা সহায়ক হবে সে ব্যাপারেও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। তা ছাড়া বাহিনীর ভেতরকার ট্রেডগুলো পরিবর্তন করে বেসামরিক কারিগরি ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তি বাহিনীর শৃঙ্খলার জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াতে পারে। বেসামরিক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সার্ভিস রুল মূলবাহিনীর সার্ভিসরুলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিডিআরকে ধ্বংস করার জন্য যে বিদ্রোহের সৃষ্টি করা হয়েছিল তার লক্ষ্য ছিল বিডিআরকে একটি সম্পূর্ণ নিরামিষ বাহিনীতে পরিণত করা, যাতে শত্রুদের সুবিধা হয়। নানা আলোচনা ও সমালোচনার ফলে পুরোপুরি তা করা না গেলেও প্রস্তাবিত রূপরেখাটি বিডিআরকে একটি অকার্যকর বাহিনীতে পরিণত করার আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। এ ছাড়া দলীয়করণে সিদ্ধহস্ত এই সরকারের হাতে যখন এর জনবল বৃদ্ধি করা হবে তখন এই বাহিনীটি পরিণত হবে একটি দলীয় বাহিনীতে। এর রাষ্ট্রীয় চরিত্র বিলুপ্ত হওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হবে। তাই দেখা যাচ্ছে, দেশের শত্রুরা যা চেয়েছিল তার অনেকটাই কার্যকর হতে যাচ্ছে।
সেনাবাহিনীর ৫৭ জন অফিসারকে হত্যা করার পর খোদ সেনাবাহিনীও দুর্বল হয়ে পড়েছে। সেনাবাহিনীর একজন অফিসার তৈরি করতে অনেক সম্পদ ও সময়ের প্রয়োজন হয়। ৫৭ জন অফিসারকে হারিয়ে সেনাবাহিনীর যে ক্ষতি হলো তা কাটিয়ে উঠতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হবে। পেশাগতভাবে সেনাবাহিনীর অফিসার হওয়া এদেশের তরুণদের জন্য খুব আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বিডিআর বিদ্রোহের পর যেভাবে নিহত অফিসারদের পরিবারের সদস্যদের সম্ভ্রমহানি করা হয়েছে তার ফলে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ পাওয়ার আকর্ষণ অনেকটাই নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। এ ভাবে সেনাবাহিনীর মনোবলকেও অনেকটাই চুরমার করে দেয়া হয়েছে। এই আলোচনার পর এ সিদ্ধান্তে আসা যে বিডিআরের বিদ্রোহটি ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বৈরি শক্তির একটি কারসাজি, সে ব্যাপারে কি সন্দেহের অবকাশ থাকে?
বিডিআর বিদ্রোহের পর তাত্ক্ষণিক বিদ্রোহ দমনের জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বিদ্রোহীদের যেভাবে মারাত্মক ক্ষতিসাধন করার জন্য প্রশ্রয় দেয়া হয়েছিল তার কোনো সদুত্তর আজও পাওয়া যায়নি। বিদ্রোহ বিদ্রোহই। বিদ্রোহ দমনের পর কখনোই রাজনৈতিক সালিশি হতে পারে না। বিদ্রোহীদের প্রতি নমনীয় আচরণ ভবিষ্যতের বিদ্রোহীদেরই আস্কারা দেবে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক হিসাব থেকে দেখা গেল ৭১ জন বিডিআর সদস্য তদন্ত চলাকালে মৃত্যুবরণ করেছে। এদের কেউ আত্মহত্যা করেছে, কেউ হার্ট এ্যাটাকে মারা গেছে আবার কেউ জণ্ডিসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে বলে দাবি করা হয়েছে। জনমনে এদের মৃত্যু সম্পর্কে নানা প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। সরকার অস্বীকার করলেও অনেক নাগরিকেরই ধারণা—এসব ব্যক্তি এমন কোনো তথ্য হয়তো ফাঁস করে দিতেন যার ফলে সরকারকে বিব্রত হতে হতো। এ ক্ষেত্রেও যে স্বচ্ছতার দারুণ ঘাটতি রয়েছে তা বলাই বাহুল্য। বিডিআর মসজিদের ইমাম সাহেবের মৃত্যুটিও বড় ধরনের প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আপাতত কিছু না হলেও এসব প্রশ্ন ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের ভবিষ্যতে তাড়া করার সম্ভাবনা আছে। প্রধানমন্ত্রী ডিএডি তৌহিদসহ ১৪ জন বিদ্রোহী নেতার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ বৈঠক করেছিলেন। বৈঠকের ফলাফল হিসেবে সাধারণ ক্ষমাও ঘোষণা করা হয়েছিল। ডিএডি তৌহিদকে বিডিআরের কমান্ড্যান্ট পদেও নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। এই নিয়োগ এবং সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা বিদ্রোহের বিচারের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করবে কি-না সেই প্রশ্নটিও থেকে যাচ্ছে। এখন বলা হচ্ছে, পুঞ্জীভূত ক্ষোভের ফলেই বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছে। প্রশ্ন হলো, পুঞ্জীভূত ক্ষোভের কারণ দেখিয়ে পুঞ্জীভূত ষড়যন্ত্রকে আড়াল করা হচ্ছে কি-না।
বিডিআর বিদ্রোহের এক বছর পূর্তিতে সেনাবাহিনীর নিহত অফিসারদের আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে আমরা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আল-আমিনের কাছে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে প্রার্থনা করব, হায়েনাদের থাবা থেকে তিনি বাংলাদেশকে হেফাজত করুন।
লেখক : অধ্যাপক, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments